বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪০ শতাংশ জুড়ে যে বন অবস্থিত, যে বন ‘বিশ্বঐতিহ্য স্থান’ ও রামসার সাইট হিশেবে ঘোষিত, যে বনে দুনিয়াজোড়া খ্যাতিময় বেঙ্গল টাইগার বাস করে তার অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।
গত পরশুদিন, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪, খুলনা থেকে ফার্নেস অয়েল বহনকারী ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’কে চাঁদপাই রেঞ্জের শেলা নদীতে ‘এমটি টোটাল’ নামের একটি কার্গো ধাক্কা দিলে তেলের ট্যাংকারটি ঘটনাস্থলেই ডুবে যায়। ওই ট্যাংকারে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিলো। গত দুই দিনে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের কমপক্ষে ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে জোয়ারের পানির চাপে খুলনার রূপসা নদীতেও তেলের আস্তরণ দেখা গিয়েছে বলে সংবাদপত্রে রিপোর্ট এসেছে। ফলে, পুরো সুন্দরবন বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
চাঁদপাই রেঞ্জসহ সুন্দরবনের তিনটি স্থানকে ২০১১ সালে বিপন্ন ইরাবতি ডলফিনসহ ছয় প্রকারের ডলফিন (শুশুক), নোনাপানির কুমির ও মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এ ধরনের ডলফিনের প্রজাতি প্রতি ২০-২৫ মিনিট পরপর শ্বাস নেয়ার জন্য পানির উপর ভেসে ওঠে। তেল-দূষণের পর গত দুইদিন ধরে দুর্গত এলাকায় কোনো শুশুক দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন, কিছু শুশুক ইতোমধ্যে মারা গেছে এবং কিছু হয়তো এলাকা ত্যাগ করতে পেরেছে।
অপরদিকে দুর্ঘটনার একদিন পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় নদীর মাছ মরে ভেসে ওঠা ও পাখি মরে যাবার সংবাদ পাওয়া গেছে। সুন্দরবন ও মোহনা অঞ্চলে এখন পরিযায়ী (অতিথি) পাখিদের মৌসুম বিধায় পাখিমৃত্যুর হার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাদাবন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাসমান তেলের কারণে পানির উপরিতলের অণুজীব, মাছ ও জলনির্ভর পাখি শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাছ ও ছোটপাখি খেয়ে বেঁচে থাকে এমন প্রাণি, যেমন চিল বাজ ও ঈগলের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। অন্যদিকে সুন্দরবনের বাদাগাছের উপর এ তেল-দূষণের প্রভাব হবে ভয়াবহ। ঠেসমূল ও শ্বাসমূল তেলের আস্তরণে ঢেকে গেলে শ্বসন-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস' হয়ে বাদাগাছ শুকিয়ে মারা যেতে পারে।
সুন্দরবনের পাশেই মংলা বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় ২০০২ সালেই সরকারের উদ্যোগে ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র অর্থায়নে সুন্দরবনে তেল-দূষণ বিষয়ে জাপান অয়েল ইনজিনিয়ারিং কো. লি., ফুয়ো ওশ্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনজিনিয়ারিং কো. লি. ও বাংলাদেশের কনসোলিডেটেড সার্ভিস লি. যৌথভাবে একটি পরীক্ষা চালায়। এ পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, প্রথম ১৫ দিনের মধ্যে পাখি, কচ্ছপ, ছোট মাছ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণি মারা যাবে। ১৫-৩০ দিনের মধ্যে ছোট ছোট বাদাগাছ মারা যাবে এবং বড়ো বাদাগাছের পাতা ঝরে পড়বে। ১ বছরের মধ্যে মাঝারি আকারের গাছপালা মরে যাবে এবং কোনো ব্যবস্থা না নিলে ১ বছরের পর থেকে বড়ো গাছপালাও মরতে শুরু করবে (পৃষ্ঠা ৪৩)।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাদাবনে পরিচালিত গবেষণা ও দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণি ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। পেট্রোল ও ডিজেলের তুলনায় ফার্নেস অয়েল কম পরিশোধন করা হয়। ফলে এর ঘনত্ব বেশি ও দূষণকারী পদার্থ বেশি থাকে। তাই ফার্নেস অয়েলের এই দূষণ কতো ক্ষতি করতে পারে তা এখনও ধারণার বাইরে রয়ে গেছে।
পানিতে তেল-দূষণে মানবস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় তাও ভয়ঙ্কর। জ্বালানি তেল বাতাস ও পানিতে মিশে যাবার পর শ্বাস-প্রশ্বাস ও ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে শরীরে ঢুকে তেলের ‘বেনজিন’ নামক পদার্থ লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারের কারণ হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া তেল-দূষণের ফলে কিডনি ও যকৃত অকেজো হয়ে যাওয়া, স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি হওয়া এবং রক্তচাপ ও রক্তের তারল্য বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
তাই বাংলাদেশের গর্ব, আমাদের রক্ষাকবচ সুন্দরবন রক্ষা এবং সুন্দরবনের পার্শ্ববতী অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জীবন রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। অথচ, নিমজ্জিত তেলের ট্যাংকার টেনে তোলার দায়িত্ব কোন দপ্তরের তাই নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। ইতোমধ্যে দুইদিন পার হয়ে গেছে এবং দায়ী ট্যাংকারের মালিক দায়সারা-গোছের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তেলের বিস্তার থামানো এবং শুষে তুলে নেয়ার কাজটি ট্যাংকার উদ্ধারের চেয়েও জরুরি। তবে সে বিষয়ে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বন বিভাগ ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ - কেউই তেল শুষে তোলা বা গভীর জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়া রোধ করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। তবে, সরকারি কর্মী-নির্ভর এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা সফল হবার সম্ভাবনা কম। কারণ, যে বিস্তৃত এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে তা অপসারণের মতো পর্যাপ্ত লোকবল সরকারি দপ্তরগুলোতে পাওয়া কঠিন।
পানিদূষণের ফলে শুশুকসহ অভয়াশ্রমের অন্যান্য জলজ প্রাণির ক্ষতি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে একই দাবি জানায়। কিন্তু নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এ নির্দেশ ও অনুরোধের কোনো তোয়াক্কা করে নি। এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতরের চ্যানেল ব্যবহার বন্ধ করতে সম্মত হননি। কিন্তু তার পরপরই আন্ত-মন্ত্রণালয় সভায় চ্যানেলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এছাড়া দুর্ঘটনার পরদিনই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল জ্যাকব দুর্ঘটনাস'ল সফর করায় আমরা তাঁকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমরা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই ২০১০ সাল থেকে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিয়ে তেলের ট্যাংকারটি চলছিলো। তেল বহন করার আগে এটি বালি বহন করতো। একটি বালি বহনকারী কার্গোকে কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় তেল বহনের অনুমোদন দেয়া হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থানকারী যে কোনো নৌযান রাতে বন বিভাগের জেটিতে নোঙর করার বিধান রয়েছে। দায়ী তেলের ট্যাংকারটি মাঝনদীতে নোঙর করে এই বিধানও লঙ্ঘন করেছে। দুর্ঘটনার পরও পশুর ও শেলা নদীতে প্রচুর পরিমাণে নৌযান যত্রতত্র নোঙর করা অবস্থায় দেখা গেছে। তাই, এ দুর্ঘটনায় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গাফিলতিও স্পষ্ট। দুর্ঘটনার পর এমভি টোটাল নামের কার্গোটিকে আটক করা হলেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুটি কোম্পানির মালিক বা কোনো কর্মকর্তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। অপরদিকে দেওয়ানি মামলা করায় বন বিভাগের দাবিকৃত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ সুদূর পরাহত হবার আশঙ্কা রয়েছে।
ইতোমধ্যে নদী ও বাদাবন থেকে তেল অপসারণে বিভিন্ন ধরনের ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এ সম্পর্কে আমাদের মতামত হলো, যতো দ্রুত সম্ভব শত শত তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদেরকে নৌকা, স্পঞ্জ, মোটা কাপড়ের চালুনি ইত্যাদি দেশি উপকরণ দিয়ে তেল দ্রুত অপসারণ করা যাবে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ করেই তেল-দূষণ দূর করেছিলো। কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে তেল অপসারণ করলে কিংবা বনের ভেতরে ঢুকে তেল দূরীভূত করার চেষ্টা করলে তা হবে আত্মঘাতের শামিল। নির্দিষ্ট এলাকা ঘিরে আগুনের মাধ্যমে তেল অপসারণ করা যেতে পারে। তবে, সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বনাঞ্চলে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিতে পারে। তেলভূক ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর পদ্ধতি কার্যকর মনে করলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সেটি খরচবহুল হবে।
আমাদের দাবি
১. দুর্যোগ ব্যবস'াপনা আইন ২০১২ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত ২০১০)-এর আওতায় সুন্দরবনে পরিবেশগত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে;
২. জরুরি ভিত্তিতে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে তেল অপসারণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এজন্য সম্মিলিত সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করতে হবে এবং দেশি ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করতে হবে;
৩. যদিও কোনো অর্থমূল্যে পরিবেশগত ক্ষতি পুরোপুরি থামানো যাবে না; তবুও তেল-দূষণের জন্য দায়ী কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে যাতে তেল অপসারণ ও বাদাবন পুনর্বাসনের খরচ মেটানো যায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ হয়;
৪. সুন্দরবনের ভেতর থেকে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল স'ায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে;
৫. তেল অপসারনের কার্যক্রম যথাযথভাবে করার জন্য তদারকির দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পরিবেশ মন্ত্রীকে গ্রহণ করতে হবে;
৬. জরুরি ভিত্তিতে তেল-দূষণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ক্রয়ে অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। - Nurul Alam Masud এবং অন্যান্য 11 জন এর সাথে CLEAN এ
গত পরশুদিন, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪, খুলনা থেকে ফার্নেস অয়েল বহনকারী ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’কে চাঁদপাই রেঞ্জের শেলা নদীতে ‘এমটি টোটাল’ নামের একটি কার্গো ধাক্কা দিলে তেলের ট্যাংকারটি ঘটনাস্থলেই ডুবে যায়। ওই ট্যাংকারে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিলো। গত দুই দিনে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের কমপক্ষে ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে জোয়ারের পানির চাপে খুলনার রূপসা নদীতেও তেলের আস্তরণ দেখা গিয়েছে বলে সংবাদপত্রে রিপোর্ট এসেছে। ফলে, পুরো সুন্দরবন বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
চাঁদপাই রেঞ্জসহ সুন্দরবনের তিনটি স্থানকে ২০১১ সালে বিপন্ন ইরাবতি ডলফিনসহ ছয় প্রকারের ডলফিন (শুশুক), নোনাপানির কুমির ও মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এ ধরনের ডলফিনের প্রজাতি প্রতি ২০-২৫ মিনিট পরপর শ্বাস নেয়ার জন্য পানির উপর ভেসে ওঠে। তেল-দূষণের পর গত দুইদিন ধরে দুর্গত এলাকায় কোনো শুশুক দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন, কিছু শুশুক ইতোমধ্যে মারা গেছে এবং কিছু হয়তো এলাকা ত্যাগ করতে পেরেছে।
অপরদিকে দুর্ঘটনার একদিন পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় নদীর মাছ মরে ভেসে ওঠা ও পাখি মরে যাবার সংবাদ পাওয়া গেছে। সুন্দরবন ও মোহনা অঞ্চলে এখন পরিযায়ী (অতিথি) পাখিদের মৌসুম বিধায় পাখিমৃত্যুর হার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাদাবন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাসমান তেলের কারণে পানির উপরিতলের অণুজীব, মাছ ও জলনির্ভর পাখি শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাছ ও ছোটপাখি খেয়ে বেঁচে থাকে এমন প্রাণি, যেমন চিল বাজ ও ঈগলের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। অন্যদিকে সুন্দরবনের বাদাগাছের উপর এ তেল-দূষণের প্রভাব হবে ভয়াবহ। ঠেসমূল ও শ্বাসমূল তেলের আস্তরণে ঢেকে গেলে শ্বসন-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস' হয়ে বাদাগাছ শুকিয়ে মারা যেতে পারে।
