রেল লাইন পাতার জন্য ভারতের জঙ্গল উজাড় হয়ে
যায়। গোটা গাছ কেটে রেল লাইন স্লিপার তৈরির কাজ হত। সঙ্গে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ইঞ্জিন
চালানো হত। রেল লাইন এবং তাঁর সঙ্গে নানান পরিকাঠমোর জন্য প্রচুর ইট তৈরি করতে হয়।
সেতু, কালভারট, স্টেশন, কর্মশালা করার জন্যও অপর্যাপ্ত পরিমানে ইট ব্যাবহার করা
হয়েছে। ১৮৫৮র মাঝের দিকে, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েজএর হুলহোর ডিভিশনে ১৭ মাইল রেলপথ
পাতার জন্য ২০ লক্ষ ইট ব্যাবহার হয়। ৪৫ লক্ষ ইট রাখা ছিল ভাটায় পোড়াবার জন্য, আরও
৭০ লক্ষ কাঁচা ইটের জন্য মাটি তৈরি করে রাখা ছিল। শুধু এই ডিভিশনে ৫০টি ইট ভাটা আড়
১৬টি চুনের ভাটি দিনরাত কাজ করত কাঠের জ্বালনে। ভারতের রেলপথ তৈরির অন্যতম প্রধান
কাজ ছিল ইট তৈরি করা। এই কাজ সরকারি বরাতে রেল কম্পানিগুলি করত।
সুত্রঃ British Imperial Railways in Nineteenth Century South Asia
ভারতের জঙ্গলের শত শত বছরের পুরনো গাছ কেটে
রেলপথএর স্লিপার তৈরি হয়েছে। The forests of India were searched and
ravaged for supplies of sleeper wood….Indian wood would be felled in a forest,
possibly quite distant, by foresters in the employ of timber contractors, …it
is clear that the demands for the railways for wood – prime wood for sleepers,
buildings and carriages, and lesser wood for firewood for kilns and for fuel
for early locomotives-increased the exploitation of India’s forests and the
pressure on forest-dwelling people.( Kerr, Building
the Railways of the Raj, p 145.)
। এই সময় থেকেই ব্যাবসায়
কাঠ ব্যবহারের জন্য জঙ্গল সংরক্ষিত করার নীতি শুরু হয়। উদ্দেশ্য শিল্পের জন্য অযুত
পরিমান কাঠ সংগ্রহ। ফলে বহু জঙ্গলে থাকা আদিবাসী সমাজ উজাড়-উচ্ছেদ হয়ে যায়। হাজার
হাজার বছর ধরে জঙ্গলে বাসকরা, জঙ্গল বাঁচানো, জঙ্গলের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ভারত
সরকার প্রায় অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করে। লড়াই চলতে থাকে। জঙ্গলে থাকা মানুষদের অধিকার
কেড়ে নেওয়া হয়।
ভারি, দামী মজবুত কাঠের জন্য ভারতের জঙ্গল
বিখ্যাত ছিল। ভারতের কাঠ বহু শত বছর ধরে বিশ্ব বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। টিক, শাল, দেওদার, সেডার, চির, পাইন ভারতের
বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। ভারতজুড়ে যেহেতু রেলপথ পাতার কাজ চলছিল, ফলে প্রায় সব
ধরনের জঙ্গল নির্বিচারে কাটা ও ধ্বংস হয়েছে। এই ধ্বংস সুরু হয় পাশ্চিম ঘাটের
মালাবার উপকুলের জঙ্গল কাটা দিয়ে। রেলপথ তৈরির বহু পূর্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর
জাহাজ তৈরির জন্য মালাবার উপকুলের জঙ্গল সাফ করা চলছিল। শেষ ঘা-টি দিল ভারত
সরকারের রেলপথ তৈরির প্রকল্প। ১৮৭০ নাগাদ মালাবার জঙ্গল প্রায় সাফ হয়ে যাওয়ার পরে
আপার-বার্মার জঙ্গলের দিকে ব্রিটিশ ব্যাবসায়ীদের নজর পড়ে। গঙ্গা অবধৌত এলাকায় রেলপথ
পাতার কাজ সুরু হলে ব্যাবসায়ীদের হাত পড়ল হিমালয়ের ঘন জঙ্গলে। বাংলার হাজার হাজার
মাইলজোড়া পশ্চিম-তরাই অঞ্চলের শাল জঙ্গলও রেল প্রকল্পর জন্য সাফ করা হতে থাকল। এই
জঙ্গলগুলোয় নতুন গাছ বসাবার দায় কেউ গ্রহণ করল না। শাল কাঠ দীর্ঘ, মজবুত অথচ নমনীয়
তন্তুর জন্য রেল প্রকল্পগুলোর জন্য আদর্শ কাঠ হিসেবে গণ্যও হতে থাকে। উনবিংশ শতকে
শাল কাঠের অপ্রতুলতা সুরু হয়, দামও আকাশ ছোঁয়।
১৮৬০এর পর থেকে টিক আর শাল কাঠের দাম বাড়ায়
উত্তর ভারতের রেল উদ্যমীদের নজর পড়ল উত্তর ভারতের পাহাড়ি দেওদার গাছের দিকে। Exploitation
of the deodar forests soon became the central focus of the first half century
of Forest Department’s work in the Himalayas, first for the continuing
depletion of the deodar stands and later for the gradual stabilisation of
commercially valuable timber lands in the system of Reserved Forests(Richard
Tucker, ‘The British Colonial System and the Forests of the Western Himalayas, 1815-1914’
in Richard Tucker and John Richards (eds), Global
Deforestation and the 19th Century World Economy,
Durham, 1983, p 158-59.). ১৮৭০-৮০র দশকে উত্তর পশ্চিম ভারতে রেলরাস্তা পাতা শুরু হওয়ার
পর হিমালয়ের দেওদার জঙ্গল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
১৮৭০এর প্রথম দিকে ভারতের সবথেকে বড় রেল
প্রকল্প, দিল্লি থেকে রাজস্থান রেলপথে ৮ লক্ষ স্লিপারএর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই
অযুত পরিমানের স্লিপারের জন্য উত্তর গঙ্গা আর সিন্ধু নদী উপত্যকা, পাহাড়ি পাঞ্জাব
এবং কাশ্মীরের জঙ্গল পুরপুরি সাফ হয়ে যায়। একই সময়ে লাহোর থেকে করাচির রেল রাস্তা
তৈরি হয় পাঞ্জাবের গম ইউরোপ রপ্তানি করার জন্য। শুধু উত্তরপ্রদেশেই ১৮৭০এ ৭৮০০০
থেকে ১৪৭০০০ গাছ কাটা হয়। ৮০র দশকে এই পরিমান দ্বিগুণ হয়(ঐ)। এক মাইল রাস্তা পাতার
জন্য প্রয়োজন ছিল ১০, ১২ আর ৬ ইঞ্চির ১৭০০ স্লিপার আর ১।৫ টন কাঠের চাবির(উডেন
কী)। একটি স্লিপার তৈরির জন্য পুরো একটা বয়স্ক গাছ কাটার প্রয়োজন হত।
জনৈক জার্মান ব্যবসায়ী(ফরেস্ট এজেন্ট)
ডীয়েত্রিশ ব্রান্দিস(Dietrich Brandis)কে ভারত সরকার বন দপ্তরের নিরীক্ষক (ইন্সপেকটর জেনারেল)
হিসেবে নিযুক্ত করে ১৮৫৬ সালে, প্রথমে বার্মায় পরে ভারতে। ভারতে তিনি ২০ বছর চাকরি
করেন। তিনি বেশ কয়েকটি সমীক্ষা করে ভারত
সরকারকে সেই সমীক্ষাগুলো পেশ করেন। তাঁর সমীক্ষার মূল সুরটিই ছিল জঙ্গলকে আরও বেশি
ব্যবসায়ী কাজে ব্যবহার কি করে করা যায়। ১৮৭৮এর এক সমীক্ষায় ব্রান্দিস লেখেন ভারতের
রেলপথের স্লিপার সরবরাহের জন্য সরকারের উচিত হিমালয়য়ের জঙ্গল ব্যাবহার করা। ১৮৮০র
দিকে প্রথমদিকে রেলপথে পাতা স্লিপার বদলানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তিনি ভারত সরকারকে
জানান রেলপথ তৈরির জন্য বছরে ৫ লক্ষ স্লিপার প্রয়োজন। অথচ রেল কর্তৃপক্ষ ঠিক এর
দ্বিগুণ স্লিপার ব্যাবহার করে। ব্রান্দিসএর বহু আগেই জঙ্গলকে রেলপথের প্রয়োজনে
ব্যবহার করতে ১৮৬৪তে ভারত সরকার বন দপ্তর গঠন করে। মনেরাখতে হবে ভারত সরকার শুধু
প্রশাসনিক কাজের জন্য অথবা বন রক্ষা করার জন্য বন দপ্তর তৈরি করে নি। এই দপ্তরের
সঙ্গে রেলপথ বিকাশের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। রেলপথএর বিকাশ প্রয়োজন ছিল ঔপনিবেশিক
অর্থনীতি বজায় রাখার জন্য। সেই প্রয়োজনেই বন দপ্তরের সৃষ্টি।
ভারতজুড়ে রেলপথ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বনের
নির্মূলীকরন ঘটতে থাকে। মাদ্রাজ রেলপথ তৈরির জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির জঙ্গল
কাটা হয়। মাদ্রাজে রেল চালাতে কয়লা না ব্যবহার করে কাঠ জ্বালানো হয়। কাঠের থেকে
কয়লার দাম বেশি ছিল। কিন্তু কাঠ বেশি ব্যাবহার করতে হত। প্রতি ইঞ্জিন মাইল চালাবার
কাঠ ব্যবহার হত ৮৯.৫৩ পাউন্ড, কয়লা ২৬.৭৩ পাউন্ড।
বন ধ্বংসের জন্য সরকার ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত জঙ্গল থেকে কাঠ কিনতে শুরু
করে। তবে জঙ্গল সংরক্ষণের এই উদ্যোগ যতটা
না পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র বাঁচাবার জন্য, তাঁর থেকে বেশি ব্যবসায়িক কাজে জঙ্গলের কাঠ
তৈরির ভাবনায়। আদতে জঙ্গলের কাঠ সংরক্ষণ করে তাকে বাড়িয়ে আবার বিক্রি বা ব্যবহারের
উপযোগী করে তোলা।
রেলের উত্তুঙ্গ চাহিদায় জঙ্গল ব্যাপকভাবে ধ্বংস হতে শুরু করে। ১৮৫৯-৬০এর
রেভেন্যু বছরে, মাদ্রাজ রেলওয়ের জন্য ২৪৫৭৬৩টি বারথ সরবরাহ করা হয়, এবং সবকটি
কাঠের তৈরি। এমনকি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির রেলপথের জন্য ব্রান্দিস প্রস্তাব দেন,
সরকারি জঙ্গলের তুলনায় ব্যক্তিগত মালিকানার জঙ্গলের কাঠ ব্যাবহারের জন্য। ফলে শুধু
সরকার নিয়ন্ত্রিত জঙ্গলই নয়, ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত জঙ্গল থেকেও সমান পরিমানে কাঠ
ব্যবহার হয়েছে।সুত্রঃ British Imperial Railways in Nineteenth Century South Asia
Laxman D Satya (lsatya_99@yahoo.com) is at the Department of History, Lock Haven University of Pennsylvania, US.
November 22, 2008, Economic & Political Weekly
No comments:
Post a Comment