বন্ধু ভাগ্যে
ব্যবসা
সোরার ব্যবসা
থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আসছে অথচ এক টাকাও দাদন দিতে হচ্ছেনা। কাঠের
ব্যবসায়ও একই অবস্থা। শুধু রেশমের ব্যবসায় অগ্রিম দিতে হচ্ছে। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে এই তিন ব্যবসায় লাভ হচ্ছে বছরে
আড়াই লাখ টাকা (হেস্টিংসের বন্ধু-ব্যবসায়ীদের ক্লাব বোর্ড অব ট্রেডএর
প্রভাবশালী বন্ধু বারওয়েলের বাবাকে লেখা চিঠি, সূত্রঃ রজতকান্ত রায়)।
ব্যবসার নামে
লুঠ ছাড়াও লাভজনক চুক্তি করেও ইংরেজরা ব্যক্তিগতভাবে রোজগার করত। বন্ধুদের সঙ্গে
বকলমে বাঙালা সুবায় ব্যবসার আধিপত্য চালাবার জন্য বোর্ড অব ট্রেড তৈরি
করেছিলেন হেস্টিংস।
সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গোপন চুক্তি করত, উত্পাদকদের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিকে
পর্যন্ত ঠকিয়ে টাকা বানাতেন – ঠকচাচা
হেস্টিংস সব জানতেন শুধু নয়, নিজে এই পরিকল্পনাটির জন্মদাতাও বটে। ঘনিষ্ঠ
বন্ধুবান্ধবসহ ওয়ারেন হেস্টিংসএর উপবৃত্তে ঘোরাফেরা করা বন্ধুরাই এই ধরনের পড়ে
পাওয়া চৌদ্দ আনা লাভের সুযোগ পেতেন। ১৭৬৩ থেকে দাউদাউ জ্বলতে থাকা গ্রামীণ বাঙলার বিদ্রোহ দমন করার সাথীরূপে,
সক্রিয়ভাবে দেশিয় ব্যবসায়ীদের মাজা ভেঙে সম্রাজ্যের ভিত শক্ত করার প্রতিক্রিয়ায়,
গ্রাম বাঙলা ছেড়ে কলকাতা শহরে চলে আসা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল,
সেরেস্তাদার আর পাইকারেরা, এই লাভের লুঠের বখরা পেয়েছেন সরাসরি। এঁরাই
আগামীদিনে বাঙলার উদিতসূর্য অভিধা অর্জন করবেন, সর্বজনমান্য হয়ে রইবেন আজও।
বোর্ড অব ট্রেডএ বন্ধু-ব্যবসায়ীদের(বন্ধুরা যে সবসময়ে ব্যবসায়ীই যে হতেন এমন নয়) সঙ্গে
বাঁধ দেওয়া, রাস্তা চওড়া করা, রাস্তা তৈরি করা, কোম্পানিকে ঘোড়া, ষাঁড়, আফিম, নানান
উচ্চলাভের অসামরিক-সামরিক দ্রব্য যোগান দেওয়ারমত লোভনীয় সরকারি চুক্তি হত। স্টিফেন
সুলিভান, চার্লস ক্রফটস, চার্লস ব্লান্ট, জন বেলি প্রভৃতিরা এই সমস্ত উচ্চ
মুনাফাদার সরকারি ব্যবসার সুযোগ পেতেন। মাটিতে দাঁড়িয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন কিন্তু ইংরেজ অনুগামী বাঙালি গোমস্তা,
বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার, পাইকার আর ব্যবসায়ীরা। বোর্ড অব ট্রেডএর ব্যবসার আকাশ
ছোঁয়া লাভের অধিকাংশ যেত ইংরেজদের সিন্দুকে, ছিটেফোঁটাতেই খুশি থাকতে শিখেছিলেন
এদেশিয় দালালেরা।
বোর্ড অব ট্রেডএর চুক্তিতে ক্ষুব্ধ কোম্পানির ডিরেক্টর সভা কর্মচারীদের
দেশে ফেরার পর কয়েকজনের নামে মামলা দায়ের করে – যাদের মধ্যে
প্রভাবশালী হেস্টিংসও ছিলেন। তাতে বাস্তবিক যে কোনও ইতরবিশেষ
ঘটেনি তার প্রমাণ ব্যবসায়ীদের থেকে হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবুদেরমত মানুষদের
অবাধে বেড়ে চলা দস্তুরি নেওয়ার প্রবণতা থেকে। এদের আসল
খুঁটি ইংরেজ বড় আমলারা, যাঁরা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর
পাইকারদের মাধ্যমে বাঙলায় অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা করত। পণ্য কেনার সময়
বাঙালি কর্মচারীরা দস্তুরি নিত, প্রতি টাকায় পাঁচ গণ্ডা থেকে ৩০ গণ্ডা দরে। কোম্পানি কর্মচারীদের
লুঠের কাজে সরাসরি সাহায্য করত বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানরা দুহাত ভরে,
তাই কোম্পানি বাহাদুরও বাঙালিদের এই লুঠকার্যে বাধা দেয়নি। এরাই বেনিয়ান
রামমোহন রায় অথবা ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ ঠাকুরের পূর্বসূরী। ইংরেজেদের
সঙ্গে প্রতিযোগিতায়রত দেশিয় ব্যবসায়ী আর রায়তদের অসীম দুর্দশায় ইংরেজ কর্মচারীরা আর
ইংরেজমুখী বাঙালি কর্মচারী, দালালেরা রোজগার করতেন। পরবর্তীকালে
বাঙলায় মুক্তিসূর্য রামমোহন-দ্বারকানাথসহ কলকাতার অমিততেজেরা, অথবা রেনেসাঁজাত
খ্যাত অখ্যাত নানান ব্যক্তিত্ব কোথা থেকে তাদের ব্যবসা শুরু করার অর্থ অথবা নিজেদের
ঠাটবাট বজায় রাখার সম্পদ পেতেন, তার রহস্য বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল,
সেরেস্তাদার আর পাইকারদের অবৈধ দস্তুরির রোজগার আর ব্রিটিশদের সঙ্গে লুঠের অবৈধ
ব্যবসার সাথী হওয়া থেকে পরিস্কার। মুর্শিদাবাদের দরবারে রেসিডেন্ট কমিশনার সাইক্স সোরা, রেশম আর কাঠের
ব্যবসার সেলামি থেকে একা রোজগার করেছেন বার থেকে তের লক্ষ টাকা, তার দেওয়ান অথবা
বেনিয়ান কত রোজগার করেছে তা অনুমানযোগ্য।
ভারত দেশের রীতনীতি বিষয়ে অজ্ঞ ইওরোপিয়রা বাঙালি বেনিয়ান, গোমস্তা, মুন্সি
আর সরকারদের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। বাঙলায় নতুন
ইওরোপিয় পদার্পণ করলেই তাদের দালালি করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত এদেশিয়দের
মধ্যে। এদের
অধিকাংশই ছিলেন চিরাচরিত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মানুষ – দাদনি ব্যবসায়ী। পলাশির
পর ইওরোপিয়দের প্রধাণ ব্যবসায়ী কর্মচারী দালালদের বেনিয়ান নামে ডাকা শুরু হয়। একজন ইওরোপিয়র
দরবারে বেনিয়ান ছাড়াও ছিলেন দোভাষী, দালাল, হিসাবরক্ষক, প্রধাণ অমাত্য (সেক্রেটারি),
পুঁজির যোগানদার আর খাজাঞ্চি। নানান বৈধ অবৈধ ব্যবসায় এদেশিয়রা মাহির ছিল। ইওরোপিয়রা
শুধু তাদের নাম ধার দিতেন, আর ব্যবসায় লাভ্যাংশ পেতেন। একজন বেনিয়ান
আবার অনেকসময় একের বেশি ইওরোপিয় ব্যক্তি অথবা প্রাইভেট এজেন্সির বেনিয়ানরূপে কাজ
করতেন।
অসীম রায় নবাববাঁদী উপন্যাসে কোম্পানির পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে সদ্য
ভারতে পা রাখা প্রভাবশালী এক ইংরেজ রাজপুরুষের রাইটার ভ্রাতুষ্পুত্রকে, জনৈক
বানিয়ান গোকুল মুখার্জীর দেওয়া মাইনের যে ফর্দ উল্লেখ করেছেন তা উল্লেখ করা গেল-
পালকিতে দুলতে দুলতে গোকুলের দেওয়া লম্বা কাগজের ফালিটা চোখের সামনে মেলে
ধরে
খানসামা ১২
টাকা
বাটলার ৮
খিদমতগার ৬
পাচক ১৫
পাচকদের যোগানদার ৬
মশালচী ৩
পিয়ন ও হরকরা ৪
চুলফেলা নাপিত ২
৩টাকা হিসেবে ৬ জন বেয়ারা ১৮
হেড বেয়ারা ৫
লোকজনদের বাড়িভাড়া ২৬
দাড়িফেলা নাপিত ২
হুঁকোবরদার ৫
নালি সরদার ৪
সর্দারের অনুচর ৩
সহিস ৩
ধোবি ২
ইস্ত্রিওয়ালা ২
দর্জি ৩
মোট
১২৯ টাকা
মাই গড এরপর গোকুলের সুদ। এ ছাড়া কাপড়-চোপড়, পালকি, বগি, বজরা, বাড়ি। তার ওপর টাকা
জমানো। নাঃ প্রাইভেট ট্রেড ছাড়া কোনও উপায় নেই।
গ্রামীণেরা যখন ব্রিটিশ সৈন্যের সঙ্গে সম্মুখ সমরে
লড়ছে, তখন প্রধাণতঃ কলকাতার মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণী নানান প্রকারের ব্যবসায়
ব্রিটিশ শক্তিকে সরাসরি সাহায্য করছেন, দেশের শিল্প-ব্যবসা পরিকাঠামো ধংসে
ব্রিটিশদের সহায়তা দিয়ে, বানিয়া ইংরেজ সাম্রাজ্যের লাভের গুড়ের ছোট্টতম অংশিদার
হয়ে উঠেছেন। রাজভক্তির ছায়ায় দাঁড়িয়ে এই মহাতেজেরা কখোনো
সরাসরি(রামমোহন, দ্বারকানাথসহ অন্যান্য নিমক মহলের দেওয়ান বানিয়ান), আবার কখোনো
পরোক্ষভাবেই (বিদ্যাসাগর – গ্রাম বাঙলার গ্রামের
একলাখ পাঠশালা ধংস করে শহুরে বাঙালিদের সরকারি সাহায্যে পাঠদানের সরকারি নীতি
প্রণয়নের অন্যতম উদ্যোক্তা) দেশের পরিকাঠামে ধংস করতে, স্বাধীণতাকামী সরাসরি
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা গ্রামীণ জনগণকে খুন করতে, তাদের
উচ্চশিরদাঁড়া বেঁকিয়ে দিতে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছেন। রাজানুগত্য এমনস্তরে
পৌঁছয়, লবন মহলের লুঠতরাজে প্রতিবাদী মালঙ্গীরা স্বাধীণতা সংগ্রাম করলে, পালকি
বেহারারা কাজ বন্ধ করে দিলে, আফিম চাষীরা সরাসরি লড়াই করলেও, তিতুমীর প্রাণ দিলেও
তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য একজনও নবজীবনের অগ্রদূতেদের দেখা পাওয়া যায়না, ব্রিটিশ
বিরোধিতায় কারোর গলা একবিন্দুও ওঠেনা। শুধু নীলচীষে একটু নড়ে চড়ে বসেছিলেন। এরা সকলেই বাঙলার
নবজীবনের অগ্রদূত।
No comments:
Post a Comment