<নাহ এবারেও বেরোতে পারলাম না, যেতে পারলাম না বৌদ্ধ ভদ্রলোকিয় ছোটলোক বিরোধী পড়াশোনার
জগতে। এখনও ছোটলোকামিতে আটকে রইলাম>
আমরা দেবীপ্রসাদের খুব বড় অনুগামী
নই, কিন্তু ছোটলোক সমাজের কৈবর্ত বিপ্লবের আঙ্গটপাত হিসেবে তিনি
যে সিদ্ধদের ভূমিকা আঁচ করেছিলেন, স্বাভাবিককারণেই সেই সিদ্ধান্তটি
আমরা ফেলে দিতে পারি নি। বড়লোকের ছোটলোক ঘেন্নার ১৩০০ বছর বুঝতে আমরা যে ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপট আলোচনা করছি, সেই আলোচনা গত বারের কিস্তিতে শেষ
করে দিয়েছিলাম, কিন্তু মনে হল সিদ্ধ কৈবর্ত বিপ্লবেরে প্রভাব বুঝতে
সিদ্ধগুরুদের প্রাথমিক চরিত্র পরিচিতি দেওয়া দরকার – যে পরিচিতি অভদ্র অকেন্দ্রিভূত অপুঁজিবাদী অসুশাসনীয়, সাম্যলক্ষণযুক্ত, ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা
ছোটলোকিয় অরাজক সমাজ তৈরির ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা পাবে। এই প্রাথমিক ধারণাটুকু না
থাকলে বোঝা যাবে না সিদ্ধগুরুরা কোন অবস্থায় দার্শনিকতত্ত্ব এবং সাহিত্য রচনা
করতেন, কিভাবে কৈবর্তদের প্রভাবিত করেছেন। বর্তমানে ছোটলোক বা
অভদ্রসমাজ আলোচনায় আমরা একটা গুণগত কাজ প্রথমেই করে থাকি সেটা হল, ভদ্র সমাজ যে সবগুণগুলি দোষের মনে করে সেগুলি আমরা যারা
ভদ্রসমাজ সঞ্জাত ভদ্রসভ্য মানুষ, তারা সেগুলি বাদ দিয়ে ভদ্র
চরিত্রলক্ষ্মণগুলি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া - মানুষগুলি দেখতে ছোটলোক, কিন্তু কাজে চরিত্রে ভদ্রলোক। সেই ধারণা থেকেও আমাদের
বেরোতে হবে সিদ্ধ আলোচনায়।
সেই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে
সিদ্ধদের নাম নিয়ে আলোচনা করা যাক। আজও ভদ্রসমাজে সন্তানের নামকরণে তৎসম শব্দের
প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা যদি সিদ্ধদের নামের তালিকা করি, তাহলে দেখতে পাব অধিকাংশের আজকের ভাষায় “ভাল নাম” বা “প্রমিত নাম” নেই – প্রত্যেকের নামকরণ হয়েছে বৃত্তিগত বা পেশাগত সংযোগের কারণে (এই তথ্য থেকে আরও একটা বিষয় প্রমান হয়, ছোটলোকেদের সে সময় মোটামুটি স্থায়ী বৃত্তি ছিল) যেমন তান্তিপা - তাঁতি, চমরিপা - চামার, তেলিপা - তেলি, কুমোরিপা - কমোর, ধোম্বিপা - ধোবি, কংপারিপা - কামার, মেদিনীপা - চাষী।। এছাড়াও তাদের আচার আচরণের
ভিত্তিতেও নামকরণের ঝোঁক ধরাপড়ে লূইপা – যিনি মাছের পোঁটা খেতে ভালবাসতেন, বীণাপা – বীণা বাজাতেন, থকণপা – যিনি লোক ঠকাতেন বা মিথ্যা কথা
বলতেন, শালিপা – যিনি শেয়াল বা নেকড়ে ভয় পেতেন, এক গৃহস্থপুত্রের নাম নগুণি অর্থাত যার কোন গুণ নেই, কুক্কুরিপা – যিনি কুকুর ভালবাসতেন, দিংকপা – যিনি ঢেঁকিতে ধান কুটতেন, দারিকপা – বেশ্যার দ্বাররক্ষী ইত্যাদি।
এই সিদ্ধগুরুরা সক্কলেই কিন্তু
নিজের স্বভাবে, কাজকর্ম করে, সেই কাজেও সার্থক হয়ে সিদ্ধ
