রেল আর রোগ
সালটা ১৮৫৯। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের এক স্থানীয় এনজিনিয়ার
কাজের জায়গায় মড়ক লাগা নিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানান, বাংলার
বিভিন্ন স্থান থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের অধিকাংশ কলেরা মড়কে মারা গিয়েছে - Large
masses continued to arrive almost daily, the utmost exertions of the Engineers
failed to get together materials for at once hutting them, and a large
proportion had no shelter for many days after their arrival and when cholera
was raging among them. Kerr, , p 98। সেই সময়ের হিসেব বলছে সেই
মড়কে মারাগিয়েছিল হতভাগ্য ৪০০০ কুলি। শুধু কলেরাই নয়, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত,
নিউমোনিয়া, পেটখারাপ, ডায়রিয়া, আলসার ইত্যাদিতেও বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। যে সব
অঞ্চলে বেশিদিন কাজ হত, সেখানে ৩০ শতাংশের বেশী কুলি মারা গিয়েছে। ১৮৮৮
বেঙ্গাল-নাগপুর রাস্তায় কোনও একটা সময় কোনও একটি ট্রেঞ্চে ২০০০-৩০০০ কুলি মড়কে
মারা গিয়েছে। তাদের দেহ চাইতে কেউ আসেনি। রেল রাস্তায় ট্রেঞ্চের ধারেই দেহগুলো
গাদা করে ফেলে রেখে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কার তার বই Building the Railways of
the Rajএ বলছেন, কুলিদের থাকার ব্যাবস্থা এতই অস্বাস্থ্যকরভাবে
করা হত যে এই মৃত্যু খুব একটা আশ্চর্যজনক ছিল না। ঠিকমত থাকার জায়গার অভাব,
প্রাতকৃত্য করার অসুবিধে, পানিয় জলের সমস্যার সঙ্গে জুড়ত বৃষ্টি, গরম, ঠাণ্ডার
প্রকোপ। ঠিকেদাররা এক লপ্তে কুলিদের বয়ে নিয়ে যেত কাজের এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায়।
ফলে মড়ক খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ত। তার আঁচ লাগত স্থানীয় গ্রামগুলোয়। যে ধরনের
প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেলপথ তৈরি করা হত, তাতে ম্যালেরিয়া হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা
ছিল। ১৯২৭ সালে জনৈক চিকিতসককে ম্যালেরিয়ার উৎস খোঁজার কাজ দেওয়া হয় তিনি ঠিক এই
কথাই জানিয়ে ছিলেন(Cutting down hundreds of trees for every mile of railway ties
for every mile of trackage laid, left poorly rooted trees nearby open to
buffeting by winds which soon toppled them over. These collapses greatly
increased the area of thin soil exposed. Blasted during the dry season by the
rays of the sun and by torrential downpours during the rains, these
laterite-based soils were soon leeched out, forming water-filled cracks and
potholes which female mosquitoes intent on laying eggs found irresistible. Watts,
Epidemics and History: Disease, Power and Imperialism,
p 171.)। আর যেহেতু কাজের ধরণটাই ছিল যাযাবরী ধরনের, সেহেতু রোগের চলনশীলতাও ছিল বেশ
ভালরকমের।
ম্যালেরিয়ায় সব থেকে বেশি মৃত্যু ঘটেছে। রেল পাতার সময়
মোটামুটি একটা স্লিপার পিছু একটা মৃত্যু ধরে নেওয়া হত। গ্রেট পেনিন্সুলার রেলওয়ের
ঘাট সেকসানে, প্রত্যেক মাইল রেলপথ পাততে প্রয়োজন ছিল ১৭০০ স্লিপারের। ফলে প্রত্যেক
মাইল রেল পথ পাততে মৃত্যু হত ১৭০০ শ্রমিকের। এবং এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানর
চেস্টাও হয় নি। পরবর্তী কালে ১৮৯৭(২৭৩২ মাইল), ১৮৯৮(২৯৬৩ মাইল) রেল লাইন পাততে আরও
সস্তা মন্বন্তরে ভোগা মানুষকে যুতে দেওয়া হয়। মনেরাখতে হবে, সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতা
থেকেই কলেরা ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক নয়। এবং যদিও কোনও মড়ক লাগত তাও সীমাবদ্ধ ছিল
ছোট অঞ্চলে। ঔপনবেশিক সময়ে যেখানেই রেলপথ গিয়েছে তার পেছনে পেছনে ম্যালেরিয়া আর
কলেরা গিয়েছে। রেলএর জলাধারে বহুদিন কলেরার জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। সেই জলেই
এলাকা থেকে এলাকায় ছড়িয়ে যেত মড়ক। এই প্রসঙ্গে দুজন লেখকের দুটি উধৃতি তুলে দেওয়া
গেল। “Modernising works created
serious ‘obstacles’ to water flows, caused river systems to become ‘silted up’
and ‘moribund,’ deprived soils of enriching nutrients and damaged crop yields,
drainage and sanitation. Klein, ‘Imperialism, Ecology and Disease: Cholera in
India, 1850-1950’, p 512। While
cholera slaughtered millions thus, the British government continued to invest
heavily in railways and not much in public health. Watts, Epidemics
and History: Disease, Power and Imperialism, 168।
রেলপথ মন্বন্তর বা গণহত্যা
ব্যবসায়ী কৃষি আর রেলরাস্তা পরস্পরের হাট ধরাধরি করে
চলেছে। ব্যবসা নির্ভর কৃষি পশুচারনভুমি দখল করে ফলে গ্রামে পশুদের অবস্থার অবনতি ঘটতে
থাকে। ফলে ঘাসের দাম বাড়ে। জ্বালানি জোগাড় করতে পশু বেছেদিতে হয়। পশু গোবরের
পরিমান হ্রাস পাওয়ায় জমির উরবরাশক্তি হ্রাস ঘটে এবং ভুমিক্ষয় হয়। পুরনো বাঁধ বা
ছোট নালায় খরা রুখে দেওয়া যায়। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার সব বিনিয়োগই রেলপথে করলেন।
এই স্বাভাবিক কাণ্ডের ফল মন্বন্তর। এবং কোথাও সরাসরি কোথাও পরোক্ষে রেলরাস্তা এর
জন্য দায়ী হয়ে রইল। মুক্ত বানিজ্যের অন্যতম প্রবক্তা ভারত সারকার মন্বন্তরে পড়া
মানুষদের সাহায্য করতে অস্বীকার করল। রেলকে ব্যাবহার করে ফড়েদের দানা শস্যের ফাটকা
বানিজ্য করার চেস্টা রোখা হল না। কমদামেড় এলাকা থেকে শস্য কিনে বেশি দামের এলাকায়
বিক্রি করার চেষ্টায় মদত দিল রেল রাস্তার পাশে টেলিগ্রাফ লাইন। আধুনিক প্রযুক্তি
ভারতে গণহত্যা বহন করে এনেছে। অত্যধিক করের হারে ন্যুব্জ কৃষক রেল রাস্তা আর
টেলিগ্রাফের জুগলবন্দীতে মন্বন্তরের মুখে এসে পড়ল।
খাদ্য এবং অন্যান্য কৃষি উতপাদন রেলরাস্তা ধরে রপ্তানি
হয়ে যেত ব্রিটেনে। ভারতের ১৩ শতাংশ গম ব্রিটেনে রপ্তানি হত। ইংল্যান্ডের আগের
বছরের খারাপ চাষের জন্য১৮৯৬তে ব্যাপক হারে কৃষি দ্রব্য রপ্তানি হল। ফলে আবার
মন্বন্তর। ১৮৮৬তে ভারত ব্রিটেনের গম আমদানির
২৩ শতাংশ সরবরাহ করত। হায়দারাবাদের পুতুল রাজন্যকে প্রভাবিত করে জঙ্গলে বা অন্য
এলাকায় গমের বদলে ব্যাপকভাবে তুলোর চাষ শুরু হয়, ফলে খাদ্য নিরাপত্তার হানি ঘটল।
ধান এবং গমের অধিকাংশ লন্ডনে রপ্তানি হত(The idea that Berar enjoyed
immunity from famine was dispelled by the experiences of 1896-97 and 1899-1900.
The former year was one of scarcity, amounting to famine in parts of the
province, in the latter year the famine was severe, and affected the whole of
Berar - Report
on the Administration of the Hyderabad Assigned Districts for the Year 1901-02,
Residency Government Press, Hyderabad, 1902, para 13.)। বেরার
ব্রিটিশের ঘটান মন্বন্তরের একটা ছোট উদাহরণ মাত্র।
আজও শুধু ব্রিটনরাই নয় বহু ভারতীয়ও বিশ্বাস করে নতুন প্রযুক্তি
আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের মাহাত্ম্যে। এই সব উপকথা আজ নতুন করে প্রশ্ন করার
সময় এসেছে।
সুত্রঃ British Imperial Railways in Nineteenth Century South Asia
Laxman D Satya (lsatya_99@yahoo.com) is at the Department of History, Lock Haven University of Pennsylvania, US.
November 22, 2008, Economic & Political Weekly
No comments:
Post a Comment