সুন্দরবনের পাশেই মংলা বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় ২০০২ সালেই সরকারের উদ্যোগে ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র অর্থায়নে সুন্দরবনে তেল-দূষণ বিষয়ে জাপান অয়েল ইনজিনিয়ারিং কো. লি., ফুয়ো ওশ্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনজিনিয়ারিং কো. লি. ও বাংলাদেশের কনসোলিডেটেড সার্ভিস লি. যৌথভাবে একটি পরীক্ষা চালায়। এ পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, প্রথম ১৫ দিনের মধ্যে পাখি, কচ্ছপ, ছোট মাছ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণি মারা যাবে। ১৫-৩০ দিনের মধ্যে ছোট ছোট বাদাগাছ মারা যাবে এবং বড়ো বাদাগাছের পাতা ঝরে পড়বে। ১ বছরের মধ্যে মাঝারি আকারের গাছপালা মরে যাবে এবং কোনো ব্যবস্থা না নিলে ১ বছরের পর থেকে বড়ো গাছপালাও মরতে শুরু করবে (পৃষ্ঠা ৪৩)।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাদাবনে পরিচালিত গবেষণা ও দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণি ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। পেট্রোল ও ডিজেলের তুলনায় ফার্নেস অয়েল কম পরিশোধন করা হয়। ফলে এর ঘনত্ব বেশি ও দূষণকারী পদার্থ বেশি থাকে। তাই ফার্নেস অয়েলের এই দূষণ কতো ক্ষতি করতে পারে তা এখনও ধারণার বাইরে রয়ে গেছে।
পানিতে তেল-দূষণে মানবস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় তাও ভয়ঙ্কর। জ্বালানি তেল বাতাস ও পানিতে মিশে যাবার পর শ্বাস-প্রশ্বাস ও ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে শরীরে ঢুকে তেলের ‘বেনজিন’ নামক পদার্থ লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারের কারণ হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া তেল-দূষণের ফলে কিডনি ও যকৃত অকেজো হয়ে যাওয়া, স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি হওয়া এবং রক্তচাপ ও রক্তের তারল্য বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
তাই বাংলাদেশের গর্ব, আমাদের রক্ষাকবচ সুন্দরবন রক্ষা এবং সুন্দরবনের পার্শ্ববতী অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জীবন রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। অথচ, নিমজ্জিত তেলের ট্যাংকার টেনে তোলার দায়িত্ব কোন দপ্তরের তাই নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। ইতোমধ্যে দুইদিন পার হয়ে গেছে এবং দায়ী ট্যাংকারের মালিক দায়সারা-গোছের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তেলের বিস্তার থামানো এবং শুষে তুলে নেয়ার কাজটি ট্যাংকার উদ্ধারের চেয়েও জরুরি। তবে সে বিষয়ে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বন বিভাগ ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ - কেউই তেল শুষে তোলা বা গভীর জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়া রোধ করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। তবে, সরকারি কর্মী-নির্ভর এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা সফল হবার সম্ভাবনা কম। কারণ, যে বিস্তৃত এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে তা অপসারণের মতো পর্যাপ্ত লোকবল সরকারি দপ্তরগুলোতে পাওয়া কঠিন।
পানিদূষণের ফলে শুশুকসহ অভয়াশ্রমের অন্যান্য জলজ প্রাণির ক্ষতি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে একই দাবি জানায়। কিন্তু নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এ নির্দেশ ও অনুরোধের কোনো তোয়াক্কা করে নি। এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতরের চ্যানেল ব্যবহার বন্ধ করতে সম্মত হননি। কিন্তু তার পরপরই আন্ত-মন্ত্রণালয় সভায় চ্যানেলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এছাড়া দুর্ঘটনার পরদিনই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল জ্যাকব দুর্ঘটনাস'ল সফর করায় আমরা তাঁকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমরা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই ২০১০ সাল থেকে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিয়ে তেলের ট্যাংকারটি চলছিলো। তেল বহন করার আগে এটি বালি বহন করতো। একটি বালি বহনকারী কার্গোকে কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় তেল বহনের অনুমোদন দেয়া হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থানকারী যে কোনো নৌযান রাতে বন বিভাগের জেটিতে নোঙর করার বিধান রয়েছে। দায়ী তেলের ট্যাংকারটি মাঝনদীতে নোঙর করে এই বিধানও লঙ্ঘন করেছে। দুর্ঘটনার পরও পশুর ও শেলা নদীতে প্রচুর পরিমাণে নৌযান যত্রতত্র নোঙর করা অবস্থায় দেখা গেছে। তাই, এ দুর্ঘটনায় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গাফিলতিও স্পষ্ট। দুর্ঘটনার পর এমভি টোটাল নামের কার্গোটিকে আটক করা হলেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুটি কোম্পানির মালিক বা কোনো কর্মকর্তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। অপরদিকে দেওয়ানি মামলা করায় বন বিভাগের দাবিকৃত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ সুদূর পরাহত হবার আশঙ্কা রয়েছে।
ইতোমধ্যে নদী ও বাদাবন থেকে তেল অপসারণে বিভিন্ন ধরনের ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এ সম্পর্কে আমাদের মতামত হলো, যতো দ্রুত সম্ভব শত শত তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদেরকে নৌকা, স্পঞ্জ, মোটা কাপড়ের চালুনি ইত্যাদি দেশি উপকরণ দিয়ে তেল দ্রুত অপসারণ করা যাবে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ করেই তেল-দূষণ দূর করেছিলো। কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে তেল অপসারণ করলে কিংবা বনের ভেতরে ঢুকে তেল দূরীভূত করার চেষ্টা করলে তা হবে আত্মঘাতের শামিল। নির্দিষ্ট এলাকা ঘিরে আগুনের মাধ্যমে তেল অপসারণ করা যেতে পারে। তবে, সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বনাঞ্চলে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিতে পারে। তেলভূক ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর পদ্ধতি কার্যকর মনে করলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সেটি খরচবহুল হবে।
আমাদের দাবি
১. দুর্যোগ ব্যবস'াপনা আইন ২০১২ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত ২০১০)-এর আওতায় সুন্দরবনে পরিবেশগত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে;
২. জরুরি ভিত্তিতে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে তেল অপসারণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এজন্য সম্মিলিত সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করতে হবে এবং দেশি ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করতে হবে;
৩. যদিও কোনো অর্থমূল্যে পরিবেশগত ক্ষতি পুরোপুরি থামানো যাবে না; তবুও তেল-দূষণের জন্য দায়ী কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে যাতে তেল অপসারণ ও বাদাবন পুনর্বাসনের খরচ মেটানো যায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ হয়;
৪. সুন্দরবনের ভেতর থেকে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল স'ায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে;
৫. তেল অপসারনের কার্যক্রম যথাযথভাবে করার জন্য তদারকির দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পরিবেশ মন্ত্রীকে গ্রহণ করতে হবে;
৬. জরুরি ভিত্তিতে তেল-দূষণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ক্রয়ে অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। - Nurul Alam Masud এবং অন্যান্য 11 জন এর সাথে CLEAN এ
No comments:
Post a Comment