হয়েছেন। এরা ভদ্র সমাজের সন্ন্যাসীদের মত কেউ নিজের পোষাক ছাড়েন নি, কেউ প্রবজ্যা নেন নি, কেউ বনবাসেও যান নি, প্রবজ্যা, উপসম্পদা গ্রহণ করে মঠে মন্দিরেও
মানসিক শান্তি খোঁজেন নি। অথবা ভদ্র সমাজের লেখক কবিদের মত এঁরা কেউই শুধুই লেখক
ছিলেন না - এঁরা সক্কলে ভীষণভাবে নিজের বৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
যেমন শবরিপা – ব্যাধ, মীনপা – জেলে, গোরক্ষপা – রাখাল, খড়্গপা – চোর, নারোপা – শুঁড়ি, ছত্রপা – ভিক্ষুক, ভন্ধোপা – চিত্রকর, অচিন্ত্যপা – কাঠুরে, মেকোপা – মুদি, কোটলিপা – মাটিকোপানো ব্যক্তি, যোগিপা – চণ্ডাল, গোরুরপা – পাখিমারা, পচরিপা – পিঠে বিক্রেতা, কন্তিলিপা – দির্জি, সরহপা – শর তৈরিতে দক্ষ ইত্যাদি। শুধু পেশাই নই ভদ্র সমাজে যে সব
চরিত্রগুলি গুণনীয়ক হিসেবে পরিচিত সত্য কথা বলা, মানুষকে না ঠকানো ইত্যাদিতেও তারা ভদ্রসমাজের গুণতির বাইরে
ছিলেন। ঠকণপা মানুষ ঠকাতেন বা মিথ্যে বলতেন ইত্যাদি।
ওপরের পেশাগুলি লক্ষ্য করে দেখুন
সেদিনও এই পেশাগুলি ভদ্রসমাজের পেশা ছিল না, আজও এগুলি কোনওভাবেই ভদ্রসমাজের
পেশা হিসেবেও চিহ্নিত নয়। চুরাশিজন সিদ্ধর মধ্যে কুড়ি জনই স্পষ্টতঃ শূদ্র বলা
হয়েছে। একমাত্র বিরূপাকেই তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে সংঘারামে, কিন্তু সেখানে মদ খাওয়ার দোষে তিনি বিতাড়িত হন, এবং তারপরে মদ খাওয়ার মাত্রা বেড়েই চললে। ভদ্র সমাজের সঙ্গী
হতে যে সব গুণ অর্জন করা দরকার হয়, তারা সে সব গুণের বাইরে ছিলেন।
এঁদের দুচারজন যে ভদ্রসমাজের ছিলেন না তা নয়, কিন্তু সিদ্ধ হতে গিয়ে এদের
প্রথমেই জাতিচ্যুত হতে সয়েছে। দিংকপা প্রথম জীবনে ছিলেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী – সিদ্ধি লাভের জন্যে মদ বিক্রি
করতে হয়েছে, ধান কুটতে হয়েছে – কেন না ব্রাহ্মণত্বের অর্থাৎ
ভদ্রত্বের মুখোশ খুলে তার ব্রাহ্মণত্বের অহংকার চূর্ণ করতে এই কাজগুলি করা
প্রাথমিক কর্তব্য ছিল। রাজা ইন্দ্রপাল সিদ্ধ হবার জন্যে বারনারীর দাসত্ব গ্রহণ
করেছিলেন, তিনি বেশ্যার পা ধুইয়েছেন, শরীর মালিশ করেছেন, তারপর সিদ্ধ পদবাচ্য হয়ে দারিকপা
হয়ে তার দ্বাররক্ষা করেছেন।
অর্থাৎ ছোটলোকত্বের একটা ধারা ছিল
সেই ১৩০০ বছর আগে। এবং সেই ধারা সে সময়েই খুব শক্তিশালীও ছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ
এটি খুব পুরোনো ঐতিহ্যের ধাবাহিকতা - ১৩০০ বছরেরও পুরোনো। ছোটলোকত্ব
এতই জোরদার ছিল যে ছোটলোকামি করতে তাঁদের ভদ্রবেশ, ভদ্রপন্থার চরিত্রকে নানান প্রক্রিয়ায় ধুয়ে ফেলতে হয়েছে।
ভদ্রলোকামির চত্ত্বরের বাইরে ছোটলোকামি একটি নির্দিষ্ট যাপন, যা নিয়ে একবারও ভদ্রসমাজ আলোচনা করে নি বরং তাকে ঘৃণা করে
এসেছে এবং ভদ্রসমাজের বাইরে রেখে দিয়েছে। এই জন্যেই বলি তাতে ছোটলোক সমাজের কিছুই
যায় আসে নি। তারাও দ্বিধাহীনভাবে ছোটলোকত্বকে দৃঢ করার জন্যে কাজ কাজ করে গিয়েছে।
No comments:
Post a Comment