Monday, November 20, 2017

বেরা ভাসান উৎসব১২ - সমুদ্র যাত্রার পাঁচালি - রীলা মুখার্জী

উপসংহার
Bob Pokrant, Leidenকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাংলায় বেরা ভাসান কেন ওনাদের েলাকায় হয় না? শুরুতেই আমরা বলেছি এ ধরণের উৎসব দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মার সঙ্গে জুরে থাকা চরিত্র। এটি কেন মালাবার, গুজরাত, বিজয়নগর বা হায়দ্রাবাদের সমারোহতে জোড়ে নি, কেন শুধুই বাংলায় এটি টিকে আছে, সে উত্তর হয়ত আগামী দিনের গবেষণায় আসতে পারে। কেননা ক্যাম্বে, সুরাট, কালিকট এবং মছলিপত্তনমএর নাবিক বাংলার মতই সমুদ্রে যেত।

আমি কতগুলো সম্ভাব্য উত্তর খুঁজছি। প্রথমত বাংলার মত এত কৃষি উতপাদকতা অন্য কোন রাজ্যের নেই/ছিলনা। নদীভিত্তিক দেশে সেদো, বা বারা বা গঙ্গাপুজো এই উতপাদকতা আর নদীভিত্তি উৎসবের মুখড়া হিসেবে কাজ করে। এটা পদ্মা(ঢাকা) না ভাগীরথী(মুর্শিদাবাদ)তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেটা জনগনের কাছে খুব তুচ্ছ ব্যাপার, যতদিন জল আর জমির মধ্যে যোগাযোগের তত্ত্বটা জুড়ে থাকবে, ততদিন এই উৎসব বেঁচে থাকবে। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলটার নদীগুলি যহেতু সাগরের সঙ্গে মূলত জুড়ত, তাই নবাবদের পক্ষে এটাকে তাদের ক্ষমতার মণ্ডলের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, একই রকম অন্যান্য রাজ্য যেমন উত্তরভারতের নবাবী রাজ্যগুলো কিন্তু আশরফি কৃষ্টি আপন করে নিয়েছিল, বাংলায় উপকূলিয় লৌকিক কৃষ্টিকে পাঁচ শতাব্দের ইসলামি সংস্কৃতি বিনষ্ট করতে পারে নি। এই অঞ্চলের সুফিরা যতটা লৌকিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ততটা অন্যে এলাকায় দ্যাখা যায় না। চতুর্থত, দিল্লি আর বাংলার চোখে নিজেদের ইসলামি শাসক হিসেবে রাজনৈতিক অবস্থানটা নিশ্ছিদ্র করতে, এই দেখনদারি উতসবটায় নিজেদের জুড়ে নিয়েছিলেন নবাবেরা। অযোধ্যা বা হায়দারাবাদের ইসলামি উৎসবের মত বাংলায় অন্যান্য ইস্লামি উৎসব ছিল না। পূর্ব বাংলার সঙ্গে জুড়ে থাকা দেশগুলো যেমন বার্মা থেকে মালয় এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলি পর্যন্ত নদী সমারোহের সঙ্গে দরকারি ক্ষমতার মিলনকে দেখানোর দরকার ছিল। এবং মুর্শিদলিকুলি খাঁ দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে নিজের সার্বভৌমত্ব দেখাতে এই উৎসব ব্যবহার করতেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করা দরকার।

বছরের পর বছর ধরে বেরা ভাসানের ধারাবাহিকতার নানান আচারের যে পরিবর্তন হয়েছে তার গুরুত্ব আলোচনা করা যাক। আসুন আমরা তার কয়েকটা খুঁজে বার করিঃ ১) আধুনিকপূর্ব বিশ্বে এটি তিনটি বিশ্ব এবং তিনটি কর্মকে জুড়ত - সমুদ্রযাত্রা, নদীজাল আর কৃষি যা আদতে সওদাগরি, মাছধরা নৌকোচালানো এবং ফসলাদি(harvest); ২) সপ্তদশ শতে এই কাজকর্মগুলি বিপুল বিস্তারলাভ করায় এই প্রথাগুলি সাধারণ লৌকিক আচারের চেহারা ঝেড়ে ফেলে সামাজিক উৎসব হয়ে ওঠে; ৩) অষ্টাদশ শতে নবাবী বাংলা এটিকে আত্মীকরণ করে নেয়। এটি ধুমধাম করে পালনের সমারোহ হয়ে ওঠায়, পৌষ সঙ্ক্রান্তির উৎসব থেকে ভাদ্রের বৃহস্পতিবারে আনার জন্য, একটি আস্ত নতুন পঞ্জিকার প্রবর্তন করতে হল। এই পরিবর্তনগুলি থেকে পরিষ্কার, বাংলার নতুন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সচেতনভাবে কৃষির সঙ্গে সমুদ্রবাণিজ্যযাত্রাকে মেশাতে আর হিন্দু মুসমলানের মধ্যে সদ্ভাব তৈরি করতে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে বেরা ভাসানের আগের দিন রাষ্ট্রের ক্ষমতা বোঝাবার জন্য এবং সেই কাজে সব ধরণের মানুষজকে জুড়ে নিতে একটা সমারোহমূলক জুলুসের আয়োজন করেন। আমরা এর আগেই বলেছি বেরা ভাসানের আগের দিন নবাব তার দরবার উন্মুক্ত করতেন দেশি বিদেশি(এশিয় ইওরোপিয়) সকলের জন্য এবং তাদের সক্কলকে নজর দান করতেন(ব্রিটিশ লাইব্রেরির Kasimbazar Factory Records, G/23 Series,দেখুন)। বাংলার সব কটা ইওরোপিয় কুঠির আমলাকে সেই দিন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে দরবারে উপস্থিত থাকতে হত। উনবিংশ শতকে যখন মুর্শিদাবাদের নিজামতের রোজগার মাটিতে মিশেছেপ্রায়, নবাব সে সময় সারা বছর জুড়ে ১৮টা উৎসব আয়োজন করতেন, বেরা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল। ফলে বেরা ভাসান শুধু আর নবাবি উৎসব ছিল না, এটা নবাবি পরিচিতি প্রদান, ধর্মীয় উৎসব হয়ে দাঁড়াল। সে সময় বেগম রুইসুন্নিসা, রোগেভোগা সন্তানের সুস্থতা কামনায় আলাদা করে তাঁর নিজস্ব বেরা উৎসব শুরু করেন (Das, S. and Pal, R., 1998, Hazarduarir Nabab: Sube Banglar Shesh Nazim)। এটা আর শুধুই সমুদ্রযাত্রার উৎসব রইল না, ধর্মীয় উতসবে পরিগণিত হল। ৪) এটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও চালিয়ে যেতে হয়েছেঃ স্টুয়ার্ট ঢাকায় দেখেছেন এবং ৫) বর্তমানে বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটিকে আয়োজনের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের মিলন উৎসব হিসেবে দেখছেন।

সপ্তদশ শতক থেকে বেরা উৎসব একটি লৌকিক আচার থেকে যাত্রা শুরু করে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পরিচয়ের উতসবে পরিবর্তিত হল। মুর্শিদাবাদ নয়, মুঘল বাংলার রাজধানী ঢাকায় এটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং পরে যখন মুর্শিদকুলিখাঁ এটিকে সাড়ম্বরে মুর্শিদাবাদের নিয়ে এলেন এটি তখন তার মণ্ডল, ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াল। তবে আজ বেরার জোর হল বাংলার ইসলামের সংশ্লেষী ভূমিকার প্রায় প্রতিনিধিত্ব করার। এবং ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর দুই বাংলার দুই সম্প্রদায়ের কাছে যে সব যৌথ প্রথা হারিয়ে গিয়েছিল, বেরা আয়োজনের মাধ্যমে সেগুলিকে ফিরিয়ে আনে জাত রাষ্ট্র বিকাশের একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। তবে এটা শুধু যৌথ বাংলার মানচিত্রের মধ্যে আটকে নেই তার আত্মার মধ্যে বিলীন হয়ে গয়েছে।
(পরেরটায় পুস্তক তালিকা দিয়ে শেষ হবে)

No comments: