দূরাদয়শ্চক্র নিভস্য তন্বী তমালতালী
বনরাজি নীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্ধারা
নিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।।(কালিদাসঃ রঘুবংশ)
ভারতের সর্বযুগের সর্বশ্রষ্ঠ লেখক,
কালিদাস, অতীতের শ্বেতদ্বীপ আজকের গঙ্গাসাগরের প্রকৃতিকে প্রণাম জানিয়েছেন পূর্বের শ্লোকটিতে। সামনে আদিগন্ত সমুদ্র,
পশ্চাদপটে
শ্যামল বনানী আর বালুকাময় বেলাভূমি আর মহর্ষি কপিলের মন্দির বাঙলার অন্যতম প্রধান তীর্থ-পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবনের অন্যান্য
অঞ্চলের মতই একদা সাগরদ্বীপ ছিল সমৃদ্ধতম জনপদ। ১৬৮৮এর সুনামিতে সাগরদ্বীপের প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ভেসে যায় এবং
দ্বীপটি শ্রীহীন
হয়ে পড়ে। ইওরোপিয়রা বাংলা বাণিজ্যের শুরুতেই
নজর দেয় এই দ্বীপে। ব্রিটিশার জেমস প্রাইসের লেখায়পাই পাই গঙ্গাসাগরের উল্লেখ। ১৬৮৩তে হেজেস এখানে একটি হিন্দুমন্দির
দেখেছেন।
এখানকার রাজা নাকি বছরে দু’লাখ টাকা তীর্থকর আদায় করতেন। লুইল্লিয়ার
নামে আর এক ইওরোপিয়
সাগরদ্বীপে দুই সাধুকে দেখেছিলেন।
১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজেণ্ডার হ্যামিলটনের সময় পুরোনো
স্মৃতি খুঁড়ে সাগরদ্বীপ ভারততীর্থের
অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান হয়ে ওঠে।
১৮১১
খ্রিস্টাব্দের ‘সমাচার
দর্পন’ বলছে, ‘‘যাহারা
গঙ্গাসাগর উপদ্বীপে বসতি করাইবার উদ্যোগ করিতেছে, তাহারা কলিকাতার এক্সচেঞ্জে অর্থাৎ ক্রয়বিক্রয়ের
ঘরে গত বুধবার একত্র হইল এবং দশ জন সাহেব ও দুই এতদ্দেশীয় লোককে সেই কর্ম
সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত করিল...।’’
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চার আনা খাজনায় সাগরদ্বীপের ইজারা দেওয়া
হয়। ১৮৩৩ ও ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের সাইক্লোন সাগরদ্বীপকে তছনছ করে দেয়। শুধুমাত্র ১৮৬৪-র ঝড়ে পাঁচ
হাজার জনের মৃত্যু হয়।
ইতিহাসের পাতাতেই নয়, মৎস্য, বায়ু এবং পদ্মপুরাণ
শাস্ত্রেও সাগরতীর্থ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ এবং কয়েকটি
মঙ্গলকাব্যেও ছড়িয়ে আছে গঙ্গাসাগর প্রসঙ্গ। ‘মহাভারতে’-এর বনপর্বে দেখা যায়, স্বয়ং যুধিষ্ঠির সাগরসঙ্গমে এসেছিলেন। মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙের
বিবরণেও গঙ্গাসাগর স্থান পেয়েছে। বঙ্কিম সাহিত্যে অজর অমর এক চরিত্র
নবকুমার গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার পথে কপালকুণ্ডলাকে অর্জন করে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি এসে দেখলেন, ওই বছরেই তেইশটি
শিশু সন্তান বিসর্জনের ঘটনা ঘটেছে। আইন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু পুরনো প্রথা স্মরণে
আজও কখনও
চোখে পড়ে প্রথম সন্তানকে সাগরজলে বিসর্জন দিয়েই তুলে নিচ্ছেন কোনও মা। রবীন্দ্রনাথের
‘দেবতার
গ্রাস’ কবিতায়
সাগরসঙ্গমে সন্তান বিসর্জনের করুণ
কাহিনী তো সকলেরই জানা।
গঙ্গাসাগরের পুরাণ বর্ণনা আদতে, রাজা সগরের নাতি ভগীরথের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠার কাহিনী, পাহাড়
বসিনী পুণ্যতোয়া গঙ্গার বঙ্গে বয়ে আনার কাহিনী। ভাগবান
রামের পূর্বপুরুষ সূর্যবংশের পরাক্রান্ত রাজা সগর, স্বর্গরাজ
ইন্দ্রের সমপর্যায়ে উন্নিত হওয়ার প্রচেষ্টায় শততম অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করছেন। ইন্দ্ররাজ শেষতম ঘোড়াটি অপহরণ করে লুকিয়ে
রাখলেন। সগরের ষাট হাজার পুত্র বহু অন্বেষণে যজ্ঞাশ্বের সন্ধান পেলেন গভীর
ধ্যানে মগ্ন মহর্ষি কপিলের নির্জন সাধনক্ষেত্রে। রাজপুত্ররা
মুণি
দেহে আঘাত করলে, মহর্ষির কোপানলে মুহূর্তেই ভস্মীভুত হন। সগর পৌত্র ভগীরথ কঠোর তপস্যায়
গঙ্গাকে মর্তে নিয়ে এলেন। তাঁর পুণ্য সলিলের স্পর্শে পাপমুক্ত হলেন
সগরনন্দনরা। সাগরের সঙ্গমস্থল পরিণত হল তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাসাগরে। প্রতিষ্ঠিত
হল কপিলমুনি আশ্রম।
খ্রিস্টিয়
৪৩৭ অব্দে সাগরে একটি প্রচীন মন্দিরের অস্তিত্বের কথা
জানা যায়। কিন্তু নদীর পথ পরিবর্তনের ফলে সে মন্দির সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে
যায়। এর পরেও দু’বার
মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রগ্রাসে কোনওটাই স্থায়ী হয়নি। বর্তমান
মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় দুই কিমি দূরে অবস্থিত। ১৩৮০-৮১ (ইং
১৯৭৩-৭৪) বঙ্গাব্দে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তৈরি করান অযোধ্যার
হনুমানগড়ি মঠের মোহন্ত রামদাসজি মহারাজ। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে উইলসন সাহেবের
বর্ণনানুযায়ী মন্দির চত্বরে ছিল প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষ, যার পাদদেশেই ছিল
শ্রীরাম ও হনুমানের মূর্তি।
মন্দিরাভ্যন্তরে
আজও বিরাজমান লালসিঁদুরে পরিলিপ্ত শিলাময় কতিপয় বিগ্রহ। চোখে
পড়ে পদ্মাসনে যোগারুঢ়, জটাশ্মশ্রুমণ্ডিত মহাযোগী কপিল, যাঁর বামহস্তে
কমণ্ডুল, ঊর্ধে
উত্থোলিত দক্ষিণ-করে জপমালা। শিরোদেশে পঞ্চনাগ-ছত্র। ডানপাশে চতুর্ভুজা মকর বাহিনী
গঙ্গাদেবী, যাঁর অঙ্কে
মহাতাপস ভগীরথ। স্বল্পদূরে গদা ও গন্ধমাদন পর্বত হস্তে মহাবীর হনুমান। কপিল
বিগ্রহের বাঁয়ে ষাট সহস্র সন্তান বিয়োগ বেদনায় মুহ্যমান নগররাজ, যিনি মহর্ষি কপিলের
করুণায় বীতশোক। রাজমূর্তির বাঁয়ে অষ্টভুজ সিংহবাহিনী
বিশালাক্ষীদেবী। সর্ব বাঁয়ে অশ্বের বল্গাহস্তে ইন্দ্রদেব। মন্দিরের আশেপাশে
রয়েছে কিছু দেবস্থান ও আশ্রম — স্বামী কপিলানন্দ মহারাজের
আশ্রম, চিন্তাহরণেশ্বরের
মন্দির, সীতারাম
ওঙ্কারনাথের যোগেন্দ্রমঠ, মহানির্বাণ আশ্রম, ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের ধর্মশালা, সেচবিভাগের ডাকবাংলো এবং
বেগুয়াখালির হাওয়া অফিস। কপিলমুনি আশ্রমের পরম্পরাগত পুরোহিত অযোধ্যার
যাজনিক ব্রাহ্মণেরা প্রত্যহ মন্দিরে পাঁচবার পূজারতি করেন—রাত দ্বিপ্রহরে
ভোগারতি, সায়াহ্নে
সন্ধ্যারতি এবং রাত ন’ঘটিকায় শয়নারতি।
‘‘সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার।’ খনার উবাচ, সারা বছর যারা
শয়ন একাদশী, ভৈমী একাদশী, উত্থান একাদশী, পার্শ্ব একাদশী,
জন্মাষ্টমী, রামনবমী, শিব চতুর্দশী
বা দুর্গা মহাষ্টমীর মতো শাস্ত্রীয় আচারের একটিও পালন
করতে পারবে না, তাঁরা যদি পৌষ সংক্রান্তির দিন শুধু একবার
সাগরসঙ্গমে স্নান করে, তা হলে সর্বতীর্থের পুণ্য অর্জন করবে। তারই অমোঘ আকর্ষণে সাগরদ্বীপ পরিণত হয় মানুষের মিলনমেলায়। শাস্ত্রীয় স্নানপর্ব একদিনের।
মেলা কিন্তু চলে
পক্ষকাল। শীতের হিমেল হাওয়ায় বালিয়াড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গমে সূর্যোদয়
অথবা সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে পুণ্যার্থীরা আদিগন্ত জলসীমায় পৌঁছে যান। সাধারণ
তীর্থযাত্রীদের কাছে সাগরমেলার প্রধান আকর্ষণ নাগাসন্নাসী আর হিমালয়ের সাধুসন্ত।
No comments:
Post a Comment