জার্মানিতে
উচ্চশিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ফ্রেডরিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলার ভাগ্যান্বষণে ব্রিটেনে
হয়ে এলেন। তাঁর হাত ধরে শুরু হল ভারতের বুদ্ধিদাসত্ব যুগের। তিনি সংস্কৃত
পন্ডিত। অথচ
তাঁর সংস্কৃত শেখানিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এমত এক মানুষ লন্ডনেই বেদ অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিলেন। অনুবাদ করারমত
সংস্কৃত শিখতে প্রয়োজন বেশ কয়েক দশকের সময়ের ব্যাপ্তি। আর সবথেকে
বেশি যেটি প্রয়োজন, সদগুরুর নির্দেশ। যিনি ভারত থেকে বহুদূরে বেড়ে উঠছেন, তার ক্ষেত্রে এই দুটি সূত্রই কঠোরভাবে
প্রযোজ্য।
তার প্রথম জীবনী লেখক স্ত্রী আর পুত্র বলছেন ১৯ বছর বয়সে ১৮৪৩এ লিপজিগ
বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ডক্টরেট হন। যদিও এই দাবি নিয়ে বহু মানুষ সংশয় প্রকাশ করেছেন(লায়েজ উইথ লং লেগ,
প্রদোষ আইচ এবং এই প্রবন্ধ)। ১৮৪৬ তিনি ভাগ্যান্বেষণে লন্ডনে আসেন। জার্মান প্রেম-পরিণয়ের
নভেল লেখেন। অথচ
তিনি কার কাছে সংস্কৃত শিখেছেন সে তথ্যে জীবনীকারেরা চুপ। মুলার ভারতে আসেন
নি। অথচ সংস্কৃত শিখেছেন। মুলার যখন ভারতউত্সুক, তখনও ভারতে সংস্কৃত কথ্য ভাষা ছিলনা। যে ভাষা কথ্য নয়,
সে ভাষা শিখতে উপযুক্ত শিক্ষক সময় প্রয়োজন। এ তথ্য জানতে বা জানাতে জ্ঞানীগুণী পদার্থবিজ্ঞাণী হওয়ার প্রয়োজন হয় না। সেই শিক্ষা
শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। অনুবাদ করতে দুটো ভাষাতেই বিশেষজ্ঞ হতে হয়। ঋগ্বেদের
তথাকথিত অনুবাদের পথ ধরে তৈরি হল ভারতবিদ্যার ধারা। মেকলের প্রধাণ
পুরোহিত, ভাগ্যান্বেষী মুলার ক্রমে হয়ে উঠলেন ভারত বিশ্লেষণের কারিগর। তৈরি হল আর্যতত্ব।
তো, গুরুমেকলের পথ ধরে মুলারের ভারতবিশেষজ্ঞের কাজ শুরু করেন। মেকলের ১৮৩৫এর মিনিটের
ছত্রে ছত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা পৃথিবী বিখ্যাত। মিনিটের
তত্বকে ব্যজস্তুতি হিসেবে ভারতে বাস্তবে নামিয়ে আনলেন মুলার। মেকলের
মুলার-অর্জন ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। মুলার আদৌ সংস্কৃত
জানেন কীনা তা নিয়ে মেকলের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তিনি
চেয়েছিলেন এমন এক মানুষ যিনি ভারতকে শ্রদ্ধা জানাবার ছলে, ভারতকে দাস বানাতে দক্ষ। চেয়েছিলেন এমন
একজন, যার রচনায় ভারত সম্বন্ধে অজস্র শ্রদ্ধা, আর মনে চরম অশ্রদ্ধার বীজমন্ত্র। যে বীজমন্ত্র
সফলভাবে ছড়িয়ে দিতে পারবেন মেকলের তৈরি করা শিক্ষা নীতির উদ্বৃত্ত শহুরে
ভারতীয়দের মনে(অন্য কোনও দিন সুযোগ পেলে আলোচনা করা যাবে)। মুলার ইওরোপজাত। মেকলে জানতেন
তাঁর মিনিটেরমত, মনগড়া হলেও তার শিষ্যের আর্যতত্ব, শহুরেরা বিনাদ্বিধায় চোখবুজে
মেনে নেবে।
মুলারের কাছে অর্থদাতারা চাইছিলেন ভারতীয়রা যেন ৮০০০ বছরের সভ্যতার শেকড়ে ফিরতে
না পারে। শুরু হল ভারত ব্যাজস্তুতি রচনা। বাস্তবে রূপায়িত হতে শুরু করল ঋগ্বেদ অনুবাদের বকলমে মুলারের আর্যতত্ব। প্রখ্যাত হলেন
মুলার।
সে সময় মুলারকে ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসেবে তুলে
ধরার প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। ১৭৬৩
থেকে গ্রামে গ্রামে স্বাধীণতা সংগ্রামের বীজ বেনা চলছে। ব্রিটিশদের আঁকড়ে
ধরতে হচ্ছে শহরের মধ্যবিত্তদের। ইংরেজদের
পথে ভারত শাসনের জন্য তৈরি করতে হচ্ছে তাদেরকে। মেকলেও, মুলারের ইমেজ সেই ভাবে সাজিয়েছেন। মুলারের ডক্টরেট করা আর সংস্কৃত জানা নিয়ে বহু
মিথ্যের জাল বোনা হয়েছে। এই
প্রবন্ধের শেষে আমরা তার ডক্টরেট উপাধি পাওয়া বিষয়টি অনুসন্ধান করব। আমাদের দুটো ঘটনা
ঘুরে সেই প্রমাণে যেতে হবে।
No comments:
Post a Comment