খনা প্রথম পর্ব
We are thankful to http://khona.blog.com/
ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটলে তাকে পাবে না তুমি।
তাকে নিয়ে রচিত হয়নি কোন বীরত্বগাঁথা যুগ যুগ ধরে যা উজ্জ্বীবিত করতে পারে মানুষকে।
কেউ তাকে নিয়ে গায়নি কোন গান যার মনোহর সুর দিনের পর দিনে মাতিয়ে রাখে মানবহৃদয়।
কিন্তু সে বেঁচে আছে আজও, এক রহস্য হয়ে, দক্ষিণ এশিয়ার কিংবদন্তীতে, লোককথায় এবং, আরো প্রোজ্জ্বলভাবে, মানুষের জীবনে–মমতা ভালোবাসা, দ্রোহ দ্বন্দ্ব, এমনকি হিংসা ধ্বংসে, জ্ঞানের কণা সত্যের পরশ বুলিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলে তার সতত উপস্থিতি, কাব্যময় তার কথা মায়া ভরে স্মরণ করে মানুষ, প্রতিদিন। আর পশ্চিম বঙ্গে, রহস্যময় ঘুমন্ত এক ধ্বংসস্তুপে, জড়িয়ে আছে তার নাম।
তার নাম খনা (Khona)–খনার বচনের খনা।
কিংবদন্তীর কথা
তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী। এদের সাধারণ সুতোটি হচ্ছে, উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী (Avanti) তথা উজ্জয়নের (Ujjain) রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের (Harsha Vikramaditya) রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির (Varahamihira), আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা। বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে তিনি পুত্রের কোষ্ঠি (horoscope) বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। হিসেব করে দেখেন মাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র। পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু অসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে।
অনেক দূরের এক রাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায়। কিন্তু মারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে। ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির এক রাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে। মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র। একদিন দুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে।
পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহ। কৃষিকাজে মেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাস দিতে পারত সে। উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন (tenth jewel) হিসেবে আখ্য দেন। মেয়েটির জ্ঞানে সারা রাজ্য রাজপ্রাসাদ মুগ্ধ হয়ে রইল, পন্ডিত বরাহের খোঁজ আর কেউ নেয় না। এমনকি বরাহ নিজেও জনসমক্ষে এক বিতর্কে পুত্রবধুর হাতে পরাস্ত হন। ঈর্ষাপরায়ণ বরাহ তাই এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পুত্রকে আদেশ দেন মেয়েটির জিহ্বা কেটে ফেলতে যাতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় তার কন্ঠ। আর ঘটেও যায় এই মর্মন্তুদ ঘটনা!
উড়িষ্যার উপাখ্যানটিতে বর্ণিত আছে, রক্তক্ষয়ী এই ঘটনার পর মেয়েটির নাম হয় খনা, উড়িয়া ভাষায় যার মানে বোবা।
বাংলার এক কিংবদন্তীতে আছে, জন্মের পর মেয়েটির পিতা তার নাম রাখেন খনা কারণ তার জন্ম হয়েছিল এক শুভক্ষণে। কিন্তু বাংলার এই মেয়েটি বেড়ে উঠে লঙ্কা নামের রাক্ষস দ্বীপে (বর্তমানের Sri Lanka)। মধ্যযুগীয় কিছু বর্ণনায়, যেমন কালহানের রত্নরঙ্গিনীতে, বাংলার গৌড় (Gauda) কেই অবশ্য রাক্ষস রাজ্য (Kingdom of Demons) হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
রহস্যময় এক ভগ্নাবশেষ
কোলকাতা শহরের ৪০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে বারাসাত নগরীর কাছে বীরচম্পা (Berachampa) নামক জায়গায় গেলে দেখা যাবে প্রাচীন এক ভগ্নাবশেষ (ruins), মহাসড়কের উভয়পাশে বিস্তৃত। দক্ষিণ পাশে পরিলক্ষ্যিত হয় প্রাচীন দুর্গ (fort) ও প্রতিরক্ষাবেষ্টনি বা গড় (rampart) এর নিদর্শন। ধারণা করা হয়, এখানেই ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর (Chandraketu) সাম্রাজ্য। কৃষিকাজ বা অন্যান্য খননকাজে মাটির নীচ থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন (artefacts): মুদ্রা, পুঁতি (bead), প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য (stone & terracotta sculpture), গজদন্ত (ivory), উন্মোচন করে টুকরো টুকরো কত না ইতিহাস। নিদর্শনগুলির শুধু মাত্র সংখ্যার প্রাচুর্যই মুগ্ধ করে রাখার মত যথেষ্ঠ।
২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত এই এলাকাটিতে ১৯৫০ এর দশকে কিছু খননকার্য হয়েছিল। রোমান ও ভূমধ্যসাগরীয় মুদ্রা পর্যবেক্ষণ করে ঐতিহাসিকদের অভিমত, এখানকার স্থাপনাসমূহ খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের। পুরাতত্ত্ববিদগন (archeologist) এখানে মৌর্য্য (Maurya) ও গুপ্ত (Gupta) শাসনামলের নিদর্শনও আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু তৈজসপত্রের টুকরা (pot-sherds) এবং গোলাকার সিলমোহরের (seal) উপর খোদাইকরা অভিলিখন (inscription) এর মর্মোদ্ধার করা এখনও হয়ে উঠেনি, ফলে রাজা চন্দ্রকেতুর সঠিক পরিচয় এবং সেই এলাকার ইতিহাস এখনও আলো-আধাঁরিতে খেলা করে।
আর এখানেই, মহাসড়কের উত্তর পাশে শায়িত সমাধিফলকের মত এক ইঁটের স্থাপনা। বহুভুজাকৃতির উঁচু এই স্থাপনাটি কৌতূহল জাগানোর মত উত্তর-দক্ষিণে সুবিন্যস্ত, পাশে আরো কিছু স্থাপনা। এটিই খনা-মিহিরের মূড়া (Mound of Khona-Mihir) নামে পরিচিত। কিছু কিছু ঐতিহাসিক মূড়াটিকে গুপ্ত যুগের মন্দির হিসেবে অনুমান করলেও মন্দিরের পক্ষে জোড়ালো কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি এখানে।
এক বাঙ্গালী নারীর গৌরব যাত্রা
কিন্তু প্রাচীন এই ধ্বংসস্তুপের সাথে খনার নাম কেন জড়িত? খনা তো বেঁচে আছে শুধু তার ছন্দোময় জ্ঞানকথায়: আবহাওয়া, কৃষিকাজ, জ্যোতিষী শাস্ত্রে, আর কিছু ছন্দে যা তুলে ধরে তার শ্বশুর বরাহমিহিরের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা। আসলে কে সে?
অনেক কথাই হয়তো বলা যায়। কিন্তু আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে সেই কবে, পুরাকালে, বাঙ্গালী এক নারীর গৌরব-যাত্রা, বাংলার গৌড় থেকে বীরচম্পা হয়ে ভারতের অবন্তীতে, চারপাশে রেখে যাওয়া চোখ ধাঁধানো বাস্তবজ্ঞান আর মন মাতানো ছন্দ।
তারপর, সে এক বিষাদ গাঁথা, জ্ঞানের ছটা সহ্য করতে না পেরে তাকে বোবা-স্তব্ধ করে দিতে ঈর্ষাপরায়ণ কুচক্রীদের হীন বীভৎস ষড়যন্ত্র! কিন্তু কে কবে পেরেছে তা? কুচক্রীর দল মারা গেছে সেই কবে, বেঁচে আছে খনা, বেঁচে আছে তার কন্ঠ:
কলা-রুয়ে কেটো না পাত,
তাতে কাপড় তাতেই ভাত।
লেখকের কথা
খনার উপাখ্যানে রাক্ষস সম্প্রদায়ের কথা শুনে একে নিছক পুরাকালের পরমকথা বলে হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। গঙ্গার তীরে বাংলার দুর্ধর্ষ গঙ্গারিধি জাতি বহুবার থামিয়ে দিয়েছিল বহিরাগত শত্রুর বিজয় অভিযান, পরাক্রমশালী আলেকজান্ডার সাহসই করেননি এই এলাকায় অভিযানের, আর্যরাও ঢুকতে পারেনি বহুকাল, আর তাই বহি:শত্রুরা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে অপমান-ক্ষোভে প্রায়ই বাংলার মানুষকে তাদের সাহিত্যে আখ্যা দিয়েছে রাক্ষস, দানব, বানর হিসেবে।
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Friday, July 9, 2010
Khona Of Bengal Part I
লেবেলসমূহ:
Bengal,
folk wishdom,
Khona,
traditionalKnowledge
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment