১৭৫৭র পালাশি চক্রান্তের পর থেকেই সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা
বাঙলা এবং ভারত ধনে, মানে, জ্ঞাণে উত্তমর্ণ থেকে অধমর্ণ জনপদে পরিণত হল। ১৭৫৭র পরপরই
বাংলার জ্ঞাণী গ্রামাণেরা বুঝে ছিলেন ব্রিটিশদের চরিত্র। তাঁরা বুঝেছিলেন ১০,০০০ বছরের ভারত সভ্যতার চাকা মাটিতে বসিয়ে দিতে
এসেছে ব্রিটিশেরা। হাতিয়ার আর্য
তত্ব, উত্পাদন আর ব্যবসার ধংস আর প্রযুক্তি চুরি। এই প্রথম ইওরোপ থেকে এশিয়ায় দামি ধাতুর স্রোত আসা হেঁটমুন্ড উর্ধপদ হল। তত্বটি বোঝার
জন্য গ্রামীণেরা ব্রিটিশদের হাতে বিশ্বজুড়ে নানান সুপ্রাচীণ সভ্যতা ধংস আর লুঠ কর্ম দেখেন নি। পড়তে হয় নি ভারি ভারি বিপ্লবী কেতাব অথবা লড়়াইখ্যাপা জনগণের ভাল করার জন্য রাজনৈতিক দলও তৈরি করতে হয় নি। পলাশি চক্রান্তের পাঁচ বছর যেতে না যেতেই গ্রামীণেরা স্বাধীণতা সংগ্রাম
শুরু করেছিলেন(অথচ পাঠ্য পুস্তকে লেখা, ভারতের প্রথম স্বাধীণতা
সংগ্রাম নাকি সিপাই বিদ্রোহ – দয়া করে আরও
একবার আনন্দমঠটি অথবা দেবী চৌধুরাণীটি পড়ুন – এই উপন্যাস
দুটি যে কোনও রগরগে বলিউডি সিনেমাকে হার মানাতে পারে, কিন্তু সেই সময়ের ঘটমান
বর্তমানকে তুলে ধরেছিল অসীম দক্ষতায়)।
১৭৬৩ থেকে
ফকির-সন্ন্যাসীদের আত্মবলিদানে বাঙলার স্বাধীণতা সংগ্রামের যে সূচনা হল, সেই
লড়াইতে কোটি কোটি সাধারণে অসাধারণ গ্রামীণ আত্মাহুতি দিয়েছেন, নিজেদের পরিবারকে
ছুঁড়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ রাজের রোষানলে, কারাবরণ করেছেন ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি
দিয়ে। সমাজের
স্বার্থে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার অন্যতম অবলম্বন, ঋজু শিরদাঁড়ায় আবলীলায়
দাঁড়িয়েছেন গর্জে ওঠা ব্রিটিশ কামান, বন্দুকের ছুঁচোলো বেয়নেট আর কলকাতায় তৈরি টোটার সামনে চোখ রাঙিয়ে, গালপাট্টা ফুলিয়ে, মালকোঁচা মেরে। অসম সেই
যুদ্ধে গ্রামীণরা জয়ী হননি – বাংলার
উচ্চমধ্যবিত্তরাও এই সংগ্রামের পাশে দাঁড়ান নি। ইওরোপিয় ধারা
অনুযায়ী, বর্তমান ইতিহাস আর লেখ্য ইতিহাসের কারিগরেরা বিজয়ী পক্ষাবলম্বী। বাঙলার
স্বাধীণতাকামী অকুতোভয় গ্রামীণদের স্মৃতি প্রায়অতলে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। ১৭৬৩ থেকেই
যাঁরা ব্রিটিশ সরকারের লুন্ঠনকর্মে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের স্মৃতি ইতিহাসে
বেঁচে রয়েছে আজও।
ইওরোপিয়
ব্যবসায়ী-প্রশাসকেদের বাংলা তথা ভারত দখলের প্রায় অর্ধ দশক পর্যন্ত, বিশ্বের
অন্যতম ধণী অঞ্চল, বাংলা সুবা শুধু উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ ছিল না, প্রযুক্তিতেও
বাংলা বিশ্বের অন্যতম প্রধান জনপদ ছিল। বেশকিছু প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব ছিল। সে সব প্রযুক্তি
বাংলা রপ্তানিও করেছে পেটেন্টের পরোয়া না করেই। বিশ্বদ্যালয় খুলে শিখিয়েছে বিশ্বের
নানান সমাজকে। তার নিজের মেধা আর পরিশ্রমে এতই বিশ্বাস ছিল, যে সে প্রযুক্তি
ভাবনা কেউ চুরি করলেও সেই প্রযুক্তি অতিক্রম করে নতুন কিছু সৃষ্টি করার যোগ্যতা আর
বিশ্বাস ছিল সেই অদম্য মানুষগুলির। ব্রিটিশ শাসনের আগেও সেই যোগ্যতার
বিচ্ছুরণ দেখা যেত বিশ্বের রপ্তানি বাজারে বাংলার গালা বা লাক্ষা, আফিম, নীল রং,
লৌহ আকরিকজাত দ্রব্য, প্রশিক্ষিত হাতি, হাজার হাজারমনি নৌকো, পান, সুপুরি, তাঁত,
রেশম, মুগার বস্ত্র দ্রব্য, গুড় এবং গুড়জাত মদ্য রপ্তানিতে। অন্তত ১৫০তির বেশী একচেটিয়াভাবে বিশ্বে বাজার ধরা উতপাদনগুলো বাঙলার গ্রামীনেরা তৈরি আর ব্যাবসা করে এসেছেন – যতদিননা তার শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে
দিয়ে তার উতপাদন আর ব্যাবসা উদ্যমকে ধংস করা হয় নি। ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের শিল্প
উত্পদনের প্রায় ৮০ শতাংশ উত্পাদিত হত ভারত, চিন আর পারস্যে। এর মধ্যে বাংলার
অবদান খুব কম ছিল না।
প্রায়
প্রত্যেকটি দ্রব্যের বিশ্বজোড়া একচেটিয়া বাজার। অথচ বাঙলার ছোটবড় দব বণিক বা উত্পাদকেরা
সমাজের বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে থেকেই বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করতেন। তাদের একচেটিয়া কারবার
করতে ভারতীয় সমাজ কোনওদিনও উত্সাহ দেয় নি। ইওরোপিয়
উদ্যমী এবং বণিকদেরমত, নিজের দেশ অথবা সামগ্রিক বিশ্বের সামাজিক গঠণ পাল্টে অথবা
প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ব বাজার দখল করার বিধ্বংসী পরিকল্পনা তৈরি করে নি -
বলাভাল সমাজ করতে দেয় নি। এই উত্পাদন
প্রক্রিয়ার ছিল বিকেন্দ্রিভূত। এই বিকেন্দ্রীকৃত উত্পাদন ব্যবস্থার
বড় অংশিদারিত্ব ছিল বাঙলার পারম্পরিক শিল্পী-ব্যবসায়ীদের, যাদের উদ্যমকে পরের
দিকে অসংগঠিত অথবা হস্তশিল্প ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে বড় ব্যবসার সম্প্রসারণের
উদ্দেশ্য। ফলে লাভের গুড় সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে না গিয়ে, কয়েকটি হাতে কেন্দ্রিভূত হয়েছে। পেছনে সরে গেছে সামাজিক সাম্য।
বাঙ্গালি জিবনে পরিবর্তনটা
এল দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকে। ইওরোপিয় আধিপত্য বিকাশের সঙ্গে, চাকরি আর ব্যাবসার টোপ দিয়ে বাঙালি উচ্চমধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যের ছোট অংশিদার করে নেওয়া হল। প্রথমে বাঙলা-বিহারে, পরে সারা ভারতে জনপদে জনপদে অসীম
অত্যাচার, আর ধংসমূলক বাণিজ্য এবং উত্পাদনের পরিকাঠামো ধংসের প্রচেষ্টা শুরু হল। সেই
সময় থেকেই বাংলার বিশ্বজয়ী ছোটবড় পারম্পরিক বণিকদের পরাধীণতা, বাংলার পারম্পরিক শিল্প
উত্পাদনের বাংলার অর্থনীতি-প্রযুক্তির পরাধীণতার যুগের শুরু।
মানসিকভাবে
মেরে দেওয়া হয়েছে এই ব্যবসায়ী আর উদ্যমী মানুষগুলিকে। গ্রমীণ
মানুষগুলির সভ্যতার ধারকরূপে মানসিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, তাদের অনুপস্থিতিও ঘটেছে
লেখ্য ইতিহাসেও। আজও
সমানে চলেছে ভারতের পারম্পরিক সমাজ গড়নে তাদের ভূমিকার ন্যুনতা
প্র্চারের ধারাবাহিকতা।
ব্রিটিশ প্রশাসক আর বণিক দস্যুদের অমিত অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙলার শহুরে
সাহিত্যিক অভিচারে একের পর এক উজ্জ্বল উত্কর্ষের, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের
দর্শণ, এলাকাগুলো প্রায় হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। পুরোনো
সাহিত্যগুলি থেকে বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালির উতপাদন আর ব্যবসাকর্মও ব্রিটিশ
আর মধ্যবিত্ত অনাচারে, অত্যাচারে নষ্ট হয়েছে। সমাজের
কর্মকারকের সৃষ্টি করেছেন যাঁরা, স্বাধীণতার পরও সরকারি ও সমাজের নানান স্তরে
বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে তাদের অনুপস্থিতির ছবি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে।
ব্রিটিশদের
প্রযোজনায় চলে আসা অনাচারগুলি রোধ করার নানান উদ্যমের সূচনা হবে, এমন রঞ্জিত
আশাবাদ রোপিত হয়েছিল স্বাধীণতাপূর্ব আমলে। অথচ, স্বাধীণতার পর ভায়বহ আতঙ্কের ফল ফলল দেশজুড়ে। স্বাধীণতার পর
বিগত ছ দশকেরও বেশি সময় ধরে অত্যাচারী শাসক ব্রিটিশ সৃষ্ট অনাচারগুলি রোখার চেষ্টা
হল না। সবথেকে
বেশি ক্ষতি হল গ্রামীণ ভারতের। ইওরোপিয় উচ্চমধ্যবিত্তকেন্দ্রিক উন্নয়ণ প্রক্রিয়ায়, সরাসরি নিপীড়িত হলেন
ভারতের আপামর গ্রামীণ।
গ্রামীণদের নিরবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা, দর্শণ আর মানবমুখীনতায় গড়ে উঠেছিল যে
বাঙলা তথা ভারতের সামাজিক সার্বিক সম্পদ, যে প্রযুক্তি, যে জ্ঞাণের বিকাশ ঘটেছিল
বিগত কয়েক সহস্রাব্দে, দেশ বিকাশের ধারায় গ্রামীণ মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতির
অভাবে, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে, প্রযুক্তির বিকাশ, গবেষণা বিকাশ, উদ্ভাবনার
কর্মে ছেদ পড়ল।
১৭৫৭র পর থেকে
যে সমাজ-অর্থনীতির বিকাশের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ১৯৪৭এর পর নতুন পরিবর্তন এল না যার দ্বারা গ্রামীণেরা নতুন করে প্রযুক্তি বা কর্মবিকাশের অনুরূপ পরিবেশ ফিরে
পেতে পারেন।
রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও, ১৭৫৭র ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটলনা। সরকারিস্তরে গ্রামীণদের উদ্দেশ্যকরে নানান প্রকল্প রচিত হল ঠিকই, কিন্তু তার মূল খাতক গোষ্ঠী
উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ। গ্রাম
সমাজে আরও বড় আঘাত নামে এল বিদেশি দাতাদের দেওয়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি
প্রকল্পে।
গ্রাম্যস্তরে প্রযুক্তি নিযুক্তি (টেকনলজি ট্রান্সফার)র নামে গড়ে উঠল নতুনতর এর
কর্মযজ্ঞ। সমাজ
বদলানোর ছুতোয়, সমাজ-উন্নয়ণকর্মের নামে বিদেশি প্রযুক্তি কিনে, ভারতে বিকশিত
