এক পদ, দুই প্রখ্যাত
মুলার ইংলন্ডে থাকাকালীন অর্থকষ্টে
ছিলেন, যেমন ছিলেন অন্য দুই উইলিয়াম, কেরি আর জোন্স। অর্থকষ্ট থেকে
মুক্তি পেতে আর্যতত্বের
মশলা মাখানো নানান প্রকল্পের প্রস্তাব দিচ্ছিলেন নানান ব্যক্তি, সংস্থাকে। মুলার নজর ছিল
কোম্পানির অন্দরে। ১৮৪৬এ
প্রুসিয়ার কুটনীতিক ব্যারন ভন বুনসেন আর আর অক্সফোর্ডের সংস্কৃতর অধ্যাপক হোরেস
উইলসন কোম্পানিকে আবেদন করেন ঋগ্বেদের অনুবাদের প্রকল্পে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি
প্রেসকে সাহায্য করতে। তখনও
মেকলের সঙ্গে মুলারের দেখা হয় নি। মেকলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মুলর খগ্বেদ অনুবাদ আর আর্যতত্বে ভারতীয় মাথা
মুড়োনোর বরাত পেলেন। অনুবাদের পর ওঠা ধন্য ধন্য রবে, মুলরের ধারণা হয়েছিল অক্সফোর্ড
বিশ্বদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক পদের জন্য তিনিই যোগ্য। আর কোম্পানিও
তার পেছনে রয়েছে। তখন তিনি অক্সফোর্ডে আধুনিক ইওরোপিয় ভাষার অধ্যাপক। তাঁর শেষ স্বপ্ন,
অক্সফোর্ডে সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক পদ অলঙ্করণ।
তো আর্যতত্ব আর কোম্পানির দয়া সম্বল করে মুলার প্রখ্যাত আর ধনী হয়েছেন, সেই
খ্যাতি অবলম্বন করে মুলর ঝাঁপ দিলেন অক্সফোর্ডের সংস্কৃত প্রফেসরির জন্য। এই পদটির সরকারি
নাম বোডিন প্রফেসরশিপ অব সংস্কৃত। পদটি তৈরি হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে ভারতে খ্রিস্টধর্ম
প্রচারের উদ্দেশ্যে। বোডিন বম্বে নেটিভ ইনফ্যান্ট্রিতে ছিলেন। ১৮১১তে মারা
যান। উইল
অনুযায়ী তাঁর কন্যার মৃত্যুরপর(১৮২৭) সমস্ত সম্পত্তি অক্সফোর্ড পায়। শর্ত ছিল তার
অর্থে যে অধ্যাপক পদ তৈরি হবে, তার মূল উদ্দেশ্য হবে ভারতে সংস্কৃত নানান শাস্ত্র
ইংরেজিতে অনুবাদ করে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার প্রসার। এই পদে ১৮৩২এ
এই প্রথম অধ্যাপক হোরেস উইলসন। ১৮৬০এ তিনি মারা যান।
নতুন অধ্যাপকের বিজ্ঞাপন প্রকাশ হল। ১৮৬০এ সংস্কৃত অধ্যাপক পদের মাইনে ছিল বছরে ৯০০ থেকে ১০০০ পাউন্ড। সময়ের তুলনায়
বেশ বেশি। মুলার তখন অক্সফোর্ডে টেলরিয়ান প্রফেসর অব মডার্ন ইওরোপিয়ন ল্যাঙ্গুয়েজ। মাইনে বছরে ৫০০
ডলার।
সংস্কৃত অধ্যাপক পদের অর্ধেক। অধ্যাপক পদের জন্য মনিয়ের মনিয়ের উইলিয়ম আর ফ্রেড্রিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন
মুলার লড়া শুরু করলেন।
মনিয়েরের তুলনায় ভারতে খ্যাতি বেশি মুলারের। ভারতীয়রা তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছের মানুষ হিসেবে জানে। ইংলন্ডে উল্টো। মনিয়ের
কোম্পানির ঘরের মানুষ।
মুলারের অর্থ সাহায্য পাওয়ার আগেই কোম্পানির অর্থ সাহায্যে ইংরেজি-সংস্কৃত অভিধান
তৈরি করেন মনিয়ের উইলিয়ম। এই
কাজে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেট অব ইন্ডিয়ার দপ্তর। যেসব আমলা
কোম্পানি থেকে সরসারি সরকারে ভারত শাসনের কাজে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন, তাঁদের সমর্থন
পেয়েছেন মনিয়ের।
মুলার, মনিয়েরসহ পাঁচজন কৃতি এই পদে আবেদন করেন। অন্য তিনজন
ছিলেন গভর্মেন্ট কলেজ অব ক্যালকাটার সংস্কৃতের অধ্যাপক এডওয়ার্ড কাওয়েল(২৮মে, দ্য
টাইমসএর খবর)।
বেনারসের সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ও প্রাক্তণ বডিন স্কলার রালফ গ্রিফিথ। বেনারসের এক
কলেজের অধ্যক্ষ জেমস ব্যালেন্টাইন। শেষ পর্যন্ত এই তিনজনই আবেদন পত্র তুলে নেন। টিকে থাকেন
দুজন প্রখ্যাত। তাঁর
আবেদনে মনিয়ের বললেন তিনি এই পদটি পেলে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে কাজ করবেন। মনিয়ের তার
সমর্থকদের দিয়ে একটি প্রচারপত্রও বিলি করেন। পাল্টা লড়াই দেন মুলার। ২৯ অক্টোবর ১৮৬০এ মুলার দ্য টাইমসএ মনিয়েরের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। সে সময় মনিয়ের
লন্ডনে প্রখ্যাত ছিলেন সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপকরূপে। আর মুলার
বিখ্যাত, কিন্তু পরিচয় তিনি অনুবাদকমাত্র। অধ্যাপক নন।
সংস্কৃততো পড়ানই না। সে সময়
লন্ডনের উচ্চকুল এই নির্বাচনে বেশ মশগুল হয়ে ওঠে। (সূত্র http://en.wikipedia.org/wiki/Boden_Professor_of_Sanskrit_election,_1860)
সদ্য থেঁতলে দেওয়া সিপাই স্বাধীণতা সংগ্রামের আঘাত
তখনও দগদগে ঘা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জাতীয়করণ হয়ে ভারতে
এসেছে ভিক্টোরিয়ার নামে চলা ব্রিটিশ সরকার। নতুন সরকার। নতুন ক্ষমতা। নতুন সমীকরণ। নতুন মুখ। পুরোনো পরিকল্পনার নতুন
সাজ। নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতার নতুনতর
সমীকরণটি সমাধান করে ফেল্লেন স্বদেশিয়প্রতিদ্বন্দ্বী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
প্রাক্তণ চাকর মনিয়ের উইলিয়মস, পরে স্যর। দুজনেরই উদ্দেশ্য দাতার উদ্দেশ্যকে আরও বেশি তুলে
ধরে, ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার। ৭ ডিসেম্বর ১৮৬০এ অক্সফোর্ডের শেলডন থিয়েটারে
সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ভোটে ৬১০ জন মুলারের পক্ষে আর ৮৩৩জন উইলিয়মকে সমর্থন করলেন। মনিয়ের পেলেন ২৩০টি
বেশি ভোট। জিতলেন। মনিয়ের ১৮৬০এ অক্সফোর্ডে বোডিন প্রফেসরশিপ অব
সংস্কৃত অধ্যাপকের পদ দখল করলেন মুলারকে টপকে। অধ্যপক পদ পেয়ে তাঁর
প্রথম বক্তৃতা ছিল, "The Study of Sanskrit
in Relation to Missionary Work"। ১৮৮৭এ
অবসর নিলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনিয়ের অক্সফোর্ডে সংস্কৃত পড়িয়েছেন বডিন
প্রফেসররূপে। অক্সফোর্ডে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটও তৈরি করেছেন। মুলারও অক্সফোর্ডে
ছিলেন। ১৯০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মুলার, একদিনও সংস্কৃত
পড়ান নি। ১৮৭৫এ মনিয়েরকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দান করার
সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ মুলার তার তুলনামূলক ভাষাতত্ব বিভাগে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন ছেঁদো
যুক্তি দিয়ে, তিনি আরও সময় পড়াশোনায় ব্যয় করবেন। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ
তার পদত্যাগপত্র স্বীকার করে সাম্মানিক উপ-অধ্যাপক(ডেপুটি প্রফেসর) হিসেবে বরণ করে। শেষ দিন পর্যন্ত সেই
সম্মান বহন করেছেন। অক্সফোর্ডের
প্রশাসকদের জুতো মেরে গরু দানে ক্ষিপ্ত মুলার, তাঁর এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রিয়তম
বৌদ্ধিক সন্তান, আর্যদাসতত্বকে অস্বীকার করলেন(সুযোগ পেলে এটিও বারান্তরে আলোচনা
করা যাবে)।
No comments:
Post a Comment