ধূসর মৃত্যুর ছায়া

প্রায় তিনদশক আগে লেখা এক পথভাঙা উপন্যাসে সৈয়দ মুজতাফা সিরাজমশাই আলকাপ
গান আর তার পরিবেশ পরিজন বর্ণনে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় পরম মমতায় তুলে ধরলেন। এর
আগেও বহু মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে আলকাপ নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন অথবা তাকে নিয়ে শহরের
প্রাঙ্গনে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু মায়ামৃদঙ্গ এমন একটি উপন্যাস, যার ব্যপ্তি শুধুই
কাগজের পাতা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাস্তবের কঠিন মাটিতে পলিমাটিরমত সিরাজের নরম
তুলতুলে কলমের ঘাতে। নিজের জীবনদিয়েই কিশোরী বেশী আলকাপ বালক আর
আন্যান্য কুশিলবের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণা, বাস্তব জীবন সংগ্রামের রক্তঝরা কাহিনী
মরমীয়া কবিরমমতায় সৈয়দমশাই প্রথম তুলে এনেছিলেন শহরের বাবুসমাজের সামনে।
আজথেকে প্রায় চার দশক আগেই মায়ামৃদঙ্গের রচনার সময়েই তিনি রচনা করেছিলেন, আলকাপের
গায়ে ধূসর মৃত্যুর ছোঁয়া মন কেমন করা প্রতিবেদন।
মুক্তগোলার্ধ রচনার নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশক শেষ, সেই ছায়া আরও দীর্ঘতর, আরও
গাঢ়, আরও গভীর হয়ে চেপে বসেছে আলকাপের পরতে পরতে।
বিশ্বজয়ী বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বিকট মুখব্যদনে, কৃষি উত্পাদনের বিধ্বংসী কৌশলী
কৃতকৌশলের পরিবর্তমে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে হাজার হজার বছরের মাটির সংস্কৃতি।
আলকাপই
যে শুধু মৃত্যুর মুখেমুখি বললে অপলাপ হবে, মনসা-চন্ডীর মেল্লি আর ফুল, কালিকাচ
নৃত্য, ডাং-সুতো-বেণী-ছায়া পুতুল নাচ, বন্ধুয়ালা, সং, বহুরূপী, লেটো, গাজন, মুখা
খেইল, ডোমনি, মাছানি, খন, বোলান, বনবিবির পালা, চেরচুর্ণি, দেতরা, নাচনি, হাজারো
ব্রতকথা, সত্পীর, বিষহরা, পীর-পীরীনি, মদনকাম নৃ্ত্য, বৈরাতি নৃত্য, ধেমাল, শিকনি
ঢাল, ছো, রায়বেঁশে, নটুয়া, পাইক, ভাওয়াইয়া, চটকা, চা বাগানের গান, তিস্তাবুড়ির
গান, তুখ্যা গান, বীরভূম আর নদিয়ার বাউল, সাধুগান, মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল,
ধর্মমঙ্গলহ অন্যান্য মঙ্গলগান মনসার ঝাঁপান, জারি, সারি, মুর্শিয়া, ফকিরি, সাধু,
তেহট্টের মালপাহাড়িদের নাচ, নানান মুখোশ নৃত্য আর গান, পট, গাজির গান, ময়নামতির
গান, গোপীচন্দ্রের গান, কবিগান, আখড়াই, হাফআখড়াই, জেলেপাড়ার গান, ধানভানার গান,
পট গান, গাজিপট গান, পীরের গান, ফকিরিগান, মুর্শিদ্যা, পালা গান, লীলা গান, রামায়ণ
গান, ঝুমুর, টুসু, ভাদু, সাঁওতালি নাচ-গান, মুণ্ডারি সাংস্কৃতিককর্ম, হো, লোধাদের
দং, রাভা নৃত্য, মেচ নাটক, মালপাহাড়ি নাচ, রাজবংশী সংস্কৃতিসহ বাঙলার আরও হাজারও
সংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গীকে হাজার হাজার বছর ধরে লালনপালন করা শিল্পীদের চোখে
বায়না না পাওয়ার, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বেদনা, অতলান্ত হাহাকার ক্রমাগত বর্ধমান। শিল্প-শিল্পী-জীবন
যে জীবনযাত্রায় মিলেমিশে একাকার, সেই জীবনে শিল্পকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার,
শিল্পকে পেশ করার যন্ত্রণা প্রতিটি শিল্পীর জাবনে ফুটে উঠছে। একদিকে
দূরদর্শনে প্রতি সন্ধ্যায় অপরিসীম চাহিদা তৈরির কারখানার বাড়বাড়ন্ত অন্যদিকে
শহরের শেকড়ছেঁড়া চাহিদাভিত্তিক সংস্কৃতির চাপে গ্রামীণ সংস্কৃতির নাভিশ্বাস। শতাব্দের পর
শতাব্দ গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে অন্তর্লীন স্রোতেরমত লৌকিক-গ্রামীণ সংস্কৃতি আজ
দিশাহারা। আপাত সহজিয়া দর্শনে জারিত কিন্তু বাস্তবে যথেষ্ট জটিল
এই গ্রামীণ শিল্পের নানান প্রকাশভঙ্গী চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অন্তরালে। শহরের এই
অনির্দেশ্য আচরণ ফুটে উঠেছে লৌকিক গবেষণা কর্মেও। মধুমঙ্গল
মালাকার দিনাজপুরেরই মুস্কিপুর গ্রামে থেকে বহু প্রজন্মধরে স্থানীয় লৌকিক আচার
আচরণের জন্য প্রয়োজনীয় শোলা শিল্পদ্রব্য তৈরি করেন। মুখোশ থেকে
মেল্লি, টোপর থেকে শোলার ফুল, কল্কা থেকে পীরের ঘোড়া, সবই তৈরি করেন মধুমঙ্গল
তাঁর পূর্বজদের দেখনো পথ ধরে, অননুকরণীয় দক্ষতায়। অথচ শহুরে
গবেষণায় আজও উঠে আসেনি তাঁর কাজ। কোনো গবেষণায় উচ্চারিত হয়নি তাঁর
শোলার মুখোশের বর্ণনা – অথচ বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশের সংগ্রহশালায় তাঁর শিল্প
সাগ্রহে শোভাপায়। বাঙলার কোনও গবেষক জানেননা মেল্লি আদতে কী। স্বকীয়তায়
উজ্জ্বল, লৌকিক জীবনে আজও অন্তরঙ্গ মধুমঙ্গলের শোলার কাজ কিন্তু অপেক্ষা করে নেই
গবেষকদের কাজের জন্য। তিনি নিজ চেতনায় ভাস্বর।

No comments:
Post a Comment