Thursday, November 23, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই১০ - যোগেশ রাম মিশ্র

দুটো অপ্রকাশিত তথ্য আমাদের সেই লাভের অঙ্কের দিকে ইঙ্গিত করে। সেখানে আমরা প্রকল্পের আরও কিছু তথ্য পেয়ে যাই। ১৭৭৫ সালের ১ মার্চের একটা তথ্য বলছে তাঁর একটা হাট তৈরি করার পরিকল্পনা বাতিল করে বীরভূমের নায়েব, তিনি ভবঘুরে ব্যবসায়ী(হকার?, itinerant traders) প্রকল্পতের কাছে জড়ো হতে বাধা দেন। ফলে উতপাদকেদের দৈনিক বহুদূর থেকে মাল বয়ে নিয়ে আসতে হত। নতুন করে আবেদন করার পর প্রভিনশিয়াল কাউন্সিল তাকে হাট তৈরিতে অনুমতি দিয়ে, একই সময়ে হাট নিয়ন্ত্রণ করার নীতি অনুসরণ করে নায়েবকে নির্দেশ দেয় হাটে সব ধরণের লোহা কেনাবেচা নিষিদ্ধ করতে।

১৭৭৭ সালের এপ্রিল মাসে ইন্দ্রনারায়ণের আরেকটি আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রকল্পের আরও কিছু তথ্য আমরা জানতে পারছি। সে সময়ের অঙ্কের হিসেবে, প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনাগতভাবে তাঁর প্রকল্পটি দৈত্যসম বললেও অত্যুক্তি হয় না। উৎপাদন পুর্ব বিনিয়োগ ৩০০০০হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এক মাইল লম্বা এলাকা রাস্তার জন্য পরিষ্কার করা হল। চারদিকে চৌকি বসিয়ে দূর থেকে আনা কাঠকয়লার নিরাপত্তার ব্যস্থা করা হল। পাহাড়ের তলায় ঝর্নাকে কাজে লাগিয়ে হাপর চালানোর ব্যবস্থা করা হল, এবং ভারতে সেটা প্রথম প্রচেষ্টা। এছাড়াও ইন্দ্রনারায়ণ স্থানীয় কাঠকয়লা প্রস্তুতকারক, লোহাচুর খোদক কারিগর, চুল্লি কারিগর, এবং কামারকে নিযুক্ত করেছিলেন। তার কারিগরেরা সাধারণত স্থানীয় চুয়াড়। কাঠকয়লা তৈরি করতে চুয়াড়দের বসতি (ডিহি) তৈরি হল।

১৭৭৭ এপ্রিলের আবেদনের তথ্যে আরও বেশি কিছু ইঙ্গিত ছিল, যা দিয়ে আমরা ইন্দ্রনারায়ণের কারখানার উদ্যমের নানান কর্মকাণ্ড নতুন করে বানিয়ে নিতে পারি। ১৭৭৬এর অক্টোবর এবং নভেম্বরে পরপর দুমাসে চুয়াড়েরা তার কারখানা(শাল) আক্রমন করে ধ্বংস করে। চুয়াড়েরা দুজন চৌকিদার খুন করে, সব পশু সাথে নিয়ে যায়, যা কিছু দামি ছিল সব মাটিতে মিশিয়ে দেয় আর যা নিতে পারল না সব পুড়িয়ে দেয়। কোম্পানির বেসামরিক আমলাদে বা বীরভূমে থাকা সামরিক বাহিনী থেকে তিনি কোন সাহায্য পেলেন না। তার মনে হল তার শাল ধ্বংস যারা করল তারাই যেন সরকারি নিরাপত্তা পাচ্ছে। তার কারিগরেরা কারখানা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল। যারা ছিল তারা বেশি মাইনে দাবি করে। নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রকল্পের খরচ বেড়ে যেতে শুরু করায় তার পক্ষে সেটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে জানালেন। তিনি কাউন্সিল আর আমিনকে লিখে জানালেন তার যে ক্ষতি হয়েছে সেটা যদি তার বাৎসরিক ভাড়া থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তার ক্ষতি কম হয়।

চুয়াড়েরা তার প্রকল্পে ইতি টেনে দিয়ে গেল। উল্লেখ্য তার কর্মচারী এবং ধংসকারী উভয়েই চূয়াড় ছিল। তার কর্মচারীরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় প্রকল্পে নতুন করে হামলার আশংকায় নিরাপত্তা বারাতে হল। চুয়াড়েরা গোটা শীত জুড়েও হাটগাছায় থানা গেড়ে রইল। ইন্দ্রনারায়ণ কাউন্সিলের কাছে সেনা সাহায্য চাইলেন।

ইন্দ্রনারায়ণের শিল্প-উদ্যম আলোচনার নানান উপাদান এতই অল্প যে এর সঙ্গে জুড়ে থাকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ গোষ্ঠী জমিদার আর ব্যবসায়ীদের কি প্রভাব ছিল তা জানা যায় না। আগেই বলেছি বীরভূমের রাজারা তার অঞ্চলের লোহার খনির ওপর পরিবারের দাবি জানিয়েছিল। তার দপ্তর লোহা উৎপাদন এবং ব্যবসা সংক্রান্ত নানা শুল্ক, কর আদায় করত। অন্য দিকে ব্যাপারীরা লোহাচুর বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে থেকে লোহার উৎপন্ন দ্রব্য শালগুলি থেকে বাজার আর গ্রাহক পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করত। তাদের উদ্যমেই লোহা কারখানা থেকে বাজারে পৌঁছত। হাটগাছা রাজার রাজস্ব মহালের অধীনে ছিল না, তাই তাঁর পক্ষে অভিযোগ করা ছাড়া আর কোন যুক্তি ছিলনা। এবং হাটগাছার কারখানায় একটাও পণ্য উৎপাদন হওয়ার আগেই সেটি ধ্বংস হয়ে গেল। ফলে এই উদ্যমে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ তখনও বোধহয় জড়িয়ে ছিল না।
(চলবে)

No comments: