দ্বিতীয় বিশ্বষুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ সম্মেলনে ব্রিটিশ
সরকার সংবাদমাধ্যম মদতে একের পর এক তৃতীয় রাইখের কুশলীদের অত্যাচারের নথি ফাঁস
করছে, শাস্তি দিচ্ছে, প্রয়োজনে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধঅপরাধীদের খুঁজে বার করে তাদের
যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। ব্রিটিশরা বিশ্বের স্বাধীণতা, সুস্থিরতা নিয়ে নিদারুণ
ভাবিত এমন এক বার্তা ছড়িয়ে চারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র। নানান যুদ্ধ বিরোধী
সাহিত্য তৈরি হচ্ছে ব্রিটিশ উদ্যমে। তৈরি হচ্ছে একের পর এক গেস্টাপো, নাজি বিরোধী
ব্রিটিশশক্তির বিজয় প্রচারভিত্তিক চলচ্চিত্র। ব্রিটিশের স্বাধীণতার,
গণতন্ত্রের ধারণায় মুগ্ধ, ছেড়ে আসা উপনিবেশের বাজারের হাত ঘুরে সেই চলচ্চিত্র
ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বের নানান প্রান্তে, যে বাজার তৈরি করেছিল একদা কোম্পানির
যুদ্ধখোর আমলারা, একদিকে তুলাযন্ত্র নিয়ে অন্যদিকে অস্ত্রধারী সেনাছাউনি রেখে। লন্ডনের সিনেমা শিল্প আর
কিছুটা তার সঙ্গ দেওয়া আমেরিকার হলিউডের খ্যাতনামা তারকার সমন্বয়ে, বিশ্ব জুড়ে
গড়ে তুলল এক তৈরি করা ধারণা – বিংশ শতকের বিশ্ব
গণতন্ত্রের অর্থ, একমাত্রই পশ্চিমি গণতন্ত্র। এ ধারণা যদিও তার আগে থেকেই
গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে- মান্যতা পেল বিশ্বব্যাপী উদ্দাম নাজি বিরোধিতার পরিবেশে। অনুচ্চারে বুঝিয়ে দেওয়া
হল, এর বাইরে আর কোনো গণতন্ত্রের ধারণা থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক এ তত্ব
বিশ্ববুদ্ধিবিভাষাময় মানুষদের লেখা পত্তরের মলাট ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী। ধারের গণতন্ত্রের কলম করা
গাছের কল্যানে গড়ে উঠল এশিয় আফ্রিকিয় দেশগুলিতে ইংলন্ডিয় রপ্তানি গণতন্ত্রের
পরিবেশ।
ভারতীয়দের প্রায় রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল বিশ্বউদ্ধারে
ব্যস্ততম মহান ব্রিটিশ গণতন্ত্রবার্তা। একের পর এক বিশ্বচিত্তজয়ী চলচ্চিত্র আছড়ে পড়েছে
আলোআঁধারি প্রেক্ষাগৃহে – বিগার দ্য পিকচার বিগার দ্য ইমোশন তত্ব সম্বল করে। রাষ্ট্র প্রণোদিত সাহিত্য,
ছবি, নাটক পরিবেশ তৈরি করছে, মান্যতা দিয়েছে, ব্রিটিশদের বিচার দেওয়ার যোগ্যতাকে,
সভ্যতার হয়ে লড়াই করার অদম্য ক্ষমতাকে। আড়াইশ বছরের সরকারি মদতে, কোম্পানির হাতে গড়ে ওঠা
বাজারের মদতে, ব্রিটিশ অত্যাচারের তথ্যগুলোকে লুকোতে, ঔপনিবেশিক লুঠের সম্পদে তৈরি
হল হয়ার ইগলস ডেয়ার, গানস অব ন্যাভারোন,
ওডেসা ফাইল, সাউন্ড অব মিউজিক, লরেন্স অব আরাবিয়া, ব্রিজ অন রিভার কোয়াই-এরমত
গায়ে শিহরণ জাগানো, চোপ গণতন্ত্র চলছে!
মার্কা, বিশ্বজুড়ে বক্স-অফিসের রেকর্ড ভাঙা গোছা গোছা চলচ্চিত্র। জার্মানির যুদ্ধের
ভয়ঙ্করতা থেকে বিশ্বকে উদ্ধার করে, মৃত্যু-গর্বিত নায়ক সগর্বে ঘোষণা করে যান
ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মাহাত্ম্য। বিশ্বের একের পর এক দেশে
লুকিয়ে থাকা জার্মান যুদ্ধ অপরাধীকে খুঁজে বের করে তাদের শাস্তিদেওয়ার শিহরণে সারা
বিশ্ব আমোদিত।
বিজিত জার্মানির কবরে, বিশ্বজুড়ে তৈরি হল নতুন ধরণের ব্রিটিশ গণতন্ত্রের
ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ, যে আধিপত্য এর পরের দশকগুলো থেকেই ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়বে
বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে, নিরাপত্তা দেবে ব্রিটিশ সরকারকে তার
অতীতের সমস্ত কুকর্ম থেকে।
ব্রিটিশ রাজশক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তাদের
সমস্ত শক্তি ব্যয় করে, হিটলারের অধীন জার্মানিকে বিশ্বের একমাত্র শত্রু হিসেবে
দেখানোর চেষ্টা করল বিশ্বের সমস্ত মাধ্যমগুলোকে জুড়ে নিয়ে, নইলে ১৭৫৭ থেকে বাংলা
এবং ভারতজুড়ে যে সন্ত্রাস, লুঠকর্ম চালিয়েছে, তা প্রাকাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা
যথেষ্ট ছিল।
ব্রিটিশ রাজ জানত যে, যুদ্ধোত্তর সময়ে তার সাম্রাজ্যের কুকর্ম সে ঢাকাদিতে পারবে – ভারত থেকে ন্যুরেমবার্গে বেছে বেছে একজন বাঙালিকেও ঠাঁই
দেওয়া হল। মাত্র এক দশক আগে
বিয়াল্লিশের মন্বন্তরে ব্রিটিশ সরকারের পোড়ামাটি নীতির ফলে, চোখের সামনে কোটি
কোটি বাঙালি মা-বাবা-ভাই-বোনকে ঠাণ্ডামাথায় অভুক্ত রেখে, খুন হতে দেখেও বাঙালি এক
বিচারক আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে ব্রিটিশদের পাশে দাঁড়িয়ে জার্মানির বদমাশ খুনেদের
বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই দিলেন। অহো! বাঙালিরা সে আন্তর্জাতিক গর্বে আনন্দে মাতোয়ারা
আজও।
No comments:
Post a Comment