Tuesday, November 21, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই২ - যোগেশ রাম মিশ্র

(এই পর্বে কোম্পানি দেওয়ানি থেকে সরকারে রূপান্তরের প্রক্রিয়া)

কোম্পানি রাজস্ব চাহিদা চূড়ান্ত করতে বাংলার পুরনো রাজনৈতিক সীমান্ত বদল হচ্ছিল। এলাকাগুলো ছোট করতে দেওয়া হল, যাতে একটিতে রাজস্ব আদায় গণ্ডগোল হলে যাতে সে ঘাটতি সরকারি ব্যবস্থাপনায় বড় প্রভাব না ফেলতে পারে। প্রত্যেকটি জমিদারি মোটামুটি যতটাসম্ভব এক টোপোগ্রাফিতে নিয়ে আসা হল। বিদ্রোহী জনগন আর জমিদারদের এক দিকে নিয়ে আসারও পরিকল্পনা ছকে নেওয়া হল। কয়েক হাজার বছর ধরে যে স্থানীয় স্বায়ত্ত্ব শাসন চলছিল এই সেটলমেন্ট পরিকল্পনায় তার অবসান ঘটল। বহু রাজা এর বিরোধিতা করলেন। অনেকের বিরোধিতা সেনা দিয়ে সামলাতে হল।

এই পরিকল্পনা কোম্পানির দীর্ঘকালীন ব্যবসার স্বার্থকে নিশ্চিত করল। নবাবী আমলে কোম্পানির ব্যবসায় যে বাধাবন্ধ ছিল সেগুলি হটে গেল। কোম্পানি শাসিত জমিতে বিনা বাধায় তার পতাকা তুলল। কোম্পানির পতাকাই হল বাংলা জোড়া অবাধ ব্যবসার ছাড়পত্র। মীরকাশিম বুঝছিলেন দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় তার অধিকার খর্ব করছে ব্রিটিশ, সেটা ক্লাইভকে চিঠি লিখেও জানালেন(all the English chiefs, with their Gomasthas and agents in every district, act as collectors, renters, Zemindars and Talukdars, and setting up the Company’s colours allow no power to my officers)। সৈয়দ গোলাম হুসেন খান সিয়ারে মুতক্ষরিণ(মানে আধুনিক কালের সংবাদ সমীক্ষা)এ অবাক বিষ্ময়ে লিখছেন, বাংলার সব ধরণের উন্মুক্ত ব্যবসা ব্রিটিশেরা দখল করে নিচ্ছে([O]f the various branches of trade heretofore open to all, none is free. They are all engrossed by the Company themselves or by the English in general; as these, whether they enjoy the Company’s service …or chance to be otherwise circumstanced, very seldom are without concerns in trade)। যখন্ম কলকাতার একটা এলাকা জাগির হিসেবে কোম্পানির কাউন্সিলকে দেওয়া হল, তারা হুগলির নদীতে পথ দেখানোর(pilotage) কর আর বন্দর কর বসিয়ে এই এলাকায় নিজেদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে।

১৭৭০ নাগাদ রাজস্ব আধিকারিক কোম্পানি, যে আসলে বাংলা সুবার দেওয়ান, সরকারের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে দিয়েছে। এই সার্বভৌমত্বের অধিকার পালনে পরের দিকে রাজা ইন্দ্রনারায়ণকে, কোম্পানির কাউন্সিল লোহা তৈরির কারখানা তৈরির অনুমতি দিলেও, ফারকুহরকে শুল্কছাড়া লোহা ব্যবসার অনুমতি দেয়। ঐতিহাসিকেরা দেখাচ্ছেন যদিও দেওয়ান সরকারে রূপান্তরিত হচ্ছে অতি দ্রুত, কিন্তু তার ফল মাটিতে কি হয়েছিল, তা খুব একটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো নেই। আমি পরের দিকে দেখাব, সে সময়ে যে কটা লোহা তৈরির কারখানা ছিল, তারা কোম্পানির দেওয়ানি ক্ষমতা স্বীকার করলেও, তাদের সরকারের ভূমিকার বিরোধিতা করেছে।

ঐতিহাসিকেরা দেখিয়েছেন, কিভাবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ব্যবসার দখলদারিতে ব্যবহৃত হয়েছে। কোম্পানির ব্যবসায় যতটা পারাযায় লাভ আর চূড়ান্ততমটুকু রাজস্ব আদায়ের উদ্যম এই তত্ত্ব প্রমান করে। মুঘল আমলে পণ্যে যে কর বসত তাতে জুড়েছিল আর আর চুঙ্গিকর(excise and income-tax)। এগুলিকে একাকীভাবে সায়ের বলা হত, যার আভিধানিক অর্থ variable revenue arising from moveable goods(The Index and Glossary to the Regulations, Vol. III (1832) Sayer সংজ্ঞা দিচ্ছে ‘Sayer. What moves. Variable imports, distinct from land-rent or revenue, consisting of customs, tolls, licenses, duties on merchandize, and taxes on houses, shops, bazaars)। অন্যান্য এলাকায় সায়ের চিলকে নামক পথ কর (transit duties - literally, 2-1/2 per cent or one in forty) জমিদারেরা বসাত। কখনো কখনো জমিদারেরা দস্তুর আর মাঙ্গন চাপানোয় এটা বাড়ত সাড়ে তিন শতাংশ পর্যন্ত।

দেওয়ানি পাওয়ার পরে দেশের সমস্ত পারম্পরিক আইনকানুন বাতিল করে দিয়ে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থকে বড় করে দেখতে চাইল কোম্পানি। কোম্পানি সায়েরকে স্বৈরিতান্ত্রিক আর নিপীড়নমূলক দাবি করলেও তারা তাদের আদায়ে সায়েরকে অন্তর্ভূক্ত করল। ১৭৮১-১৮০১ সময়ের ব্যতিক্রম বাদ দিলে নতুন করে বাংলার সমস্ত গুরুত্বপূর্ন শহরে inland duty তোলা হতে থাকল। সায়ের এখন আর জমিদারদের আদায়ের কর রইল না। যত ধরণের পণ্য চৌকি দিয়ে পার হতে হত, সেগুলিকে কোম্পানির কুঠিতে নিয়ে এসে তার মূল্যমান নির্ধারণ করত কোম্পানি আমলারা। কর দেওয়ার পর ব্যবসায়ীকে রোয়ান্না নামক একটা ছাড়পত্র দেওয়া হত, এবং তাত্ত্বিকভাবে সেই পণ্য কোম্পানির এলাকায় আর কোন কর না দিয়ে বহন করে নেওয়া যেত।
(চলবে)

No comments: