আমরা যে সময়টি
নিয়ে আলোচনা করছি, সেই মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দেও বাংলা থেকে মুল পণ্য রেশম এবং সুতি
বস্ত্রের এশিয় বণিকদের রপ্তানি ইওরোপিয়দের থেকে অনেক বেশি ছিল(H.T.Colebrooke, Remarks on the Husbandry, p.· 105)। অষ্টাদশ শতকের
শেষার্ধে বাংলা সুবায় স্থানীয়ভাবে ব্যবহার্য বস্ত্রের মোট পরিমান ছিল ৬ কোটি টাকার।
এই তথ্যের আলোকে আমরা বলতে পারি অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে এক ছিল, হয়তবা বেশিই ছিল
(১৭৭০এর মন্বন্তর এবং তার পরের সময়ে উচ্চ মৃত্যু হারের কথা মাথায় রেখেই(এই
মন্বন্তরে বাংলার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে যায়, BPP, XXIX, 37, quoted in
D.B.Mitra, Cotton
Weavers, p.212))।
সম্ভবত এশিয়দের বস্ত্র রপ্তানির পরিমান ছিল ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যে এবং
ইওরোপিয়দের ৫০-৬০ লক্ষ টাকা। আমরা দেখলাম ইওরোপিয় বস্ত্র রপ্তানি ছিল মোট উৎপাদনের
মাত্র একটা ছোট অংশ, যে বৃদ্ধি উৎপাদন ব্যবস্থায় মৌল পরিবর্তন না ঘটিয়েই করা
গিয়েছিল। যদি সুবার মোট উৎপাদনের তুলনায় ইওরোপিয় চাহিদা বেশি হত তাহলে বাংলার
উৎপাদন ব্যবস্থার সরবরাহ দিকে ব্যাপক চাপ পড়ত, তাহলেই চাহিদার চাপে প্রযুক্তি বা
উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি জোরদার হত। কিন্তু তারা যা চাহিদা সৃষ্টি করল তা
মোট উৎপাদনের ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ। ব্যাপক, প্রভূত ইওরোপিয় বস্ত্রের চাহিদার দাবি
অযৌক্তিক এবং সেই ক্ষুদ্র চাহিদা মেটাতে ব্যবস্থা বা প্রযুক্তির পরিবর্তনের দাবি
অনাবশ্যক।
কিন্তু যদি আমরা
যৌথভাবে এশিয় এবং ইওরোপিয় রপ্তানির চাহিদা দেখি তাহলে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গী পাব এবং
ব্যাপক সংখ্যার মুখোমুখি হতে হয়। বলাহয় ১৫৭৫ সালে মুঘলেরা বাংলা দখল করার পর থেকেই
এবং মুঘল রাজত্বের স্থায়িত্ব এবং শান্তিশৃঙ্খলার জন্যে বহর্বিশ্ব বাংলায় এসেছে,
বাংলা বহির্বিশ্বে গিয়েছে(J.N.Sarkar,
ed., History
of Bengal, vol.II,
p. 188)। যদিও অত্যুক্তি মনে হবে তবুও বলি, অস্বীকার করার উপায় নেই ব্যবসা বাণিজ্য
পরিবেশ বাড়ানোর জন্যে মুঘল আমলের শান্তির প্রয়োজন হয়েছিল। সপ্তদশ শতের প্রথমের
দিকে উত্তরভারতের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য বিপুল আকার ধারণ করে। ১৬৮০র পর থেকে বাংলায়
ইওরোপিয় বাণিজ্যে বিপুল গতি আসে। এই পরিবেশে যদি আমরা এশিয় বণিকদের রপ্তানির
পরিমানটা ধরি, তাহলে রপ্তানির পরিমান মোট উৎপাদনের একটা বড় অংশ হয়। এই প্রেক্ষিতে
প্রযুক্তির বদলের প্রশ্নটা উঠতেই পারে।
এই তথ্য সত্য যে
প্রাযুক্তির বিকাশের পথ রুদ্ধ করার বেশ কিছু চলক বাংলায় সক্রিয় ছিল সেই সময়। এই
শিল্পে প্রযুক্তির উদ্ভাবনের পথ কোন কোন চলক রুদ্ধ করে রেখেছিল, সেই বিষয়টা
আমাকদের আলোচনায় আনা অতীব জরুরি। এখানে এটাও বলা দরকার, বস্ত্র শিল্পের উদ্ভাবনের
দ্বার সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে খুব বেশি রুদ্ধ ছিল না(এই বিতর্কটা বুঝতে Morris et al, Indian
Economy বইটা পড়তে পারেন)। প্রযুক্তির
পরিবর্তন তেমন না ঘটলেও, অতীত থেকে বিচ্যুত না হয়েও কিছুটা উতপাদকেদের সাঙ্গঠনিক
স্বরূপের পরিবর্তন আসে। প্রযুক্তি খুব সাধারণ এবং পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা প্রায়
ছিলই না বলা চলে তবুও দাদনি বণিকদের সাহায্যে, স্থানিকতা বাড়িয়ে(increased
localization), দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞতা বাড়িয়ে আর শ্রমের সূক্ষ্ম
পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে তাঁতিরা বিপুল উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়। বর্ধিত
চাহিদা পূরণে উৎপাদনের সঙ্গঠনগুলি অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করে। এটি চলতি
আঙ্গিকের গুণগত বিকাশ এবং এই উৎপাদন ব্যবস্থা কোনও ভাবেই পরম্পরা ব্যবস্থাপনা থেকে
বিচ্যুত হয় না। কিন্তু প্রযুক্তির পরিবর্তনের তুলনায় সাঙ্গঠনিক পরিবর্তন অনেক বেশি
মৌলিক।