প্রযুক্তির নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ার কাজ আরও দ্রুতগিতে এগোল। যে প্রাযুক্তিগুলো এল, তার অধিকাংশই ইওরোপ আমেরিকা অথবা জাপানের বাতিল প্রযুক্তি। সেই বাতিল
প্রযুক্তি ভারতে এনে করপোরেটদেরজন্য আরও বেশি মুনাফার বাজার তৈরি হল শাসক
মধ্যবিত্তের পরিকল্পনায়।
একসময় ভারত
থেকে সুতোর বস্ত্র আমদানি করে ব্রিটিনের সমাজে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত স্বাস্থ্যবিধানকে
যেমন ন্যুনতম একটি মান দিয়েছে, তেমনি গ্রীষ্মে সুতিবস্ত্র পরে কাটানোর স্বস্তিও
অনুভব করেছে ইওরোপিয়রা। ভারত
আর চিনের চা, ব্রিটনের দৈনন্দিন জীবনকে পাল্টে দিয়েছে চিরতরে। অন্যান্য ভারতীয়
খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে – তাই বিরত থাকা
গেল। ভারতই একদা ব্রিটেনকে সভ্য করেছে, দিল্লি স্কুল আর ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক, ওম
প্রকাশের এই দাবি খুব একটা আজকের ভারতে দাগ কাটেনা তা বোঝাই যায় বিভিন্ন লেখপত্রেয নমুনায়।
বোঝা যায় ভারতের
শহরে শহরে, বাজারের পর বাজারে সেদিনের লন্ডনের দোকানে দোকানে বাংলা তথা ভারতীয়
দ্রব্য সাজিয়ে রাখারমত, ব্রিটিশ, চিনের আর আমেরিকার ফোরেন জিনিস কেনার জন্য উচ্চ-মধ্যবিত্তের আদিখ্যেতায়। ১৮০০র আগে, ভারত থেকে
রপ্তানি হওয়া পণ্যগুলো ব্রিটেনের
উচ্চ-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল সেটি আজ ঐতিহাসিক
সত্য। বছরের
পর বছর ধরে পণ্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে গ্রামীণ শিল্পীদের কারিগরির যন্ত্রের
বিকাশ, ভারতে আর বিশ্বে বাজার তৈরি, আর নতুন নতুন পণ্যদ্রব্য উদ্ভাবনী আবিষ্কারের
অননুকরণীয় দক্ষতায় ভারত তথা বাংলা ছিল মাহির। শুধু বস্ত্র
উত্পাদনে অসাধারণ দক্ষতাই নয়, নানান ধরণের ধাতুজ দ্রব্য(আকরির লৌহ আর ক্রুসিবল
স্টিল – প্রখ্যাত
দামাস্কাস তরোয়ালের পিন্ডটি তৈরি করত ডোকরা কামারেরা, আজও তারা যে লোহার দ্রব্য
তৈরি করেন, তাতে মাথাখাপকরা জং ঢাকতে, বিন্দুমাত্র রংএর প্রয়োজন হয় না – যে প্রযুক্তি আজও প্রযুক্তিগর্বী ইওরোপ আবিষ্কার করতে পারে নি – দিল্লির মিনার অথবা বিষ্ণুপুরের মদনমোহন অথবা পুরোনো পরিবারের লোহার তৈরি
দেবতা কোনও বিশেষ প্রসাধণ ছাড়াই শয়ে শয়ে বছর খোলা আকাশের তলায় পড়ে থাকেমাথা উঁচু
করে), খাবারদাবার(পান, সুপুরি, গুড়, চা, নুন, মশলা, চাল), পরিধেয়(চামড়া, সুতো,
সিল্ক, তসর), রং(নীল অর্থাত ইন্ডিগো), শিল্পী(মস্করী বা পটুয়ারা দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার নানান বৌদ্ধগুম্ফা তৈরি করেছেন), মাটির বাড়ি তৈরির (পোড়া মাটির মন্দির
অন্ততঃ তিনশো বছর ধরে রোদ, জল, ঝঞ্ঝায় দাঁড়িয়ে থেকেছে বাংলার প্রযুক্তির অনন্য বিজ্ঞাপণ
হয়ে, আজও বিলাসবাহুল বাড়ির ব্রিটিশ নাম কিন্তু বাংলা বা বাংলো) প্রযুক্তি অথবা পণ্য সরবরাহ করত বাংলার তথাকথিত হস্তশিল্পীরা। তবে তার অকলঙ্ক
খ্যাতি ছিল নানান ধরনের বস্ত্র উত্পাদনে, লৌহ দ্রব্য তৈরিতে, শিল্পীর গুণমানে আর
তাদের কারিগরীর চূড়ান্ত দক্ষতায়।
-----
এই কলামে আমরা দেখার চেষ্টা করব সেই সব মানুষ, সেই সব সমাজের
উদ্যম, সেই সব প্রযুক্তি, যাদের অসীম প্রচেষ্টায় বাংলা ১৮০০ সন পর্যন্ত বিশ্ব
বিজয়ী শিল্প আর ব্যবসা উদ্যমের আঁতুড় ঘর রূপে প্রখ্যাত ছিল। পাঠকেরা
দয়াকরে মনে রাখুন ব্রিটিশপূর্ব বাঙলা তথা গৌড়বঙ্গের সীমা ছিল(বাঙলা সুবা নয়),
পশ্চিমে দ্বারভাঙা(দ্বারভাঙা অর্থাত দ্বারবঙ্গ, বঙ্গের দ্বার – মহামহোপাধ্যায়
হরপ্রসাদ উবাচ) পূর্বে ছিল মায়ানমার সীমান্ত, দক্ষিণে ওড়িশা, উত্তরে আসাম ছাড়িয়ে প্রায় তিব্বত। বাংলার যে
সব শিল্প উদ্যম নিয়ে পূর্বে আলোচনা করলাম, সেগুলি আজও ব্রিটিশদের অসীম অত্যাচার
মধ্যবিত্তের অসীম উদাসীনতা সয়ে আজও টিকে রয়েছে টিমটিম করে বাংলার নানান গ্রামে। একদা যে দ্রব্য
তৈরি করতে সমগ্র অঞ্চল আজ হয়ত সেই কাজটি করছে কয়েকটি পরিবারমাত্র। সেই পারম্পরিক
শিল্পীরা বিগত কয়েক দশকে হয়ত ভুলেছেন তাঁদের বর্ণময় ঐতিহ্য, বাংলা তথা ভারতের
বিকাশে তাঁদের দান। সেই
মানুষদের আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত করব এই কলামে, যাতে তাঁরা আবারও নতুনভাবে
একটু কাজ করার উদ্যম এঁচে নিতে পারেন। আজ আলোচনা করব মেদিনীপুরের খড়ুই গ্রামের গালা পুতুল শিল্পী বৃন্দাবন
চন্দের উদ্যম।
বৃন্দাবনের গালার পুতুল
কয়েক দশক আগেও পূর্ব মেদিনীপুরের বহু কারিগরপরিবার বাঙলার অন্যতম প্রধান ও
পরম্পরাগত নিজস্ব শিল্প, গালার পুতুল, গালার গয়না তৈরির যুক্ত ছিলেন। বিগত তিন-চার দশকের টালমাটাল সময়ে, বাঙলার সামগ্রিক পারম্পরিক শিল্পের ভাঁটার টানে, গালার পুতুল তৈরির অনেক পরিবার বৃত্তিচ্যুত হয়ে
দিনমজুর বনে গিয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের খড়্গপুর-দীঘা
রাস্তায় এগরা-বাজকুল পথে, অথবা দীঘা-মেচেদা রাস্তায় বাজকুল হয়ে ভাগবানপুর-এগরার
পথে বাস বা ট্রেকারে খড়ুই বাজার। বাজারের পথ বেয়ে খড়ুই গ্রামের
প্রখ্যাততম কয়েকটি বাসিন্দা-পরিবার গদাধর চন্দ, বৃন্দাবন চন্দ আর কানাই নন্দী গালার পুতুল
তৈরির অদম্য কারিগর পরিবার।
বৃন্দাবন
অগ্রজ, শ্রীবাস
দৃষ্টি খুইয়েছে চিরকালের জন্য। বাঙলার পারম্পরিক শিল্প বিকাশে তাঁর
শরীরের অমূল্যতম অঙ্গ, চক্ষুরত্নটি চিরকালের জন্য হারিয়েছেন, এ অসাধারণ অবদানময়
তথ্যটুকুও বাঙলার সমাজে স্বীকৃতি পায় নি। চোখ হারিয়ে শ্রীবাস আর তার
পরিবার আজ কর্মহীন।
এই গালা
গলানোর, গালা রাঙানোর, ছোপানোর প্রযুক্তি বাঙলার কারিগরদের হাতে বিকশিত হয়েছে হাজার
হাজার বছর ধরে। শুধু শিশুদের উপযোগী রঙিন খেলনা পুতুল নয়, অসম্ভব
সুন্দর রঙিন গালার চুড়ি, দুল, লকেটসহ নানান ধরণের দৈনন্দিনতায়ঋদ্ধ ব্যবহার্যের
সঙ্গে ঘর সাজানোর বহু শৌখিন দ্রব্যও তৈরি করতেন শ্রীবাস, বৃন্দাবনেরমত কারিগরের
পূর্বজ, হাজার হাজার বছরের অর্জিত পারিবারিক অসীমতম দক্ষতামানক ব্যবহার করে। এঁরাই একদা
এবং আজও বাঙলা শিল্পের অন্যতম ধারকবাহক ছিলেন আছেন, মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি মানুক
ছাই না মানুক।
ঐতিহ্যেস্থিত
থেকে বৃন্দাবন চন্দের কাজে সূক্ষ্মতম অন্তর্লীন নিজস্বতা শিল্প সংগ্রাহক-রসিকদের
অন্যতম প্রধান পাওনা। আজও তার কর্মে কলকাতার পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত
শিল্প নির্দেশকদের ছোঁয়া লাগেনি, এ তথ্য আশ্বাসজনক। এই শিল্প-নিজস্বতা বৃন্দাবন, অদম্য বাঙলার গ্রামীণ সমাজ
থেকেই অর্জন করেছেন অননুকরনীয় পারম্পরিক অনপনেয় অনেককালের প্রাচেষ্টিক দক্ষতায় – অশিক্ষিতের পটুত্ব বাঙলার মধ্যবিত্তের প্রযোজনায়
তৈরি অশ্লীলতম বাক্যবন্ধশুধু। কলকাতার
প্রখ্যাত বিদ্যালয়ে বৃন্দাবন আজও বাঙলার ঐতিহ্য-মন্ডিত শিল্পকে নিয়মিত নতুন
প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কাজ করে চলেছেন, নানান বন্ধুর উদ্যমেও কর্মশাল আয়োজন
করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্বদ্যালয়েও। গালাঋদ্ধ প্রামাণ্য চেহারার মুর্তি
তৈরিতে আজও নানান প্রান্ত থেকে তিনি ডাক পান।
ভারতীয়
বর্ণময় পারম্পরিক পুতুলকলার সঙ্গে খড়ুইএর গালার পুতুল গড়ার ধারার এক সরলরৈথিক
পরম্পরা রেখা অঙ্কন করা যায় স্বচ্ছন্দে। বৃন্দাবনেরমত খড়ুইএর
শিল্পীরা বাঙলার এই চিরাচরিত সম্পদের ধারকবাহক। নানান
পিছুটান, অভাব, বঞ্চনা, অযাচিত অপমান সত্বেও, তারা চিরাচরিত শিল্পবিদ্যা প্রদর্শণে
একাভিমানমুখী। মধ্যবিত্ত
বাঙালি সমাজে পশ্চিমমুখীনতার আদেখলেপনা সত্বেও সাধারণ এই তথ্যটি আজও দেশজভাবনায়
উদ্বুদ্ধ শিল্পী, রসিকদের দেশের মাটির গভীরে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রাণিত করে।
অদম্য
বৃন্দাবন আজও বয়ে চলেছেন কয়েক হাজার বছরের বাঙলার প্রাচীণ শিল্পধারা, হয়ত
স্বরস্বতী-মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা রেশের অন্যতম শেষ প্রতিভূ তিনি। আর কত দিন
পারবেন কে জানে। যে ব্যস্তানুপাতিক হারে অনুপানগুলির দাম বাড়ছে আর
শিল্পদ্রব্যের দাম আর বাজারের ওপর শিল্পীর পকড় কমছে গুণোত্তর প্রগতিতে, তাতে শুধু
বৃন্দাবনেদেরমত শিল্পনৈপুণ্যধারী পরিবারের বেঁচে থাকার আশংকা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর
হচ্ছে। বাংলার ইতিহাস অথবা সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা
হাজারো পারম্পরিক কারু, বয়ন ও অভিকর শিল্পের সঙ্গে যাঁরা হাতেকলমে যুক্ত, তাঁদের
প্রত্যেক পরিবারের সম্বন্ধে একই কথা বলা যায়।
বৃন্দাবনেরমত শিল্পীরা আজও জীবন বাজিরেখে চেষ্টা করেচলেছেন, শিল্পীর অহং বজায় রেখে
অসামান্য উদ্যমে নিজের পরিবারের উদ্যম বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করেচলেছেন। এই লড়াই কী
শুধুই বৃন্দাবনের! বৃন্দাবনের সঙ্গে বাংলার পারম্পরিক শিল্প আজও বাঁচতে চায়। সেই ঐতিহাসিক
দায়িত্ব গ্রহণ করুক আজকের মধ্যবিত্ত। নতুন সহস্রাব্দে এইটুকুই চান বৃন্দাবনেরা। অলমিতি।
No comments:
Post a Comment