Tuesday, November 28, 2017

উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা - কৃষি সম্পদ থেকে অর্থ সম্পদ - লুঠ যাত্রার পরম্পরা - স্বামীনাথন থেকে নরেন্দ্র মোদি২

১৯৮৬ সালের দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘পদদলিত, কিন্তু হারি নি’ শীর্ষক রিচারিয়াজীর একটি সাক্ষাৎকার নেন ক্লদ আলভারেজ।
গোটা সাক্ষাতকারটি
ক্লদ আলভারেজঃ ধান বিষয়ে আপনার কাজ কিছু বলুন।
রিচারিয়াঃ যেখানে যখন কাজ করেছি, সেখানে যে ধান পেয়েছি তা সংগ্রহ করা আমার নেশা ছিল। তার বৈচিত্র আমায় মুগ্ধ করত। ধান আমার ভালবাসার বিষয়। যেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাকেই আমি নতুন ধান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতাম। ১৯৫৯ পর্যন্ত বিহারে এবং তার পরে কটকে এসে এইভাবে আমি প্রচুর ধানের প্রজাতি সংগ্রহ করি। এখানে আমি তাইওয়ানের ৬৭টা প্রজাতি নিয়ে কাজ শুরু করি। দেখলাম একটা দুটো স্তবকে বেঁটে ধান হচ্ছে। সেগুলি নিয়ে বেশ উতসাহিত হয়ে পড়ি। ৬৭টির মধ্যে দুটো বা তিনটে নিয়ে শুরু হল তাইচুং নেটিভ ১(টিএন১)এর জয় যাত্রা। আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে এটি দেখি। এগুলি নিয়ে মাঠেই গবেষণা শুরু করি। এর মধ্যে একটি দেখলাম রোগ আর পোকা থেকে বেঁচে যাচ্ছে।
ক্লঃ কিভাবে আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থা, কেন্দ্রিয় ধান্য গবেষণা সংস্থার এই কাজটি চুরি করল? কেননা আপনি সে সময় ধানে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থার নির্দেশক রবার্ট শ্যান্ডলার যখন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, তখনও তিনি একটাও ধান গাছ দেখেন নি।
রিঃ আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থা শুরু হয় ১৯৬২ সালে। শ্যান্ডলার কটকে আসতেন বৈজ্ঞানিক হিসেবে। আমি তাঁকে ঘুরিয়ে সব দেখাই। যখন তাঁকে আমি মাঠে নিয়ে বল্লাম, ‘এই প্রজাতিটা প্রতি একরে ৯০০০পাউণ্ড ফলন দেয়, এবং পোকাও লাগে না।’ এখানেই আমার ভুল হয়েছিল। আমি তাঁকে সব বিশদে না বললেই পারতাম। তার উত্তরে তিনি জানালেন এটি সাধনার ব্যাপার। আমি বললাম সেই কাজটি আমি করে ফেলেছি। তিনি সেই তথ্য টূকে নিলেন।
শ্যান্ডলার দিল্লি ফিরে গিয়ে কেন্দ্রিয় ধান্য গবেষণা সংস্থাকে আইআর৮ আর টিএন১ নিয়ে কাজ করতে বললেন। বললেন এই দুটি প্রজাতি ভারতে কৃষি বিপ্লব এনে দেবে।
সেই সময় আমি কৃষি ভবনে ধান কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। ড বি পি পাল আমাকে জানালেন দুপুরে খাওয়ার সময় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। রকফেলার ফাউন্ডেশনের ড কামিন্সও সেই বৈঠকে ছিলেন – যদিও তিনি সদস্য ছিলেন না। ড পাল আমার বললেন যদি কামিন্স আমাদের কথাবার্তায় থাকেন তাহলে কেমন হয়। ড পালের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, তিনি টিএন১কে আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থাকে দিচ্ছেন। তাঁরা সেটি নিয়ে ভারতে চাষ করাবেন। আমি বললাম ড পাল আপনি ভুল করছেন। এটি এখনও মাঠে যাবার জন্য তৈরি নয়। রোগ পোকার আক্রমণ থেকে এটি এখনও বাঁচবে না। আর প্রচুর ভাইরাস রয়েছে এতে। এর বীজ নিয়ে যদি আপনি চাষ করতে শুরু করেন, তাহলে জমিগুলোর ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে। আমি যে মাঠে চাষ করছি, তাতেও প্রচুর ভাইরাস দেখাতে পারি আপনাকে। তিনি বললেন কি আর করা যাবে – এটাকে ওরা বিমানে করে আমাদের উপহারস্বরূপ পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি জানালাম আমি এই সিদ্ধান্ত মানছি না। আমি এই ধান আমদানি করার বিরোধী।
ক্লঃ কিভাবে আপনার কাজে শ্যান্ডলার মাথা গলাতেন?
রিঃ আরেকবার তিনি সিআরআরাইএর ৩১১ প্রজাতিটি এনেছিলেন – এটিও রোগে ভর্তি আর পোকা লাগার সম্ভাবনা ছিল। আমার অনুমতি ছাড়াই তিনি এটি আমার কর্মচারীকে দেন। তখন আমরা সিআরআরাইতে সেমিনার করছি। ফিলিপিন্সের বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক আমার ডাকে এসেছিলেন। তিনি কর্মচারীদের নির্দেশ দেন এর একটি গোছা সিআরআরাইতে থাকবে অন্যটি কোর্ডিনেটেড রাইস রিসার্চ সেন্টার, হায়দ্রাবাদে যাবে।
সেদিন শ্যান্ডলার বিমানে করে ফিরে যাচ্ছেন। আমি তার সঙ্গে বিমানবন্দরে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করতে যাব। গাড়িতে উঠছি, আমার এক কর্মচারী এসে আমায় একটি প্যাকেট দিল; আর একটি দিল ড ফ্রিম্যানকে দেওয়ার জন্য, তিনিও শ্যান্ডলারের সঙ্গে বিমানে যাবেন। ড ফ্রিম্যান তখন হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রটির দায়িত্বে। তখন বুঝলাম, আমায় অন্ধকারে রেখে ভাইরাসে ভর্তি প্রজাতিটি আইআরারআই থেকে ভারতকে দেওয়া হল।
আমি তখন আমার অধস্তনকে বললাম সে একজন বিদেশীর হাত থেকে কি করে এটি নিয়ে ভাগ করল এবং দুজনের জন্য প্যাকেট করল? যাইহোক আমি প্রশ্ন করলাম সে কি এটির জন্য কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র নিয়েছে? কেননা আমরা এই শংসাপত্র ছাড়া কোনো জীবিত গাছ আমদানি করতে পারি না। সে বলল, না।
আমি বিমানবন্দরে গিয়ে শ্যান্ডলারকে বললাম আমার অজ্ঞাতে আপনি এরকম বহু প্রজাতি আমার কর্মচারী মার্ফত আমার কেন্দ্রে আর হায়দ্রাবাদে পাঠিয়েছেন। এইগুলির কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র আমি চাই। তিনি বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি আপনার দেশে ভাইরাস ছড়াতে এসেছি? আমি বললাম, আমি ভাইরাসের প্রশ্নটিই তুলিনি। আপনি তুলেছেন। আমি শুধু শংসাপত্র চেয়েছি। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী এই শংসাপত্র ছাড়া কোন গাছ গাছালি আমদানি করা যায় না। তাঁর কাছে কোন কিছু ছিল না। তিনি চলে গেলেন।
আমার কর্মচারী(এক বা দুজন)দের হাত করে ঘুষ দিয়ে আইআরারআই আমাদের থেকে বহু তথ্য চুরি করেছে যাতে তাঁরা ধান বিশ্বে এগিয়ে থাকতে পারে।
পরে শুনেছিলাম শ্যান্ডলার সরাসরি কৃষি মন্ত্রীকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন, আমি থাকলে তাঁরা ভারতে কাজ করবেন না। কৃষি মন্ত্রী ছিলেন সি সুব্রহ্মনিয়ম আমায় অবসর নিয়ে নির্দেশ দেন। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, পূর্বতন কৃষিসচিব শিবরামন ছিলেন আমার বন্ধু। তিনি মন্ত্রীকে বলেন, রিচারিয়া সিআরআরআই নিজের হাতে তৈরি করে গড়ে তুলেছেন। আমরা তাঁকে এখুনি অবসর নিতে বলতে পারি না। তাঁকে ভাল হয় সদ্য শুরু হওয়া রাইস ডেভেলাপমেন্ট কাউন্সিলে বদলি করা হোক।
শিবরমন আমায় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তার পিএকে বললাম। আমার সাক্কাতকারের সময় হল তার বাড়িতে সকাল সাড়ে ছটা থেকে সাতটা। পৌছলাম। চুপচাপ। একজন ঘর পরিষ্কার করছেন। তাঁকে বললাম মন্ত্রীমিহাশয়ের সঙ্গে আমি দেখা করব। তিনি ভেতরে গেলেন। আমি ঢুকলে মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘প্রথমে আপনি বলেছেন তাইচুং ভাল জাতের ধান। আজ আপনি বিরোধিতা করছেন? আমি বললাম, আমি একটি বিশেষ প্রজাতির একটির কথা বলেছিলাম। কিন্তু আপনি যদি বিদেশ থেকে বাছাবাছি না করে ডাঁই করে ধানের বীজ আনেন, তাহলে সেগুলি আমাদের দেশের ধানের প্রজাতিগুলি ধ্বংস করে দেবে। সেগুলিতে সেই ধানের ভাইরাস লাগবে আর পোকা খেয়ে ফেলবে। আমি যেটি তৈরি করেছি সেটি আলাদা। তিনি তখন আমায় বললেন, আমি কিছু জানি না, রফেলাররা যেগুলি পাঠিয়েছে সেগুলি আপনাকে নিতেই হবে। আমি বললাম আমি পারব না। আমি দোষের ভাগী হতে পারব না। কেউ যদি প্রশ্ন করে এই সংস্থার নির্দেশক এই প্রজাতিটি ভারতে এনেছিল – সেই দায় আমি নিতে পারব না।
ক্লঃ ডাঁই করে ধানের বীজ আনার সমস্যা কি ছিল?
রিঃ সেগুলি ভাইরাস আর পোকা মুক্ত হবে না। আপনি বিপুল পরিমান আমদানি করতেই পারেন – সেগুলি নির্দিষ্ট রাসায়নিকে প্রক্রিয়া করে নিতে হবে – দেখে নিতে হবে তাতে কোনও জীবানু, রোগ বা পোকা রয়েছে কি না। তাঁদের দাবি তাঁরা তা করেই পাঠায়। তবুও সেগুলিতে পোকা লাগার আশংকা থাকে। বিশেষ করে নতুন পরিবেশে এসে, নতুন রোগ, নতুন পোকা লাগার প্রচুর স্মভাবনা থেকেই যায়। ফলে সেই প্রজাতি চাষ করলে দেশে সেই রোগ, বা ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়ে দেশের প্রজাতিগুলো নষ্ট করে দিতে পারে। এরকম করেই টুংগ্রো ভাইরাস এদেশে এসেছিল।
ক্লঃ মানে, জেনেশুনে এমন কোন প্রজাতি এদেশে নিয়ে আসা যায় যাতে নির্দিষ্ট কোন ভাইরাস ধরতে পারে?
রিঃ টিএন১ আর আইআর৮ তাঁরা জেনেশুনেই এদেশে নিয়ে এসেছিল। তারাও তো ধান বিশেষজ্ঞ।
ক্লঃ আপনি যে তাইচুং প্রজাতি চাষ করেছিলেন, আর তাঁরা যেটি নিয়ে এসেছিল, এই দুটির মধ্যে পার্থক্ত কি ছিল?
রিঃ আমি যেটি বেছেছিলাম, সেটি ভাইরাস, পোকা আর রোগ প্রতিরোধক ছিল। যখন বীজ বিপুল পরিমানে আসে, সেগুলি সমমানের(হেটারোজিনিয়াস)হয় না। তার থেকে আমাকে বেছে নিতে হবে, কোনটা আমি চাইছি। এই রকম হাজারো তাইচুং গাছের মধ্যে কয়েকটা আমি বেছেছিলাম। সেগুলি চাষ করেছিলাম। আর আপনি যদি গোটা বস্তার বীজ একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করেন তাহলে ভাল খারাপ তো একসঙ্গে মিশে যাবে।
ক্লঃ তার মানে সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে এটির ভারতে আগমন।
রিঃ মোটামুটি এই সময়েই এসেছিল। আমিই প্রথম মানুষ যে আবিষ্কার করি, বিপুল পরিমানে বিদেশ থেকে আসা বীজ বেছে বেছে ব্যবহার না করলে, এবং এই বীজের সঙ্গে আসা ভাইরাস(যেমন টুংগ্রো বা ট্রানজিটরি) অবাধে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের দেশের উতপাদনের হারের ওপর প্রভাব ফেলবে। আজ দেশিয়(এক্সটিক) প্রজাতির মধ্যে বেঁটে গাছগুলি চাষ হচ্ছে।
ক্লঃ আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, যে দেশে ধান হয়ইনা বলা চলে, সেই দেশ আমাদের দেশের ধান গবেষণা আর কোটি কোটি জণগনের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করল।
রিঃ এইভাবেই তাঁরা জেতে। যদি সিআরআরআই কাজ করতে পারত, তাহলে কোটি কোটি ডলার ঢেলে আইআরআরআইএর তৈরি করার কোন মানে ছিল? তারা এমন একটি দেশের খোঁজ করছিল, যেখানে তাঁরা নিজের ইচ্ছে মত কৃষি গবেষণা নিয়ন্ত্রণ আর ইচ্ছে মত ধানের প্রজাতি চাষের কাজে ইন্ট্রোডিউস করতে পারবে। প্রথমে তাঁরা রকফেলার ফাউন্ডেশন ট্রাস্টকে কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্রকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যাতে তাঁরা সেটি বিলয় করে ভারতে আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। আমি তখন সদ্য কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্রতে যোগ দিয়েছি।
যখন এই বিষয়টা আমার কাছে এল, তখন আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম, যে ভারতে এরকম আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা অস্বাস্থ্যকর উদাহরণ হবে, কেননা, এতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমার প্রস্তাব ছিল কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ নিরপেক্ষ সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠুক, একে রকফেলারদের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। যতই হোক এটি একটি বেসরকারি সংস্থা। সে সময় ভারত সরকারেরও এই মত ছিল। এর পরে ১৯৬০ সাল নাগাদ এটি ম্যানিলায় নিয়ে যাওয়া হল। কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্র কিন্তু ভাল কাজ করছিল। দেশিয় প্রজাতিগুলি থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে সেগুলির উৎপাদন হার ৩০-৪০ শতাংশ বাড়ানোর কাজ করেছিলাম। আরও অন্যান্য কাজ করছিলাম - যেমন আইসোটপ দিয়ে ইত্যাদি।হঠাত আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। সমস্ত উদ্যম গিয়ে নিহিত হল উচ্চফলনশীল বীজ তৈরির কাজে – টিএন১ আর আইআর৮এর বেঁটে প্রজাতি ব্যবহার করে, যেগুলিতে বেশি বেশি সার লাগে। এগুলির সঙ্গে আমাদের দেশের নানান বীজ মিশিয়ে নতুন উচ্চ ফলনশীল বেঁটে ধান গাছের বীজ তৈরি করা হল। তার মেনে যদি আপনি এই দুই প্রজাতির জিন ব্যবহার না করছেন, তাহলে আপনি উচ্চফলনশীল ধান পাচ্ছেন না। আমরা ভুলে গেলাম এ ধরণের জিন আমাদের নিজেদের দেশের ধান গাছে রয়েছে।
আইসিএআর এই চাপে বেঁকে গেল। আমি কিন্তু আমার বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন রবার্ট শ্যান্ডলার। তাদের বক্তব্য ছিল আমাদের যে সব দেশি ধানের জার্মপ্লাজম ছিল তাতে বেঁটে প্রজাতির জিন ছিল না। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। আপনি এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ান তাহলে আপনার চাকরি বাঁচে, আর যদি বিরোধিতা করেন, তাহলে আইসিএআর আপনার পদাবনতি ঘটাবে, আপনার শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে দেবে। আমাকে সেটাই করেছিল।
ক্লঃ তাহলে তাঁরা আপনাকে অবসর নিইয়ে চাড়ল?
রিঃ ১৯৬৬তে আমাকে তিন মাসের নোটিশ দিল – যখন সিআরআরআই পুরোপুরি আইসিএআরএর অধীনে চলে গেল, ৩১ মার্চ ১৯৬৬। ১ জানুয়ারি আমায় নোটিশ ধরাল। যাতে আমি আইসিএআরএ যোগ দিতে না পারি। আমি যদিও আইসিএআরএ যোগদিতে ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল প্রবীণতার দিক থেকে আমার নির্দেশক হব।
আমি ওড়িশা হাইকোর্টে আইসিএআর আর কৃষি মন্ত্রকের বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিলাম। আমার উলিক বলল, এত তারাতাড়ি আমার মক্কেলকে কেন অবসর নোট বলছ? সে যদি আরও কয়েকমাস চাকরি করে সম্মাঞ্জনকভাবে অবসর নিতে পারে তাহলে তোমার আপত্তি কোথায়? তাঁদের কাছে উত্তর ছিল না। আমার একটি মামলায় সরকার দুটি পাখি মারতে চাইল – আমি যদি এই তারিখে অবসর নিই তাহলে তাঁদের লোক স্বামীনাথন নির্দেশক হয়ে বসে। আর আমায় যদি তাঁরা তাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে বিনা বাধায় তাঁদের ইচ্ছে মত উচ্চফলনশীল ধানগুলির চাষ তাঁরা শুরু করতে পারে।
দুবছর, তিনবছর, চার বছরেরো বেশি সময় চলে গেল। আমাকে কটক ছেড়ে যেতে হবে। কত দিন আআর আমি নির্দেশকের বাংলো আটকে বসে থাকব? তাঁরা আমার বিরুদ্ধে সমন জারি করবে। এক সময় দেখাগেল জলের লাইন কেটে দিয়েছে। আর কি কি হয়েছে তা না বলাই ভাল। আমার উকিল বললেন বাড়ি ফিরে যান। আমি ওনাকে বললাম, আপনি প্রধান বিচারপতিকে বলুন আমার বিচার দেরি হওয়ায় আমার ওপর কি মানসিক অত্যাচার হয়েছে। কোনো কোনো দিন আমি আদালতে গিয়ে ফিয়ে এসেছি।
আমি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম আমার কি করা উচিত? আমার সন্তানকেও মানুষ করতে হবে। তাঁরা বলল আমি যদি মামলা তুলে নিই তাহলে তাঁরা আমাকে ফাওতে যেতে দেবে। স্ত্রী বললেন, নিজে যা ভাল মনে কর করবে। তবে তোমায় একটা কথা বলি, তুমি যদি মামলা তুলে নাও জনগণ বলবে, রিচারিয়ার কোনো দুর্বলতা ছিল, ঘোটালা ছিল। তাই শেষে সে মামলা তুলে নিয়ে ফাওতে চলে গেল আমি তাঁর মতে মত দিলাম।
আমি স্ত্রীর কথা মত স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ধার করে কটকে গেলাম। উকিলকে তাঁর প্রাপ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করলাম। তিনি ভারিত সরকার আর আইসিএআরকে নোটিশ ধরালেন। তাঁরা এত দিন পরে উত্তর দিল। আমরা রিচারিয়াকে বিজ্ঞানী বলে মনেই করি না। তাই তাঁকে আইসিএআর থেকে অবসর নিতে বলেছি। তাঁরা রিচারয়াকে বিজ্ঞানী বলে মনে করেন না বলেই তাঁর আবেদনপত্র ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। আমি জিতলাম। তাঁরা আমায় যদি বিজ্ঞানী মনে নাই করে তাহলে তাঁরা আমায় তিন মাসের নোটিশ দিল কেন?
ফলে রায় কার্যকর করতে হবে। তাঁরা আমায় সিআরআরআইতে ডাকলেন।আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার কাগজপত্র তখন ভোপালে পাঠালেন সই করার জন্য – যাতে আমি নির্দেশক হিসেবে গিয়ে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি। আমি বললাম আমি এখন যোগ দেব না। আমার সব কাগজ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পদ্মনাভনকে বললাম, আমি এখানে একমাস কাজ করব। তাঁর পরে যে কেউ আমার থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারে। তিনি বললেন ঠিক আছে তাই হবে। পরের দিন যখন আমি ইন্সটিটিউটে গেলাম, আমার ঘরে দুটো তালা পড়েছে। আমার সব গবেষণাপত্র, আরও সব গুরুত্বপূর্ণ নথি পেলাম না। আজও সেগুলো পাই নি।
ক্লঃ মধ্যপ্রদেশ সরকার কবে আপনাকে বলল ধান্য গবেষণাগার স্থাপন করতে?
রিঃ ১৯৭১এ। আমি সরকারের কৃষি উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিই। রায়পুরে ধানের জার্মপ্লাজম ব্যাঙ্ক স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই নানান এলাকার বিশেষ করে বস্তারের অবুঝমাঢের পাওয়া ধানের তথ্য যোগ করলাম।
ক্লঃ কি করে এই দ্বিতীয় সংস্থাটিও বন্ধ হয়ে গেল? বিশ্বব্যাংকের আর স্বামীনাথনের ভূমিকা কি ছিল?
রিঃ স্বামীনাথনের আইআরআরআইএর কাজে খুব উতসাহ ছিল। তিনি তখন আইসিএআরএর সেক্রেটারি এবং ভাইস চেয়ারম্যান। ধান বিষয়ে দেশের যত গবেষণা, উদ্যম সব তাঁর হাতে ন্যস্ত ছিল। তাঁরা সব ধানের প্রজাতি সংগ্রহ করে চাইছিলেন আইসিএআরএর এবং কটকের সিআরআরআইএর মাধ্যমে। সিআরআরআই তখন আইসিএআরএর অধীন। তাঁরা আমার কাছে এলেন। আমি বললাম কাগজ না দেখে আমি কোনো মন্তব্য করব না। যে কাজগুলি হয়েছে সেগুলি বিষয়ে মন্তব্য করতে হবে। যা আমি জানি না সেগুলি কি করে অনুমোদন দেব? আইসিএআরএর দুতিনজন আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁরা আমার মন বুঝতে চাইলেন। বললেন আমাদের কাগজের বদলে ওরা কি কিছু কাগজ দেবেন? আইআরআরআইএর প্রতিনিধিরা বললেন তাঁরা আমার আর ওদের গবেষণার কাগজ অদল বদল করতে চাইলেন। আমি স্পষ্ট করে দিলাম, ওদের গবেষণায় আমার রুচি নেই। কেননা সেই প্রজাতিগুলি ভাইরাস দূষিত হয়ে রয়েছে। আর আ্মারটি মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের ধান্য অঞ্চলের উপাত্ত থেকে তৈরি।
ক্লঃ আইসিএআরএর প্রধান(স্বামীনাথন)কি এর পিছনে ছিলেন?
রিঃ তিনিইতো নাটেরগুরু। তিনিই ঠিক করতেন কি কি কত কত প্রজাতি সিআরআরআইতে থাকবে, কি কি দিল্লিতে যাবে সেখান থেকে আইআরআরআইতে যাবে। তাঁর হাতেই তো অসীম ক্ষমতা। আর তিনি তো সরকারের সচিব আর আইসিএআরএর নির্দেশক। তাঁর হাতেই ভারতের খাদ্য তথ্যের সব কিছু রয়েছে। সব উপাত্ত রয়েছে। সেই সব তথ্যের ওপর বসে তিনি ভারতের খাদ্য নীতি তৈরি করলেন। তিনি আমাদের ধানের সমস্ত সম্পদের তথ্য জানতেন।
ক্লঃ ফলে আপনার নতুন সংস্থাকে বন্ধ করে দেওয়া হল?
রিঃ আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের প্রস্তাব বাতিল করি নি। আমি বললাম আগে আমি যে সব সংগ্রহ করেছি, সেগুলি বিষয়ে পড়াশোনা, গবেষণা করি, তাঁর পর জানাব। তাঁদের কিছু বেঁটে জাতের গাছও দিলাম। আমি আইআরআরআইএর বিজ্ঞানীদের বললাম, আমার গবেষণা আর সংগৃহীত প্রজাতি যদি দক্ষিণপূর্ব এশিয় দেশগুলির উন্নতিতে সাহায্য করে, তাহলে আমি এই কাজ করতে এক পায়ে খাড়া – তবে আমার কিছু শর্ত রয়েছে, আমার থেকে নেওয়া প্রজাতিগুলির ওপর আপনারা যে কাজ করবেন, সেগুলির একটা করে সমীক্ষা আমাকে পাঠাতে হবে, বিশেষ করে বেঁটে জাতের প্রজাতি যেগুলি আমি আপনাদের উপহার দিলাম। তাঁরা তা নিয়ে গেল কিন্তু আমায় কোন সমীক্ষাপত্র পাঠায় নি।
আমি সারাজীবন লড়াই করে একটা কথা বলে গিয়েছি, যে দেশে ধান চাষের উদ্গাতা, সে দেশে প্রচুর উন্নতমানের ধানের প্রজাতি রয়েছে। তাঁরা আমার তত্ত্বে সহমত পোষণ করেছেন। তাঁদের লেখা পত্রে মধ্যপ্রদেশে ধান গবেষণা সংস্থায় আমি যে সব কাজ করেছি, সেগুলি উল্লেখ করেছেন। তাই তাঁরা চেষ্টা করেছেন আমার সংগৃহীত প্রজাতিগুলি হাতানোর। মাঝে মধ্যেই তাঁরা রায়পুরে আসতেন। আমার গোপন করার কিছুই ছিল না। তাঁদের ধারণা ছিল আমাকে তাঁরা যে শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে আমার শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে।
ফলে তাঁরা ধারণা করেছিলেন আমাকে ওরা যা বলবেন আমি তাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব। কিন্তু দেখলেন উল্টোটা হচ্ছে। আমি যে সংস্থায় কাজ করতাম সেটিকে তাঁরা অর্থ সাহায্য করেন নি। সেটি একটি রাজ্য সরকারি সংস্থা। যেটি আমার খাটাখাটনিতে, দীর্ঘ পরিশ্রমে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, সেই বলে বেড়ে উঠেছে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি এই বিষয়ে একমত হব, তবে আমায় গবেষণা শেষ হলে তবেই। তাঁরা বুঝলেন আমায় নোয়ানো যাবে না। তাঁরা জানতেন আমাদের কাছে যে সব প্রজাতি রয়েছে সেগুলি নিতে পারলে কেল্লা ফতে করতে পারবেন। তবে আমি যেটি ওদের দিয়েছিলাম, সেটি ওদের এই প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদদের হাতে রয়েছে।
তাঁরা একটি ছক কষলেন। আমার ধারণা সরকারি প্রক্রিয়ার এরকম পরিকল্পনা সাধারণত হয় না। তাঁরা আমায় বললেন আমাদের ৪ কোটি টাকা দেবেন(অবশ্যই মাঝের কোন এক দালালের হাত দিয়ে, এক্ষেত্রে এটি হল বিশ্ব ব্যাঙ্ক) ধান গবেষণার জন্য – তবে যেহেতু দু জায়গায় এই ধরণের গবেষণা হচ্ছে, তাই মধ্যপ্রদেশের সংস্থাটিকে এই গবেষণা বন্ধ করতে হবে। তাঁদের উদ্দেশ্য আমাদের সংগ্রহ করা যত জার্মপ্লাজম রয়েছে সেগুলি হাতিয়ে নেওয়া, আর সেগুলি বেঁটে প্রজাতি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা, যাতে দেশে রাসায়নিক সারের কোম্পানিগুলির বাজার বাড়ে।
তাঁদের বিশ্বাস ছিল আমি যদি গবেষণা চালিয়ে যাই তাহলে আমি তাহলে আমাদের দেশের নিজস্ব উন্নত মানের উচ্চফলনশীল ধান বাজারে নিয়ে আসব। সেই চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। তাঁরা আমাকে বঞ্চনা করে আমার গবেষণার কাজকে নষ্ট করে আমায় অসহায় করে দিলেন। আর তাঁর পরে সারা দেশে খুব খারাপ প্রজাতির ধান ছড়িয়ে দিয়ে দেশের ধানের উৎপাদন কমিয়ে দিলেন।
ক্লঃ রিচারিয়াজী, আজ কি ভারতের ধান উৎপাদন বাড়ানোর কোন মান্য পদ্ধতি অবশিষ্ট আছে? আপনি আদিবাসীদের কাজ তাঁদের পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছেন। আপনার তৈরি করা মানুষদের কি একই ধারণা?
রিঃ I had proposed that hybrid vigour exploitation is possible in India, by utilising vegetative propagation technology which constituted a direct challenge to the dwarf plant type technology concept. । কিন্তু আজ ধান বিজ্ঞানীদের সমস্ত পরিশ্রম ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এই ভুল কাজে। উচ্চফলনশীল বেঁটে প্রজাতি মোটেই ভাল প্রজাতি নয়। এটি প্রমাণিতই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কর্তাদের অঙ্গুলি হেলনে আজও সেই কাজ হয়ে চলেছে।
তাহলে? আমি মনে করি, আজ ভারতের প্ল্যান্ট ব্রিডার্সরা নিজেদের মত করে কাজ করুণ, নিজেদের পদ্ধতি নিজেরা উদ্ভাবন করুক, যাতে আইআরআরআইকে নতুন রণকৌশল গ্রহণ করতে হয়, বিশেষ করে যে রাস্তায় আমি হেঁটেছি। ফলে আইআরআরআই বাধ্য হবে ভারতীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসতে। তাঁরা আমায় মেল স্টেরাইল পদ্ধতিতে কাজ করতে বলেছিল। চিন এই পদ্ধতিতে এগিয়েছে। এই কাজ করা খুব সহজ নয়। সময় এবং ভাল প্রজাতির প্রয়োজন – তবুও সাফল্য নাও আসতে পারে। আর এই পদ্ধতিতে বাসমতির মত চালের একই ধরণের গন্ধ আর একই সঙ্গে চরম উতপাদনশীলতার হার ধরে রাখা খুব মুশকিল। বাসমতিকে এই পদ্ধতিতে বিকাশ করা যেতে পারে। হয়ত নয়। কিন্তু আইআরআরআই চাইছে তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্দতি নিয়ে, বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের পদ্ধতি জলাঞ্জলি দিক। আমি বলি why don’t you exploit the hybrid vigour through clonal propagation which insures the economic production of crossed seeds from F1 plans for full normal crop from the F2 population (hybrid vigour persists in later generations also).।
আজ আমরা চিনের ধান আমদানি করছি। সেই টিএন১ আর আইআর৮এর পুরোনো ভুল ঘটে চলেছে। আমার ধারণা ভারতীয় পরিবেশে এই বিদেশী প্রজাতিগুলি সম্পুর্ণ কাজ দেবে কি না। আজো আমাদের নিজস্ব ধান প্রজাতি না নিয়ে আমরা সেই পুরোনো ভুলের চির্বিতচর্বণ করে চলেছি। আমার প্রশ্ন, কবে আর একে গুরুত্ব দিয়ে ভাবব?

No comments: