Monday, March 28, 2016

উপনেবেশবাদ বিরোধী চর্চা - কেন আমরা বড় পুঁজির বিরোধী

আমরা যারা গাঁইয়া ছোটলোকেদের রাজনীতি করি, তাদের কাছে ২০১৬ সালের এই চলতি নির্বাচনটা খুব অদ্ভুত ঢাপুয়া বাতাস। বাংলার রাজনীতিতে পুঁজির ব্যাখ্যাকারেদের রোল রিভার্সাল বেশ মজার কান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাজনৈতিক দলের বড় পুঁজির দালালি করার কথা - তারা না করে, পথের ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে - ঘোমটা পরে নয়, সরাসরি - এতদিন যাদের পশ্চিমি উচ্চশিক্ষা পাত্তাই দেয়নি - স্বীকারই করে নি সেটা অর্থনীতি আর প্রযুক্তি বলে - যাদের সেই অবস্থানটি নেওয়ার কথা নয় তারা তাঁদের মান্যতা দিল - আর যাদের বড় পুঁজির পাশে দাঁড়াবার কথাই নয়, শৃঙ্খল ভাঙার কথা - তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবেই বড় পুঁজির পাশে দাঁড়াবার কাজ খুব জোর দিয়ে ক্রে চলেছেন; সেই পরিচয় বদলের কম্মটা বিন্দুমাত্র আনন্দের নয় এবং বোধহয় নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে।
বড় পুঁজি নির্ভর শিল্পবিপ্লবের প্রাথমিক দর্শন হল উৎপাদনের কেন্দ্রিকতা এবং এই কেন্দ্রিকতা সফল হয় না যদি না শ্রমকে বৃহতভাবে প্রতিস্থাপন করা যায় বিপুল যন্ত্র ব্যবহার এবং বিশ্বজোড়া প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের মাধমে। ফলে শ্রম প্রতিস্থাপনকারী প্রযুক্তি বিকাশ ঘটতে শুরু করে বিদ্যুৎবাহী স্বতঃচল মাকু চালানোর মাধ্যমে। তাতেও কাপড়ের মিলের লাভ দেখা যায় নি যতদিন না পলাশী উত্তর সময়ে বাংলা লুঠের সম্পদ লন্ডনে যায় নি আর ভারতের বস্ত্রশিল্পকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ আর দেশিয় বাজার দখল করে মিলগুলির খুব খারাপ উৎপাদন এই বাজার গুলোতে বিক্রির ব্যবস্থা করা যায় নি।
বড় পুঁজির এই দখলদারির কাজে সরাসরি সাহায্য করেছে ঔপনিবেশিক প্রযুক্তি আর শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং তাঁদের উচ্চমধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার প্রণোদনা। সে এই সম্পদ লুঠ আর শ্রম প্রতিস্থাপনের কাজে বড় পুঁজিকে নিঃশর্ত সাহায্য করে গিয়েছে এবং সিঙ্গুরের কারখানার একটা হিসেব দেখেছি, ১৫০০ কোটি টাকার কোম্পানিতে সরাসরি কাজ হওয়ার কথা মেরেকেটে ১০০০-১৫০০ সাদা কলারের শ্রমিকের। সেটা সরাসরি আসত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই। ফলে বড় পুঁজির বিকাশের সঙ্গে মধ্যবিত্তের স্বার্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত - ফলে বড় পুঁজির দখলদারির স্বার্থ মধ্যবিত্ত দেখবে এটা আর আশ্চর্যের কি?
আমরা যারা ছোট গ্রামীন উতপাদকেদের রাজনীতিতে জড়িয়ে রয়েছি, তারা মনে করি ভারতের/এশিয়ার গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দর্শন - যেখানে হাজারো বিক্রেতা, হাজারো উৎপাদক বিরাজ করে - পুঁজির, লাভের মালিকানা একজন বা কয়েকজনের হাতে জড়ো হয় না, সারা সমাজে ছড়িয়ে যায়। ফলে সামাজিক সাম্য বজায় থাকে। তেমনি বড় পুঁজি প্রণোদিত হোস্টাইল টেকওভারের মত শুধুই গায়ের জোরে, বড় পুঁজির তৈরি প্রশাসনের আইনের লাঠি দেখিয়ে অনিচ্ছুক উতপাদকের উৎপাদন পরিকাঠামো কিনে নেওয়ারও সুযোগ নেই গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থায়। এই উৎপাদন ব্যবস্থা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, অনেক বেশি পরিবেশ বান্ধব, কম অপচয়ী, প্রযোজনভিত্তিক, স্থানীয় অর্থনীতিকে জোরদার করে, স্থানীয়ভাবে কর্ম সৃষ্টি করে, স্থানীয় জ্ঞানভিত্তিক - লাভ দূর দেশে বসে থাকা একজন বা কয়েকজনের হাতে গিয়ে জড়ো হয় না। ফলে আমরা সরাসরি এই শ্রম প্রতিস্থাপন দর্শনের বিরোধী, বড় পুঁজির গায়ের জোরে দখলদারির বিরোধী, শ্রমের অবমাননার বিরোধী।
অবশ্যই এই ব্যবস্থায় বড় পুঁজির ব্যবস্থাপক মধ্যবিত্তের পুনর্বাসনের জায়গা নেই। স্বাভাবিকভাবেই এই দর্শনটি যে মধ্যবিত্ত তাঁদের স্বার্থেই অপছন্দ করবেন এবং করছেনও। গত কয়েক দশক ধরে বড় পুঁজি, জমি, মালিকানা, উৎপাদন পদ্ধতি বিষয়ে সারা ভারতে যে বিতর্ক উঠেছে তা মনের জানালা খুলে দেয়। নতুন করে ভাবতে শেখায়।

গর্গের কিছু কথা

শিল্পপ্রেমিকদের জন্য...
কেন শিল্প বা কোন কিছুই চাই, কারণ চাকরি চাই। অতয়েব চাকরি আনতে, জমি বা কর ছাড়। এত অবধি বুঝলাম। তাহলে কত চাকরি হলো, তার ভিত্তিতে কর ছাড় ইত্যাদিতে কোন বড় কর্পোরেট রাজি হোন না কেন? পশ্চিম বাংলার GSDP গত ৫ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে (প্লানিং কমিশন তথ্য বলছে) - ২০১০-১১ তে এই বাংলার যে রেঙ্ক ছিল, তার থেকে এখুন অবস্থা ভালো, মাঝে আমরা কর্নাটক (যেখানে ন্মধ্যবিত্তের আইটি সন্তানেরা কলকাতায় চাকরি না পেয়ে যাচ্ছে) আর গুজরাট (যেখানে ন্যানো কোম্পানি চলছে এবং হেব্বি কাজ তাজ হচ্ছে, তা কিনা বাংলায় হলে বাংলা নাকি বদলে যেতো)- - এই দুটিকে টপকে গেছি। । GSDP কেইসটা কি? Gross State Domestic Product (GSDP) is defined as a measure, in monetary terms, of the volume of all goods and services produced within the boundaries of the State during a given period of time. এখানে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো produced. অর্থাৎ উত্পাদনে আমাদের বাংলা গুজরাট ও কর্নাটক-কে পিছনে ফেলে দিয়েছে এই সরকারের আমলে - যা সিপিএম আমলে ছিল এই রাজ্য গুলির পিছনে, রেঙ্কিং-এও ছিল পিছিয়ে। অথচ এখানে ভারী শিল্প আসছে না। মানেটা কি? মানে একটাই - এমন সব ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে উত্পাদন বেড়েছে, যেগুলো ঝিনচ্যাক না, বড় পুঁজির না, অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজি ভিত্তিক নানা ব্যাপারে। সকলেই জানেন, এই সকল ক্ষেত্রে টাকা প্রতি তৈরী চাকরির সংখ্যা বেশি হয়। মানেটা কি দাঁড়ালো? এই উত্পাদন বৃদ্ধি হয়েছে কৃষকের জমি জোর করে কেড়ে না নিয়ে। এবং তার ফলে এতটাই বেড়েছে, যে SEZ ও জোর করে কৃষিজমি হাতানোয় পারঙ্গম রাজ্যগুলিকে পিছনে ফেলে। এই বাংলার থেকে পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে রয়েছে মানুফ্য়াক্চারিং-এর নয়া স্বর্গ গুজরাট। গুজরাট viable অথচ আমাদের বাংলা তার চেয়েও viable । কি করে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তার আগের কথা হলো, হচ্ছে। এইটেই বড় কথা। যারা জীবনে কাউকে একটি চাকরিও দেবেন না, তারা শিল্পায়ন বনাম বিকল্প, এই সকল তরজায় থাকুন, মমতার আমলে বাংলায় উত্পাদন বেশ বেড়েছে। চাকরি তৈরী হয় উত্পাদন বাড়লে, আরো বেশি চাকরি তৈরী হয়, সেটা যদি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের হাত ধরে বাড়ে। এবং সেটা বাড়ছে। এইটাই মেসেজ। যারা মেসেজ খোঁজেন টাটা এবং হাই-টেক-এ, তারা খুঁজে যান। বাংলার উত্পাদক শ্রেণী মেসেজ পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে। বাংলায় ক্রেডিট/ডেপোসিট্ রেশিও বেড়েছে, অর্থাত বাংলায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বেড়েছে (সরকার দ্বারা দেওয়া ঋণ না - যা নিয়ে অনেক হুক্কাহুয়া হয়)। এর মানে কি? এর মানে, আগে বাংলার জমানো পুঁজির যত অংশ বাংলাতেই ধার দেয়া হতো নতুন কোন উদ্যোগের জন্য, এখান তার চেয়েও বেশি বেশি অংশ ধার হিসেবে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলার জমান পুঁজি বাংলার কাজে আরো বেশি লাগছে - আগে বাংলার টাকায় অন্যেরা ব্যবসা করত। এবং এই সকলই হচ্ছে সিন্ডিকেটের পরিপ্রেক্ষিতে। যে বিশ্বে পুঁজির পথে কোন রকম স্পীডব্রেকার বা বাম্পার সরানোই হলো তাদের রাজনৈতিক দালালদের কাজ, সিন্ডিকেট হলো এমন এক ব্যবস্থা তা অতি-সচল পুঁজিকে স্থানীয় এলাকাকে পাপোশ বা হোটেল বা গ্যারেজের মত ব্যবহার করার জন্য স্থানীয় কর দিতে বাধ্য করে। এটা ছাড়া পুঁজির আর সমস্যা কিসের এদিক সেদিক উড়ে যাবার? মুম্বই হোক আর বালিগঞ্জ হোক, সেখানকার পুঁজি যে রঘুনাথপুরে মাটি কিনে মাল কামাবে, তাতে রঘুনাথপুরে এলাকাবাসীর আসলে কোন অধিকারের জায়গা নেই। সিন্ডিকেট সেই হৃত প্রাকৃতিক অধিকারকে বেআইনি ভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তাই পুঁজি সিন্ডিকেটকে ঘেন্না করে। এবং সেই পুঁজির দালাল মিডিয়া-ও সিন্ডিকেটকে ঘেন্না করে।

কলকাতার বসন্ত টিকা

বিডন স্ট্রিটে যে আয়ুর্বেদিক কলেজ আছে, যতদূর সম্ভব কবিরাজ গণনাথ সেনের পরিবারের(তাঁরা ভগভট্ট সঙ্কলিত, রসরত্নসমুচ্চয়ঃ অনুবাদ ও প্রকাশ করেন) - এখন রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে, এখানকার এক অধ্যাপক বছর দেড়েক আগে বলছিলেন কলেজের উল্টো দিকের বাড়িটি ভাঙ্গার আগে বসন্ত ঔষধালয় ছিল তা তিনি দেখেছেন। তার ধারণা ছিল সেটি বসন্ত নামে কোন ব্যক্তির। একদিন অকারণ কৌতুহলে, দোকানের ইতিহাস জানতে প্রশ্ন করেছিলেন বসন্ত কে ছিলেন? দোকানি উত্তর দিয়েছিল, তার পূর্বপুরুষ বসন্তের টিকা দিতেন, তাই দোকানের নাম বসন্ত ঔষধালয়। সেই টিকা দেওয়ার ইতিহাস কম করে ৩০০ বছরের পুরোনো। দোকানটা খুব কম করে ১৫০-২০০ বছরের প্রাচীন।
এই সব ইতিহাস হেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো আয়ুর্বেদ বৈদ্যদের পরিবারগুলিকে নিয়ে গবেষণা করা দরকার - বহু পরিবারে নিশ্চই পুরোনো পুঁথি বা তথ্যাদি রয়েছে। আর খোঁজা দরকার নাথ, দেব, দেবনাথ উপাধিধারী পরিবারের পুরোনো মানুষদের - এঁরা নাথ পরম্পরার মানুষ। ভবানীপুরের পদ্মপুকর রোডের খালসা বিদ্যালয়ের কাছের একটা গলিতে প্রচুর নাথ পরিবার বাস করেন। এই বৈদ্যদের পরিবারে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার স্বাস্থ্যের আর চিকিতসাবিদ্যার ইতিহাস।

Friday, March 25, 2016

বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কেন বামপন্থী?

আমাদের কতগুলি উপপাদ্য আছে -
ক। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালী ভদ্রলোকেরা হঠাত বামপন্থী হয়ে উঠল কেন? তার ইতিহাস আগে একটু খুঁজি। কয়েকটি প্রকাশনার মাধ্যমে আমরা বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম, বাংলা তথা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ সময়ের আগে পর্যন্ত নানান সামাজিক অভিচারের পরেও আমা
দের পছন্দ হোক আর নাই হোক - পরিব্যাপ্ত, বিশাল জ্ঞানচর্চার অবিচ্ছিন্ন ধারা গড়ে উঠেছিল - কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায়। আমরা শুধু আলোচনা করেছি মাত্র এক জাহার বছরের কাছাকাছি সময়, তার বাইরে যাইনি। পলাশীর পরে লুঠেরা খুনি কোম্পানি এক ভারতে রাজত্ব করতে। হেস্টিংসের আগে, ক্লাইভের সময় থেকেই বাংলায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চেপে বসতে শুরু করে। হেস্টিংসের সময়ে তামাক, নুন আর সুপারি ব্যবসা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে উৎপাদন ব্যবস্থা কুক্ষিগত করে তা ধ্বংস করার, বিশিল্পাযনের কাজ শুরু হল, সে কাজ সফল তো শুধু সাদাদের দিয়ে হবে না। প্রয়োজন কালো চামড়ার মানুষ। ফলে যে ভদ্রলোকেরা ইংরেজি শিখলেন তাঁরা তাঁদের ধনী পরিবারের শৈশব থেকেই দেখে আসছেন রাষ্ট্রের মদতে তাদের পরিবারগুলি ফুলেফেঁপে উঠছে। এখন মার্ক্স সাহেব বলেগিয়েছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানার কথা। একবার অধ্যাপক অঞ্জনবাবুকে এক বৈঠকে প্রশ্ন করা গিয়েছিল, মার্ক্সপন্থা কি যদি এক কথায় বলতে হয়? তিনি বলেছিলেন উৎপাদনের রাষ্ট্রীয় করণ। আরে বাবা ছোট বেলা থেকেই বংশপরম্পরারয় তো তাঁরা সেই অবস্থা দেখে আসছন - উৎপাদনের রাষ্ট্রীয় করণ তো করেই ফেলেছিল কোম্পানি পরে ব্রিটিশ রাজ। সেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তাঁরা সামিল হয়েছেন পলাশীর পর থেকেই - তার সঙ্গে তাঁদের কাছে অন্তত বামপন্থার কোন পার্থক্য নেই। তাই ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালী স্বভাবতই বামপন্থী।
খ। আর ইসলামি আমল থেকে তাঁরা বিদেশি ভাষা শিখেছে। তখন আর্বি ফার্সি পরে তার যায়গা করেছিল ইংরেজি - অন্তত রামমোহন পর্যন্ত আর্বি ফার্সি চলেছে - পরিপূর্ণ বয়সে রামমোহনকে লুঠের সঙ্গী হতে ইংরেজি শিখতে হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যি শুরু হচ্ছে রাজমোহনস ওয়াইফ আর তার আগে মাইকেলের ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে। কেন শিক্ষিত বাঙালী বাংলা শিখবে? কেন বাংলা বলবে? কেন? কেন? তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। শঙ্খবাবুর, সুকুমার সেন বা সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ দেখুন, শুধুই ইওরোপিয় উদ্ধৃতির, ভাবনার কাঁটা। ইংরেজি শিক্ষিতরা ভাবছেন এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম।

ভারতের ধ্বংস হওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা - ইসলামি জ্ঞানচর্চা২

এর বাইরে গৃহভিত্তিক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র ছিল। সে ক্ষেত্রে দিগদর্শন করাতেন কোন এক গুণী ওস্তাদ। এই গুণী ওস্তাদের গৃহক্ষেত্রজুড়ে গড়ে উঠত এক বিশাল বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র। যে সব সম্রাট এই শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তৃতির কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলক(১৩৫১-১৩৮৮) অন্যতম। তার রাজসভায় বহু জ্ঞানী গুনীর সমাগম হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি, সিরাজ আরিফ, জিয়াউদ্দিন বার্নি, মৌলানা খ্বাজা, কাজি আবদুর কাদির, আজিজুদ্দিন খালিদ খানি অন্যতম।
ফরিস্তা লিখছেন ফিরোজ যে সব পরিকাঠামো গড়ে ছিলেন তার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র অন্যতম ছিল। আবুল বাকি বলছেন তিনি এধরণের অন্তর ৫০টি মাদ্রাসা তৈরি করিয়েছিলেন যেখানে রাষ্ট্র শিক্ষকদের মাইনে দিত। এগুলির মধ্যে সবথেকে প্রখ্যাত ছিল ফিরুজাবাদের ফিরোজশাহী মাদ্রাসা যার বর্ণনা বার্নি বিশদে দিয়েছেন। এখানে পড়াতেন রুমি, বহু শিক্ষককে সমরখন্দ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছিল। দিল্লির লাহোর গেটের কাছে তার পুত্র ফাতা খানের সমাধিতে সে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে তার নাম কদম শরিফ।
সিকান্দর লোধি(১৪৫৮-১৫১৮)র বিষয়ে ফরিস্তা লিখছেন, এ সময়ে অমুসলমানেরা পার্সি পঠন পাঠন আর ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিলেন। একশ বছরও লাগল না, তাঁরা হয়ে উঠলেন ইসলামি জ্ঞানীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার উপযুক্ত। তিনি আয়ুর্বেদকে পার্সি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করান। সিকান্দর লোধির প্রধানমন্ত্রী মিঞা ভোয়া, সুলতানের নির্দেশে হাকিম আর বৈদ্যদের দিয়ে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা লেখান। এই বইটির নাম দেওয়া হয় মাদনুষ সাইফি সিকান্দরি। ওয়াকয়াতি মুস্তাকি লিখছেন এই বইটির নাম টিবইসিকান্দরি, সে সময় ভারতে আয়ুর্বেদ বিষয়ে এর থেকে ভাল বই আর ছিল না। তার সূত্র থেকে জানতে পারি সেই সময় খোরসান এবং অন্যান্য এলাকা থেকে থেকে পাঁচজন হস্তলেখবিদ নিয়ে আসা হয়েছিল সব ধরণের বিজ্ঞান বিষয়ে পুস্তক তৈরির জন্য। মুঘল আম্লের জ্ঞানচর্চা নিয়ে বিশদে চর্চা হয়েছে। পরম আমরা মুঘল বিদুষীও ছেপেছি। ফলে এখন মুঘল আমল এড়িয়ে যাওয়া গেল।
প্রযুক্তি শিক্ষা
ইসলামি যুগের আগে থেকেই বাংলা তথা ভারত শিল্প উৎপাদনে মাহির ছিল। তবে সে প্রচেষ্টা কিছুটা গতি পায় ইসলামি আমলে। বিশেষ করে বয়ন শিল্প, সূচের কাজ করা ফেজ টুপি, চিত্রিত এবং এনামেলের কাজ করা পাত্র, বিভিন্ন তৈজস্পতে, ইস্পাতের বন্দুক, ছুরি, কামান, কাঁচি, সাদা কাগজ, সোনা রূপা এবং নানান দামি ধাতুর অলঙ্কারের কাজ আজও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রযুক্তি বিষয়ে বিশদ বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চা ছাড়া এত অগ্রগতি যে করা যেত না তা বলাই বাহুল্য। গৃহস্থ ভিত্তিকই হোক বা শিক্ষাক্ষেত্র, উস্তাদেরা ছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে। তাঁর গুণ আর তাঁর শিক্ষা দেওয়ার মানের ওপর নির্ভর করত সেই ক্ষেত্রটির উতকর্ষ। শাগির্দরা গুরুর বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন - এই ব্যবস্থাটা আগে আমরা আলোচনা করা শিক্ষানবিশী ব্যবস্থারই অনুরূপ।
আদতে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের রূপ আর গন্ধ পরিবর্তন ঘটলেও যে শুদ্র শিক্ষা ব্যবস্থার কথা আমরা আলোচনা করছি, তার মৌলিক কোন পরিবর্তন আসে নি, যতদিন না বিশ্বাসঘাতক, দেশিয় শিল্প-বিদ্যাচর্চা ধ্বংসকারী মধ্যবিত্তকে ট্যাঁকে নিয়ে দেশিয় জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে নি। পারিবারিক ক্ষেত্রে বাবা পুত্রের শিক্ষার দায়িত্ব নিতেন, আর মা পুত্রীর। বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরি করার অসীম দক্ষতার বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন পরিবারে - যেমন নক্ষত্র যন্ত্র - এস্ট্রোলেবেল তৈরি করতেন চার প্রজন্মের পরিবারে বিকশিত লাহোরের শেখ আল্লাদাদএর পুত্র মুল্লা ইশার পুত্র কায়িম মহম্মদের পুত্র জিয়াউদ্দিন মহম্মদ। এই যন্ত্রের চাহিদা ছিল সারা এশিয়া জুড়ে। ইওরোপের কথা না বলাই ভাল।
কারখানা
ওস্তাদ-শাগির্দ পরম্পরার বাইরে গড়ে উঠেছিল কারখানা ব্যবস্থা। প্রথমে ছিল শুধুই উৎপাদন ব্যবস্থা, কিন্তু ক্রমশ তাঁরা উৎপাদনের পাশাপাশি শিক্ষা দিতেও উদ্যমী হয়। এই ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত চলতে পারে তার জন্য শাসকেরা জনকৃত্য বিভাগ সুরাতিআম তৈরি করেন। এই বিভাগের কাজ ছিল কারখানাগুলি ঠিক মত চলছে কিনা তা দেখা শোনা করা এবং তাঁরা যাতে সঠিকভাবে শিক্ষা দান করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক কারখানায় বিভিন্ন বিভাগ থাকত, সেখানে থাকত নানান কাজের যন্ত্র কাজের বিভাগ অনুসারে।
বার্ণিয়ে বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন। বড় একটি ঘরকে কারখানা বলা হত। হয়ত সেটি বিভিন্ন উপঘরে ভাগ করা হত। একটি ঘরে সূচীকারীরা ওস্তাদের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন। অন্য ঘরে হয়ত আছেন স্বর্ণিকার, কোথাও চিত্রকর, কোথাও গালার কাজের শিল্পী, কোথাও বা বার্নিশ হচ্ছে, পঞ্চম ঘরে জোড়াদার, টার্নার, দর্জি, আর মুচি কাজ করছেন একযোগে, ষষ্ঠ ঘরে মসলিন, তসর, রেশম কাপড় দিয়ে উষ্ণীষ, ব্রোকেড, সোনার ফুল, ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে মহিলাদের জন্য - সেগুলি এতই স্পর্শকাতর যে এক রাত্র পরলেই সেগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এই একরাতের পরিধানগুলির দাম হয়ত ১০ থেকে ১২ ক্রাউন বা আরও বেশি।

Thursday, March 24, 2016

ভারতের ধ্বংস হওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামি জ্ঞানচর্চা১


বৌদ্ধধর্ম অস্তাচলে গেল। কিন্তু পূর্বভারতের শুদ্র সভ্যতার অবসান হল না।
কেন্দ্রিভূত রাজপৃষ্ঠপষকতাযুক্ত বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হলেও যে বিকেন্দ্রিত জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত পরিকাঠামো গড়ে উঠেছি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় তা কিন্তু পূর্বিভারতে থেকে গেল - তার প্রমান তারপরেও ব্রিটিশ লুঠেরা রাজত্বের আগে পর্যন্ত ৬০০ বছর ধরে বৃহত্তর বাংলার বাণিজ্য এবং জ্ঞানচর্চা সকলের ঈর্ষার কারণ ছিল। সেই তৃণমূলস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ল কোরাণের আয়াত আর হদিস। পশ্চিম এশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে আমাদের আলোচ্য ভারতে এবং পূর্বভারতে নবতম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র যুক্ত হল(এর একটা অংশ পরমএর ব্রিটিশপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রকাশ করেছিলাম আমরা)। আজ বলতে বুক ফেটেযাচ্ছে, লুঠেরা, খুনে পশ্চিমের জঙ্গীপনায় ধ্বংস হওয়া বাগদাদের নিজামিয়া বিদ্যালয়ে পড়াতেন প্রখ্যাত দার্শনিক আল-গজলি। এই বিস্তৃত জ্ঞানচর্চার শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ানো হত ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র/যুক্তিবিদ্যা, অদ্বৈতবাদ, দর্শনশাস্ত্র, অঙ্ক, ধর্মতত্ত্ব এবং আইন। এখানে দর্শন দুটি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানচর্চার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল - ক। পদার্থবিদ্যা এবং অধিবিদ্যা আর এই জ্ঞানচর্চার ভিত্তি ছিল অঙ্ক, জ্যোতর্বিদ্যা, বীজগণিত, জ্যামিতি এবং পাটিগণিত। এই বিদ্যাচর্চা সাধারণত মাধ্যমিক এবং কিছুটা উচ্চতর জ্ঞানচর্চায় পাঠ্য ছিল। আর বুনিয়াদি স্তরে সারা এশিয়ায় পড়ানো হত পড়া, লেখা এবং যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মত অঙ্কের ভিত্তিপ্রস্তর।
ভারতে এই ব্যবস্থা অনুকৃত হল মাদ্রাসা, মক্তবগুলিতে। সব থেকে বড় ব্যাপার হল শিক্ষাচর্চায় বিজ্ঞানবোধ। কোথাও কোথাও দর্শনের থেকে গুরুত্ব পেল প্রযুক্তিচর্চা। বিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রগুলি তাত্ত্বিক পড়াশোনা করাত, প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা হল কারখানাগুলিতে।
ইসলামি আমলে তিনিটি মূল ধরণের পড়াশোনার কাঠামো ছিল ১। ব্যক্তিগতভাবে বহু গৃহস্থ বুনিয়াদি শিক্ষা দান করতেন; ২। মসজিদ এবং অন্যান্য ধার্মিক স্থানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা দান ক্রা হত; ৩। মক্তব আর মাদ্রাসা ছিল উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্র।
বাড়িতে বাচ্চারা শিখত অক্ষরজ্ঞান, উচ্চারণ, দ্রুতপঠন, তাখি(স্লেট বা লেখার বস্তু) -তে লেখার অভ্যেস আর কিছু ছবি আর সাধারণ আঁক কষা। তবে মাধ্যমিকস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রিভূত ছিল মসজিদ, খনকা আর দরগায়। কুতুবুদ্দিন আইবক সারা দেশজুড়ে হাজারো মাদ্রাসা, মসজিদ তৈরি করেছিলেন। তার বিদ্যাচর্চার ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব পরের সম্রাটেরা অনুসরণ করেছেন। শাহ নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং মইনুদ্দিন চিস্তি(১২৬৫খ্রি) খনকাগুলি বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। দরগাগুলি বিভিন্ন সুফির সমাধিস্থান। এবং অধিকাংশ দরগাই বিদ্যাকেন্দ্র রূপে গড়ে উঠেছিল - কেননা হাজারে হাজারে শ্রদ্ধালু মানুষ এই কেন্দ্রগুলিতে আসতেন, পথ নির্দেশ চাইতেন। মসজিদের সঙ্গে জুড়ে থাকত মক্তিব আর মাদ্রাসা। অতীত সময়ের মতই উচ্চশিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থা - কখোনো লাখেরাজের বা পীরোত্তরের মত করহীন জমি দান করে বা কখনো আর্থিক সাহায্যে। অযোধ্যার গোপামাউ আর খইরাবাদ এবং আগ্রার জৌনপুরে আফগানিস্তান, বোখারা থেকেও পাঠ নিতে আসত। প্রখ্যাত শিক্ষকেরা পড়াতেন ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র/যুক্তিবিদ্যা, অদ্বৈতবাদ, দর্শনশাস্ত্র, অঙ্ক, ধর্মতত্ত্ব এবং আইন এবং বিজ্ঞান।

বৃহতবঙ্গের বিদ্যাচর্চা২: পূর্বভারতের বৌদ্ধজ্ঞানচর্চা

বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, জগদল বিহার
বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মপাল অষ্টম শতে, আজকের ভাগলপুরের কাছাকাছি। বিক্রমশীলায় মূলত তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম পড়ানো হত - এবং সেই সূত্র ধরেই বিক্রমশীলার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর সংস্কৃত এবং অন্যান্য ভাষার বৌদ্ধ সাহিত্য তিব্বতি ভাষায় অনুদিত হয়।
বিক্রমশীলায় একটি কেন্দ্রিয় বিপুলাকৃতি প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে লাগোয়া ছিল ছটি বিদ্যালয়। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য থাকত বিপুলাকৃতি দ্বার। প্রত্যেক দ্বারে ছিলেন দ্বারপণ্ডিত - তাঁদের সন্তুষ্ট করলে, বিদ্যালয়ে প্রবেশের ছাড়পত্র মিলত - অর্থাৎ ছাত্রদের বেছে বেছে নেওয়া হত - যারা অধিকারী তাঁরাই হতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র। রত্নাকরশান্তি(এঁকে নিয়ে সে সময়ের বাংলার জ্ঞানচর্চার খুব সুন্দর ছবি এঁকেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই) যখন বাংলার বিশ্বশ্রুত পণ্ডিত দ্বারপাল রূপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, যে সময়ের প্রত্যেক ছয়টি দ্বারের দ্বারপণ্ডিতের একটি তালিকা মিলেছে - তিনি ছিলেন পূর্ব দ্বারে; পশ্চিমের দ্বারে ছিলেন কাশীর বাগীশ্বরকীর্তি; উত্তর দ্বারে -নারোপা বা নাঢপাদ(যেখান থেকে সম্ভবত ন্যাড়ানেড়ি শব্দটা এসেছে, এদের স্ত্রীর নাম হত নাঢী - পরের দিকে বাংলাড় নাড় বা নাড়ি জ্ঞানী শব্দের প্রতিরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হত); দক্ষিণ দ্বারে প্রজ্ঞাকর্মতি; প্রথম কেন্দ্রিয় দ্বারে কাশ্মীরের রত্নবজ্র এবং দ্বিতীয় কেন্দ্রিয় দ্বারে গৌড়ের জ্ঞানশ্রীমিত্র।
কি, কখন, কিভাবে পড়ানো হত তা কোনো সূত্র পাওয়া যায় নি। তবে সেসময়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাধারণত ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, তন্ত্র এবং নানান ধর্মীয় শাস্ত্র পড়ানো হত। বিক্রমশীলায় তিব্বতি বৌদ্ধ শাস্ত্র শিক্ষার সব থেকে বড় ক্ষেত্র ছিল। এখানকার ছাত্ররা তিব্বতের নানান বৌদ্ধ মঠ বা রাজসভায় শিক্ষক বা অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বিক্রমশীলা উপাধি দিত - এই উপাধি দেওয়া আবার বিক্রমশীলার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল। তিব্বত সূত্রে যে দুজন ছাত্রের নাম পাওয়া যাচ্ছে - জেতারি আর রত্নবজ্র - তাঁরা এই বিদ্যালয় থেকে উপাধি পেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক, বাংলার রাজার থেকেও শংসাপত্র পান।
বিক্রমশীলার নাম অমর হয়ে থাকবে বাঙ্গালী পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান(জ ৯৮০)এর জন্য। তিনি এক সময় বিক্রমশীলার উপাচার্য(১০৩৪-৩৮)ও হন। তিব্বতী রাজার আমন্ত্রণে তিনি জীবনের শেষ ১৩ বছর তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম(বজ্রযান)এর নানা গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে অনুবাদ, বিশ্লেষণ করেন, তিব্বতে আজও তিনি দ্বিতীয় বুদ্ধরূপে পুজিত হন। বিক্রমশীলার অন্য ছাত্রদের মধ্যে বিরোচন রক্ষিত(জ ৭৫০), জেতারি, রত্নাকরশান্তি, জ্ঞানশ্রীমিত্র, রত্নবজ্র এবং বাগীশ্বরকীর্তি অন্যতম, তাঁরা প্রত্যেকেই জ্ঞানী দ্বারী রূপে সময় ব্যয় করেছেন তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ভারত ভ্রমণ কালে হিউএনসাং ভারতের অন্য নানান একালায় এ ধরণের শিক্ষা ক্ষেত্র লক্ষ্য করেছেন। কাশ্মীর ছিল একটি বড় কেন্দ্র জয়েন্দ্রতে বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা ক্ষেত্র চলত। তিনি সেখানে বহুকাল বসবাস করেন এবং অধ্যয়ন, এবং ধর্মগ্রন্থ সংগ্রহ করেন। পাঞ্জাবে চিনাপতি, জলন্ধর, যুক্ত প্রদেশে মতিপুর এবং কনৌজ এবং ভদ্রতে বিহার ছিল। তবে উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমের যত বিহার তিনি দেখেছিলেন, সেগুলি তাদের ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল ততদিনে। কিন্তু ইসলামের বাংলা বিজয়ের আগে পর্যন্ত কিন্তু বাংলায় বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ধারা অপ্রতিহিত গতিতে চলছিল - বিশেষ করে ওদন্তপুরী এবং জগদ্দল বিহারে।
ওদন্তপুরী
প্রতিষ্ঠা করেন গোপাল। এখানে যুক্ত ছিলেন রত্নাকরশান্তি, দীপঙ্করশ্রীজ্ঞান অতীশ, শ্রীল রক্ষিত প্রভৃতি বিশ্বশ্রুত পণ্ডিত। বিক্রমশীলায় যাঁরা দ্বারপণ্ডিত রূপে বৃত হতেন, তাঁদের ভিত্তি স্থাপিত হত ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই ১৯ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের কাছে নাড়া বেঁধে ১৯ বছর বয়সী দীপঙ্কর জ্ঞানবিশ্বে প্রবেশের অনুমতি লাভ করেন। তিব্বতের রাজা তিব্বতের স্যাম-এতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ওদন্তপুরী বিহারের অনুসরণেই, শান্তরক্ষিতএর পরিকল্পনায়। এখানে একাদশ দ্বাদশ শতে ১০০০ ছাত্র ছিল, মহাবোধিতে ছিল ১০০০, বিক্রমশীলায় ছিল ৩০০০ ছাত্র এবং বিপুল গ্রন্থাগার - এই বিপুল জ্ঞানচর্চার পরিকাঠামো তুর্কি লুঠেরাদের আক্রমনে বিনষ্ট হয়ে যায়।
জগদল
রামপাল দ্বাদশ শতে গঙ্গা আর করতোয়ার মাঝে, বারেন্দ্র ক্ষেত্রে জগদল বিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বখতিয়ার ১২০৩ সালে এটি অন্যান্য কেন্দ্রের মত ধ্বংস করে। এই খুব কম সময়ে বিভূতিচন্দ্র, দানশীল, শুভঙ্কর, মোক্ষকরগুপ্তর মত ছাত্র তৈরি করেছিল এই বিহার।

বৃহতবঙ্গের বিদ্যাচর্চাঃ পূর্বভারতের বৌদ্ধজ্ঞানচর্চা

ইউনিভার্সিটিজ অব ইওরোপ ইন মিডল এজেস বইতে হেস্টিংস রাশডাল বলছেন মধ্যযুগের ইওরোপে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝাত বিভিন্ন সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক, শহরে থাকা নানান ধরণের প্রযুক্তিবিদদের মিলিত জ্ঞানচর্চার প্রচেষ্টাকে। তিনি যাকে স্টুডিয়াম জেনারেল বলে অভিহিত করছেন, সেটিই আসলে আজকের লব্জে বিশ্ববিদ্যালয়। স্টুডিয়াম জেনারেল বলতে কিছু নিদির্ষ্ট জ্ঞানচর্চার শিক্ষক এবং ছাত্রর সমাহার বোজাহত, এবং ছাত্ররা আসত শুধু স্থানীয় অঞ্চল থেকে নয়, দূরদূরান্ত থেকেও - তাঁরা পড়ত উচ্চ শিক্ষার তিনটে মূল বিষয় - ধর্মতত্ত্ব(থিওলজি), আইন এবং ডাক্তারি(ল এন্ড মেডিসিন) - পরে কোনোদিন ব্রিটিশ পুর্ব ভারতের বিস্তৃত পড়াশোনার বিষয়াবলী আর সেই সময়ের ব্রিটেনের পড়াশোনার তুলনামূলক আলোচনা করব। ইওরোপের সব থেকে পুরোনো স্টুডিয়াম ছিল দ্বাদশ শতের ইতালির বোলোনা এবং রেজিওতে, এবং ফ্রান্সের প্যারিসে আর ইংলন্ডের অক্সফোর্ডে। ভারতে যে জেসুইটরা জ্ঞান নথি করতে এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন ইতালিতে শিক্ষিত - বিশেষ করে ম্যাটিও রিশি।
সাধারণত আমরা খুব বেশি ইওরোপপন্থী নই। কিন্তু বর্তমান ভারতে বহু শিক্ষিত মানুষের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রপাত ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে, ইওরোপিয় বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা ভারতে নিয়ে আসার উদ্যম - যা সর্বৈব মিথ্যে।ভারতে এই প্রচেষ্টার বহু আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে বৃহতবঙ্গের নানা স্থানে। আজকে আমরা বিহারেরগুলি আলোচনা করব। বর্তমান বিহারে, অতীতে বিহার নামে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, শিক্ষাদান করতেন। এই বিহারে বিপুল সঙ্খ্যক ভিক্ষু থাকতেন, যারা বিদ্যচর্চা করতেন নির্লিপ্তভাবে। প্রাথমিকভাবে একএকটি বিহারের দায় নিতে হত একটি সঙ্ঘকে। প্রত্যেক বিহারের প্রবীন ভিক্ষুরা একজন শিষ্যকে শিক্ষিত করার ভার নিতেন, তাকে পাঠ করতে শেখাতেন, ধর্ম কি বলতেন, এবং নির্দিষ্ট সময়ে তার পরীক্ষা নিতেন, তার অগ্রগতি বুঝতেন। বিশ্ব জুড়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের সুযোগ বাড়তে থাকায় যারা সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানচর্চার অংশ নন, তাদেরকেও বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় নিয়ে আসাহল উপশাখা নাম দিয়ে। ক্রমশঃ শধু ধর্মচর্চার পাশাপাশি ব্যাকরণ, দর্শন, ডাক্তারি, জ্যোতর্বিদ্যা সহ নানান কলা ও বিজ্ঞান শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রত্যেক বিহারে গড়ে উঠেছিল জটিল ব্যবস্থাপনার এক বিস্তৃত পরিসর, এবং তার ফলে বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানচর্চা অধ্যয়ণের সুযোগও বাড়ল। রমশ গঠিত হতে শুরু করল বিশেষ করে পূর্বভারতে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, জগদ্দল বিহারের মত বিশালাকৃতি জ্ঞানচর্চা, বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র।
নালন্দা
নালন্দা এক সময় অবৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল। গয়া ছিল বহুকালের সনাতন ধর্মের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। নাগার্জুন, তারানাথের স্মৃতি লিখতে গিয়ে, বৌদ্ধ জনগ্য এবং ব্রাহ্মণ সুদুর্জয়ের তর্কযুদ্ধের বিশদ বিররণ দিচ্ছেন। পঞ্চম শত পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বড় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিল নালন্দা। গুপ্ত রাজাদের সময় এই অঞ্চলে বেশকিছু বিশালাকৃতি বিহার গড়ে উঠতে থাকে, এই অঞ্চলের দিকচক্রবাল ঢেকে দেয়। সেই জ্ঞানচর্চার ইতিহাস চলতে থাকে একাদশ শত পর্যন্ত - ইসলামি ধ্বংসক্রিয়া পর্যন্ত। নালন্দা ছিল এক মাইল লম্বা একমাইল চওড়া এলাকা নিয়ে তৈরি এক বিশাল বিদ্যালয়। ৩০০টি পড়ানোর ঘর ছিল। ৭টি বিশাল বিশাল প্রেক্ষাগৃহ ছিল। যশোবর্মার শিলালিপি আমাদের বলে বিশ্ববিদ্যালয়টি এত উঁচু ছিল যে সেটি যেন আকাশ চুম্বন করত(সেই সময় প্রত্যেক তলাকে বিমান নামে অভিহিত করা হত)। কোরিয় তীর্থযাত্রী হুই লুন বলছেন, নালন্দা বর্গাকার এলাকাছিল, প্রত্যেক সিংহ দরজা ৩৬ ফুট উঁচু ছিল। সবথেকে বড় প্রেক্ষাগৃহের পাশে ছিল বিশাল একটা স্তুপ, এবং বিভিন্ন ধরণের মণিমুক্তো এবং দুর্মূল্য পাথরে সাজানো চৈত্য - জল ঘড়ি সময় রাখত।
হিউএনসাং বলছেন ১০০০০ ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। ইতসিং(৬৭৫খ্রি) ৩০০০ ছাত্র দেখেছিলেন। শিক্ষক ভিক্ষুর সংখ্যা ছিল ১০০০ থেকে ১৫০০। হিউএনসাং বলছেন ১০০০ ভিক্ষু ২০টি আর ৫০০ জন ৩০টি, আড় ১০ জন- যাঁদের মধ্যে তিনি পড়েন ৫০টি বিভিন্ন সূত্র আর শাস্ত্র বিশদে বোঝাতে পারতেন। এই জ্ঞানচর্চার ধারা বজায় রাখতে। রত্নসাগর, রত্নদধি রত্নরাজ্ঞক নামে তিনিটি সুবিশাল গ্রন্থাগার ছিল। এই গ্রন্থাগারগুলিতে ইতসিং ৪০০টি সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে ৫ লক্ষ শ্লোক নকল করে দেশে নিয়ে যান।
যদিও নালন্দার খ্যাতি ছিল মহাযান বিশেষ করে বসুবন্ধু, নাগার্জুন, অসঙ্গ, ধর্মকীর্তির নানান বিদ্যাচর্চা জ্ঞানচর্চা ক্ষেত্র রূপে; কিন্তু হীনযান জ্ঞানচর্চা, আথবা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য জ্ঞানচর্চা যেমন বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা এবং আয়ুর্বেদ পড়ানো হত। ভারতে এমন কোন জ্ঞানচর্চা ছিল না যা নালন্দায় পড়ানো হত না। চিন, কোরিয়া, তিব্বত এবং তোখারা থেকে ছাত্ররা পড়তে আসতেন সেখানে, পড়াতেন বিশ্বশ্রুত পণ্ডিতেরা। ফলে বিশ্বের নানান স্থানে নালন্দার ছাত্র শিক্ষদের চাহিদা ছিল উত্তুঙ্গ। পাশের বাড়ির তিব্বতে অষ্টম শতে রাজা চন্দ্রাগোমিনের উদ্যোগে তব্বতীয় বিদ্যা শুরু হয়, বিভিন্ন বৌদ্ধ এবং সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। চিনে নালন্দার ছাত্র হিসেবে অষ্টম শতে শুভঙ্কর সিংহ এবং দশম শতে ধর্মদেব পড়াতে যান। তবে নালন্দার পাঠ্যক্রম পাওয়া যায় নি।

Wednesday, March 23, 2016

ফারাক্কার আশনি সঙ্কেত

কলাবতী মুদ্রা যে আন্তর্জাতিক ক্রুজে অনুষ্ঠান করে, সেটি গঙ্গা বয়ে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত যায় - বিদেশি পর্যটকেদের এতই ভিড় থাকে যে মাসে চারটে ট্রিপ করতে হয় - কর্তৃপক্ষ জানিয়ে ছিলেন আগামী দু বছর তাঁদের জাহাজের সমস্ত ট্রিপ ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
অথচ গত পনের দিন ধরে সেই ক্রুজ প্রায় বন্ধ। জানা গেল গঙ্গায় জলের অভাবেই জাহাজ খুব কষ্ট করেই যাতায়াত করছে - এবং শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই মাসে তিনটে দলের ভ্রমণ বাতিল করতে হয়েছে। অথচ বুকিং ছিল পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত - সেগুলিও বাতিলের মুখে। কর্তৃপক্ষ জানালেন হয়ত এই মরশুমে হয়ত আর জাহাজ চালানো যাবে না।
ফারাক্কা বিষয়ে দূরদর্শী 'পাকিস্তানি চর' কপিল ভট্টচার্য যা বলেছিলেন, তা গত কয়েক দশক ধরে বর্ণে বর্ণে ফলে যাচ্ছে-
(১) গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক জল সংযোগ(ফিডার) খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।
(২) গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের জন্য জল প্রবাহ দুষ্কর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।
(৩) ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতি শক্তির নদী - এবং এটি গঙ্গার নিম্নতম প্রবাহ। তাই গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি হবে।
(৬) ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
(৭) শুষ্ক মরসুমে জল প্রবাহ কম হওয়ার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন হবে।
গত কয়েকদিন ধরে ২১০০ মেগাওয়াটের ফারাক্কা জলবিদ্যুৎ প্রকলপের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ আছে। ফারাক্কা কর্মীদের বসতিতে ব্যবহারের জন্য জল পাওয়া যাচ্ছে না - জল কিনতে হচ্ছে - যেমন করে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ কিনে বহু বাঁধের বিদ্যুৎ প্রয়োজন মেটানো হয়। সংযোগ খালে জল শুকিয়ে ফুটিফাটা।
দূরদর্শনে শোনাগেল ফারাক্কায় জলবিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ। চ্যানেলগুলোর হাহাকার বিহার, ঝাড়খণ্ড আর বাংলা, অসম বিদ্যুৎ পাবে না - অথচ গঙ্গার মৃত্যুতে দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতি মরে যাবে - নিম্ন বাংলা মরতে বসেছে - সে কথা উঠছে না। শুধু অকালেই ক্রুজ বন্ধ বা বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়া, নয় গত কয়েক দশকে গঙ্গার ভাঙ্গন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কয়েক লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি থেকে ভাঙ্গনের জন্য উচ্ছেদ হচ্ছেন সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু হাজার পরিবার।
এই বাংলা বা ভারত সরকার নতুন করে ভাবুক কি করা যায়।

উচ্চবর্ণের নিপীড়নঃ আমাদের তত্ত্ব

আমার নিজের একটা তত্ত্ব আছে। আজ যারা মূল নিবাসী আন্দোলন করদেন বা বহু মানুষ মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করেন ছোট জাতের মানুষদের উচ্চবর্ণ দমিয়ে রেখে ছিল, সেটা কিন্তু ব্রিটিশ ধ্বংসলীলার আগে হতে পারে নি। তাঁর জন্য গোটা উচ্চবর্ণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পঞ্চম বাহিনী হয়ে কাজ করতে হয়েছে।
বাংলা(বৃহত্তরবঙ্গ, দীনেশ সেন মশয় উবাচ) ব্যবসায় জ্ঞানচর্চায় অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। এখানে বহু আগে হেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসেছে, বৌদ্ধ ধর্মের উত্তুঙ্গ সময়েও, তাঁর পরেও এই ব্রিটিশ আমলের আগেও। সভ্যতাটা মূলত ছিল শুদ্র সভ্যতা। বিশ্বাস, ঘোষ, পোদ, সাঁওতাল, মুণ্ডা, বাগদী, হাড়ি এবং আরও অনেক সমাজ বাংলার নানান জায়গায় রাজত্ব, উৎপাদন আর ব্যবসা করত। হিপ্পালাসের বহু আগে থেকেই তাঁরা মৌসুমী বায়ূ বয়ে বিদেশে ব্যবসা করতে যেতেন। লোহা, যার নাম অয়ষ্কান্ত নামে খ্যাত ছিল - তা ছিল মর্চেহীন ইস্পাত ক্রুসিবল স্টিল - তৈরি করতেন আদিবাসী সমাজ। অনেক সময় ধাতুর প্রতিশব্দ রূপে লোহা ব্যবহার হয়েছে। কৃষি ছিল মাত্র ২৭ শতাংশের জীবিকা অন্যান্যরা তাঁকে নির্ভর করে জীবিকা ব্যবসা নির্বাহ করেছে। এই যে ব্যাপ্ত সভ্যতা, তা চালাত এ দেশেরই গ্রামীণ শুদ্ররা।
উচ্চবর্ণ জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পেল শ্রীচৈতন্যের আমলে - তাঁর আগে পর্যন্ত ছিল এদেশিদের রমরমা - সাহিত্যে দেখুন, ব্যবসায় দেখুন সব কিছুতেই এদের জাঁক। চৈতন্যের পরে ধর্ম প্রচারে তাঁরা গ্রামে ঢূকলেন। বুঝতে শুরু করলেন এদেশের সমাজ ব্যবস্থা। চৈতন্য বিদ্রোহী ছিলেন - কিন্তু গৌড়িয় মতের মত নাকউঁচু, বর্ণভেদী ব্যবস্থার ধারক হয়ে উঠলেন গোস্বামী ভাইয়েরা। তাঁরা কিন্তু বাংলায় কিছু লিখলেন না। প্রচুর ব্যবসায়ী শ্রীচৈতন্যের অনুগামী হলেন। তখনও বাংলার উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা কিন্তু দেশিয়দের হাতে। আরবি ফার্সি শিখে যারা রাজসভার দাক্ষিণ্য পেলেন, তাঁরা তখনও কিন্তু গ্রাম্য উৎপাদন ব্যবস্থায় দাঁত ফোটাতে পারেন নি। নানান ভাবে চেষ্টা করে গিয়েছেন। তখনও কিন্তু রাষ্ট্র সমাজের স্বাতন্ত্র্যে হাত দেয় নি। কাবাব ঘোঁট অনেক চেষ্টা করেছে - পালেদের সময়ে দেখুন - কৈবর্তদের মেরেফেলা হয়েছ, বৌদ্ধধর্ম অস্তাচলে গিয়েছে, কিন্তু ছোটজাতের মানুষদের সমাজ নিয়ন্ত্রণ যায় নি। ১৭৫৭তে সুযোগ হল ব্রিটিশদের হাত ধরে এই ব্যাপ্ত পরিকাঠামো ধ্বংস করা। কাবাবেরা উঠে এল পাদপ্রদীপের আলোয়। শুরু হল নবজাগরণ। বঙ্কিমচন্দ্র বললেন ইসলাম নয় এখন পুজ্য ব্রিটিশ, তা ভগবানের দান।

Tuesday, March 22, 2016

বাংলার বাণিজ্যচর্চা: তারানাথ তর্কবাচস্পতি, Traditional Business Of Bengal: Taranath Tarrkabacospoti

খুব সম্প্রতি সরকার নির্ভর পুঁজিবাদ নিয়ে খুব তর্ক বিতর্ক উঠছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশে পলাশীর কুশিলবেরা কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে বড় মানুষ হয়ে উঠছেন - কোম্পানির রাজত্বের কর্ণধারদের সঙ্গে ওঠা বসার সুযোগে ধনবান হয়ে উঠছেন - এমনকি বিদ্যাসাগর মশাইও ব্যবসায়ে সরকার নির্ভরতার পথ ধরতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
অথচ তারানাথ বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে পড়েও তাঁর সহধ্যায়ীদের মত চাকুরিজীবিও হননি, আবার সরকারি সুযোগ সুবিধে নিয়েও ধনী হননি। চিরাচরিত ব্যবসায়ী বাংলার অতীত ঐতিহ্য মেনে কলকাতার বাইরে চালিয়েছেন বিশাল কর্মযজ্ঞ।
সেই মানুষটির প্রতি ছোট ব্যবসায়ীদের সংগঠন উইভার্স, পার্ফরমিং আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফরমিং আর্টিস্টস গিল্ডএর শ্রদ্ধার্ঘ-





কালিদাস সার্বভৌমের পুত্র তারানাথ তর্কবাচস্পতি ১৮১২ খৃষ্টাব্দে কালনায় জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগরের চেয়ে তারানাথ প্রায় আট নয় বছরের বড় ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের ততকালীন অধ্যক্ষ, বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন মশায়ের সঙ্গে কালনার 'বাঙাল ভট্টাচার্য' পরিবারের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।
রামকমল প্রায়ই কালনায় যেতেন। তিনিই তারানাথ ও তাঁর জৈষ্ঠতাতপুত্র তারাকান্তকে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেন। তারানাথ প্রথমে অলংকার শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক নিমচাঁদ শিরোমণির কাছে ন্যায়শাস্ত্র আধ্যয়ন করেন। যখন তিনি ন্যায়শাস্ত্রের ছাত্র, তখন বিদ্যাসাগর আলঙ্কার শ্রেণীর ছাত্র। প্রতিদিন বিকেলবেলা ছুটির পর বিদ্যাসাগর, তারানাথের ঠনঠনিয়ার বাসায় যেতেন। তখনকার কলকাতার বড় বড় পণ্ডিতসভায় তারানাথ বিচারের জন্য আমন্ত্রিত হতেন এবং বালক ছাত্র বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি যেতেন সভায়। বিদ্যাসাগরকে দিয়েই তিনি সবায় প্রায়ই 'পূর্বপক্ষ' করাতেন। পনের বছরের বালক বিদ্যাসাগরের 'পূর্বপক্ষ' করা দেখে সকলে বিস্মিত হতেন। পরে তারানাথ উঠে সভাস্থ পণ্ডিতদের বিচারে পরাস্ত করতেন।
কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পর বাচস্পতি মশায় বর্ধমানের সদর আমিন পদের নিয়োগপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। বৃত্তিভোগ করা বা চাকুরী করার মতন মনোভাব তাঁর কোনকালেই ছিল না, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে উন্নতি করাই বাচস্পতি মশায়ের কাম্য ছিল। ...কালনায় নিজ বাড়িতে টোল ...খুললেন ...এবং কাপড়ের দোকান খুললেন বাজারে। তখন বিলেতী কাপড়ের আমদানি পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় নি। বিলেতী সুতো কিনে আম্বিকা-কালনায় প্রায় বারোশ তন্তুবায়কে দিয়ে তিনি কাপড় বুনিয়ে ব্যবসা করতেন এবং বাইরেতেও কাপড় চালান দিতেন। কিছুদিন পরে তারানাথ মেদিনীপুর জেলার রাধানগর গ্রামে কাপড়ের কুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। কাশী, মির্জাপুর, কানপুর, মথুরা, গোয়ালিয়র প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি কাপড় পাঠাতেন। তখনও কিন্তু রেলপথ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গরুর গাড়িতে আথবা মুটের মাথায় পণ্ডিত মশায় লক্ষ লক্ষ টাকার কাপড় চালান দিতেন। কলকাতার বড়বাজারেও তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। কাশী-আমৃতশহর থেকে তখন প্রায় ছয় লক্ষ টাকার শাল বাংলাদেশে আমদানি হত। তাঁর মধ্যে প্রায় এক লক্ষ টাকার শাল বাচস্পতি মশায় নিজে আমদানি করতেন। এ-ছাড়া হীরা-জহরত, সোনা-রূপার আলঙ্গারেরও তাঁর ব্যবসা ছিল। বীরভূমের দশ হাজার বিঘে জঙ্গল কিনে তিনি চাষ আরম্ভ করেন এবং পাঁচশ গরু কেনেন দুধ-ঘিয়ের ব্যবসার জন্য। মুটের মাথায় করে কলকাতায় ঘি এনে তিনি বিক্রী করতেন। কালনাতে তিনি নেপালে ও তরাই অঞ্চল থেকে কাঠ আমদানি শুরু করেন এবং কাঠের ব্যবসাতেই কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। এই সময় কালনাতে তিনি প্রাসাদের মত বিরাট অট্টালিকা তৈরি করেন বসবাসের জন্য। কাপড় কাঠ ছাড়া চালের ব্যবসা করতেও বাচস্পতি মশায় ছাড়েননি। কালনায় কয়েক শত ঢেঁকি বসিয়ে তিনি ধান ভানতে আরম্ভ করেন, কারণ চালের কল তখনও তেমন আমদানি হয় নি। ঢেঁকির শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে কালনাবাসী যখন অভিযোগ করেন, তখন তিনি তাঁর ঢেঁকিশাল বা ঢেঁকির কারখানা দূরের গাঁয়ে সরিয়ে নিয়ে যান।

বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি্র থেকে(বই কৃতজ্ঞতাঃ সৌমেন নাথ)

Saturday, March 19, 2016

কেন বড় পুঁজির বিরোধিতা, Why we oppose corporate capital

এই শিক্ষিত বিতর্কে অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মুর্খ, কুসংকারাচ্ছন্ন, সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্য না দেখে গ্রামের মধ্যে বাস করা কুপমণ্ডুকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু কথা - গুছিয়ে বলতে পারব কি না জানি না চেষ্টা করছি।
বড় পুঁজি ছোট্ট পুঁজি বিতর্কে আমরা সাধারণের স্বার্থবাহী ছোট্ট পুঁজির পক্ষে - ছোট্ট পুঁজি খুব বেশি মানুষ/গোষ্ঠীর হাতে পুঁজি পুঁজি জমতে দেয় না - অনেক ছোট উৎপাদক বিক্রেতা থাকলে সেই উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থায় লাভ ছড়িয়ে যায় সমাজের মধ্যে। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ আগ্রাসনের পূর্বে ভারত/এশিয়া/লাতিন আমেরিকা/আফ্রিকা মূলত ছোট পুঁজির অঞ্চল ছিল। বড় পুঁজি কি ছিল না? ছিল। ব্যবসায়ীরা যে সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে বিদেশে ব্যবসা করতে যেতেন, তা তো আদতে বড় পুঁজি - কিন্তু কর্পোরেট পুঁজি ছিল না। তার ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রবল ছিল। তাঁকে ঘাড় ধরে সিএসআর করাতে হত না।
পলাশির আগেও বড় পুঁজি সমাজ-রাষ্ট্রের সার্বিক নীতি নির্ধারণ করার অবস্থায় ছিল না। তার কিছু বিধিনিষেধ ছিল। এক উৎপাদক অন্য উতপাদকের উৎপাদন পরিকাঠামো কিনে নিতে পারত না - শিল্পবিপ্লবীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন কোন উৎপাদক না চাইলেও তার ব্যবসা অন্য উৎপাদক কিনে নিতে পারেন হোস্টাইল টেকওভারএর মাধ্যমে - জানি বড় পুঁজি আরও বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে তার থেকে পাঁচগুণ বড় কোম্পানি কিনে নিয়ে তা সামলাতে না পেরে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয় - এ তত্ত্ব-তথ্য খুব সম্প্রতির ইতিহাসে প্রমানিত। কৃষককে যদি ছোট্ট পুঁজির উতপাদন ব্যবস্থার অংশ ধরি, রাষ্ট্রের মদতে সেই লাভের(কৃষিকে শুধু লাভজনক উতপাদন ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে গিয়ে কৃষির কর্পোরেটাইজেশন ঘটছে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে) উতপাদন-ব্যবসাকে জোর করে সারা বিশ্বজুড়ে দখল করা হচ্ছে, বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে।
ভারত বহুকাল ধরে বহু কৃষি ও শিল্প উৎপাদন সারা বিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসা করে এসেছে - নীল থেকে ইস্পাতের মণ্ড পর্যন্ত - তখন জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি তার নিজস্ব ছিল। তার জোরে ১৮০০ পর্যন্ত সে ছিল ব্যবসায় উতবৃত্ত দেশ। বড় পুঁজির বিতরণ ব্যবস্থা(এমন কি ছোট্ট পুঁজিও) সেগুলি নিয়ে বিদেশে গিয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় দাঁত ফোটাতে পারে নি। প্রসন্নন পার্থসারথি বা ওম প্রকাশজীদের তাঁতিদের বিষয়ে গবেষণা বলছে, পলাশীর আগে পর্যন্ত তাঁতিরা ব্যবসায়ীদের দাদন ফিরিয়ে দিতে পারতেন - তাদের রোজগার ছিল ইওরোপের তাঁতিদের তুলনায় অনেক বেশি। নীল উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থাই ধরা যাক, ২০০০ বছর আগে রোমে ভারতীয় নীল যেই - নাম ইন্ডিগো ভৌগোলিকতার সূত্র ধরে - নীল লাতিন আমেরিকা থেকেও সে সময়ের ইওরোপে আসত - কিন্তু তারও নাম ছিল ইন্ডিগো - এই ব্যবসাকে ১৮০০ সালের পর রাষ্ট্রের মদতে, বড় পুঁজি উতপাদকেদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে দখল - তারপর ধ্বংস করল, সে সময়ের আগে একচেটিয়া ব্যবসা করেও কেন্দ্রিয় দখলদারির, চাষীদের নিংড়ে লাভের শেষ কপর্দক তুলে নেওয়ার নীলকর তৈরি হয় নি। ম্যাঞ্চেষ্টারের অতিরিক্ত উতপাদনের কাপড় মিলগুলি লাভ করতে ততদিন পারে নি, যতদিন না বন্দুকের মুখে দাঁড় করিয়ে ভারতের আড়ংগুলি ধ্বংস করা হয় নি, নীল চাষ-ব্যবসা দখল করা হয় নি, ইওরোপে ইস্পাতের (ধাতুর) কারখানা চলে নি যতদিননা ভারত ব্যপ্ত ৩০০০০ চলন্তিকা ছোট্ট গলনচুল্লির ধারক-বাহক, দেশের ছোট সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ ডোকরা উতপাদকেদের ধ্বংস করা হয় নি - এই ইস্পাত মণ্ড দিয়ে এক সময় বিশ্ববিখ্যাত দামাস্কাস তরোয়াল তৈরি হত।
আর্যভটের হাত ধরে আরও হাজারো গুনীর চেষ্টায় যে নিয়ন্ত্রণমুক্ত কলন বিদ্যা তাঁতিদের, নাবিকদের, চাষীদের হাতে প্রতিকূলতা জয় করার করার সুযোগ করে দিয়েছিল, বিশিল্পিয়ায়ন করার উদ্যমে সেই ব্যপ্ত কেন্দ্রবিহীন ভারতজোড়া বিদ্যাচর্চাকেও উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ধ্বংস করা হল, ইওরোপে গিয়ে সেই মুক্ত প্রাথমিক জ্ঞানচর্চা হয়ে উঠল উচ্চতম শিক্ষাব্যবস্থার অংশ। বাংলা তথা ভারতের স্বাস্থ্য ববস্থার অন্যতম ধারক বসন্তের টিকাকারদের নিষিদ্ধ করে জেনারের উদ্ভাবিত টিকা ব্যবস্থাকেই চালাতে হয়েছে।
ছোট্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় উতপাদকের নিয়ন্ত্রণে থাকে প্রযুক্তির প্রয়োগে। কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণযুক্ত বড় পুঁজি চেষ্টা করেই যাচ্ছে প্রযুক্তি, জ্ঞানচর্চার দখল পেটেন্ট, কপিরাইট ইত্যাদি ব্যবস্থা করে নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে। তাহলে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তার দখলদারি নিশ্চিত হয়। তাই উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র বিচারে আমাদের প্রাথমিক প্রশ্ন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? পুঁজির চরিত্র কি - সে অন্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে কন্সোলিডেশনের নাম করে, উন্নয়নের নাম করে সমাজের সম্পদ দখল করার ছাড়পত্র পায় কি না।
অন্য সভ্যতার কথা জানি না, ভারত মূলত শুদ্র সভ্যতা - জ্ঞানচর্চা, উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণহীন পকড় নতুন ভাবে ভারতকে বসিয়েছিল বিশ্ব উতপাদন ব্যবস্থায়। ইতর, ছোটলোকেদের হাতে ছিল দেশের মূল উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থা - তাঁরাই তৈরি করেছিলেন এই ব্যবস্থার দর্শন। কয়েক হাজার বছর ধরে শুদ্ররা, বৈশ্যরা, নিজেদের বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন দর্শন তৈরি করেছিলেন - যে দর্শনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে গিয়েছে ইওরোপ ৫০০ বছর ধরে। পলাশির পর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বিশিল্পিয়ায়ন, জ্ঞানচর্চা ধ্বংস, লুঠ, খুন ব্যবস্থা নামিয়ে এনে সেই দর্শন ধ্বংস বাস্তবে রূপ পায়, তা চরম রূপ ধারণ করেছে স্বাধীনতার পর - তার জন্য কয়েক কোটি গ্রামীন শুদ্রকে উচ্ছেদ করতে হয়েছে - সে লড়াই চলছে আজও। তবুও রক্তবীজের বংশধরেরা তাদের মত করে দেশের গ্রাম উতপাদন ব্যবস্থা ধারণ করে রয়েছেন বলেই বিশ্ব মন্দা ভারতে প্রভাব ফেলে না।
আর কেন এই উতপাদন ব্যবস্থায় রয়েছি, কেন এই বড় পুঁজির প্রযুক্তি ব্যবহার করি? এই দখলদারির রাষ্ট্র ব্যবস্থা না মেনে নিয়েও যেমন করে কাশ্মীর, উত্তরপূর্ব ভারতকে বন্দুকের নলের জোরে দখল রাখা, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো ভারত রাষ্ট্রের অংশ হয়ে থাকি, তার দেওয়া নানান ভর্তুকি খেয়ে ফুলে ফলে বেড়ে উঠতে থাকি, ঠিক সেই যুক্তিতেই বড় পুঁজির দখলদারির প্রতিবাদ জানিয়েও সেই ব্যবস্থাকে মেনে নিই নিমরাজি হয়েও।

Tuesday, March 8, 2016

দেশজ কৃষ্টি চর্চা - নারকেল মালার ললন্তিকা

আমাদের(বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ) বীরভূমী মেয়েরা এই কাজটি করেছেন। অসাধারণ এর চেহারা।
না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
কি সাধারণ জিনিস দিয়ে অসাধারণ সব জিনিস্পত্র তৈরি করেন!

পাওয়া যাচ্ছে হাওড়ার অবনী রিভারসাইড মলএ পরম মাটিতে।



 

Monday, March 7, 2016

শুদ্র সভ্যতার দেশজ শিল্প চর্চা

শুদ্র সভ্যতায় সক্কলকে আমন্ত্রণ।
বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক...
পরম মাটি আপণে বঙ্গ সভ্যতার নবতম সৃষ্টি।
ঢেঁকি ছাঁটা চাল এসেছে - এবং শেষ হয়ে গিয়েছে।
পরেরটি আসছে - বিশ্ববংলার জন্য,
আপনাদের জন্যও।