এই ধরণের জনঅংশগ্রহণ শুধুই যে আলকাপে ঘটে বললে পশ্চিমিধারায় সত্যের অপলাপ হবেতো বটেই, কেননা লেটো, গম্ভীরা, মাছানি, বনবিবির পালারমত নানান অঞ্চলের লোক নাট্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। লোকনাট্য বললে যেন মনে হয়, শুধুই নাটক এই আঙ্গিকের মূল স্তম্ভ নয়, গান আর নাচের সমবিব্যহারে গড়েওঠে একটি লোকনাটকের আঙ্গিক। ভারতীয় সিনেমায় হঠাত হঠাতই গান গেয়ে ওঠে নায়ক বা পার্শ্বচরিত্র, সেটাই আদত লোক নাটকের দান। আগেই বলাগিয়েছে, লোকনাট্যের প্রত্যেক কুশীলবই যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পী। নাচ, গান আর অভিনয় – অভিকর শিল্পের এই তিন মূল স্তম্ভে সমাভাবে দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাই গ্রামীণেরা রাতে শুধু নাটক দেখতে যান না, তারা পালা-গান বা শুধুই গান দেখতে যান, যা শহুরে যাত্রাগানের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তাই অনায়াসে গান গেয়ে ওঠেন রাজা-রানী – এর জন্য অলাদা পরিমণ্ডল তৈরিরও প্রয়োজন হয়না, হাজার হাজার বছরের রসজ্ঞানী দর্শক হতচকিত না হয়ে, যেন তৈরিই থাকেন এমন এক শৈল্পিক বাঁকের সামনে।
বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে লোকনাট্যের অন্যতম প্রদান উপাদান ছোকরারা। এঁরা নাচে, গানে, লাস্যে উজ্জ্বল করে রাখেন লোকনাট্যের আসর আর তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক দর্শককুলকে। এই ছোকরাদের অভিনয় প্রতিভা কোনো প্রতিষ্ঠিত মহিলা শিল্পীর থেকে একচুলও ন্যুন নয়। শ্রদ্ধেয় সিরাজমশাইএর জবানিতে শোনা যাক – মোয়েদের হৃদয় ও মুখমন্ডল বিশিষ্ট তরুণ পুরুষের শরীরে কিংবদন্তীর গ্রাম পরীরা কীভাবে অনপ্রবেশ করে দেখেছি। আলকাপ দলের নাচিয়ে ছোকরার প্রেমো পড়েছি। অচরিতার্থ কামনায় জ্বলে মরেছি। ১৯৫০এ তার ছিল চৌদ্দ বছর। অপূর্ব মুখশ্রী আর দেহের গড়ন। ওকে ছেলে বলে চেনা কঠিন ছিল। আমার প্রথম বিভ্রম সে। সেই ভালবাসা কেনো মেয়েকে দেওয়া যায়না। কারন তার সবটাই ছিল মনের আর শুদ্ধতার। তার শারীরিক নটে গাছটি মুড়িয়ে যায় না – দীর্ঘ মিথে বেঁচে থাকে(দেশ সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৩)। এক ছোকরাকে নিয়ে দুই ধনবান পুরুষের লাঠালাঠিতে বেঁচে গেছে কত দল। ভেঙেছে কত পরিবারের দাম্পত্য। এরকম বহু জনশ্রুতি শোনাযাবে আলকাপের ধাত্রীঅঞ্চল ভাগবানগেলা গ্রামেরমত পশ্চিমবঙ্গের কত কত গ্রামে আজও। শুধু আলকাপ নয় নানান লোকনাট্যের দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত বুকভাঙা কাহিনীর দীর্ঘশ্বাস। লেটোর কৃতি সংদার হর কুমার গুপ্ত আর আলকাপের কে কে(করুণাকান্ত) হাজরা শুনিয়েছিলেন এরকম নানান কাহিনী আজ থেকে অন্ততঃ বিশ বছর পূর্বে।
যাঁরা কোনো লোক নাট্য দলের মহড়া দেখেছেন তাঁরাই সাক্ষ্যদেবেন যে, এঁরা কেউ শহুরে বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায় স্বভাব শিল্পী নন। সকলেই সমান পরিশ্রমে সমান শৈল্পিক প্রচেষ্টায় নিজেকে তিন তিন করে গড়ে তোলেন নিজেদের। গ্রামে হ্যাজাকের আলোর সামনে বছরের পর বছর হাজার হাজার কালো মাথা আর খাটিয়ে হৃদয় ভেদ করে এক একজন প্রশিক্ষিত শিল্পীই তার সম্মোহনকারী স্বরক্ষেপ, অভিনয়, বাজনা দর্শকদের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করতে পারেন, শুধু স্বভাবে একদিন বা দুদিনই ঘটতে পারে, কিন্তু দীর্ঘকালের কঠোর অনুশীলনই পারে একদল শিল্পী বা দলকে কিংবদন্তীর পর্যায়ে তুলে নিয়ে যেতে।
ছোকরারা ভূমি মঞ্চে প্রবেশ করেন আসর বন্দনায়। বন্দনার বিযয় নানান ধরনের হতে পারে। মঞ্চ থেকে গুরু, পিতা-মাতা থেকে পরিবেশ, গ্রাম থেকে উপস্থিত দর্শক, দেবদেবী (যে কোনো ধর্মের) থেকে চতুর্দিক সব কিছুই চলে আসে বন্দনাংশে। বন্দনাশিল্পীদের আশা, প্রণাম চাওয়া সকলের আশীর্বাদ যেন দলের মাথায় আশিসস্বরূপ ঝরে পড়ে আর তাদের দলের গান দর্শকদের গ্রহনীয় হয়। বোলানের একটি ছোট বন্দনা, প্রণমি গণরায় আমারে দেহ অভয়, তোমারি করুণায় বেদনা দূরে যায়, দয়াময়ী দীন তারিনী সেজো না আর পাষাণী, ভবানী ভৈরবী তুমি পাষাণের নন্দিনী। লেটোর বন্দনা বাহিরের পুজা বাহিরে মা গো-, বাহিরের পুজা বাহিরে নাও, অন্তরের পুজা অন্তরে নাও মা আমার, আরতি ধর মা আমার। এবার আলকাপ জগজ্জননী মাগো তারা, জগতকে তরালি, আমারে কাঁদালি, আমি কী মাতোর চরণ ছাড়া, জগজ্জননী মাগে তারা। গানের শেষ পদটি ধুয়ো বা ধ্রুবপদ। বাজনদারদের সঙ্গে বসে দোহারেরী শেষ পদটি নিয়ে ধুয়া ধরত ছোকরাদের গানসহ নাচের শেষে।
No comments:
Post a Comment