Friday, March 30, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩২ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

তিনি বললেন ইওরোপিয়দের, উচ্চচাকুরে ভারতীয়দের সামাজিক প্রথা ও মৌখিক আলাপচারিতার চরিত্র সম্বন্ধে গভীরভাবে জানতে বুঝতে হবে। বিপরীতে কোন ভারতীয় অধস্তন যদি কোন ইওরোপিয়, এমন কি দেশিয় উচ্চপদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে বা খারাপ কথা বলে, তাহলে তাদের কোনোভাবেই ছেড়ে কথা বলা যাবে না। ভারতে বসবাসকারী অধিকাংশ ইওরোপিয়র মতই গিলক্রিস্টও পা ঢাকার নানান ইঙ্গিতময় পরিধেয় আর প্রথা আবশ্যিক জানার বিষয়ে তার ছাত্রদের বলেছেন। তিনি লিখছেন, ইওরোপিয়রা মাথার আবরণ খুলে সম্মান জানায়, সেখানে মন্দির মসজিদে পুজো আর সম্মান জানাতে বা বাড়িতে বা দপ্তরে ঢুকতে ভারতীয়রা পায়ের জুতো খোলে। তবুও তিনি লিখছেন, ইন্ট্রুড অন দ্য ব্রিটিশ ইনহ্যাবিট্যান্টস অব ক্যালকাটা এন্ড এনভায়রনস, উইদাউট দ্য স্লাইটেস্ট আটেনশন টু দিজ এক্ট অব পোলাইটনেস, মোস্ট ক্রুপুলাসলি অবজার্ভড অলমোস্ট দেমসেলভস, এজ ইফ দে ওয়ার ডিটারমাইনড টু ট্রামপ্ল আস আন্ডার দ্য প্রাইড অব কাস্ট, বাই এভিন্সিং, দ্যাট টু আ হিন্দু অর মুসলমান এলোন, ইট ওয়াজ নেসেসারি টু পে দ্য কমন মার্কস অব সিভিলিটি অর রেস্পেক্ট।
ইওরোপিয়দের বাড়িতে ভারতীয়দের জুতো পরে বিচরণকে দেখা হল বৃহত্তর ভারতীয় জনসমষ্টির পক্ষে ইওরপিয়দের সমকক্ষ বা উচ্চশ্রেণীর হওয়ার বাসনা হিসেবে, শুধু ইওরোপিয়দের সম্বন্ধ সূত্রে নয়, অনান্য ভারতীয়দের তুলনাতেও, যেন জুতো পরে ইওরোপিয়দের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা।
ভারতীয় ভাষাগুলির শালীন আকারের ক্রমবিভক্ত ব্যকরণ ব্যবস্থা, এবং বিভিন্ন ধাপের পরিচিতি আর সম্মানের ব্যবস্থা, ইওরোপিয়দের কাছে অসম্মান বলে মনে হতে লাগল। ভারতে আসা অসতর্ক(আনউইটিং) ইওরোপিয়দের সম্বোধনে ভৃত্যরা সাধারণত একবাচনিক বিশেষণ ব্যবহার করত ...ইট ইজ র‍্যাদার সারপ্রাইজিং দ্যাট সার্ভ্যান্টস এন্ড সিপাহিজ ইটিসি, শুড বি এলাউড টু টেক সাচ এডভান্টেজ অব মাস্টার্স ইগ্নোর‍্যান্স অব দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কাস্টমস অব দ্য কান্ট্রি, এস টু ‘তু’ এন্ড ‘তেরা’ দেম অন এভ্রি অকেশনস; আ লিবার্টি দে ডেয়ার নট টেক উইথ ওয়ান এনাদার। ভৃত্যরা সাহেবদের যে অসম্মানসূচক সম্বোধন করে সেটা যে শুধু ব্যক্তিগত অসম্মানই নয়, এতে দেশেরও সম্মান হানি হয়। গিলক্রিস্টের বক্তব্য ছিল, দেশিয় ভাষা আর প্রথার প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ শুধু যে সাহেবদের সম্মান আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট তো বটেই, একই সঙ্গে সাহেবের পক্ষে অবাঞ্ছিত অবস্থাও এড়ানোর চেষ্টা হতে পারত।

গিলক্রিস্ট নির্দেশিত ব্রিটিশদের ভারতীয়(মূলতঃ হিন্দুস্থানী) ভাষা শিক্ষার যে নিদান দিয়েছেন প্রথমতঃ তা কতটা ভালভাবে তারা করতে পেরেছে, দ্বিতীয়তঃ গিলক্রিস্ট সে মাপদণ্ডটা তৈরি করে গিয়েছেন তা কতটা স্থায়ী হয়েছে? সেই শতকের মধ্যপথ পর্যন্ত অভিযোগ উঠছিল, ব্রিটিশেরা হিন্দুস্থানী বা সাধারণত যাকে উর্দু বলে, সেটি ভালভাবে শিখছে না। এফ জে শোর, যাকে মনে করা হয় ভারতীয়দের বন্ধুভাবাপন্ন এবং ভারত আর ভারতবাসী সম্বন্ধে কোম্পানি আর তাদের আমলাদের নীতিসমূহের বিরোধী, তিনি বেশ কয়েক বছর ভারতে চাকরি করা বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট আর সেনা আধিকারিকদের হিন্দুস্থানী শিক্ষার মান আর জ্ঞান নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। ফরাসী আর ইটালিয়রা যেভাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলে, তেমনি তার স্বদেশিয়দের ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দুস্থানী জানা নিয়েও ঠাট্টা মস্করা করেছেন। তার মনে হয়েছে, ইওরোপিয়দের এই ভাষাটি সঠিকভাবে না বলতে পারায় ইওরোপিয়দের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতীয়রা রীতিনীতি বহির্ভূত আচরণ করছে। তিনি একটি কাল্পনিক ঘটনা আলোচনা করেছেন – দুতিনজন ব্রিটিশ শিকারে বেরোল এদের মধ্যে একজন ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দুস্থানী বলতে পারে, একজন ভারতীয়কে সে শিকার সম্বন্ধে কোন এক প্রশ্ন করল, দেশিয় ব্যক্তিটি আগ্রহহীনভাবে উত্তর দিল, তার কাজ বন্ধ না করেই; অনেক সময় তার মুখের দিকে না তাকিয়েই, অসম্মান্সূচকভাবেই। আরেকজন যিনি ভালকরে দেশিয় ভাষায় কথা বলতে পারেন, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মান দিয়ে ভাষাটি বললেন একজন চাষীর সঙ্গে, তাতে চাষীটি সম্মান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার কাজ বন্ধ করে, সালাম দিল, এবং সব থেকে সাম্মানসূচক ভাষায় তার উত্তরটি প্রদান করল। কেন দুজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারটা আলাদা হল, আমি যদি কোন একজন ভারতীয়কে এই প্রশ্নটা করি তাহলে হয়ত উত্তরটা হবে, দুজন ভদ্রলোক? আপনি প্রথমজনকে ভদ্রলোক আখ্যা দিচ্ছেন? যদি তাই হয়, তাহলে তিনি কেন আমার মত সহজভাবে কথা বলতে পারেন না? দ্বিতীয়জন অবশ্যই ভদ্রলোক। আমি শপথ নিয়ে বলতে পারি একথা।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

গিলক্রিস্টের ভাষার ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া থেকে সাম্রাজ্যের পক্ষে ভারতীয়দের চরিত্র বিশ্লেষণ ঘটে গেল এবং তাদের কিভাবে দাবিয়ে রাখতে হবে সেটাও স্থির হয়ে গেল। এই মনোভাবের চমৎকার বিশ্লেষণ পাই লেফটান্যান্ট কর্নেল জন ব্রিগসএর লেটার্স এড্রেসড টু আ ইয়ং পার্সনস ইন ইন্ডিয়ায়। এই বইটিতে যেন তার দুই পুত্রকে – বড়টি সেনাবাহিনীতে আর ছোটটি প্রশাসনিক সেবায় থাকা – চিঠি লিখছেন ভারতে কোম্পানির চাকরি করা এক প্রবীন পিতা। প্রশাসনিক সেবায় কি ধরণের ব্যবহার করতে হয় তার বিশদ বিবরণ বইতে তুলে ধরেছেন ব্রিগস। বেশ কিছু বছর ভারতে থাকা বড় ছেলেটি বহু ভুল করেছে। ছোটটি কে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন সেই ভুলগুলি সঠিকভাবে এড়িয়ে যেতে। বড়টি দেশিয় ভাষা শেখে নি, ধারে গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে, ভুল রকমের চাকর নির্বাচন করেছে, চাকরকে নিয়মিত মারে এবং গালি দেয় ইত্যাদি - সাধারণভাবে যা ঠিক করার ছিল সে সব কিছু না করে সব ওলটপালট করে ফেলে। ছোট্টটির কাছে চিঠি লিখে বাবা জানান যে বড়টির ব্যর্থতা থেকে নিরন্তর শিখতে হবে কিভাবে নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানো যায়, সব থেকে বড় কথা যেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত না নড়ে সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। ব্রিগস তার যুবা পাঠককে যা বলছেন, ঠিক সেই কথাই মেজর জেনারেল স্যর জন ম্যালকম বলছেন ব্রিগসের ভাষায় – অলমোস্ট অল হু ফ্রম নলেজ এন্ড এক্সপিরিয়েন্স, হ্যাভ বিন ক্যাপেবল অব ফরমিং এনি জাজমেন্ট আপন কোশ্চান, আর আগ্রিড দ্যাট আওয়ার পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া রেস্টস অন দ্য জেনারেল ওপিনিয়ান অব দ্য নেটিভস অব আওয়ার কম্পারেটিভ সুপিরিওরিটি ইন গুড ফেইথ, উইসডম, এন্ড স্ট্রেংন্থ, টু দেয়ার ওউন রুলারস। দি ইম্পরট্যান্ট ইম্প্রেশন উইল বি ইম্প্রুভ বাই দ্য কন্সিডারেশন উই শো টু দেয়ার হ্যাবিটস, ইন্সটিটিউসন্স এন্ড রেলিজিয়ন – বাই দ্য মডারেশন, টেম্পার এন্ড কাইন্ডনেস, উইথ হুইচ উই কন্ডাক্ট আওয়ারসেলভস টুওয়ার্ডস দেম; এন্ড ইনজিওর্ড বাই এভ্রি এক্ট দ্যাট অফেন্ডস দেয়ার বিলিফ অর সুপারস্টিসন, দ্যাট শোজ ডিসরিগার্ড অব নেগলেক্ট অব ইন্ডিভিজুয়ালস অর কমিউনিটিজ, অর দ্যাট এভিনসেস আওয়ার হ্যাভিং, উইথ দ্য এরোগ্যান্স অব কনকারারস, ফরগটন, দোজ ম্যাক্সিমস বাই হুইচ দিস গ্রেট এম্পায়ার হ্যাজ বিন এস্টাব্লিশড, এন্ড বাই হুইচ আলোন ইট ক্যান বি প্রিজার্ভড।
ম্যালকমের নির্দেশ অনুযায়ী জ্ঞান আর সহানুভূতি অর্জিত হবে জনগণের বোলি শেখার মাধ্যমে – দ্য ভেইল হুইচ এক্সিস্টস বিটুইন আস এন্ড দ্য নেটিভস ক্যান অনলি বি রিমুভড বাই মিউচুয়াল এন্ড কাইন্ড ইন্টারকোর্স, লিখলেন ম্যালকম। অবশ্যই সহানুভূতিপূর্ণ আদানপ্রদান প্রয়োজন ছিল নেটিভদের সঙ্গে আলোচনায়, কিন্তু ব্রিগদের নিদানে, বোলি শেখার প্রয়োজন ছিল কেননা ভাষা না জানলে তথ্য জোগাড় করা যায় না। কারণ ভারতীয় ভাষাগুলির শেখার দক্ষতায় শাসিত দেশের যে ভারতীয় অনুগত(ডোসাইল), সহযোগী (কোয়াপারেটিভ), এবং সাহেবদের নির্দেশ মান্য করতে সদা তৎপর তাদের সমাজের আজব আজব প্রথা, আইন, এবং ভারতীয়দের আচার আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা জরুরি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে; ব্যতিক্রম যখন সাহেবের অজ্ঞতায় ভৃত্যের সংস্কারে আঘাত লাগায়। ভারতে যারা নতুন আসছে, তাদের হিন্দু আর মুসলমান – এই দুই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয় করয়ে দেওয়া হচ্ছে বইতেই। গিলক্রিস্ট তার পাঠকদের জানাচ্ছেন, মুসলমানেরা বড় চেহারার, দাড়িওয়ালা, আর হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী আর অকুতোভয়। কিভাবে চেহারা আর কাপড়চোপড়, পাগড়ি, কাপড় বাঁধা, চুল বাঁধার আঙ্গিক এবং সর্বোপরি তাদের নাম আর খাদ্যাভ্যাস থেকে তাদের আলাদা করা যাবে তাও বিশদে বলেছেন।

ব্রিগস আর ম্যালকমের চাকরি ছিল মধ্য আর পশ্চিম ভারত জুড়ে, তাই তাঁরা চাকরবাকরদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই উপদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে জ্ঞানী, রাজা, ধনী ব্যাঙ্কার, সওদাগর, এবং চাষীদের সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে তাও বলছেন – কিন্তু উলটো দিকে গিলক্রিস্টের ভারতীয় সমাজ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী বদ্ধ হয়েছিল নিচুশ্রেণীর চাকর আর গৃহভৃত্যদের মধ্যেই। বাংলাতে এসেই সব থেকে জ্ঞানী, সব থেকে উদারচিত্ত ইওরোপিয়ই বাঙ্গালি চাকরদের নির্বুদ্ধিতা, বিকৃতমনস্কতা এবং ক্ষুদ্রতা নিয়ে লিখে তাদের মারধোর করার নিদান দিয়েছেন। কিন্তু গিলক্রিস্ট বলছেন কি ভাবে এই সব অবস্থায় ইওরোপিয়দের চরিত্র বিচার হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন উচ্চবিত্তর বাড়িতে আমোদের নেমন্তন্নে গিয়ে গান-বাজানা, নাচা-গানা, এবং যদি নাটকের কোন অংশ ইওরোপিয় সূক্ষ্মতায় আঘাত লাগে, তাহলে ইওরোপিয়দের গলা তুলে ‘পশুসুলভ’ এই বিনোদন বিষয়ে প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকা উচিত। গিলক্রিস্ট বলছেন চুপ করে সেই সময় নিজেকে অকুস্থল থেকে সরিয়ে নিও যা তোমার বংশমর্যাদা আর উচ্চাভিমানের সঙ্গে মানানসই। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩০ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

কিন্তু আসল গন্ডগোল শুরু হয় যখন সাহেব গায়েগতরে খাটতে শুরু করেন। হাঁটার জন্যে বরাদ্দ মাত্র ২১টা বাক্যাংশ হল, উলটো দিকে ঘোড়ায় চড়া বা গাড়ি চড়া বা পালকিতে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ ১৩৪টা। মালিক যা ভুল করবেন তা সব শুধরোনোর দায় চাকরের। ভ্রমণের সময় যেন সাহেব সব কিছুই বড্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেন, বিশেষ করে সুরার পাত্র। কাজমকর্ম প্রায় ঢিলে ঢালা গোছের, যখন কাজ করার কথা তখন শোয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন গিলক্রিস্ট। তবে বিনোদনও আছে। চাকরকে স্থানীয় গ্রামে পাঠানো হয়, সেখানে কোন শিকার খেলার উপকরণ/উপাদান আছে কিনা খোঁজ করতে, কিন্তু সে গিয়ে দেখে সেই গ্রামে বিপুল সংখ্যায় বাঘের বাস, ফলে সব বিনোদনে ইতি। জমিদারকে নির্দেশ পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে শিকার খেলার বিনোদোনের জন্য হল্লা পার্টির ব্যবস্থা করুণ।
নির্দেশমূলক ভাষার চরিত্র শুধুই যে ব্যক্তিগত বা বাড়ির ব্যাপারস্যাপার ছিল এমন নয়, এটা রাষ্ট্রের ভাষাও বটে। ১৮০৮ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ১৬ জন সফল ছাত্রের পারিতোষিক বিতরণের অনুষ্ঠানে এসে ভারত শাসক মিন্টো ভারতীয়দের সঙ্গে কোন ভাষায় তারা কথা বলবে তার নির্দেশাবলী দিয়ে যান ...ইয়ু আর আবউট টু এমপ্লয়েড ইন দ্য এডমিনিস্ট্রেশন অব আ গ্রেট এন্ড এক্সটেন্সিভ কান্ট্রি ইন হুইচ ... দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ নট নোন। ইয়ু উইল হ্যাভ টু ডিল উইথ মালিটিচিউডস; হু ক্যান কমিউনিকেট উইথ ইউ, ক্যান রিসিভ ইয়োর কমান্ডস, অর রেন্ডার এন একাউন্ট অব দেয়ার পারফরমেন্স অব দেম; হুজ টেস্টিমনিজ ক্যান বি ডেলিভার্ড, হুজ এনগেজমেন্ট ক্যান বি কন্ট্রাক্টেড; হুজ এফেয়ার্স, অনলি ইন সাম ওয়ান অর এনাদারব দ্য ল্যাঙ্গুয়েজেস টট এট কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়াম।
এর সঙ্গে ব্রিটিশারদের (সাম্রাজ্যিক) সম্ভ্রম আর স্বসম্মানও জড়িয়েছিল সেটা আমরা বুঝতে পারি মিন্টোর বক্তৃতায় অথবা গত ষাট বছর ধরে কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের বা গভর্নর জেনারেলদের চিঠিতে বা কথাবার্তায় বা ভাষা শিক্ষকদের নির্দেশনামাগুলিতে। তারা বারংবার দোভাষীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানানোর এবং তাদের দুর্মতির কথা বলছেন। তিনি বলছেন শাসক যদি শাসিতের ভাষা সঠিকভাবে না জানে, তাহলে তাকে এমন অবস্থায় পড়তে হয় যেখানে তার অধস্তন এবং দেশি আধিকারিক কাজের স্থলে বিরক্তি উতপাদন করবে এবং তাদের ওপর অসীমভাবে নির্ভর করতে হবে। ইয়োরোপীয়রা যদি দেশিয় ভাষা না জানে তাহলে তাদের দেশিয় ভৃত্যদের কাছে দাসত্ব করতে হয়। নামী আধিকারিকদের সম্মান ধুলিতে গড়াগড়ি যাবে, সরকারের ক্ষতি হবে এবং আধিকারিক ব্যক্তিগতভাবে লজ্জায় পড়বেন এবং তার ধ্বংস অনিবার্য হবে।

ব্রিটিশারদের শুধু দেশিয় ভাষা বলার ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি ব্যকরণ জানলেই হবে না, কিন্তু সে যে ভাষা বলছে সেটি এমনভাবে বলতে হবে যাতে সে নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে প্রত্যেক সময় তার নিজের ইচ্ছার পরিতুষ্টি ঘটাতে পারে। যারা গিলক্রিস্টের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করবে, তারা ভারতে তাদের চাকরি জীবনে দেশিয় ভাষা শিখে দ্রুত উন্নতি ঘটাতে পারবে এবং দৈনিকভাবে দেশের নানা বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনও করতে পারবে। যারা ধ্রুপদী ভাষা শিখে দেশিয় ভাষা শেখার নিদান দিচ্ছিলেন, তাদের নস্যাৎ করে দিয়ে গিলক্রিস্ট বললেন, তাদের বৌদ্ধিক ক্ষমতার এবং সাধারণ জ্ঞানের অবনতি ঘটবে ‘ডিমিনিশিং দোজ ইন্টালেকচুয়াল পাওয়ারস, এন্ড দ্যাট কমন সেন্স হুইচ আর ফ্রিকোয়েন্টলি সাঙ্ক আন্ডার আ হেভি লোড অব শিয়ার পেডান্ট্রি এন্ড ক্যাসিক্যাল লোর, ভেরি ডিফারেন্ট ইন্ডিড ফ্রম রিয়্যাল সায়েন্স এন্ড প্রাক্টিক্যাল উইশডম’। গিলক্রিস্টের বাতচিত পড়ে এই সময়ের পাঠকের মনে হতে পারে তিনি এমন ব্রিটিশার তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যারা ভারতে শুধু নির্দেশই দেবে, কিভাবে সঠিক যোগ্য নির্দেশ দিতে হয় জানবে এবং কিভাবে দেশিয়দের যোগ্যতা অনুসারে সঠিক স্তরে রাখতে হয় তা শিখবে; টোবে বাস্তবিক ভাবে, ধ্রুপদী জ্ঞানের মাধ্যমে নয়। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৯ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

কেরির ‘ডায়ালগ’ শুরু হচ্ছে একজন খানসামা বা সরকারের সঙ্গে ইওরোপিয়র আলাপ দিয়ে। যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন সেটি ফারসি, বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণ। দৈনন্দিনের একটি গৃহস্থ বাড়ি চালাতে কি কি প্রয়োজন হয়, সেকথাই এই ‘ডায়ালগ’এ বলা হয়েছে। সাহেব শিখবেন কিভাবে আগোছালো ব্যবহার আর কাপড়জামার জন্যে চাকরের ওপর চোপা করতে হয়, ভ্রমনের সময় কি কি প্রয়োজন হয় গুছিয়ে দেওয়ার জন্যে, আর বাংলোতে কিভাবে বাগান করতে হয়। এছাড়াও নানান ধরণের ভারতীয়র(বলা দরকার ছিল বাঙালি) সঙ্গে যেমন শহুরে ভাষায় ব্রাহ্মণ বলে পুজোপার্বন আর পরিবার বিষয়ে, সেখানে সাহেব শেখে আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো আর ধর্মীয় আচার। নিম্নশ্রেণীর মানুষ যেমন জেলে, নিচুজাতের মহিলার সঙ্গে আলাপ আছে; যে ভাষা কেরির মতে যে ভাষা আক্ষরিকভাবে সঙ্গতিহীন। কেরি দায়িত্বপূর্ণ ও বিচক্ষণ বাঙ্গালিকে কাজে লাগিয়ে এই ‘ডায়ালগ’গুলি তৈরি করেন। শিশির কুমার দাসের মতে কেরিকে সহায়তা দেন যতদূর সম্ভব রাম রাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।
গিলক্রিস্ট তার প্রথম হিন্দুস্থানী আলাপ প্রকাশ করেন ১৭৯৮ সালে ওরিয়েন্টাল লিঙ্গুইস্টের পাতায়। এটি নতুন করে লেখা হয় ১৮০৯ এবং ১৮২০ সালে। ১৮০৯এর সংস্করণের ডায়ালগে তিনি যুবা ব্রিটিশকে শেখান কি করে আম ভারতীয়র সঙ্গে কথা বলতে হয়। তার প্রত্যেক ভারতীয় চরিত্রই চাকর। তিনি ইওরোপিয়কে শেখালেন কিভাবে দেশিয় মানুষকে নির্দেশ দেওয়া যায়। এই নির্দেশের বয়ানটাই শুরু হচ্ছে শুনো শব্দ দিয়ে। গিলক্রিস্টএর মতে এই শব্দটা চাকরকে সব সময় এক পায়ে খাড়া করে রাখবে। তাকে নির্দেশ দাও খুব সহজ ভাষায়, তাকে বলো না আমাকে একটি পেয়ালা দে, শুধু বল পেয়ালা। ইওরোপিয়কে অনুজ্ঞানসূচক বহুচন ব্যবহার করতে হবে আমরা অমুক অমুকটা চাই। তার নির্দেশ চাকরের সঙ্গে কোন খুচরো(ক্যাজুয়াল) আলাপ কোরো না কারন, দুর্বৃত্ত হিন্দুস্থানীরা যে কোন আবাল(ইনোসেন্ট) প্রশ্নকেও নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইওরোপিয় কর্তাকে কোন না কোন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে।
ডায়ালগে এই বিষয়গুলো আলোচনা আনে – খাওয়া এবং খাদ্য তৈরি(৩১ পাতা), ব্যক্তিগত সেবা যেমন কাপড়জামা পরা বভা বিছানা তৈরি করা(১৮ পাতা), কাছে আর দূরের ভ্রমন(৪৩ পাতা), খেলাধুলা আর বিনোদোন(২৭ পাতা), মেমসাহেবরা কি করে চাকরদের সঙ্গে ব্যবহার করবে(মাত্র ৭ পাতা), পড়াশোনা (১৪পাতা) ব্যবসায়িক কাজকর্ম(১৩ পাতা), চাকরকে সামান্য বকাঝকা এবং খিস্তিখেউড়(এবিউজিং) করা এবং খবর বার করা(১৩ পাতা), সময় এবং জলবায়ু(৫ পাতা), নরমভাবে জিজ্ঞাসা (২পাতা), স্বাস্থ্য, ওষুধ, স্থানীয় চিকিতসকের সঙ্গে আলাপালোচনা(৪০ পাতা – যতদূর সম্ভব এটি লিখতে গিয়ে গিলক্রিস্ট নিজের পুরোনো পেশা মনে পড়ছিল)। কথাবলার সুরটাই হল বাগাড়ম্বরপূর্ণতা – আমাকে ওটা এনে দে, সব সরিয়ে নিয়ে যা, সকালের খাবার তৈরি কর ইত্যাদি। গিলক্রিস্টের নিদান হোল সাহেবকে খুব তাড়াতাড়ি চাকরের সঙ্গে কড়া ভাবে কথা বলা শিখে নিতে হবে, রোজ সকালে আমি তোকে আমার খাবার টেবিলের সামনে দেখতে চাই নাহলে বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল অথবা, আমি তোকে ছাড়িয়ে দেব, বেয়াদব, অথবা ভাল চাস তো শুধরে যা নইলে আমি তোকে জেলে পাঠাব ইত্যাদি। খাওয়ার দেওয়ার ফেরিওয়ালাকে সব সময় তার খাদ্যর গুণাগুণ সম্বন্ধে কড়া কথা শুনিয়ে দিতে হবে। এখানে একটা বাক্য পেলাম যেখানে গিলক্রিস্ট তাকে বলতে বলছেন রুটিতে বালি আছে রে ব্যাটা। প্রত্যেকটা আলাপে চাকরদের ব্যর্থতা, ভুল কাজ আর মূঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে – চামচ ছাড়া স্যুপ দিয়েছিস কেন, খাওয়ারটা খুব বেশি গরম, ঠাণ্ডা, মোটা বা খুব পাতলা। চাকরকে বলতে হবে আগামি দিনে এই হিন্দুস্থানী খাবারটায় এত মশলা দিবি না, আমি শুধু কালোমরিচের স্বাদ চাই, বা মদটা ঠাণ্ডা নেই কেন?

Thursday, March 29, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৮ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞাও

তিনটি ভাষার ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারাটি গিলক্রিস্টের মতে প্রথমে হিন্দৌভি, তারপরে সংস্কৃত, সব শেষে হিন্দুস্থানী। সংস্কৃত স্বাভাবিক ভাষা নয়, সে হিন্দৌভির স্থান জোর করে দখল করে কপট বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে। যে যুক্তিতে গিলক্রিস্ট উপনীত হলেন সেটা হল, ঐতিহাসিকভাবে সংস্কৃত হিন্দৌভির পরে এসেছে; এর সঙ্গে তিনি ভাষার বিবর্তনের তত্ত্বকে মিলিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যদি সংস্কৃত অন্য দুটির আগের ভাষা হবে, তাহলে সেটি কেন (ইওরোপিয় দৃষ্টিতে) অনাবশ্যক জটিল বুননের হবে এবং কেন তার নামের সঙ্গে কৃত্রিম বা পালিশ করা বোঝাবে? তিনি বুঝি উঠতে পারছেন না, কিভাবে এত জটিল ভাষা অতীতের সভ্যতায় গড়ে উঠল। এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন, তার মতে ধূর্ত বৈয়াকরণিকেরা মানুষের মুখের ভাষাকে তুলে নিয়ে সেটিকে কৃত্রিমভাবে গড়ে তুলে বলছে এটা পুরনো ভাষা। মানুষের ভাষা থেকে তারা একটি জটিল রহস্যময়, কিন্তু পুজার জন্যে পুরোহিতদের হাতে তুলে দেওয়ার ভাষা তৈরি করে। পুরোহিতদের ভাষা একটি বিপুল চক্রান্তের অংশ যেখানে তারা সমাজে দুটি প্রভাব সৃষ্টি করল, প্রাথমিকভাবে হাল্কা নিপীড়নের এবং দ্বিতীয়ত অকথ্য সার্বজনীন ধর্মীয় আচার(ইনস্যাটিয়েবল ক্যাথলিক রেলিজিয়াস পারসুয়েশন) প্রচার। ভাষার সৃষ্টিকর্তা ব্রাহ্মণেরা তাদের জ্ঞানকে ব্যবহার করে ভারতের হিন্দু জনগণকে দাস করে রাখল। ব্রাহ্মণদের তিনি খলনায়ক পুরোহিত দাগিয়ে দিলেন এবং তাদের প্রণীত শিক্ষাকে বললেন উচ্চনাদী অসংলগ্ন এঁড়ে ব্রাহ্মণ নেকড়েদের আচরণ।
গিলক্রিস্ট বহু গণ্ডগোলের পরে তার শব্দার্থ প্রকাশ করেন। এর পরে লাগাতর ভারতীয় ভাষা বিষয়ে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ উভয় বোদ্ধাদের চরম সমালোচনা শুরু করে দিলেন, বিশেষ করে তাদের উদ্দেশ্যে যারা মনে করেন হিন্দুস্থানী শেখার জন্যে যে কোন একটি ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক। ১৭৯৯ সালে তিনি কলকাতায় কোম্পানির কর্মচারীদের ভাষা শিক্ষার জন্যে একটা ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্থাপনের পরিকল্পনা করলেন। সে সময় কোম্পানি করণিককে ৩০টাকা দিত একজন ফারসি ভাষা শেখার মুন্সি নিয়োগ করার জন্যে। গিলক্রিস্ট সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকে মুন্সির মাইনেটা খেয়ে নিজে বিদ্যালয় খুললেন। তার বক্তব্য মুন্সিদের দিয়ে ভাষা শিক্ষা অকার্যকর কারণ তারা ইংরেজি তো বলতেই পারে না আর তাছাড়া শিক্ষা দেওয়ার সরঞ্জামেরও বেশ অভাব রয়েছে। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর ওয়েলেসলি বিজ্ঞাপন দিয়ে বললেন, ১৮০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অফিস অব ট্রাস্ট এন্ড রেসপন্সিবিলিটিতে কোন আমলা নিযুক্ত হবে না, যদি সরকার মনে করে আইন আর প্রথা সম্বন্ধে তার যথেষ্ট জ্ঞান নেই ... এবং সেই দপ্তরগুলির কাজ করতে গেলে তার বেশ কয়েকটি ভাষায় দখল থাকা চাই।
১৮০০ সালে ওয়েলেসলির পরিকল্পনায় ফোর্ট উইলিয়ামে কলেজ স্থাপন হওয়ায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি উঠে গেল এবং নতুন কলেজে গিলক্রিস্ট হিন্দুস্থানী ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। গিলক্রিস্টএর তত্ত্বাবধানে একদল ভারতীয় বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত হল যাদের কাজ হল হিন্দুস্থানী বিষয়ে বৌদ্ধিক, শিক্ষাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক গবেষনা করে বেশ কিছু প্রকাশনা করা যার বলে আগামী দিনে ছাত্ররা হিন্দুস্থানী বিষয়ে পড়তে, বলতে এবং লিখতে পারবে। কলেজে ইওরোপিয় শিক্ষকদের মধ্যে দুটি দল তৈরি হয়ে গেল, একদল চাইল ধ্রুপদী ভাষা হোক দেশিয় ভাষা শিক্ষার বাহন, কেউ চাইল কোন ভাষা শেখার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে ভাষাটি গড়গড়িয়ে বলার চেষ্টায়, তত্ত্ব প্রয়োগ। গিলক্রিস্ট আর উইলিয়াম কেরি ছিলেন দ্বিতীয় দলে। দুজনেই আলাদা আলাদা ‘ডায়ালগ’ লিখলেন যাতে নতুন ছাত্ররা কথ্যভাষার স্বাদ পেতে পারে, একই সঙ্গে নতুন কাজে যোগ দিতে যাওয়া করণিকেরা ভারতীয় প্রথা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করতে পারে।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৭ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

হিন্দুস্থানির তিনটি বাচনিক স্তর-আঙ্গিকের কথা বলেছেন গিলক্রিস্ট – হাইকোর্ট ফারসি আঙ্গিক, মধ্যম বা জেনুইন হিন্দুস্থানি আঙ্গিক এবং অপকৃষ্ট(ভালগার) হিন্দৌভি।
প্রথম আঙ্গিকের উদাহরণ সৌদা, বালী, মীর দর্দ এবং অন্যান্য কবির কবিতায়। তিনি লিখলেন, এটি আড়ম্বরপূর্ণ এবং আঙ্গিক সর্বস্ব সাহিত্যিক এবং রাজনীতির ভাষা। এতে বিপুল আরবি আর ফারসির মিশেল রয়েছে। দ্বিতীয় স্তরের যে ভাষাকে তিনি আসল হিন্দুস্থানী বলতে চাইলেন, সেটি হল জনগণের ভাষা এবং এটি পাওয়া যায় মিস্কিনের এলিজিতে বা সৌদার ব্যঙ্গে আর যুদ্ধ সংক্রান্ত লেখালিখির অনুবাদে। তৃতীয়স্তরের অপকৃষ্ট হিন্দৌভিটির উদাহরণ হল ফস্টারের অনুদিত রেগুলেশনস অব গভর্ন্মমেন্ট... অধিকাংশ হিন্দুস্থানী লেখালিখি নাগরি লিপিতেই হয়ে থাকে, আর এই ভাষাটা বলে হিন্দু ঘরের নিম্নশ্রেণীর চাকবাকরেরা আর হিন্দুস্থানের চাষাভুষোরা।
গিলক্রিস্ট ভালভাবে জানতেন তিনি যে ভাষাটি নিয়ে আলোচনা করছেন তা ক্ষণস্থায়ী, আলোছায়ায় ভরা এবং অস্থিরতায় ভরা। তিনি মনে করছেন, তার কাজ আরও কঠিন করেদিয়েছিল হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যারা পেশাদারভাবে ভাষাকে ব্যবহার করতেন, তারা, এবং যাদের কাজে জ্ঞান মানেই অকারণ পণ্ডিতিপনা ... ইন আ আকন্ট্রি হয়ার পেদান্ট্রি ইজ এস্টিমড [এজ] দ্য টাচস্টোন অব লার্নিং, দ্য লার্নেড মুসলমান গ্লোরিজ ইন হিজ আরবিক এন্ড পার্সিয়ান ... দ্য হিন্দু ইজ নো লেস এতাচড টু স্যাংস্কৃট এন্ড হিন্দৌভি।
গিলক্রিস্ট বললেন ভাষার আঙ্গিক নির্নয় করা হবে তার ইতিহাস নির্মান করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানের আসার এবং ছেয়ে যাওয়ার আগে উত্তরভারত জুড়ে একটাই ভাষা ছিল তার নাম ব্রিজ ভাষা, একটি শুদ্ধ বোলি... ভারতীয় স্বপ্নজগতের ভাষা। তিনি বললেন এই ভাষাকে মুসলমানেরা নাম দিয়েছিল হিন্দৌভি, হিন্দুদের ভাষা। ভারতীয় ভাষার ইতিহাস রচনা করে গলক্রিস্ট হিন্দৌভির সঙ্গে ফরাসীদের আক্রমনের আগে স্যাকসন ভাষার রূপের তুলনা করলেন। স্যাক্সনের মতই হিন্দৌভি আরবি আর ফারসির তোড়ে ভেসে যায়। বারবার মুসলিম আক্রমনের পর হিন্দৌভি রূপান্তরিত হল নতুন ভাষা হিন্দুস্থানিতে। মুসলমানেরা এর নাম দল ওর্দুয়ি যা তাদের সেনাবাহিনীর ভাষা আর রেখতু হল তাদের কাব্য কবিতার ভাষা আর হিন্দি হয়ে উঠল হিন্দুদের দৈনন্দিনের ভাষা।
এই ভাষার একতা সামগ্রিক নাম দিলেন গিলক্রিস্ট, হিন্দুস্থানী, যা হিন্দুস্থানের ভৌগোলিক সূত্র। অষ্টাদশ শতকে দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশ, বলা ভাল বিন্ধ্যর ওপরে গোটা ভারতবর্ষকে বোঝাবে। হিন্দুস্থানী শব্দটা ব্যবহার করে গিলক্রিস্ট সে সময়ের হিন্দু আর মুসলমান উভয়ের কথ্যভাষাকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তবে তিনি হিন্দুদের ভাষাকে হিন্দৌভি নয় হিন্দিই বলার পক্ষপাতী ছিলেন।
গিলক্রিস্টের তত্ত্বে মৃত, পূন্য, হিন্দুদের রহস্যময় ভাষা সংস্কৃতর এই ভাষা ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা ছিল না। তার তত্ত্বে হিন্দৌভি থেকে সংস্কৃতের উতপত্তি এবং মুসলমানদের ভারতে আসার আগে এটিই জনগনের ভাষা ছিল। উত্তর ভারতের অন্যান্য যে সব ভাষা তিনি লক্ষ্য করেন, সেগুক্লি হল  বাংলা, রাজপুতি, পূর্বি (ভোজপুরী)। তিনি মনে করতেন এই ভাষাগুলি হিন্দুস্থানীর থেকে লেখ্য এবং কথিতভাবে যথেষ্ট ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। ভারতের অন্যান্য ভাষা সম্বন্ধে বললেন দক্ষিণী, দক্ষিণ ভারতে মুসলমানদের ভাষা, ওডিয়া, মারোয়াড়ি, গুজরাটি, তিলুঙ্গী(তেলুগু) আর কাশ্মীরী। তার বক্তব্য এগুলির হিন্দৌভি – ব্রিজ ভাষা বা ব্রিজ ভাখা থেকে জন্ম। তারমতে ভারতে ভাষাগুলি বহুল প্রজাতির প্রায় অন্তহীন তাদের সংখ্যা এবং প্রতিটির স্থানীয় নাম রয়েছে। দক্ষিণি আর পাঞ্জাবীকে তিনি হিন্দুস্থানীর উপভাষা(ভ্যারাইটি) আর বাঙ্গাল ভাষাকে হিন্দৌভির সরাসরি উপভাষা ভাবতেন।  

তাত্ত্বিকভাবে তিনি মনে করতেন ভারতে তিনটে বৃহৎ দেশিয় ভাষা আছে, যার মধ্যে দুটি বলা হয় মৌখিকভাবে – হিন্দুস্থানী আর হিন্দৌভি এবং তৃতীয়টা সংস্কৃত – যা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে মৃতভাষা, অতীতে হিন্দুরা বিজ্ঞান চর্চা এবং ধর্মীয় কাজ এর মাধ্যমে করতেন। বিভিন্ন রাজ্যে এই দুই চালু ভাষা নানান ধরণের উপভাষা তৈরি করেছে। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৬ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ব্রিটিশ ভাষা পরিকল্পনার কেন্দ্রে হিন্দুস্তানি

দুবছরের মধ্যে গিলক্রিস্ট সেনা বাহিনীয় কাজ ছেড়ে ফৈজাবাদে বাস করতে শুরু করে এবং এমন কাপড়চোপড় পরতে শুরু করে যাতে তাকে একজন দেশি মানুষের মত মনে হয়। তিনি কিছু প্রখ্যাত হিন্দুস্তানিকে (তিনি বলেছেন উত্তরভারতে হিন্দু মুসলমানকে এইনামেই সকলে ডাকত) নিয়ে তাদের শব্দকোষ আর ব্যকরণ রচনা করার কাজ শুরু করেন। তার সাথীরা তাকে তাদের কোন শব্দকোষ দিতে না পারায় তিনি মৌখিকভাবে বলিয়ে তাদের বিপুল শব্দভাণ্ডারের কিছু চেনা শব্দ দিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি তার মুন্সিকে বলেন a, ab, abab, abach এবং এইরকমের উচ্চারণ দিয়ে শুরু শব্দ জোগাড় করে তাকে দিতে। তিনি যে দল(সিলেবল) শুরু করলেন তাতে বিপুল শব্দের ভাণ্ডার তৈরি হল। এই পদ্ধতিটা তার পছন্দ হল না, তিনি জনসন্সের ইংলিশ ডিক্সনারির পথ ধরলেন। গিলক্রিস্ট একটি ইউংরেজি শব্দ বলতেন এবং তার সঙ্গীদের তাদের ভাষায় সেটির সব থেকে কাছের মানে ওয়ালা শব্দ খুঁজতে বলতেন।
তিনি খুব তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করলেন যে তার সাথীরা খুব সহজ, দৈনন্দিনের, পরিচিত শব্দ না বলে দূরের কোন দেশের যেমন পারস্যের কোন পাহাড়ের বা আরবের মরুভূমির শব্দ খুঁজছে। অন্য কেউ সংস্কৃত জটিল শব্দবন্ধের মধ্যে বাক্যের মানে খূঁজছে। এটায় গিলক্রিস্টের টিকা করতে অসুবিধে হল তাই নয়, তিনি বার বার প্রশ্ন করতে থাকলেন যে নিশ্চই তাদের ভাষার কোন ব্যকরণ বই থাকবে। তারা তার উত্তরে না বলল। শেষমেশ যা তৈরি হল তা যেন প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঠের শব্দাবলীর তালিকা।
তিনি তার সাথীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনলেন। অন্যান্য ঔপনিবেশিকদের মত তারও ধারনা জন্মাল যে শিক্ষিত দেশিয়রা ব্রিটিশদের বিপুল ভারতের জনগনের কাছে পৌঁছতে দেয় না। তিনি তাত্ত্বিকভাবে লিখছেন, দ্যাট ইট ইজ নট ইম্প্রোবাবল দ্যাট দ্য করবরেন্ট ক্রু অব দেওয়ানস, মুতসুদ্দিজ, সরকার্স, নাজিরস, পন্ডিতস, এন্ড আ ট্রিমেন্ডাস রোল কল অব হারপিস হু এনকম্পাসেস পাওয়ার হিয়ার সি উইথ জেলাস সলিটিউড এভরি এটেমটস ইন দেয়ার মাস্টার্স টু একয়ার দ্য মিনস অব ইমিডিয়েট কমিউনিকেশন উইথ দ্য গ্রেট মাস অব পিপল হু দোজ লকাস্টস অব দ্য ল্যান্ড কন্সিভ দেয়ার লফুল প্রে।

কিন্তু গিলক্রিস্টের পুর্বসূরীরা কেন হিন্দুস্তানিকে এমন অবহেলা করল। তিনি তার বইতে এই প্রশ্নের জটিল উত্তর খুঁজেছেন। তার মনে হয়েছে ব্রিটিশেরা এই ভাষাকে জার্গন দেগে দিয়েছিল। অধিকাংশ ইওরোপিয় যাকে মুর্স ভাষা বলত, তিনি তাকে হিন্দুস্তানি বললেন। মুর্স আজকের লব্জে পিজিন বা বিকৃত বাণিজ্যিক ভাষা। মুরকে গিলক্রিস্ট বললেন বারবারিয়ান গ্যাবল (হুইচ) এক্সিস্টস নোহয়ার এলস বাট এমং দ্য ড্রেগস অব আওয়ার সার্ভ্যান্টস, ইন দ্য শিপ স্ন্যাপ ডায়ালগস উইথ আস অনলি। ইভন দে উড নট ডিগ্রেড দেমসেলভস বাই চ্যাটারিং দ্য গিব্বারিশ অব দ্য স্যাভেজ হোয়াইল কনভার্সিং উইথ আড্রেসিং ইচ আদার ইন দ্য ক্যাপাসিটি অব হিউম্যান বিইংস।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৫ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ধ্রুপদী প্রকল্প এবং ভারতীয় অভদ্র ভাষাগুলির সংজ্ঞা
ব্রিটিশ ভাষা পরিকল্পনার কেন্দ্রে হিন্দুস্তানি

অষ্টাদশ শতকের আগে পর্যন্ত ভারতজুড়ে বিভিন্ন ধরণের যে সব ভাষা বলা হত সে সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান খুবই অল্প ছিল। পর্তুজিগ, জার্মান এবং ড্যানিশ ধর্মযাজকেরা এবং কোম্পানির ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ ডাচ আর ফরাসিরাও কোন না কোন ভাষার ব্যকরণ তৈরি করছিলেন। ব্রিটিশেরা এই দিকে নজরই দেয় নি। ব্রিটিশেরা যেভাবে ভারতীয় ভাষাগুলি বিশ্লেষণ করেছে তা হল মোটামুটি ওপরওপর এবং এককে অন্যের ঘাড়ে ফেলা এবং ভৌগোলিক আর ক্রিয়া ভিত্তিক। মালাবার এমন একটা ভাষা হিসেবে তারা চিহ্নিত করে যা মালাবারের এবং করমণ্ডল উভয় উপকূলের জেলেরা বলে এবং আজকের তামিলনাড়ুর ভাষা হয়ে ওঠে। জেন্টু বা তেলিঙ্গা অন্ধ্রের ভাষা কিন্তু দক্ষিণ ভারতের নানান এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সে, এবং দক্ষিণ ভারতের সেনাবাহিনীগুলির যুদ্ধ সমাজের ভাষা এটা। বানিয়ান এক সময় গুজরাটি ভাষা হিসেবে বলা হত, কিন্তু পশ্চিম উপকূলের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই গুজরাটি। কলকাতা, বম্বে এবং মাদ্রাজ বহুভাষিক বহুসামাজিক শহর। সপ্তদশ এবং অষ্টদশ শতাব্দের রাজনৈতিক ইতিহাস অনুসরণ করে ব্রিটিসরা মনে করত মারাঠি, ফারসি এবং মুর দক্ষিণ ভারতের ভাষা।
প্রাথমিকভাবে মুঘল দরবারে প্রবেশ করে ব্রিটিশেরা বুঝতে পারল সেখানে কোন ধরণের ভাষা চলে, এবং সেখানে ভারতের অন্যান্য প্রান্তে বলা ভাষার কেন্দ্রিয় গুরুত্বটুকু কত। টমাস রো’র সঙ্গে যাওয়া রেভারেন্ড টেরির ভাষায় দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব এম্পায়ার, আই মিন দ্য ভালগার, বিয়ার্স দ্য নেম অব ইট, এন্ড ইজ কলড ইন্দোস্তান; ইট হ্যাথ মাচ আফিনিটি উইথ দ্য পার্সিয়ান এন্ড আরাবিয়ান টাং... আ ল্যাঙ্গুয়েজ হুইচ ইজ ভেরি সিগ্নিফিক্যান্ট, এন্ড স্পিকস মাচ ইন আ ফিউ ওয়ার্ডস। ইট ইজ এক্সপ্রেসড বাই লেটার্স হুইচ আর ডিফারেন্ট দ্যান দোজ এলফাবেটস বাই হুইচ দ্য পারসিয়ান এন্ড আরাবিক টাং আর ফর্মড।
পরের দুশ বছর জুড়ে এই ভাষাটি বা তার অন্যান্য উপভাষা(ভ্যারিয়্যান্ট) বহুনামে পরিচিত হবে – মুর্স, ইন্দোস্তান, হিন্দুস্তানিক, হিন্ডোয়ি, নাগ্রিও এবং কুটা। মোটামুটি যে নামটা অধিকাংশের ব্যবহারে চালু হল সেটা হল মুর্স।
পলাশীর পরে পরেই, এমনকি ভাষার ব্যকরণ প্রকাশের আগেই, মূলত কোম্পানির সেনাবাহিনীর আধিকারিকদের মধ্যে ভাষা শিক্ষার জন্যে নানান ধরণের চিরকুট এবং পাণ্ডুলিপি আদানপ্রদান হত। এডওয়ার্ড হ্যাডলি প্রথম লন্ডনে মুর ভাষার ব্যকরণ প্রকাশ করেন মূলত কোম্পানির আধিকারিকদের জন্যে। এডওয়ার্ড ছিলেন বাংলা সেনাবাহিনীর আধিকারিক যিনি বললেন স্থানীয় সেনাদের থেকে শেখা ভাষা জ্ঞান ছাড়া তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা সম্ভব ছিল না। পূর্বের দেশের মুর ভাষার কোন ব্যকরণ ছিল না এই তত্ত্ব তিনি উড়িয়ে দেন। তিনি আরও বললেন এই ভাষার ক্রিয়াপদের সঙ্গে ফারসির ক্রিয়াপদের কোন মিল নেই; তার ধারনা অন্যকোন ভাষা থেকে, হয়ত উত্তর ভারতে আক্রমণকারী তাতারদের থেকে এই ভাষার ব্যকরণের সূত্রপাত। হ্যাডলির ব্যকরণ বহু মানুষ সম্পাদনা করেন এবং ১৮০৯ সাল পর্যন্ত সাতটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় যতক্ষণনা জন বর্থউইক গিলিক্রিস্টের আবির্ভাব হবে, যাকে মনে করা হয় ভারতের সরকারি ব্রিটিশ ভাষা হিন্দুস্থানির স্রষ্টা।

১৭৮২ সালে ২৩ বছর বয়সে এডিনবরা থেকে চিকিতসাবিদ্যা পড়ে গিলক্রিস্ট বম্বের উপকূলে পা দেন এসিস্ট্যান্ট সার্জেন হিসেবে, পরে তাকে বাংলা আর্মিতে বদলি করা হয়। ১৭৮২তে তিনি লেখেন, আই ইন্সট্যান্টলি ফোরসও দ্যাট মাই রেসিডেন্স, ইন এনি ক্যাপাসিটি, উড প্রুভ এজ আন প্লেজেন্ট টু মাইসেলফ, এন আনপ্রফিটেবল টু মাই এমপ্লয়ার, আন্টিল আই একোয়ার্ড এন এডিকোয়েট নলেজ অব দ্য কারেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য কান্ট্রি, ইন হুইচ আই ওয়াজ নাউ টু সরজঁ। আই দেয়ারফোর স্যাট রেজলিউটলি ডাউন টু একোয়ার হোয়াট ওয়াজ দেন টার্মড এজ মুর্স... ডিউরিং দ্য মার্চ উইথ দ্য বেঙ্গল ট্রুপস আন্ডার দ্য কমান্ড অব কর্নেল চার্লস মরগান ফ্রম সুরাট টু ফুটিগড়, আ হ্যাড ইনিউমারেবল ইন্সট্যানসেস ইন এভ্রি টাউন এন্ড ভিলেজ উই ভিজিটেড অব দ্য ইউনিভার্সাল কারেন্সি অব দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ আই হ্যাড বিন লার্নিং। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৪ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

ধ্রুপদী প্রকল্প এবং ভারতীয় অভদ্র ভাষাগুলির সংজ্ঞা
তিনি মনে করতেন, মূল হিন্দুস্থানী বোলি বলে সাধারণত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতীয়রা, এই ভাষা মূলত বাণিজ্য সহায়ক ভাষা। হ্যালহেড হিন্দুস্তানি আর বাংলার মধ্যে সাযুজ্য টেনেছেন, - হোয়াট দ্য পিওর হিন্দুস্তানিক ইজ টু আপার ইন্ডিয়া, দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ হুইচ আই হ্যাভ হিয়ার এন্ডেভারড টু এক্সপ্লেইন ইজ টু বেঙ্গল, ইন্টিমেটলি রিলেটেড টু দ্য স্যাংস্কৃট বোথ ইন এক্সপ্রেসনস, কন্সস্ট্রাকশনস এন্ড ক্যারেকটার। ইট ইস দ্য সোল চ্যানেল অব পারসোনাল এন্ড এপিস্টোলারি কমিউনিকেশন এমাং দ্য হিন্দুজ অব এভরি অকুপেশন এন্ড ট্রাইব। অল দেয়ার বিজনেসেস ইজ ট্রানজাকটেড, এন্ড অল দেয়ার একাউন্টস আর কেপ্ট ইন ইট, এন্ড দেয়ার সিস্টেম অব এডুকেশন ইস ইন জেনারেল ভেরি কনফাইন্ড, দেয়ার আর ফিউ এমং দেম হু ক্যান রাইট অর রিড এনি আদার ইডিয়ম; দ্য আনএডুকেটেড, অর এইট পারটস ইন টেন অব দ্য হোল নেশন আর নেসেসারিলি কনফাইন্ড টু দ্য ইউসেজ অব দেয়ার মাদার টাং।
জোনসের আগেই হ্যালহেড সংস্কৃতের সঙ্গে ল্যাটিন আর গ্রিকের সম্পর্ক নির্নয় করেছিলেন। সংস্কৃতর সঙ্গে ফারসি এবং আরবি এমনিকি ল্যাটিন আর গ্রিক শব্দের বিশেষ করে একদল(মনোসিলেবল) শব্দ আর সঙ্খ্যার মধ্যে মিল দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বললেন সারা হিন্দুস্তানে যে সব হিন্দুস্তানি বোলি বলা হয় প্রত্যেকটার উদ্ভব সংস্কৃত থেকে, ঠিক যেভাবে ফ্রান্স বা ইটালির বোলিগুলির উদ্ভব ল্যাটিন থেকে।
হ্যালহেড বললেন আরেক ধরণের হিন্দুস্তানী বোলি তৈরি করেছে মুসলিম আক্রমনকারীরা, যারা হিন্দুদের ভাষা বলতে পারত না; হিন্দুরা সংস্কৃতর মৌলিকত্ব আর নিজের বোলির চরিত্র বজায় রাখতে সংস্কৃতকে বিমূর্ত করে তোলে। মুসলিমেরা তাদের ভাষা থেকে প্রচুর দেশি(এক্সটিক) শব্দ ধার দিয়ে হিন্দুস্তানী ব্যকরণের তত্ত্বে প্রবেশ করিয়ে দেয়। হ্যালহেড এই ধরণের হিন্দুস্তানীর কম্পাউন্ড ইডিয়ম মুসলমান দরবারের হিন্দু বাংলায় বলা হয় বলে বললেন। ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য অতিশিক্ষিত হিন্দুরা যাদের উচ্চাশা নীতবোধকে আচ্ছন্ন করে নি, তারা শুদ্ধ হিন্দুস্থানী বলা এবং লেখা চালিয়ে যান এবং আরবি অক্ষর ধার না করে নাগরি অক্ষরে লিখতে থাকেন।
ব্রিটিশরা প্রাথমিকভাবে ভারতীয় ভাষাগুলি বিকাশ এবং তত্ত্ব বিষয়ে যে দিকে যেতে চাইছিল, হ্যালহেডের গ্রামার, সেই বিশেষ জ্ঞানের পথে যাত্রার সংক্ষিপ্ত এবং প্রাথমিক খসড়া। পরের ত্রিশ বছরে যা ঘটবে সেই পথাঙ্কন করে দিয়ে যান হ্যালহেড। ধ্রুপদী ভাষায় শিক্ষিত মানুষ হিসেবে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে একটা ঐক্যের নীতি খুঁজতে চেষ্টা করছিলেন তিনি, এটা পেলেন সংস্কৃতর মধ্যে, যা আদতে ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের পেটিকা। ব্রিটিশদের ভারতীয় ভাষা শিক্ষার কারণ হল প্রায়োগিক বাস্তবতা। তবে সেই সময়ের যে কোন সমকালীন ভাষার উপভাষা, লব্জ, এবং ইডিয়াম শেখার জন্যে এই কাজটা শিক্ষার্থীর করা সম্ভব কোন একটা ‘ধ্রুপদী’ ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে।

হ্যালহেড মনে করতেন, বাংলায় এবং উত্তর ভারতে যে কটা ভাষা বলা হয় সেগুলি অতীতের কোন একটি শুদ্ধ, মৌলিক, সুসংহত, যুক্তিসম্মত ভাষার বিকৃত, ভাঙ্গা, পতিত এবং দূষিত রূপ। আজও হিন্দু আর আক্রমনকারী মুসলমানেরা সেই পবিত্র এবং সাহিত্যিক সংস্কৃত, আরবি এবং ফারসির উত্তরাধিকারবহন করছেন। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৩ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

ধ্রুপদী প্রকল্প এবং ভারতীয় অভদ্র ভাষাগুলির সংজ্ঞা
জেন্টু কোডের অনুবাদক এবং বাংলায় প্রথম ব্যকরণ লেখক ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড তার প্রায় সব কটি কাজের মূল স্তম্ভ হিসেবে অষ্টাদশ শতকের ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে রোমিয়দের তুলনা টেনেছেন। বাংলার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন এবং তাকে স্থিতিকরণের কাজে ব্যকরণ লেখার প্রকল্পটা একটা বড় হাতিয়ার। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড লিখলেন, বাংলায় ব্রিটিশ কর্তাদের(ইংলিশ মাস্টারস অব বেঙ্গল) রোমিয়দের মত বাংলাতেও স্বচ্ছন্দ হতে হবে, কেননা রোমিয়রা ছিল জ্ঞানে আর রুচিতে পিছিয়ে পড়া, এবং তারা গ্রিস দখল করার পরেই নিজেদের যোগ্য করে তুলন। ঠিক তেমনিভাবেই ব্রিটিশদের বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় দখল নেওয়া দরকার যেহেতু এই ভাষাটি সরকার আর তার প্রজাদের মধ্যে, শাসক ইওরোপিয়দের সঙ্গে দেশিয় শাসিতদের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা যারা শাসকদের শাসন মাথা নামিয়ে স্বীকার করবে। এর সঙ্গে ব্রিটিশদের মহানুভবভাবে শাসন করার জন্যে এবং আইন প্রয়োগ করার জন্যে এই ভাষাটি জানা প্রয়োজন।
অষ্টাদশ শতকের বাংলায় ব্রিটিশেরা জটিল ভাষা বিভ্রাটে পড়েছিল। হাতেগোনা ব্রিটিশ বাংলা জানত, অধিকাংশ ব্যবসায়িক কাজেকম্মে মুর ভাষা এবং পারসি ব্যবহার করত। এর থেকে প্রমান হয় তাদের অধিকাংশ অধস্তন ভারতীয় কর্মচারী কি ধরণের ভাষা ব্যবহার করত।
১৭৯৯ থেকে ১৮০২ সালের মধ্যে ইংরেজি/বাংলা এবং বাংলা/ইংরেজি শব্দকোষ প্রকাশ করা এইচ পি ফস্টার বাংলার আদালতে ফারসি ব্যবহারের একটা কল্পিত উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখছেন সমাজের এক্কেবারে নিম্নস্তরের অশিক্ষিত একজন ডোম দারোগার কাছে আভিযোগ দায়ের করতে গিয়েছে। ফস্টার বলছেন দারোগার ফারসি জ্ঞান প্রাথমিকে পড়া কবুতরের গল্প পর্যন্ত ছিল। ডোমটি অভদ্র(ভালগার) বাঙালি ভাষায় তার অভিযোগ দায়ের করে। দারোগাটি ডোমের বাংলা ভাষা ভাঙ্গা ফারসিতে অনুবাদ করে ফারসি অক্ষরে আর কিছু ফারসি শব্দ বন্ধ ব্যবহার করে নথিবদ্ধ করল। এই অভিযোগটি তারপরে ফারসিতে অনুবাদিত হয়ে নিজামত আদালত পর্যন্ত যদি যাওয়ার সুযোগ হয় তবেই এটি ইংরেজিতে অনুদিত হবে। ফস্টারের যুক্তি, বাংলার বিভিন্ন শহর যেমন ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং কলকাতার নিয়মিত বোলি বাংলা ভাষা যদি ব্রিটিশ শেখে, তাহলে প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমটি আরও সরল হতে পারে।
উইলিয়াম কেরি দেখেছেন যে ব্যক্তিগত বা সরকারি ভৃত্যরা ইওরপিয়দের সঙ্গে কিন্তু বাংলায় ভুলভাল ইংরেজি ফারসি আরবি আর পর্তুগিজ শব্দ মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলে। কেরি দেশিয় ভ্রাতাদের সাবধান করে বলেছেন যে, সাধারণ দোভাষীরা কিছু মুর শব্দবন্ধ নির্ভর করে সম্মানিত ভদ্রলোকেদের সঙ্গে কথা বলার কাজ চালিয়ে নেয় আবার সাধারণ মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে।
হ্যালহেড যে গ্রামারটা প্রকাশ করলেন সেটি সম্পূর্ণভাবে ইওরোপিয় ব্যকরণ তত্ত্ব সঞ্জাত যেমন পার্টস অব স্পিচ, এলিমেন্টস এন্ড সান্সট্যান্টেটিভস, প্রোনাউনস, ভার্বস, নিউমারালস, সিন্ট্যাক্স, অর্থোগ্রাফি এবং ভার্সিফিকেশনের অধ্যায় সাজিয়ে তোলা। গর্বকরে বলেছেন, তিনিই প্রথম ইওরোপিয় যে বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতর মিলন ঘটাল ফারসি এবং হিন্দুস্তানি শব্দগুলির বিচ্ছিন্ন করণ করে – দ্য ফলোয়িং ওয়ার্ক প্রেজেন্টস দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মেরিলি এজ ডিরাইভড ফ্রম ইটস পেরেন্ট স্যাংস্কৃট। তবে যারা সঠিক অনুবাদের পথ খুঁজছেন, তাদের অবশ্যই ফারসি আর হিন্দুস্থানী বোলিগুলি পড়তে হবে, কেননা আধুনিককালের ব্যবসাবাণিজ্য আজকের অশিক্ষিত প্রজন্মের হাতে এসে পড়েছে, তারা চিঠি লেখে হিসেব রাখে নকল করা শব্দবন্ধ দিয়ে এবং অবৈধ বাক্য দিয়ে। হ্যালহেডের বাংলা ব্যকরণ জ্ঞানের দৌড় ছিল এক পণ্ডিতের সঙ্গে সামান্য বাক্যালাপে যে তার সামনে ব্যকরণের সূত্রগুলি উন্মোচিত করেছে। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২২ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে
সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
১৭৮৬সালের অক্টোবরে(অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই) জোনস (নিজের ঔপনিবেশিক হৃদয় সম্বল করে) সংস্কৃত জ্ঞান সম্বল করে তার আদালতের পণ্ডিতদের স্মৃতিভাষ্য সংশোধনের কাজে লেগে গেলেন। এবং মনুস্মৃতি অনুবাদের কাজ শুরু করে দিলেন। জোনস(বার্কের মতই) মনে করতেন আদালতে হিন্দু মুসলমান বাঙ্গালি অনুবাদকেরা চরম দুর্নীতি পরায়ণ এবং তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত নিদানের হাত থেকে কুসুমমতি ব্রিটিশ বিচারকেদের মুক্তি প্রয়োজন। এক দশক আগে ব্রিটিশেরা পার্সি ভাষায় জ্ঞান অবলম্বন করে যে রাজনৈতিক নথিপত্র পড়া আর লেখার মাধ্যম হিসেবে আখুন্দ, মৌলভি এবং কায়স্থদের থেকে মুক্তির আশা করছিল, জোনস সেই প্রকল্পকে আরও জোর ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দেবেন। জোনস তার হাতের কাছে থাকা হিন্দু মুসলমান স্মৃতি শাস্ত্র থেকে একীভূত করে একটি সঙ্কলনের প্রস্তাব দিলেন এবং বললেন সেগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ হলে ইওরোপিয় বিচারকেরা দেশিয় অনুবাদকদের নিগড় থেকে মুক্তি পাবে। জোনস এমন একটা পদ্ধতি চাইছিলেন যার মাধ্যমে দেশিয়দের আইন অলঙ্ঘনীয় এবং আদালতের নির্দেশ হিন্দু আর মুসলমান উভয়ের জন্যে পালনযোগ্য হবে।
যে পদ্ধতি জোনস অনুসরণ করতে চাইছিলেন, তা সংগঠিত করতে গেলে নানান ধরণের জ্ঞানকে নথিকরণ করা এবং সেগুলি জনগণের কাজেও নিয়ে যাওয়া জরুরি কাজ ছিল। জোনস এবং অন্যান্য আধিকারিক, পণ্ডিত এবং মৌলভির নেতৃত্বে হিন্দু এবং মুসলমান আইন একত্রিত করে বিচারকদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। হিন্দু মুসলমান আইন বোঝার জন্যে একটা জ্ঞানচর্চা সংঘ তৈরি করা জরুরি হয়ে উঠল। এই জ্ঞানী সংগঠন জ্ঞানের ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিভাগ করে এমন রায় দানের কাঠামো তৈরি করবেন, যেখানে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা মানুষেরাও ন্যায় বিচার পাবে।
জোনস এবং অন্যান্যদের বিশ্বাস ছিল যে অতীত থেকে ভারতে ন্যায় প্রদানের আইন ছিল এবং সেই ন্যায় দেওয়ার সংঘও ছিল যা সময়ের হস্তাবলেপনে এবং আকারে বৃদ্ধি পেতে পেতে চরমতম দুর্ণীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশেরা মনে করল অতীতের মূল স্মৃতিশাস্ত্র বর্তমানের স্মৃতিকারদের হাতে পড়ে টিকাকরণ এবং ব্যাখ্যা আর দুর্নীতির জঙ্গল হিসেবে গড়ে উঠেছে, তাকে সেই পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে অতীতের আকারে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। এবং একই সঙ্গে তিনি মনে করতেন এই মূল শাস্ত্র কিন্তু টিকাকার ব্যাখ্যাকার পণ্ডিতদের কাছেই রাখা আছে আর হিন্দু আর মুসলমান আইনকে পণ্ডিত ও মৌলভি অনুবাদকদের স্বৈরাচার থেকেও মুক্তি দেওয়া জরুরি। কিন্তু মুশকিল হল এই কাজটি যে কোন প্রকারে সম্পন্ন হতে হবে অবিশ্বাসী পণ্ডিত এবং মৌলভিদের অংশগ্রহণেই, যারা এই আইনের ব্যাখ্যার একচেটিয়া অধিকার নিয়ে রেখেছে। ভারতে আসার আগেই জোনস ভারতীয় আইন বিষয়ক জ্ঞানী আর অনুবাদকদের পরম্পরাকে বিশ্বাস করতেন না – সেই অবিশ্বাস ভারতে আসার পরে আরও বেড়েছিল। তিনি কর্নওয়ালিসকে ১৭৮৮ সালে লিখলেন, সহজে আমি দেশিয় অনুবাদকদের নিদানকে বিশ্বাস করতে পারছি না কারণ তারা সব সময়েই আদালতকে বিপথে পরিচালিত করতে চায়। জোনস ভারতে রাজা আর কোম্পানি পরিচালিত ব্রিটিশ আদালত পরিকল্পনা পেশ করলেন, যা একমাত্র খাঁটি এবং বিশুদ্ধ হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রের নিদান দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযোগী সংঘ। তাহলে তার মতে পণ্ডিত ব্রাহ্মণ এবং ভারতীয় ব্যবহারবিদদের হাতে হিন্দু আইনের যথেচ্ছ বিকৃতি সম্ভব হবে না।
হিন্দু আর মুসলিম আইনের একটি শাস্ত্র তৈরি করার উচ্চাশা ব্যক্ত করে জোনস অতীতের রোমিয় পটভূমি আর ব্রিটিশদের এদেশে আগামী দিনে শাসনীয় প্রবাহমানতাকে জুড়লেন। তার পরিকল্পনায় তিনি বললেন কিভাবে আইন প্রণেতা ট্রিবোনিয়ান বৈজ্ঞানিকভাবে শুধুই মূল শাস্ত্র অবলম্বন করে জাস্টিনিয়ান কোড সংকলন করেছিলেন। তিনি বার বার বললেন আইনের মূল কাঠামোটাই হল চুক্তিভিত্তি আর উত্তরাধিকারসূত্র এবং ব্যক্তিগত বাস্তব সম্পত্তির অধিকার।

জোনস ভারতের ট্রিবোনিয়ন হওয়ার উচ্চাশার প্রকল্প বাস্তবায়িত করার সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন না। আজও তিনি কোর্ট অব ডিরেক্টর্সদের দেওয়া সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের প্রাঙ্গনে টোগা পরিহিত মুর্তি হয়ে হাতে কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোমানিয় অতীতের ব্রিটিশিয় অবশেষ আজও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখা যায় যেখানে রোমান সেনেটারের অনুকরণে টোগা পরিহিত ওয়ারেন হেস্টিংস দাঁড়িয়ে আছেন, যার নিচে দাঁরীয়েয়াছেন একজন তালপাতার পাণ্ডুলিপি হাতে ব্রাহ্মণ এবং ফারসি পুথি হাতে মৌলভি। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে
সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
হেস্টিংসের সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়াল হিন্দু আইন আদপে কি? এর জন্যে তিনি বাংলা জোড়া এগারো জন প্রখ্যাততম এবং সম্মানিত পণ্ডিত বাছলেন, যারা এই সংক্রান্ত স্মৃতিশাস্ত্রর সংহিতা সংকলন করবেন। এর সঙ্গে তিনি এন বি হ্যালহেডকে এই সঙ্কলনের কাজ দেখাশোনা আর সেগুলি ইংরেজি অনুবাদের কাজে জুড়ে দিলেন। হ্যালহেদের ভাষায় আমরা জানতে পারি কিভাবে সেই স্মৃতিগুলি সংকলিত এবং অনুদিত হয়েছিল – দ্য প্রফেসরস অব দ্য অর্ডিন্যান্স হিয়ার কালেকটেড স্টিল স্পিক এন্ড অরিজিনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ইন হুইচ দে অয়ার কম্পোজড। ... আ সেট অব মোস্ট এক্সপিরিয়েন্সড লয়ার্স ওয়াজ সিলেক্টেড ফ্রম এভরি পার্ট অব বেঙ্গল ফর দ্য পারপাস অব কম্পাইলিং দ্য প্রেজেন্ট ওয়ার্ক, হুইচ দে পিকড আউট সেন্টেন্স বাই সেন্টেন্স ফ্রম ভেরিয়াস অরিজিনালস ইন দ্য স্যাংস্কৃট ল্যাঙ্গুয়েজ, নায়দার এডিং, নর ডিমিনিশিং এনি পার্ট অব দ্য এন্সিয়েন্ট টেক্সট। দ্য আর্টিকলস দাস কালেকটেড অয়ার নেক্সট ট্রানলেটেড লিটারালি ইন্টু পার্সিয়ান, আন্ডার দ্য ইন্সপেকশন অব ওয়ান অব দেয়ার ওন বডি; এন্ড ফ্রম দ্যাট ট্রান্সলেশন অয়ার রেন্ডার্ড ইন্টু ইংলিশ উইথ এন একুয়াল এটেনশন টু দ্য ক্লোজনেস এন্ড ফাইডালিটি অব দ্য ভার্সানস।
সঙ্কলনটির নাম হল বিবাদার্ণবসেতু। যেভাবে এই সঙ্কলনটি তৈরি হল সেই পদ্ধতিটি আগামী পনের বছরের মধ্যেই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। হ্যালহেদের সংস্কৃত জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল। তিনি পণ্ডিতদের করা সংস্কৃত শ্লোকগুলি বাংলা বা হিন্দুস্তানীতে অনুবাদ করিয়ে নিয়ে, সেগুলি কোন মুন্সিকে দিয়ে ফারসিতে অনুবাদ করাবার পরেই ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন।
১৭৮৩ সালে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়ে জেন্টু ল’কে রোমান ডাইজেস্ট হিসেবে মনে করলেন, এবং এটির প্রামাণিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুললেন(কিন্তু ছাড় দিলেন হ্যালহেডকে)। বললেন যদি মূল সংস্কৃততেই গণ্ডগোল থাকে, তাহলে অনুবাদেও বিপত্তি দেখা দেবে – বাট হোয়াটএভার বি দ্য মেরিট অব দ্য অরিজিনাল, দ্য ট্রান্সলেশন অব ইট হ্যাজ নো অথরিটি, এন্ড ইজ অব নো আদার ইউজ দ্যান টু সাজেস্ট ইনকুয়ারিজ অন দ্য মেনি ডার্ক প্যাসেজেস, হুইচ উই ফাইন্ড ইন ইট; প্রপার্লি স্পিকিং, ইন্ডিড, উই ক্যাননট কল ইট আ ট্রান্সলেশন; ফর, দো মি হ্যালহেড পারফরমড হিজ পার্ট উইথ ফাইডালিটি, ইয়েট দ্য পার্সিয়ান ইন্টারপ্রেটর হ্যাড সাপলায়েড হিম অনলি উইথ আ লুজ ইনজুডিসিয়াস এপিটোম অব দ্য অরিজিনাল স্যাংস্কৃট, ইন হুইচ এব্যাস্ট্রাক্ট মেনি এসেন্সিয়াল প্যাসেজেস আর অমিটেড... অল দিজ আই সে ইন কনফিডেন্স, হ্যাভিং অলরেডি পারসুড নো স্মল পার্ট অব দ্য অরিজিনাল উইথ আ লার্নেড পন্ডিত, কম্পেয়ারিং ইট, এজ ই প্রসেডেড, উইথ দ্য ইংলিশ ভার্সান।
কলকাতায় এসে সংস্কৃত শেখার কোন পরিকল্পনা জোনসের ছিল না – তিনি উইলকিনসকে বললেন, জীবন খুবই ছোট, আমার কাজকর্ম খুবই বিস্তৃত, ফলে এখন নতুন ভাষা শিক্ষার আর সময় নেই। কিন্তু জোনসের ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আগ্রহ আর কলকাতার ক্রাউন কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কাজকর্ম তাকে সংস্কৃত ভাষার দিকে টেনে নিয়ে গেল। কলকাতায় আসার এক বছরের মধ্যেই জোনস বেনারসে গিয়ে মৌলভি, পণ্ডিত আর রাজাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইব্রাহিম খান, যাকে ব্রিটিশেরা জ্ঞানী আর বিচারপতি হিসেবে সম্মান করত। জোনসের আসা ছিল যে ইব্রাহিম তাকে ধর্ম শাস্ত্র মনু স্মৃতির পার্সি অনুবাদ করে দেবেন যেটি সে সময়ের এই শাস্ত্রের মূলানুগ অনুবাদ ছিল। কিন্তু ইব্রাহিমের কাছে ছিল ধর্মশাস্ত্রের মূল সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি। সেটি বেনারসের পণ্ডিতেরা ফারসিতে অনুবাদ করে দিতে অস্বীকার করে।

জোনস মনে করছিলেন স্মৃতিশাস্ত্রের অক্ষম ফারসি অনুবাদ তার কোন কাজে আসবে না। ১৭৮৫ সালে উইলিয়াম পিট ইয়ংগারকে লিখলেন আমি আদালতের পণ্ডিতদের সায়েস্তা করতে সংস্কৃত শিখব ভাবছি। এক মাস পরে উইলকিনসকে লিখলেন হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রটা মূলানুগ হওয়া খুব জরুরি, নাহলে আমাদের সংস্কৃততে অজ্ঞতা সারাক্ষণ দেশিয় স্মৃতিবিদদের ওপর নির্ভর করিয়ে রাখবে। ১৭৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি আশ্চর্যজনক এবং শ্রদ্ধেয় ভাষাটির প্রাথমিক জ্ঞানটুকু শিখতে নদীয়া গেলেন। অক্টোবরে কলকাতা ফিরলেন নদীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় পিতৃসম অব্রাহ্মণ শিক্ষককে নিয়ে যিনি ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীদের ব্যকরণ এবং নীতিশাস্ত্র শিক্ষা দিতেন। তিনি জোনসের সংস্কৃত শিক্ষক হলেন এবং এক বছরের মাথায় জোনস বললেন যে তিনি টলারেবলি স্ট্রং ইন সংস্কৃত এবং ভারতের মিনোজ, মনুর স্মৃতিশাস্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্যে তৈরি। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২০ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
ভারতে ব্রিটিশদের সংস্কৃত শিক্ষার দুটি মোদ্দা কারণের প্রথমটি হল প্রাথমিকভাবে প্রাচীন এই ভাষাটি জেনে, তাতে ঢুকে বৌদ্ধিক টহল দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাংলায় উপযুক্ত শাসন দেওয়ার পরিকল্পনা। হেস্টিংস তার পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইয়রেক্টর্সকে লিখে জানালেন এই পরিকল্পনায় বাংলায় কোম্পানির শাসন আরও মজবুত এবং ন্যায় পরায়ণ হয়ে উঠবে। পরিকল্পনাটির ভিত্তি ছিল, প্রিন্সিপলস অব এক্সপিরিয়েন্স এন্ড কমন অবজারভেশন, উইদাউট দ্য এডভান্টেজেস হুইচ এন ইনটিমেট নলেজ অব দ্য থিওরি অব ল মাইট হ্যাভ এফোর্ড আস। উই হ্যাভ এন্ডেভার্ড টু এডাপ্ট আওয়ার রেগুলেশনস টু দ্য ম্যানার্স এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংস অব দ্য পিপল, এনড দ্য এক্সসিজেন্সিজ অব দ্য কান্ট্রি, এন্টারিং এজ ক্লোজলি এজ উই আর এবল টু দেয়ার এন্সিয়েন্ট ইউজেস এন্ড ইন্সটিটিশন।
হেস্টিংসের প্রকল্পের তাত্ত্বিক অবস্থান পরিষ্কার ছিল, ভারতীয়দের ভারতীয় নীতির দ্বারা শাসন করা দরকার, বিশেষ করে আইনএর দৃষ্টিতে। মুখ্য প্রশ্নটি ওঠে এই প্রাচীন ভাষা চর্চা এবং জ্ঞান অর্জন করে ব্রিটিশদের লাভ কি? প্রশ্নটা হেস্টিংসের কাছে খুব সোজা ছিল, সুদূর অতীত থেকেই হিন্দুদের কাছে অবিচ্ছিন্নভাবে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে এই আইনটা সংরক্ষিত রয়েছে, সেটিকে জানতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে। তিনি লিখলেন, এটি ভারতজুড়ে ব্রাহ্মণ বা আইনের অধ্যাপকেদের অধিকারে আছে, যারা বিভিন্ন দানে এবং জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতায় বেঁচে থাকে। অধ্যাপকেরা প্রত্যেক মূর্তিপূজকের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। প্রত্যেক ফৌজদারি আদালতে কাজি, মুফতি এবং দুজন মৌলভি আইনের নিহিতার্থ প্রকাশ করে আভিযুক্ত কতটা দায়ি তা নির্নয় করেন। প্রত্যেক দেওয়ানি আদালতে উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতি এবং অন্যান্য ধর্মীয় কলহ মুসলমানেদের কোরানিয় আইনের দ্বারা আর জেন্টুদের ক্ষেত্রে শাস্ত্র ভিত্তি করে সাজা শোনানো হয়।
কোম্পানির মত বাণিজ্যিক সঙ্গঠনে দেওয়ানি আদালতের আইন জানা অনেক বেশি কাজ দেয় কেননা তাদের পরিচালিত দেওয়ানি আদালতের মুখ্য বিচারের বিষয়গুলিই হল ব্যক্তি বা পারমার্থিক সম্পত্তি বিবাদ, উত্তরাধিকারের আইন সংক্রান্ত বিবাদ, বিবাহ বা জাতি সংক্রান্ত বিবাদ, ধার সংক্রান্ত বিবাদ, হিসাব রাখার বিবাদ, চুক্তি খেলাপি, অংশিদারি ব্যবসা সংক্রান্ত বিবাদ এবং ভাড়া সংক্রান্ত বিবাদ মেটানো। এই পরিকল্পনা অনুসারে হেস্টিংস এবং অন্যান্য অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ অভিজাত চাইলেন কোম্পানি সরকার ভারতীয়দের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করুক দেশিয় আইনে বিচার দিতে।
এই পরিকল্পনা সফল করতে ব্রিটিশ জনগনকে হেস্টিংস বোঝালেন এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে প্রবাহমানতার ধারণা, বাস্তবতা আর তত্ত্বগুলি। ভারতের প্রাচীন সংবিধান দুটিভাগে বিভক্ত হিন্দু, মুসলমান। পণ্ডিতেরা মূলত অধ্যাপক, আবার কেউ কেউ আইনজ্ঞও বটে। আইন রূপায়নের জন্যে আছেন বিশেষজ্ঞ কাজি – বিচারক, যিনি বিচারের আইনগুলি কোথায় কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে সেটা জানেন। তাদের সাম্রাজ্যের আগে বাংলায় ছিল মুসলমান শাসন, ফলে ব্রিটিশেরা মনে করল সেই সময়ের ইসলামি ফৌজদারি আইনই দেশের আইন কিন্তু দেওয়ানি আইন পরিচালিত হবে হিন্দুদের জন্যে এক ধরণের আইন অনুসারে আর মুসলমানদের জন্যে আলাদা আইন অনুসারে। হেস্টিংস আর ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আইন বিষয়ক এই সিদ্ধান্ত ভারতের বিচার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।
ব্রিটিশদের মনে হল, যদি হিন্দুদের জন্যে হিন্দু আধিকারিকের(পণ্ডিত) নেতৃত্বে হিন্দু আইন বলবত করতে হয় তা হলে হিন্দুদের নিয়ে একটি স্থায়ী সঙ্ঘ গঠন করা জরুরি, যারা তাদের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারবে এবং সেগুলি ইংরেজিতে অনুবাদও করা যাবে, যাতে (ব্রিটিশ)বিচারপতি কি ধরণের বিচারে কি ধরণের রায় দিতে পারেন সেটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে।

উপনিবেশবাদ বিরোধীচর্চা - আর্যভট থেকে নীলকান্ত

অন্তত বর্ণবাদী মেকলিয় বাঙালির ইয়োরোপীয় দাসত্ব মোছার একটা চেষ্টা করা যাক

কয়েক বছর আগেই পড়ছিলাম সঞ্জয় পাসোয়ানের কালচারাল ন্যাশনালিজম এন্ড দলিত বইটি। আমরা, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ এবং উইভার, আরটিজান ট্রাডিশনাল আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াটাগ) সদস্য, যারা গ্রামজ উতপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তি আর সংগঠন বিষয়ে অল্পস্বল্প নজর দিয়েছি। আমাদের পথচলা দর্শনের সঙ্গে, এই বইটির ভাষ্য কিছুটা হলেও মিলে যায়। তাঁর বক্তব্য ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব সময়ে ভারতে দলিতদের অবস্থান খুব খারাপ ছিল না – এই ভাষ্যে কিন্তু তিনি জাত ব্যবস্থায় কোনভাবেই উচবর্ণের অবস্থান সমর্থন করছেন না - আমরাও। তিনি বাল্মিকী, বেদব্যাস, কবীর থেকে রবিদাসের জীবনী আলোচনা করেছেন। দক্ষিণের এজাভা পরিবারের নারায়ণ গুরুর কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। আমরা এখানে বাংলার নানান সম্প্রদায়ের কথা বলতে পারি। সঞ্জয় জোর দিচ্ছেন এডাম সমীক্ষার বাংলা-বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থার তথ্যে, যেখানে তথাকথিত বর্ণাশ্রমের উপরের দিককার মানুষদের থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-ছাত্র ছিলেন দলিত মানুষেরা।
আজ ভারতে দলিত আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে। অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইটা তো রয়েইছে - আগে প্রয়োজন আমার কি ছিল, সে বিষয়ে নিরন্তর আলোচনা। যার একটি ঝাঁকি আমরা সঞ্জয় পাসোয়ানের বইটিতে পেয়েছি, নিজেরা নিরন্তর আলোচনা করছি পরম নামক একটি মাসিক পত্রিকায়। কি হারিয়েছি, হাহুতাশ তো আছেই। কিন্তু যে কেন্দ্রিভূত দর্শনের জাতিবিদ্যা তৈরি হয়েছে ভারতে বিগত কয়েক শতক ধরে মেকলিয় ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চায়, তাকে সবার আগে প্রশ্ন করা দরকার। হাজার হাজার বছর ধরে বিকেন্দ্রীভূত, বৈচিত্র্যময়, আসাধারণ এক সভ্যতার ভিত্তিভূমি গড়ে তুলেছেন মূলত শূদ্ররা – তাই ভারত সভ্যতা শুদ্র সভ্যতা – এটা বলতে হবে। তাঁরাই পারেন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে নিজেদের দর্শন দিয়েই প্রশ্ন করতে। বড় পুঁজির দর্শনের ভেতরে দাঁড়িয়ে তা হয়ত হবে না। নতুনভাবে দেখতে হবে বড় পুঁজিভিত্তিক লুঠেরা পশ্চিমি গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর সমাজতত্ত্বের ভিত্তিকে – নিজেদের তৈরি পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র, নিজেদের বিকশিত জ্ঞানচর্চার মহিমা দিয়ে। ভারতে তৃণমূল স্তরে আজও সেই দর্শনে টিকে থাকার উদ্যম রয়েছে কর্পোরেট পালিত উন্নততর বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মহিমা কীর্তন আর তাদের হাতে আঞ্চলিক জ্ঞানচর্চার ধ্বংস ক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েও।
নিজের সভ্যতার প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার উদ্যমের অভাব রয়েছে ইংরেজি শিক্ষিতদ দলিত নেতৃত্বের মধ্যে। তাঁদের অধিকাংশই বড় পুঁজির তৈরি করা আঞ্চলিক জ্ঞান ধ্বংস করা আধুনিক কর্পোরেট বিজ্ঞনের অংশ হতে চান, হতে চান এই উৎপাদন ব্যবস্থার হাতিয়ার। বিনীতভাবে বলার চেষ্টা করব শিক্ষিত দলিত নেতাদের এই তাত্ত্বিক অবস্থানে বড় পুঁজিরই লাভ – যখন তাঁরা বলেন ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে সমাজ ও সভ্যতায় অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে। সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়েছে বহুল্যাংশে। আজ প্রত্যন্ত-অজপাড়াগাঁয়ে বসবাসকারী নিতান্ত আখ্যাত, হত-দরিদ্র মানুষও আগামী দিনে উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি (সমাজ বিপ্লবে মতুয়াধর্ম, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, সঙ্ঘাধিপতি, মতুয়া মহা সংঘ, শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর স্বর্ণ-সংকলন, পাতা ১৭)’। এ নিয়ে এখন তর্কে প্রবেশ করব না। আগামী দিনের জন্য তোলা রইল।
ভারতকে শূদ্র সভ্যতা বলতে গেলে নিজেদের জোরের জায়গা, কেন আমরা আলাদা, আমরা কি গড়ে তুলেছিলাম, সেটা জানাতে হবেই। ‘উন্নত সভ্যতা’বিশিষ্ট ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের’ কেন্দ্র বড় শরিকের দর্শনের অনুবর্তী হয়ে হাতেগোণা মানুষ হয়ত স্বচ্ছল থাকতে পারবেন, পিঠ চাপড়ানি পাবেন, কিন্তু নিজস্ব সভ্যতার যে পরিচয় গড়ে উঠেছিল কয়েক সহস্র বছর ধরে, সেই পরিচয় তৈরি হবে না।
ভারতের অঙ্ক দর্শন এবং ইতিহাসকার চন্দ্র কান্ত রাজুর দারুণ একটা দুপাতার হিন্দি প্রবন্ধ দলিত ঔর বিজ্ঞান। যদিও আমরা পশ্চিমি মতে ভারতীয় ইতিহাসে যুগ বিভাজনে বিশ্বাস করি না, বলতে পারি, প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে বাংলার শুদ্ররা মূলত তান্ত্রিক, বৌদ্ধ, এবং পরে ইসলামি রাজত্বের অংশ হয়ে ঈর্ষনীয় বৌদ্ধিক, কৃষ্টিগত এবং অকেন্দ্রিভূত উৎপাদনভিত্তিক বিশ্বজোড়া বাণিজ্য বিকাশের স্তরে পৌছে ছিল। রাজু তাঁর কালচারাল ফাউন্ডেশন অব ম্যাথেমেটিক্স শুরুই করছেন আর্যভট(এই নামের বুৎপত্তি নিয়ে কয়েকদিন আগেই একটা প্রকাশনা দিয়েছিলাম। আশাকরি সেটি মাথায় রয়েছে – শুধু বলি, ক্ষমতায় থাকা মানুষজন যখন আর্যভটকে সুচতুর ভাবে আর্যভট্ট বলতে শুরু করে, সেই উচ্চারণকে পাঠ্যপুস্তকের অংশ করে দেন তখনই ইতিহাসকে নতুন করে দেখতে হয়)এর জ্ঞানচর্চার অবদান দিয়ে। তিনি বিলছেন, আর্যভট used a numerical technique of solving differential equations to compute precise sine values। আজও মঙ্গলে চন্দ্রযান পাঠাতে সেই পদ্ধতিতেই গণনা করতে হয়। এবং আর্যভট প্রথম গোল পৃথিবীকে তুলনা করেছেন কদম্বের সঙ্গে তাঁর গোলধ্যায়এ।
গত কয়েক দশকে ঔপনিবেশিক পশ্চমি লুঠেরা বড় পুঁজি নির্ভর কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তি/বিজ্ঞানকে উচ্চতর বিশ্বজ্ঞনের শ্রেণীতে ফেলে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দেশজ জ্ঞান হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে এবং এটি আমরা সোনা মুখে মেনে নিয়েছি, ঠিক যেমনভাবে ভুলে ভরা পশ্চিমে কলণবিদ্যাকে উচতর জ্ঞানার্জন বলা হয়েছে। এই যুক্তিতে বলা হচ্ছে নিম্নবর্ণের ভাগ্যভাল তাঁরা এই উচ্চজ্ঞানচর্চার বেদীতে আরোহন করছেন। অর্থাৎ কেউ কেউ সফল হচ্ছেন মাত্র, সেটি নিয়ম নয়। কিন্তু ভারতে আর্যভট একমাত্র অউচ্চবর্ণ ছিলেন না। বলা যাবে না তিনি দলিত হিসেবে ভারতীয় জ্ঞানচর্চায় ব্যতিক্রম ছিলেন। ঠিক তাঁর পাঁচ দশক পরে আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় আর্যভট। কৌসাম্বী বা আম্বেদকরের মতে এই সময়ে কিন্তু মনুস্মৃতি সঙ্কলিত হচ্ছিল। তবুও কিন্তু দ্বিতীয় আর্যভট তৈরি হয়েছিলেন। আর পঞ্চম শতের পাটনার আর্যভটের অনুগামী হিসেবে ১৫শ শতে এলেন দক্ষিণ ভারতের উচ্চতম জাতের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ, যিনি আর্যভট পদ্ধতির অঙ্কবিদ্যাকে চারিয়ে নিয়ে গেলেন নতুন উচ্চতায়। নীলকান্তের পুঁথি শীর্ষক সোমস্তুভমএ তিনি আর্যভট সম্বন্ধে ভাষ্য লিখছেন। আমাদের নতুন করে ঔপনিবেশিক সময়ের তৈরি করা বিভাগকে নতুন করে ভাঙ্গার চিন্তা করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে ভারতের জ্ঞানচর্চায় দলিতদের স্থান ছিল না, এবং দুস্তর ভৌগোলিক ব্যবধান ছিল বিন্ধ্যর দুপাশে।
ভারতে জাতিভেদ একটা বাস্তব কাঠামো। সেটা যেমন বাস্তব, তেমনি ভারতীয় জ্ঞানচর্চায়, উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থায় অউচ্চবর্ণের, দলিতদের অবদান উচ্চবর্ণদের থেকে অনেক বেশি। সেটা আরও ঘোর বাস্তব। গত প্রকাশনায় বাংলার উৎপাদন-বিতরণ, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ বর্ণনাতে তা কিছুটা চুম্বকে বলা গিয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং তার ধ্বজাধারীদের জ্ঞানচর্চায় নব্য পশ্চিমি জ্ঞানচর্চকদের সূত্রে ভারতে এক্কেবারে অন্য ধরণের জাতিবাদী আখ্যান তৈরি হল। যে ভিত্তিভূমি গড়ে গিয়েছিলেন পূর্বের অব্রাহ্মণ জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা, সেই ভিত্তিভূমিকে অস্বীকার করার প্রবণতা শুরু হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছাতায়।
তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উঠলেন আর্যভট। তাঁর জাতি চরিত্র পালটে ফেলার উদ্যম গ্রহণ করা হল। নামের বানান উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পাল্টে দিয়ে তাঁকে দেখানো হল ব্রাহ্মণ রূপে। ব্রহ্মগুপ্ত কিন্তু তাঁর গুরুর নাম আর্যভট লিখেছেন অন্তত একশ বার তাঁর রচনায়। যে মানুষটি পাইএর মান নির্ণয় করলেন, দশমিক ব্যবস্থাকে জোর ভিত্তি দিলেন, আর্ভটিয়া লিখলেন, আল খোয়ারজমি যার নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর রচনায়, যিনি সাইন(জ্যা), কোসাইন(কোজ্যা), ভারসাইন(উতক্রমজ্যা), ইনভার্সসাইন(অতক্রম জ্যা), সাইন নামতা(টেবল) নয়, দশমিকের পরে, শুন্য থেকে নব্বই ডিগ্রি পর্যন্ত ৩.৭৫ ডিগ্রি অন্তরে ভার্সসাইন (1 − cos x) তালিকা সঠিক চার সংখ্যা পর্যন্ত গণনা করেছিলেন, আজও মঙ্গলগ্রহে উপগ্রহ পাঠানো হয় আর্যভটের অঙ্ক কষার পদ্ধতিতে, সেই মানুষটার জাতি চরিত্র পাল্টে দিলেন ইয়োরোপীয় ইন্ডিয়ার জাতিরাষ্ট্রের জ্ঞানচর্চকেরা।
কোন গবেষক যদি ‘সঠিক’তার দাবি করা উইকিপিডিয়ায় আর্যভট বিষয়ে দেখতে যান তাহলে কিন্তু কোথাও তাঁর জাত সম্বন্ধে একটা কথাও বলা নেই - বরং তিনি যে উপবীতধারী ব্রাহ্মণ, তাঁর চিহ্নওয়ালা একটা মূর্তির ছবি ছাপা হয়েছে সেখানে। পরোক্ষে বলে দেওয়া হয়েছে তাঁর জাত কি, যেভাবে পাঠ্য অঙ্কপুস্তকে কালো গ্রিসের অঙ্কচর্চকদের ককেসাসিয় চেহারার দেখানো হয়। Inter University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA), Puneতে এই অনৈতিহাসিক মূর্তিটি রাখা হয়েছে। রাজু বলছেন, IUCAAর জনসংযোগ আধিকারিক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশ্ন করেন আর্যভট পৃথিবীকে কোথায় কদম্বাকার বলেছেন তাঁর উল্লেখ জানতে। তিনি তাঁর যথাবিহিত উত্তর দিয়ে বললেন যে তাঁর নামের বানানটা যেন ঠিক করে নেওয়া হয়। সেই আধিকারিক তাঁকে জানালেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাকার জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকর তাঁকে ঠিক বানানটি জানিয়েছেন। তার উত্তর যখন রাজু তাঁকে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন নার্লিকর সম্পাদিত পাঠ্য পুস্তকে আর্যভটের নাম বিকৃত ছাপা হয়েছে, তিনি সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
IUCAAসূত্রে উইকিপিডিয়ায় যে ছবিটি ব্যবহার করা হল তাতে একটাই বার্তা গেল ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চায় দলিতদের/অব্রাহ্মণদের কোন স্থান ছিল না। ব্রিটিশ মেকলের অনুগামীরা নতুন ধরণের জাত ব্যবস্থা ভারতে পত্তন করলেন। মেকলে এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হল জ্ঞানে বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন উন্নত ছিল – তাই তারা ভারত জয় করতে পেরেছে – যার তাত্ত্বিক প্রতিধ্বনি বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায়ের কাজে ছড়িয়ে পড়েছে নব্য জ্ঞানচর্চায় এবং তাঁরা দেশজ পড়াশোনা ছেড়ে ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান পড়ানোর দাবি করছেন বুক বাজিয়ে। জেসুইট পাদ্রিরা কনণবিদ্যার অক্ষহৃদয় না বুঝেই নকল করে আর্যভটের হাতে শুরু হওয়া বিদ্যাটিকে ইওরোপে নিয়ে গেলেন। তখনকার শ্রেষ্ঠ ইওরোপিয় মাথা, দেকার্ত আর নিউটন সেটাকে বুঝতেই পারলেন না। এ প্রসঙ্গে রাজুর অসাধারণ স্তবকটি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না - In the spirit of Kant, a reverse racist might say white-skinned people lacked the brains. However, the inferior Western misunderstanding of the calculus, coated with a redundant Western metaphysics, is what is taught in our universities today. Academics (mostly Western dominated) are unwilling to discuss publicly the claim why Western calculus is superior. The claim of superiority will fall to pieces if discussed publicly।
আবেদন নতুন করে ভাবি। নতুন করে আমাদের পূর্বজরা যে সভ্যতা তৈরি করে গিয়েছেন তার জোরের জায়গা আলোচনা করি। তবেই তৈরি হবে আন্দোলনের ভিত। নয়ত ফক্কা।


অন্তত বর্ণবাদী বাঙালি ইয়োরোপীয় দাসত্ব কাটার একটা চেষ্টা করা যাক।

Wednesday, March 28, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৯ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
ফারসি আর আরবি ছাড়াও ভারতে আরও একটি ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃতর দিকে দৃষ্টি সপ্তদশ অশটাদশ শতকের ব্রিটিশদের আকর্ষিত হয়েছিল। কারণ ব্রিটিশেরা মনে করত এই ভাষাটি গোপন(সেক্রেট) ভাষা যেটি ব্রাহ্মণেরা তাদের ধর্ম আর দর্শন রহস্যমতার মোড়কে লুকিয়ে রেখেছে। ইওরোপিয়রা জেন্টু(সেদিনকার হিন্দু)দের ধর্ম নিয়ে খুব উতসাহী ছিল। সপ্তদশ শতকে ক্যাথলিক ধর্মযাজকেরা ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কৃত শেখার চেষ্টা করেগিয়েছেন, সে খবর অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশদের কাছে ছিল না। জেমস ফ্রেজার, হলওয়েল, আলেকজান্ডার ডাও সংস্কৃত শেখার অসফল চেষ্টা করে। তাহলে ব্রিটিশদের কাছে সংস্কৃত বিষয়ে জ্ঞান এল কি ভাবে? একটা উত্তর বিভিন্ন ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবংশীয় ভারতীয়দের সঙ্গে আলাপচারিতায় অথবা যে সব সংস্কৃত সাহিত্য ফারসিতে অনুদিত হয়েছে সেগুলি পাঠ করে।
তিরিশ বছর ভারতে কাজ করা জন হলওয়েল ফারসি, বাংলা এবং ইন্দোস্তানি ভাষা জানতেন। সেই জ্ঞান অবলম্বন করে ১৭৬৭ সালে রেলিজিয়াস টেনেন্টস অব জেন্টুজ লেখেন। ১৭৫৬ সালে সিরাজ যে বছর কলকাতা আক্রমন করেন, সেই বছর তিনি কোন একটা জেন্টু সাস্ত(শাস্ত্র) অবলম্বন করে অনুবাদ করছিলেন। এই গোলোযোগে তিনি তার পাণ্ডুলিপি সহ সেই পুথিটির হিন্দুস্থানী সংস্করণটিও হারিয়ে ফেলেন। তার অনুবাদের কৃতজ্ঞতায় তিনি অনামী নানান বিজ্ঞ এবং সাধারন অপেশাদার মানুষের অবদানের কথাও লিখেছেন।
তার পূর্বসূরীরা যেভাবে হিন্দুদের মূর্তিপূজক এবং অশিক্ষিত দাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে তার প্রতিবাদ করেছেন হলওয়েল। তারমতে যে সব গোষ্ঠীর হিন্দুদের ক্যাথলিক ধর্মমতে রূপান্তরিত করার স্বার্থ আছে যেমন রোমিয় যোগাযোগীরা, তারাই হিন্দুদের বদনাম ছড়িয়ে বেড়ায়। হলওয়েল রোমান ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের থেকেও বেশি পৌত্তলিকতার অভিযোগ এনেছেন। তিনি পোপের কর্তৃত্বকে শুধু চ্যালেঞ্জ করেন নি, যারা হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কুতসা করে তাদেরও একহাত নিয়েছেন। যেসব খুচরো হঠাৎ ভ্রমনকারী লেখক তাদের ভ্রমনকারীদের চোখ নিয়ে হিন্দুদের দেখে, তাদেরকে তিনি অজ্ঞান, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং একদেশদর্শি বলেছেন। এবং তারা যে সাধারণ প্রাদেশিকতার ওপর উঠতে পারে না সে কথাও বলেছেন, আরও বলেছেন যারা তাদের দেশের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এদেশকে দেখছে তারা নীচ মনোভাবাপন্ন। হলওয়েল একজন হঠাত ভ্রমনকারী লেখককে  ভাসাভাসা লেখক বলে অভিহিত করেছেন ...হিজ টেলিং আস সাচ এন্ড সাচ আ পিপল, ইন দ্য ইস্ট অর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ওয়ারশিপ দিজ স্টিক, অর দ্যাট স্টোন, অর মনস্ট্রাস আইডল; অনলি টু রিডিউস ইন আওয়ার এস্টিম আওয়ার ফেলো ক্রিচার্স, টু দ্য মোস্ট এবজেক্ট এন্ড ডেস্পিকেবল পয়েন্ট অব লাইট। হয়ারএজ, ওয়াজ দ্য স্কিলড ইন দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য পিপল হি ডেস্ক্রাইবস, সাফিসিয়েন্টলি টু ট্রেস দ্য এটিমোলজি অব দেয়ার ওয়ার্ডস এন্ড ফ্রেজেস এন্ড ক্যাপেবল অব ডাইভিং ইন্টু দ্য মিস্ট্রিজ অব দেয়ার থিওলজি; হি উড প্রোবাবলি বি এবল টু এভিনস আস, দ্যাট সাচ সিমিংলি প্রিপস্টারাস ওয়ারশিপ, হ্যাড দ্য মোস্ট সাবলাইম র‍্যাশনাল সোর্স এন্ড ফাউন্ডেশন।

দ্য ট্রাভেলার, হু উইদাউট দিজ এসেনশিয়াল রিকুইজিটস (এজ ওয়েল এজ ইন্ডাস্ট্রি এন্ড আ ক্লিয়ার আন্দারস্ট্যান্ডিং) প্রিটেনডস টু ডেস্ক্রাইব এন্ড ফিক্স দ্য রেলিজিয়াস টেনেন্টস অব এওনি নেশন হোয়াতএভার, ডিজনেস্টলি ইম্পোজেস হিজ ওউন রেভরিজ অব দ্য ওয়ার্লড; এন্ড ডাজ দ্য গ্রেটেস্ট ইঞ্জুরি ভায়োলেন্স টু লেতার্স, এন্ড দ্য কজ অব হিউম্যানিটি। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৮ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

ফারসিঃ ভারতীয় রাজনীতির ভাষা
ব্যকরণের ভিত তৈরি করতে গিয়ে জোনস প্রাথমিকভাবে পার্সি কবিতা নিয়ে উতসাহিত হয়ে পড়েন, এর সঙ্গে তিনি দশম থেকে পঞ্চদশ শতকের সিরাজ সাহিত্যিক বোলির বিস্তৃত বর্ণনা ভিত্তি করে তার ব্যকরণিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গ্রামারে, জোনস তার সময়ে ব্যবহৃত ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যসংস্থান এবং ভাষার বাক্য গড়নের রূপতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন।
জোনস তার পাঠকদের কিভাবে ফারসি পড়িতে হয় সে দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে নিয়ে বলেন একজন নেটিভ পার্সি ছাড়া ফারসি ভাষা শিক্ষা অচল। পাঠক ফারসির অক্ষরগুলি প্রথমে সহজভাবে পড়তে শিখবে একজন নেটিভের মুখের কারিকুরির সঠিক উচ্চারণ নির্ভর করে। জোনস মেমিন্সকির বইটি পড়তে নির্দেশ দিয়েও বলেন, পাঠক যেন পাঠ গ্রহণের সময় নেটিভ পার্সির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না হারায়, এবং তার থেকে ভাষার নানান লব্জ এবং সাধারণ কথাবার্তার শুরুটা শিখে নেয়।
জোনন্স বললেন ছ মাস পরে পাঠক আস্তে আস্তে ছোট কবিতা বা ইতিহাসের ছোটছোট পাঠ শুরু করেন। পাঠক তার মুন্সির থেকে প্রাথমিকভাবে অনুবাদ করে হয় গুলিস্তাঁ বা ক্যাশাফির গল্পগুলি বলাটা এবং ভাঙ্গাহাতে লেখার তরিকা শিখে নেয়। এবং পাঠককে জোনস আশ্বস্ত করছেন, যদি পাঠক তার নির্দেশ মত চলে তাহলে সে এক বছরের মধ্যেই যে কোন ভারতীয় রাজার থেকে প্রাপ্ত চিঠি অনুবাদ করে পড়তে পারবে এবং উত্তরও দিতে পারবে, তারই সঙ্গে সে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অবলীলাক্রমে মধুরভাবে ও ভাষায় আলাপচারিতাও করতেও পারবে। সঙ্গে সঙ্গে তার হুঁশিয়ারি, তাকে যদি ভাল বিশ্বস্ত অনুবাদক হতে হয়, তাহলে ফারসির সঙ্গে আরবিটাও শিখে নিতে হবে – তার যুক্তি আরবি আর ফারসি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। যারা আগামী দিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে হতে চায়, তারা ভারতের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, যাকে ভুলভাবে মুরেদের ভাষা বলা হয় তাও বলতে পারবে। কেননা জোনসের মতে মুর ভাষায় বিপুল পরিমানে ফারসি শব্দ আছে, যে ভাষা থেকে তিনি পিলপাইএর কথামালা থেকে কোন কষ্ট না করে পড়েছেন এবং অনুবাদও করেছেন।
উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে কোম্পানির কাজে ঢোকা কোন নবীন করণিকের কাছে ফারসি ভাষা জানা, একটা বিপুল সম্মানের ব্যাপার ছিল। ১৭৬৫ সালে অক্সফোর্ডে ফারসি বিভাগ খোলার অসফল চেষ্টার পরে ওয়ারেন হেস্টিংস জানিয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে যে নতুন তৈরি কলেজ হচ্ছে তাতে আরবি আর ফার্সিকে অবশ্যই রাখতে হবে ...টু দ্য পার্সিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এজ বিইং দ্য মিডিয়াম অব অল পলিটক্যাল ইন্টারকোর্স দ্য ফার্স্ট প্লেস অট টু বি ইন দ্য স্টাডিজ অব দ্য পিউপলস; এন্ড এজ মাচ অব দ্য আরবিক এজ ইস নেসেসারি টু সিউ দ্য র‍্যাডিক্যাল ওয়ার্ড ডিরাইভস ফ্রম ইটস ইনফ্লেকশন্স, টু কমপ্লিট দেয়ার নলেজ অব দ্য পারসিয়ান, হুইচ ইন ইটস মডার্ন ডায়ালেক্ট কনজিস্টস ইন আ গ্রেট মেজার অব দ্য আরবিক... দ্য পার্সিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অট টু বি স্টাডিড টু পারফেকশন, এন্ড ইজ রিকুইজিট টু অল দ্য সিভিল সারভ্যান্টস অব দ্য কোম্পানি, আজ ইট মে আলসো প্রুভ অব ইকোয়াল ইউজ টু দ্য মিলিটারি অফিসার্স অব অল দ্য প্রেসিডেন্সিজ।

কলেজের প্রথম পনের বছর ফারসি বিভাগটি সব থেকে সম্মানিত এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। যে সব ছাত্র ফারসিতে ভাল করত তাদের সব থেকে ভাল, স্বচ্ছল এবং লাভজনক পদে শুরুর চাকরি মিলত যেমন কলকাতার সেক্রেটারিয়েট। এছাড়াও যেহেতু ফারসি আর আরবি ভারতের ধ্রুপদী ভাষা ছিল সেহেতু যে সব অভিজাতর ইওরোপিয় ধ্রুপদী, ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষায় খুব ভাল দখল ছিল না, এই দুই ভাষা শিক্ষা তাদের উচ্চপদে ওঠার অন্যতম ছাড়পত্র ছিল।