দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় টাঙ্গাইলের ২২টি গ্রামের বহু তন্তুবায় চলেএসেছিলেন এ বাংলার ফুলিয়া অঞ্চলে। ফুলিয়ার অগ্রণী তন্তুবায়, হরিপদ বসাকের নীলাম্বরীর নকশা(প্রকাশক, উবিনিগ, বাংলাদেশ। এই উপন্যাসের এ দেশে একজন প্রকাশক জুটলেও তিনি হতচ্ছেদ্দা করে সেই উপন্যাসটি ছেপেছেন কিন্তু বাজারে আনতে তাঁর বড় দ্বিধা) উপন্যাসে বিশদে সেই জনপদ পাতার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, যদিও সেই ইতিহাস আপাততঃ এই রচনার অংশ নয়। কাশবনময় সেই ধূধূকরা অঞ্চলটিতে উচ্চবর্ণের নানান অত্যাচারে, অনাচারে, বিশ্বাসঘাতকতায়, আমলাদের সমর্থন অথবা চক্রান্তে সব থেকে বড় কথা তাঁতিদের রক্ত, ঘামে ক্রমে ক্রমে ফুলিয়া হয়ে উঠল বাংলার কারিগরী ইতিহাসের অন্যতম অংশিদার। ফুলিয়ার টাঙ্গাইল, পাশের জনপদ শান্তিপুরের শান্তিপুরীর অসাধারণ আকর্ষণীয় তাঁতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কারিগরদের নিজস্ব দক্ষতায় বিশ্ববিজয়ী তাঁত শিল্পের মর্যাদা পেল। অন্ততঃ তিনটি পারম্পরিক তাঁত সোসাইটি বিপুল উদ্যমে বিশ্বের নানান প্রান্তে ব্যবসা করে চলেছেন। বাংলার একমাত্র টাঙ্গাইল শাড়িকে তাঁরা বাঁচিয়ে দিয়েছিন নবতম উদ্যমে। এক সময়ে সাথী হয়েছিলেন বাংলার সরকার। প্রচার আর তাঁতিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুফল ভোগকরছেন এককালে সোসাইটির প্রবল বিরোধিতা করা বহু মহাজনও। কিন্তু ততদিনে এক লাখ হস্তচালিত তন্তুবায়ের রুটি রুজি মারতে ফুলিয়া, রাণাঘাট, শান্তিপুরে বসে গিয়েছে কয়েকশ কলের তাঁতের শাড়ি কারখানা, যারা একই ধরণের শাড়ি, অথবা অন্য জামাকাপড় তৈরি করে দিচ্ছেন অতি কম দামে। বিগত এক বছরেরমধ্যে ফুলিয়ার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ হাতে চালানো তাঁত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বহু তাঁতি কাজ করছেন সেই সব স্বচালিত কারখানায়। ফুলিয়ায় তাঁত বসালেই কারখানার দাম নিচ্ছে সরকারি বিদ্যুত কোম্পানি। তাই প্রত্যেকজন তাঁতির মনে আজ ধুসর মৃ্ত্যুর ছোঁয়া। অথচ ভারত সরকারের সংরক্ষণের তালিকায় হস্তচালিত তাঁতের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তার প্রতিকার নেই।
ভারত সরকারের যে দপ্তরের এই কর্মটি রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়, ডেভেলাপমেন্ট কমিশনার অব টেক্সটাইলসএর আমলারা মুদ্রারাক্ষসের প্রভাবে কলের তাঁতের স্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যস্ত। একদিন হয়ত ঐশ্বর্যমন্ডিত ফুলিয়ার, অমর্ষি-কসবা, চন্দ্রকোণার তাঁতের চরম দশাপ্রাপ্ত হবে। দেশজ ঐতিহ্য, দেশজ সাধারণ মানুষের উদ্যম, দেশজ মানুষের গবেষণালব্ধ জ্ঞাণ রক্ষা, বিকাশে একজনও মধ্যবিত্ত আমলার উত্সাহ নেই। তাই সরকারও উদাসীন। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কলের তাঁতের একই ধরণের কোটি কোটি বস্ত্র এসে বাংলার বাজার ছেয়ে ফেলছে। যে ৪০০ওপরের দ্রব্য ভারতে আসা বন্ধ ছিল, তা সরকারি ফরমানে নেমে এসেছে কয়েকশতে। অগ্রণী তাঁতি হরিপদ বসাক নিজে ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের বস্ত্রশিল্পীদের অন্যতম প্রতিনিধি, তিনি দেখেছেন সেই ফরমান। দেশের সাধারণ মানুষের পায়ে কুড়ুল মেরে প্রতিবেশীদেশের সঙ্গে সখ্যের দৌত্য কতটা সাধারণ মানুষের ভালর জন্য হচ্ছে তা আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজ ভারত সরকারের অন্যতম উদ্যম কলস্থাপনে উতসাহদেওয়া, তাতে হস্তশিল্প মারাযায় যাক, দেশের ঐতিহ্য লুপ্তহয় হোক। স্বাধীণতার প্রায় সাড়েছয় দশক পার বয়ে যাওয়ার পরেও দেশের মানুষেরা কতটা স্বাধীণ নতুন করে ভাবতে হবে!
No comments:
Post a Comment