(From http://chorchapod.blogspot.com)
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে লেটো গানের প্রচলন হয়েছিল মূলত মুসলিম সমাজে। বিনোদনের জন্যেই শ্রমজীবী কৃষিজীবী মুসলমানরা লেটো গানের প্রবর্তন করেছেলেন। লেটো গানের আগে এবং লেটো গানের সমকালেও অন্য যে-সব লোকগান প্রচলিত ছিল সেগুলো হল- সত্যপীরের গান, ফকিরী গান, বেহুলার গান, জারি, মরমিয়া, মানিক পীরের গান, ইমামযাত্রা, কবি ও তরজা প্রভৃতি গান। কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দুখু মিয়া ক্রমে এসব গানের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, পাড়ায় বা মাজারের পাশে যখন ফকিরী গান বা সত্যপীরের গানের আসর বসতো তখন দুখু ময়িা উপভোগ ছাড়াও নিজেও সুর করে পুথি পাঠে অংশ নিতেন। মনোরঞ্জন করতেন দর্শকদের সংসারে ছিল অভাব-অনটন। আর এজন্যে মক্তব পাঠ শেষে তাকে পাড়ার মসজিদে ইমামতি করতে হতো। খাদেমগিরি করতে হতো হাজী পাহলোয়ানের মাজারে। শুধু তাই নয়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিলাদ পাঠ করেও অর্থ উপার্জন করতে হতো। অর্থ উপার্জনের বিশেষ অবলম্বন বাদ দেয়ার পর একই সমাজে, একই সময়ে প্রচলিত অন্যান্য গানে আগ্রহী না হয়ে দুখু ময়িা কেনো লেটোদলে যোগ দিয়েছিলেন, প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ‘নাচ-গান-নাট’-কে প্রাচীনকালে বলা হতো নাটগীত। খারাপ ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে ‘নাটগীত’ বলা হত। নাটগীত ও নট থেকে যে, লেটো গানের উৎপত্তি তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন দুখু মিয়ার লেটো গানের সংকলক ও সম্পাদক, মুহম্মদ আয়ুব হোসেন। তাঁর বর্ণনা তুলে ধরছি, গ্রাম্যজনের মুখে, গ্রাম্য ছড়ায়, প্রবাদ-প্রবচন ও গ্রাম্য মেয়েলী গীতে ‘নট’ ‘নেটে’ ‘নটী’ ও ‘নাটুয়া’ ইত্যাদির উল্লেখ আছে। পুরাতন আঙ্গিকে নতুন ধারায় এই গান শুরুর সময় এর নির্দিষ্ট কোন নাম ছিল না। যারা এই শ্রেণীর নাচ-গান নাটক করতো, তাদের বলা হতো ‘নট’ ‘নাটুয়া’ ইত্যাদি। এই শ্রেণীর গানকে গ্রাম্যলোকে বলতো ‘নাটুয়াদের গান’। পরে ‘নাটুয়াগান’। আরও পরে নাটয়া গান> নেটুয়া গান> নেটু গান> নেট গান> নেটো গান> লেটো গান এইভাবে এর নাম হয়ে গেল নেটো বা লেটো গান।” লেটো গানের কলাকৌশল পুরাতন কিন্তু ধারাটি তখন নতুন আর এই নতুন ধারার গানের জনক কে বা প্রথম কার চিন্তা-ভাবনায় এসেছিল বিষয়টি- তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রথমে অ-সংগঠিতভাবে চলছিল লেটো গান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যে দু’জন লেটোগানকে অসংগঠিত পর্যায় থেকে অনুশীলনের পর্যায়ে এনে সুশৃঙ্খলরূপে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী পরিবারের একজন। তিনি দুখু মিয়ার বাবা কাজী ফকির আহমদের আপন চাচাতো ভাই কাজী বজলে করীম। তিনি শিক্ষিতও ছিলেন। তিনটি ভাষা আরবি, ফারসি ও বাংলায় তার দক্ষতা ছিল। তিনি নিজেই লেটো গান রচনা করতেন। অর্থাৎ গান- সং, পালা তিনিই রচনা করতেন। তাছাড়া দলের কবি গান তিনি নিজেই গাইতেন। তাকে দলের গোদা কবিও বলা হতো। দলের মূল কবিই মূলত গোদা কবি।
চুরুলিয়া নিমশা-ফকির বৈদ্যনাথপুরের লেটো গানের অনুকরণীয় মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
দুখু মিয়া তাঁর চাচা কাজী বজলে করীমের সহযোগিতায় লেটোর দলে যোগ দিয়েছিলেন।
আরও একটি বিশেষ কারণ ছিল, আর সে কারণই প্রধান। লেটোর দলের অধিকাংশ শিল্পীরা ছিল মূলত কিশোর। বয়স্কদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। লেটো গানের দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ থাকতে হতো আর যে সব কিশোর লেটোর গানে অংশ নিতো তারা ব্যাঙাচি’ নামে পরিচিত হতো।
লেটোর দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ছিল বলেই দুখু মিয়া অন্যান্য গানের দলের প্রতি আগ্রহী না হয়ে লেটো দলে যোগ দেন। অবশ্যই অর্থ উপার্জন ছিল মুখ্য বিষয়।
লেটো গানের পরিবেশনায় ছিল- ‘ছোট ছোট’ প্রেমগীত, ডুয়েট, ইলামী গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, চাপান- উতোর সং এবং বিভিন্ন ধরনের পালা।
নিমশা গ্রামে লেটো গানের দলটির পরিচালক, গোদা কবি ও ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করীম। তার সহযোগিতা-প্রশিক্ষণ পেয়ে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। জানা যায়, বজলে করীম গানে সুরারোপ, সং ও পালা পরিচালনা এবং অভিনয় পদ্ধতি দেখিয়ে দিতেন। বজলে করীম হয়ে ওঠেন দুখু মিয়ার লেটো গানের গুরু।
লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করে। তাদের বলা হয় বাই, ছোকরা ও রাঢ়। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হয় রাণী। পাঠক বলা হয় যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র ও সেনাপতি সাজে। আর যারা নাচ, গান, অভিনয় ও সংলাপ ইত্যাদির দ্বারা দর্শক-শ্রোতাদের হাসায় তাদের বলা হয় সংদার বা সঁংগাল।
দুখু মিয়া ছোকরা সেজে গানে অংশ নিতেন কিনা এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। তবে সং সেজে যে নাচ-গান অভিনয় করে মানুষ হাসাতেন তার তথ্য রয়েছে।
কবি স্বভাব তার কৈশোরেই উন্মোচিত হতে দেখা যায় লেটো গানে। বেঙাচি হিসেবে দলে আবির্ভাব ঘটলেও দুখু যখন পাল্লাপাল্লি লেটোর গানের আসরে বিপক্ষের গোদা কবিকে হারিয়ে দিতেন, তা দেখে তাঁর চাচা লেটো গুরু বজলে করীম বলতেন, দুখু ‘বেঙাচি নয় গোখরো’, কিছুদিনের মধ্যেই গুরুর উৎসাহে ও দলের প্রয়োজনে দুখু রচনা করেন বিভিন্ন পালা, রচনা করেন, ‘প্রেম গান, ইসলামী গান, ডুয়েট গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান। হাসির গান ও অন্যান্য গান, হাস্যরসাত্মক সং।’ শুধু তাই নয়, “তাঁর অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো সং ও পালার সঠিক স্থানে। সঠিক রসের গানের সংযোজন। এসব গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। যার জন্য সং ও পালাগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। লেটোর আসরে হাস্যরসাত্মক নাট্যশ্রিত গান এবং এক মুখো কমিকের প্রচলন তিনি করে গিয়েছিলেন।”
বয়সের ভারে বজলে করীম দল ছাড়ার আগে দুখু-কে লেটো দলের ওস্তাদ পদে নিযুক্ত করেন। ওস্তাদ হবার পর তাঁর লেটো দলে আসে নতুন করে গতি।
এ ব্যাপারে সমালোচক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘ওস্তাদের পদ গ্রহণ করে তাঁর পরিচালিত লেটো দলকে ঢেলে সাজালের তিনি। নানা ঢঙের লেটো গান, নানা রসের সং, হাস্যরসাত্মক- করুনরসাত্মক একমুখো কমিক এবং নানা স্বাদের পালা রচনা করে, পুরাতন-নতুন লেটো শিল্পীদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করলেন তিনি।ঃ সুর যোজনা, অভিনয়, পরিচালনা ও বাজনার ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, লেটো গান সু-সংবাদ, সু-সমৃদ্ধ হল ও পূর্ণতা লাভ করলো।” লেটো দলের নবাগত শিল্পী হিসেবে বেঙাচি’ হয়ে অংশ গ্রহণ ছিল দুখুর। ওস্তাদ হয়ে দল পরিচালনার পর তাকে ক্ষুদে ওস্তাদ’ উপাধি দেওয়া হয়। জানা যায়, ‘এ উপাধি তিনি পেয়েছিলেন, বীরভূম জেলার দুবরাজপুরে, গ্রাম্য মেলার এক লেটো গানের আসরে।’
তারপর তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি বা ভোমর কবি’ হিসেবে। মুহম্মদ আয়ুব হোসেন এ ব্যাপারে জানিয়েছে লেটো দলে ওস্তাদ রূপে বরিত হয়ে, লেটো শিল্পীদের দ্বারা এই উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। দুখু মিয়ার সমসাময়িক লেটো শিল্প শেখ আব্দুল ওয়াজেদ মাস্টার, শেখ আব্দুল লথিব, শেখ মুবাই সংদার ও এদের পরবর্তী আলী আহমদ দফাদার ইত্যাদি আমাকে এই নামকরণ ও তার দুইটি ব্যাখ্যার কথা শুনিয়েছেন। প্রথমত ভ্রমর ফুল হতে মধু আহরণ করে তা জমা করে মৌচাকে। আমরা সেই মিষ্টি মধু পান করি।
ভ্রমর কবির রচিত গান-সং পালাগুলো মধুর মতই মিষ্টি, সেগুলো জমা হয় লেটো গানের দলে, আর মানুষ গীত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তা আস্বাদন করে। দ্বিতীয়ত ভ্রমরের হুল খুব সূক্ষ্ম আর তার জ্বালা বৃশ্চিক ইত্যাদির মত নয়। লেটো গানের আসরে বিপক্ষ দলের প্রতি যে চাপান গান ও সং গীত-অভিনীত হত তা মিষ্টি। অর্থাৎ তার চাপান গান ও সং মিষ্টি মাখা হুল।’
দুখু তার অল্প বয়সের ‘ভ্রমর কবি’ উপাধিকে গ্রহণ করেছিলেন ভিতর থেকেই। গৌরববোধও করতেন তার উপাধি নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো তার একটি গানে ভ্রমর কবি ভানতা যুক্ত পঙক্তি পাওয়া যায়। যদিও নজরুল তার বিখ্যাত একটি গানের শেষে ভ্রমর’-এর স্থলে গাঁথিস’ শব্দটি ব্যবস্থার করেছেন। গানটির প্রথম কলি “চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা এনয়ন পানে।” মুহম্মদ আয়ুব হোসেন তার গ্রন্থে তথ্যসহ দেখিয়েছেন দুখু মিয়া গানটি লেটোর গানে পরিবেশনের জন্যে লিখেছিলেন। গানটির প্রথম ও শেষে দুই পঙক্তি করে চারপঙক্তি উল্লেখ করা হলো:
চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা, এনয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি সই ও আঁখি কি জাদু জানে ।।
মিছে তুই কথার কাঁটায় সুর বিঁধে হায় রে ভ্রমর কবি।
বিকিয়ে জায়রে মালা, আয় নিরালা আঁখির দোকানে।।
বর্তমানে গানটির ‘ভ্রমর’ শব্দের স্থলে ‘গাঁথিস’ ব্যবহৃত। গানটি যে লেটোর গানের জন্যেই রচিত এ ব্যাপারেও মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের দেয়া তথ্য এরকম ‘এই গানটি আছে, কবির লেটো জীবনের বন্ধু, চুরুলিয়া নিকটবর্তী কোলজোড়ার শেখ ফকির মন্ডলের লেটো গানের খাতায়।’ দুখু-র গানগুলো তখন দুখু মিয়ার গান ও দুখুর গান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এখনও সে হিসেবেই পরিচিত। শিয়ারসোলের স্কুলে ভর্তি হয়ে রাণীগঞ্জ মুসলিম হোস্টেলে চলে গেলে লেটো গানের দল ছেড়ে দেন দুখু মিয়া। তবে শিয়ারসোল-রাণীগঞ্জের ছাত্র জীবনেও দুখু মিয়া অনেক লেটো গান, সং ও পালা রচনা করেছিলেন। লেটোর গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলবার ক্ষেত্রে এবং কৃষিজীবী শ্রমজীবী মুসলমান সমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যে দুখু মিয়ার অবদান বাংলা লোক সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Monday, October 25, 2010
লেটো কবি দুখু মিঞা
লেবেলসমূহ:
Bengal,
Dukhu Miyan,
leto,
দুখু মিয়া,
লেটো
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment