(সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর মজিলপুর, ৩০ জানুয়ারি)
বেলুচিস্তানের মেহেরগড় পর্যন্ত অজানা প্রাচীনতম টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির শিল্প নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পের বয়স প্রায় ৭০০০ বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পান্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোটের প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ও পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ের সাথে এই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হরিনারায়ানপুর প্রভৃতি স্থান থেকে পোড়ামাটির লোকশিল্পের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তা হয়ত ২০০০ বা তারও অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে ওই শিল্প প্রচলনের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের যে কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে মুর্শিদাবাদের কাঁটালিয়া ও বীরভূমের রাজনগরের কেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল শিল্পের কোনরকমে টিকে থাকা অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলির মধ্যে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া বাদে আর মাত্র দুটির একটি মেদিনীপুরের নাড়াজোল ও অপরটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার (জয়নগর) মজিলপুর। গত ২৩ জানুয়ারি ২০১০ মজিলপুর ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস ৮২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
পাঁচুগোপাল দাসের কাছে শোনা তাঁদের বংশ ইতিহাস অনুযায়ী আনুমানিক ২০০-২৫০ বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ কালিচরণ পেয়াদা জশোর থেকে মজিলপুরে চলে আসেন। পরবর্তী কোনও সময় এঁরা দাস পদবি গ্রহণ করেন। কালিচরণের দুই পুত্র, জানকী দাস ও রাম দাস। রাম কুমোরটুলির প্রতিমার ডাকের সাজের কাজে যুক্ত হন এবং জানকীকে পুতুল গড়তে অনুপ্রাণিত করেন। জানকী কুমোরটুলি দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর পুত্র হরিনাথ মজিলপুরের তথা সুন্দরবনের পরিবেশ থেকে রসদ সংগ্রহ করে পুতুল গড়তে থাকায় মজিলপুরের ঘরানার উদ্গাতা বলা যায় তাঁকে। কিন্তু এই দাস বংশের মধ্যে সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী সহ লৌকিক ধারার পুতুল গড়ে সবার চেয়ে বিখ্যাত হন হরিনাথের পুত্র গোপালের বড়ো নাতি মন্মথনাথ দাস (২৮ এপ্রিল ১৯০৫ -- ১০ জানুয়ারি ১৯৮৬)। মন্মথনাথের সময় থেকেই তাঁর হাতে গড়া সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী বেশি প্রচার পায়।
জানকীর অধস্তন ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ পাঁচুগোপাল দাসের জন্ম ১৯২৭ সালে। তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাসের কাকা মন্মথনাথের কেবল একটি কন্যা ছিল। কোনও পুত্র না থাকায় তিনি মাত্র দেড় বছর বয়স থেকে পাঁচুগোপালকেই পুত্রের মতো মানূষ করেন ও পুতুল তৈরির শিক্ষা দেন। পাঁচুগোপাল ৫-৬ ক্লাসের বেশি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। ক্রমে পুতুল তৈরি তাঁর নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় বোস পাড়ায় যেখানে তাঁদের বাস, সে পাড়ার এক প্রবীণ মানুষ অজিত বোস (৭৪ বছর) জানালেন --- উনিশশ' চল্লিশের সেই উত্তাল দশকে স্বদেশি বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণায় ও গোপন পরিচালনায় তাঁদের বাড়ির সামনেই গড়ে ওঠা জয়নগর মজিলপুর ব্যায়াম সমিতিতে পাঁচুগোপাল তাঁর মতো ৭-৮ বছরের বালকদের জিমন্যাস্টিক, জাগলারি ইত্যাদি ট্রেনিং দিতেন। জানিনা সেই মূল্যবোধের থেকেই তিনি পূর্বপুরুষের অনুসৃত লৌকিক এই পুতুল তৈরির ধারাটিকে নিষ্ঠার সাথে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিনা। যদিও এই শিল্প তাঁকে উপযুক্ত অর্থ বা যশ কিছু দিতে পারেনি, অভাব অনটনেই দিন কেটেছে, সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনও উল্লেখযোগ্য আর্থিক সাহায্য বা সম্মান তিনি পাননি। অথচ মন্মথনাথের মতো তাঁর পুতুলও ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে জায়গা পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব লোকসংস্কৃতির জগতে বহু পদস্থ কর্মকর্তা, গবেষক তাঁর বাড়িতে এসেছেন। তাঁদের পরিবারের বিষয় নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বুলেটিন (ভারতীয় সংগ্রহশালা পত্রিকায়) বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২০২-২০৪ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোক ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পত্রিকায় (জুন ২০০০, ১৬ সংখ্যা) তাঁদের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতায় বহুবার এবং বোম্বে ও মাদ্রাজের প্রদর্শনীতে তাঁদের পুতুল বিক্রি হয়েছে ও প্রশংসা পেয়েছে। প্রয়াণের কিছুদিন আগে নিত্য অভ্যাস মতো প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে জয়নগরের যোগী মিত্র শ্মশান ঘাটের কালি মন্দিরে প্রণাম করার সময় ভক্তদের জেলে রাখা মোমবাতি ধুপ ইত্যাদি থেকে অসাবধানতাবশত চাদরে আগুন ধরে গেলে দেহের পেছন দিক পুড়ে যায়। ভালো চিকিৎসার আশায় তাঁকে কসবার ব্যয়বহুল রুবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করা সত্ত্বেও অমানবিক ও অর্থলোলুপ এই বেসরকারি নার্সিং হোম তাঁর চিকিৎসা ঠিকমত করেনি। সেই কারণে শেষ দিকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাঁর স্ত্রী ও তিন পুত্র বর্তমান। আপশোসের বিষয় এই গুণী শিল্পীর হাতে তৈরি দক্ষিণ রায়, বনবিবি, আসানবিবি সহ নয় বিবি, গাজীবাবা, পির গোরাচাঁদ, বসন্ত রায়, শীতলা, মনসা, হাড়ি ঝি, চণ্ডী সহ সুন্দরবনের ২৬টি লোক দেবতার পুতুল আহ্লাদি পুতুল, গণেশ, চিরকালীন ধারার হাতে টেপা মা পুতুল, তাঁদের পরিবারে বৈশিষ্ট্যসূচক জগন্নাথ আর দেখতে পাওয়া যাবে না। যদিও আশার কথা যে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শম্ভু (২৫) তাঁর পুতুল তৈরির ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে নানা অসুবিধার মধ্যেও। তবে আজ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই ভাবতে হবে উপযুক্ত আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মজিলপুর ঘরানার এই শেষ প্রদীপটিকে বিশ্বায়ন ও প্লাস্টিক পুতুলের ঝড়ের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখার বিষয়টি। তা না হলে লুপ্তপ্রায় বাংলার ঐতিহ্যশালী পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের আরেকটি কেন্দ্রও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আপশোসোর সীমা থাকবে না।
(তথ্য সূত্র - http://sites.google.com/site/songbadmanthan/1february2010thirteen)
কলাবতী মুদ্রার সংযোজন -
সম্প্রতি কলাবতী মুদ্রার ব্যস্থাপনায গড়েওঠা একটি দুর্গাপুজোয় বাংলার পুতুল সহ নানান লৌকিক শিল্প স্থান পায়। সেই উত্সবে পাঁচুগোপাল দাসের পুত্র চারটি পুতুল পাঠান। সেগুলি সেখানে প্রদর্শিত হয়।
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Sunday, October 24, 2010
প্রয়াত পুতুল শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস
লেবেলসমূহ:
Dolls of Bengal,
FolkCommunity,
FolkCraft,
Jaynagar,
Mazilpur,
Panchugopal Das,
Sambhu Das,
Terracotta
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment