Monday, April 30, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮৬ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

ওয়িয়েন্টালাইজিং ইন্ডিয়া
সিপাহি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা তাদের জবড়জং ভারি ইওরোপিয় পোষাক ছেড়ে বেরিয়ে এল, এবং পরিধেয়কে নতুন করে সাজিয়ে তুলল। সিপাহি যুদ্ধের প্রতিবেদন পাঠাবার জন্যে ডবলিউ এইচ রাসেলকে সাংবাদিক হিসেবে ভারতে পাঠিয়েছিল টাইমস, তিনি তার চিঠিতে লিখলেন,
আই হ্যাভ অফন থট হাউ এস্টনিশড এন্ড সামথিং মোর, দ্য হর্সগার্ডস, অর দ্য অথরিটিজ, অর দ্য ক্লোদিং ডিপার্টমেন্টস, অর হোয়াটএভার অর হুএভার ইট মে বি দ্যাট ইজ ইন্টারেস্টেড ইন দ্য ওয়েটি ম্যাটার্স অব ইউনিফর্ম, এন্ড ডিসাইডস অন দ্য ব্রেদ অব দ্য কাফস, দ্য সাইজ অব লেস, দ্য নেচার অব ট্রাউজার স্ট্রাপস, এন্ড দ্য কাট অব বটনস, উড বি এট দ্য এস্পেকটস অব দিস ব্রিটিশ আর্মি ইন ইন্ডিয়া! হাউ গুড স্যর জর্জ ব্রাউন, ফর ইন্সট্যান্স, উড স্ট্যান্ড এঘাস্ট এট দ্য সাইট অব দিজ সানবার্নট ‘বাশি-বাজুকস’ হু, ফ্রম হিল টু হেড এন্ড আপওয়ার্ডস, সেট এট ডিফায়েন্স দ্য সাক্রেড ইনজাঙ্কশানস অব হার ম্যাজেস্টিজ রেগুলেশনস! এক্সসেপ্ট দ্য হাইল্যান্ডার্স ... নট আ ক্রপস দ্যাট আই হ্যাভ সিন স্পট আ মরসেল অব পিঙ্ক, অর শো আ ফ্রাগমেন্ট অব ইংলিশ স্কার্লেট। দ্য হাইল্যান্ডার্স ওয়ার এক্সেন্ট্রিক শেডস অব গ্রে লিনেন ওভার দেয়ার বনেটস; দ্য কিল্ট ইজ ডিসকার্ডেড ... লর্ড কার্ডিগান, ইন হিজ মোস্ট স্যাগেসিয়াস মোমেন্টস, উড নেভার লাইট অন দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট দোজ ডার্ক-ফেসড, বিয়ার্ডেড হর্সমেন, ক্ল্যাড ইন স্নোয়ি হোয়াইট, উইথ ফ্ল্যাগলেস ল্যান্সেস গ্লিটারিং ইন দ্য সান, আর দ্য ওয়ার হার্ডেনড ট্রুপার্স অব হার ম্যাজেস্টিজ ৯থ ল্যান্সার্স; অর দ্যাট ইয়ংডার গ্রে টিউনিকড ক্যাভেলিয়ার্স, উইথ ইল-ডিফাইন্ড হেড-ড্রেসেস, বিলং টু দ্য কুইনস বে’স... এমাং দ্য অফিসার্স ইন্ডিভিজুয়াল টেস্ট এন্ড ফ্যান্টাসি হ্যাভ ফুল প্লে। দ্য ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টস, ফর দ্য মোস্ট পার্ট, আর ড্রেসড ইন লিনেন ফ্রকস, ডায়েড কার্কি অর গ্রে স্লেট কালার – স্লেট-ব্লু ট্রাউজার্স, এন্ড শেকোজ প্রোটেকটেড বাই পুগারিজ অর লিনেন কভার্স, ফ্রম দ্য সান... ইট ইজ রিয়্যালি ওয়ান্ডারফুল হোয়াট ফেডুন্ডিটি অর ইনভেন্সন ইন দ্যট ড্রেস দেয়ার ইজ, আফটার অল, ইন দ্য ব্রিটিস মাইন্ড হোয়েন ইটস ট্যালেন্টস ক্যান বি প্রপার্লি ডেভেলপড, টু বিগ্যান উইথ দ্য হেডড্রেস। দ্য ফেভারিট উইয়ার ইজ আ হেলমেট অব ভ্যারিং শেপ, বাট অব ইউনিফর্ম আগ্লিনেস, ইন আ মোমেন্ট অব ইন্সপিরেশন সাম ক্যালকাটা হেটার কন্সিভড, আফটার আ ক্লোজ স্টাডি অব দ্য এন্টিক মডেলস, দ্য গ্রেট আইডিয়া অব রিভাইভিং, ফর এভরিডে উইজ দ্য অ ইন্সপায়ারিং হেড পিস অব পাল্লাজ এথেনি; এন্ড দ্যাট রিমার্কেব্লি আনবিকামিং এফেয়ার... বিকেম দ্য প্রোটটাইপ অব দ্য ইন্ডিয়ান টোপ ইন হুইচ দ্য ওয়াইজেস্ট এন্ড দ্য গ্রেটেস্ট অব ম্যানকাইন্ড লুকস সিমপ্লি রিডিকুলাস এন্ড লুডিক্রুয়াস। হোয়াটএভার ইট মাইট ইন পলিশড স্টিল অর বার্নিশড মেটাল, দ্য হেলমেট ইজ আ ডিক্লাইনড ফেইলিওর ইন ফেল্ট অর উইকাররওয়ার্ক অর পিথ অর এজ ফার এজ এক্সটারনাল এফেকট ইজ কন্সার্নড। ইট ইজ ভেরিয়াসলি ফ্যাব্রিকেটেড, উইথ মেনি ভ্যারাইটিজ অব ইন্টিরিওর ডাক্টস এন্ড প্যাসেজেস লিডিং টু এস্কেপ-হোলস ফর ইমাজিনারি হট এয়ার ইন দ্য ফ্রন্ট অর টপ, এন্ড এরাউন্ড ইট আর টুইস্টেড ইনফাইনাইট কালার্স এন্ড ফর্মস অব টার্বানস উইথ ফ্রিনজড এন্ডস এন্ড লেসড ফ্রিঞ্জেস। হোয়েন আ পিকক ফেদার, উইথ দ্য আইরিস এন্ডস ডিস্প্লেইড, ইজ ইন্সার্টেড ইন দ্য হোল ইন দ্য টপ অব দ্য হেলমেট, অর ইজ স্ট্রাক ইন দ্য পুগারি এরাউন্ড ইট, দ্য এফেক্ট অব দ্য কভারিং ইজ মাচ এনহ্যানসড...আই হ্যাভ সিন মোর দ্যান ওয়ান পিস্তল ইন ওয়ান অব দ্য কমরবন্ধস, অর লং শ্যাসেজ, হুইচ সাম অব আওয়ার অফিসার্স উইয়ার রাউন্ড স্টমাক ইন দ্য ওরিয়েন্টাল ফ্যাশনস।

বিপ্লবের পর উত্তরভারতে সামাজিকভাবে শান্তি এলে সেনাকে আবার নতুন করে সাজানো হয়। বাংলা সেনাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ইওরোপিয় সেনারা যারা কোম্পানির চাকরিতে ছিলেন তাদের অবসরভাতা দিয়ে বা ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া যে সব ইওরোপিয় ট্রুপ ভারতে রয়্যাল ব্যাটেলয়ান হিসেবে ছিল, তাদের সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হল। ভারতীয় সেনায় ব্রিটিস সেনা আধিকারিকেরা রাজার অধীনে এলেন এবং ভারতের বিভিন্ন ভারতীয় সেনাদের নিয়ে তৈরি বাহিনীতে যোগ দিলেন। শিখেদের মত যোদ্ধা জাতিদের থেকে বাহিনীতে বেছে বেছে নেওয়া হতে শুরু করল, ১৯১২য় মোট সেনার মধ্যে ২০% শিখ, ১৬% পাঞ্জাবি মুসলমান, ১২% গুর্খা, রাজস্থানের রাজপুত ৮%, ডোগরা আর গাড়োয়ালিরা ৭.৫%, পাঠান ৮ শতাংশ, জাট ৬%। বাকি সেনারা এল মারাঠা, ব্রাহ্মণ, হিন্দুস্থানী মুসলমান এবং অন্যান্য হিন্দুদের থেকে যাদের মধ্যে তামিল আর তেলুগুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮৫ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
রেলরাস্তা বাড়তে থাকার ফলে ভাইসরয়, তার বাহিনী, নানান স্তরের প্রশাসক এবং অন্যান্য উচ্চ পদাধিকারীরা তার সঙ্গে এবং আলাদা করে ভারতে বেরাতে শুরু করে দিলেন অনেক বেশি মাত্রায়। কেন্দ্রিয় সরকার এবং অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সুবায় শীতকালীন এবং গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল এই সব রাজধানীতে প্রায়শই নানান ধরণের বৈঠক লেগেই থাকত এবং সেই বৈঠকে ইওরোপিয় প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে দেশিয় অভিজাত, রাজা, জমিদার, বড় ব্যবসায়ী এবং সেনায় কাজ করা নিম্নপদের আধিকারিকেরা যোগ দিতেন। রাজার জন্ম দিন, জুবিলি, সপ্তম এডওয়ার্ড এবং পঞ্চম জর্জের সিংহাসনে আরোহন ইত্যাদি আয়োজন ভারতে এবং ইংলন্ডে সাম্রাজ্যের গরীমা প্রকাশের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ খালে যাতায়াত চালু হয়ে যাওয়ার পর ভারত ইংলন্ডের মধ্যে যোগাযোগের সময় একমাসের বেশি সময় কমে যায় এবং ভারতীয় অভিজাত রাজা রাজড়াদের ব্রিটেনে যাওয়া বাড়তে থাকে। ইংলন্ডে ঘোরার মধ্যে থাকত ভিক্টোরিয়ার দরবার, উইন্ডসর বা তার কটেজ, আইসল অব ওয়েটের অসবোর্ন হাউস ইত্যাদি। এখানে তিনি একটি দরবার ঘর তৈরি করেছিলেন অনুগত ভারতীয় অভিজাতদের জন্যে। এই সব অনুষ্ঠানে কিন্তু ভারতীয়দের দেশিয় পোষাকেই উপস্থিত থাকার জন্যে উৎসাহিত করা হত।

ওয়িয়েন্টালাইজিং ইন্ডিয়া
স্টার ইন্ডিয়া উপাধি এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা উপহার আদতে ব্রিটিশ ভিক্টোরিয় সামন্ততান্ত্রিক অতীতের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যম। আদতে রাজতন্ত্রের মুখচ্ছবি আরও একটু উজ্জ্বল করে তোলা এবং ব্রিটেনের যে একসময় খুব সহজ সরল অতীত ছিল, তারপরে তার সামাজিক, আর্থজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে সেটাও উপনিবেশকে দেখানো উদ্দেশ্য ছিল এই উপহার দেওয়ার চক্করে। দেখানোর চেষ্টা হল ব্রিটেনের স্বাধীনতা, তার আইনি ব্যবস্থা, এই আইনের শাসন ইত্যাদির বিকাশ ঘটেছে শাসক আর শাসিতের মধ্যে চিরাচরিত স্বাভাবিক সম্পর্ক বিকাশের মধ্যে দিয়ে। এটা খুব সরল সাধারণ স্মৃতিমেদুরতার থেকে অনেক গভীর, যা হয়ত খালি চোখে দেখা যায় না। শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে(সব সময়ে সে অভিজাত নাও হতে পারে) জনগনকে বলার চেষ্টা হল, প্রাযুক্তিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যুগে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিরতা বজায় রাখতে সুস্থিরতা, এবং হায়ারার্কি বজায় রাখা জরুরি।
ব্রিটেন এবং ভারত উভয়েরই সামন্ততান্ত্রিক অতীত, বিশেষ করে ভারতে তখনও রাজারা ছিলেন আর ছিলেন বিপুল সংখ্যক চাষী। বিভিন্ন ব্রিটিশ আমলা আর বিদ্বজ্জনেরা ভারতের যে সামাজিক বিকাশের পদ্ধতি আর পথ নির্দেশ করছেন তাতে লুকিয়ে আছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য, বর্তমান ভারত সমান ইওরোপিয় অতীত। ব্রিটিশদের হাতে ভারতের সার্বজনীন ইতিহাস তৈরি হওয়ায় ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল ইওরোপিয়দের হাতে, সেটা সামন্ততান্ত্রিক, কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা থেকে সে বেরিয়ে আসছে। ব্রিটিশেরা শুধু ভারতের অতীত ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করল তাই নয়, সে আগামি দিনের ইতিহাসও নির্দেশনার উদ্যম নিল, বর্তমানে ব্রিটিশদের ভূমিকা হল ভারত শাসন।

ব্রিটিশদের বদান্যতায় ভারতের উন্নতি নিশ্চিত এটা বলে দেওয়া গেল ঠারে ঠোরে নয় সরাসরিই। তারা বলল ভারতের শাসক হয়ে এমন কিছু অবস্থা তৈরি করেছে যাতে ভারতের সামাজিক বিকাশ দ্রুত হয় – যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারনার বীজ বপন, আধুনিক শিক্ষা, ইংরেজি ভাষা ভাবনা এবং সাহিত্য, রেলরাস্তা তৈরি, সেচব্যবস্থা তৈরি, আধুনিক পয়ঃপ্রনালী এবং ওষুধ, একনায়ক কিন্তু যুক্তিবাদী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন আর ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার বীজ রোপণ। ব্রিটিশেরা জানত খুব তাড়াতাড়ি সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার বিপদটা - মারাত্মক অরাজক অবস্থা, উচ্ছেদ এবং ভবিষ্যতে বৈপ্লবিক শক্তির বিকাশ ঘটা এবং সেগুলোকে যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে অরাজক অবস্থা আরও বাড়া। তারা নিদান দিল, এই বিপজ্জনক পরিনাম থেকে ভারতীয়দের বাঁচাতে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এবং তাদের নিজেদের ভালর জন্যে ব্রিটিশ পদ্ধতির যথোপযুক্ত চিন্তা প্রয়োগের ধারনায় বিশ্বাস করতে হবে। ভারতের ভবিষ্যত উজ্জ্বল কিন্তু বর্তমানে যাতে খুব তাড়াতাড়ি আধুনিক বিশ্বে প্রবেশের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হবে তা এড়ানোর জন্যে তাকে প্রাচ্যবাদে বিশ্বাস করতে হবে। ঠিক এই সময়েই ভারতীয় শাসকদের জন্যে প্রাচ্যের পোষাক আর সেনার জন্যে প্রাতীচ্যের পোষাকের পরিকল্পনা তৈরি হল।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮৪ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
শুরুতে এই উপাধিটি মাত্র ২৫ জন ব্রিটিশ এবং ভারতীয়কে দেওয়া হত। উচ্চতমপদগুলির ব্রিটিশ আমলা এবং ভারতীয় রাজারাই একটি আংরাখা আর একটি ইনসিগলিয়া পেতেন। চল্লিশ বছর পরে এই উপাধিকে তিনভাগে ভাগ করা হয় নাইট গ্রান্ড কমাণ্ডার, নাইট কমাণ্ডার এবং কম্পানিয়ন এবং প্রাপকদের সংখ্যা বহু বাড়ানো হয়।
আংরাখাটি ছিল হাল্কা নীল রেশমে বোনা, যা দিয়ে গোটা দেহই ঢেকে যেত। এরসঙ্গে যুক্ত ছিল সাদা একটা দড়ি এবং একটি রূপোর ট্যাসল। জামাটির বাম দিকে বুকের কাছে জ্বলন্ত সূর্যের চহ্ন আঁকা থাকত সোনার সুতো দিয়ে তার ওপরে আরেকটা হীরের ছবি বসানো থাকত। লেখা থাকত হেভেনস লাইট আওয়ার গাইড, এছাড়াও থাকত একটা তারা। কলার ছিল সোনার চেনে বোনা বড় নেকলেস পাম পাতা এবং পদ্ম; মাঝখানে থাকত রাণীর ছবি দেওয়া ব্রিটিশ রাজশক্তির চিহ্নটা।
আংরাখা, ইন্সিগনিয়া, কলার, পেন্ডেন্ট ইত্যাদি মূলত ইওরোপিয় আঙ্গিকে, ইওরোপিয় ভাবনায় তৈরি করা। উপহার পাওয়ার সময় ব্যক্তিকে স্বাক্ষর করে বলতে হত তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীকে এই উপহারগুলি রাষ্ট্রকে ফেরত দিতে হবে, যেহেতু এই উপাধিটা বংশগতভাবে প্রবাহিত হয় না। এই ধারা বহু ভারতীয়কে ক্ষুণ্ণ করেছিল, কারণ সাধারণত এই ধরণের পাওয়া সম্মান উপহারগুলি ভারতীয়রা বংশপরম্পরায় বাড়িতে সাজিয়ে রাখে তাদের পরবর্তী বংশধরদের/ভবিষ্যতের মানুষদের দেখার জন্যে, তাদের ইতিহাস জানার জন্যে। রাজাদের তোষাখানার উদ্দেশ্যটাই হল নানান ধরণের পাওয়া উপহার উপঢৌকন সম্মান সাজিয়ে রেখে দেওয়া। সেগুলি কোন এক সময় হয়ত বার করে পরা হল, দেখানো হল, আবার তোষাখানায় চলে যেত যাতে ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারীরা তাদের বংশের ইতিহাস জানতে পারে। শাল, আংরাখা, পরিধেয় এবং নানা আচার-অনুষ্ঠানে পাওয়া এক খণ্ড কাপড়ের মূল্য অনেক ছিল পরিবারগুলির কাছে। এমনকি একটি চাষী পরিবারের ট্রাঙ্ক, বিয়েতে বা অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে এই ধরণের উপহার পাওয়া কাপড়, ধুতি এবং নানান ধরণের তুচ্ছ উপহার সামগ্রীতে ভর্তি থাকে। এগুলো পরাই হয় না হয়ত, কিন্তু এসব নিয়ে নানান সময় আলোচনা ও দেখানো হয়। সরাসরিভাবে এই ধরণের উপহার ব্যক্তি, পরিবার এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ককে মজবুত করে।
ব্রিটিশদের গভীর বন্ধু, হায়দ্রাবাদের নিজামকে নাইটহুড দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান, তিনি জানান তিনি নাইটহুড নেবেন কিন্তু আংরাখা আর ইনসিগনিয়া নেবেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সালার জঙ্গকে দিয়ে ভাইসরয়কে চিঠি লিখেয়ে বললেন, এই দেশের মানুষেরা নিজেদের পোষাক ছাড়া অন্য কারোর দেওয়া পোষাক পরার বিতৃষ্ণা আছে। সালার জং ভাইসরয়কে লিখছেন এইটা আরও সত্য রাজাদের ক্ষেত্রে, যারা তাঁদের পূর্বজদের প্রাচীন ঐতিহ্যটা ধরে রাখেন বিশেষ ধরণের পরিধেয় পরার মাধ্যমে। আরও বললেন উপহার পাওয়া নতুন ধরণের আংরাখা পরা মানুষ ভাল চোখে দেখবে না, তারা তাঁকে উপহাস করবে। যদি আংরাখাটা ভেলভেট বা রেশমের হত তাহলে হয়ত মুসলমান আইন মোতাবেক হত। এছাড়াও তিনি পেন্ডেন্টে রাণীর ছবি নিয়েও প্রশ্ন তুললেন সহি মুসলমানের পক্ষে প্রোহিবিটেড ফ্রম ওয়ারিং দ্য লাইকনেস অব আনি ক্রিয়েটেড বিয়ইং অন দেয়ার পার্সন। চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ ভাইসরয় প্রধানমন্ত্রীকে লিখলেন স্টার অব ইন্ডিয়ার মর্যাদা বা আকার কোন কিছুই বদল করা যাবে না বা সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। নিজামকে হয় সেগুলি গ্রহণ করতে হবে নয়ত তাকে গোটা সম্মান বর্জন করতে হবে।
১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ভারত নাইটহুড সম্মান অন্তর্ভুক্ত করে। এবং যখন পেটেন্ট এবং ইন্সিগনিয়া নিজামের দরবারে পৌঁছল, তিনি উভয়কেই সম্মান জানালেন, আংরাখাটা কিন্তু পরলেন না। গোটা বিষয় নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্যও করলেন না। ব্যাপারটা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল। উনবিংশ শতাব্দের শেষে কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই চিহ্নগুলো গর্বকরে পরেছেন এবং সেটা জনসমক্ষেই, তাদের পূর্বজের প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই।
১৮৬৯ সালে ভারতে কোন রাজপরিবারের প্রথম সদস্য ডিউক অব এডিনবরার ভ্রমনের সময় উপস্থিত অভিজাতদের সপ্তদশ শতকের ক্যাভেলিয়ারদের পোষাক পরতে হল। ১৮৭৭ সালের ইম্পিরিয়াল এসেম্বলেজে যখন ভিক্টোরিয়াকে ভারতের রাণী হিসেবে কাজ করার জন্য সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, সেই উতসবে প্রত্যেককে ভিক্টোরিয় ফিউডাল আঙ্গিকের সম্পূর্ণ পরিধেয় পরতে হয়। ১৮৭০ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত শ্রেণী, পদ, আঞ্চলিকতা, কাজ ইত্যাদি নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয়কে সাম্রাজ্যের দেওয়া বিশেষ পোষাক পরতে হয়, এবং এ নিয়ে কোথাও কোন প্রতিবাদ ওঠে নি। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮৩ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
মুণ্ডি বিস্তৃতভাবে লিখেছেন কম্বারমিয়রের খেলাত পাওয়ার অভিজ্ঞতা,
অন রিসিভিং লর্ড কম্বারমিয়র্স অফারিং, দ্য কিং ক্লেসড আ টার্বান, সিমিলার টু হিজ ঔন, আপন হিজ হেড, এন্ড হিজ লর্ডশিপ ওয়াজ কন্ডাক্টেড, রিটায়ারিং উইথ হিজ ফেস সিডিউলাসলি টার্নড টুওয়ার্ডস দ্য থ্রোন, টু এন আউটার এপার্টমেন্ট, টু বি ইনভেস্টেড উইথ আ খিলাত, অর ড্রেস অব অনার। ইন আবউট ফাউভ মিনিটস হি রিটার্নড টু দ্য প্রেজেন্স, এটায়ার্ড ইন আ স্প্রাঙ্গলড মসলিন রোব এন্ড টিউনিক; সেলামড, এন্ড প্রেজেন্টেড এনাদার নজর। দ্য স্টাফ ওয়ার দেন লেড এক্রস দ্য কোয়াড্রাংগল বাই দ্য ‘গ্রুমস অব রোবস’ টু দ্য ‘গ্রিন রুম’, হয়ার এন কোয়ার্টার অব এন আওয়ার ওয়াজ সাফিসিয়েন্টলি ডিজএগ্রিবলি এমপ্লয়েড বাই আস ইন এরেইং আওয়ারসেল্ভস, উইথ দ্য মেটিরিয়াল টেস্টিলি বাউন্ড রাউন্ড আওয়ার ক্লকড-হ্যাটস। নেভার ডিড আই বিহোল্ড আ গ্রুপ সো লুডিক্রুয়াস এজ উই প্রেজেন্টেড হোয়েন আওয়ার টয়লেটি ওয়াজ একমপ্লিশড; উই ওয়ান্টেড নাথিং বাট আ ‘জ্যাক আই দ্য গ্রিন’ টু কোয়ালিফাই আস ফর আ মেডে এক্সহিবিশন অব দ্য মোস্ট এক্সাজারেটেড অর্ডার। ইন মাই গ্রেভেস্ট মোমেন্টস, দ্য রিকালেকশন অব দ্য সিন প্রোভোকস আন ইরেজিস্টেবল ফিট অব লাফটার। এজ সুন এজ উই হ্যাড বিন ডেকড আউট ইন দিজ স্যাটিসফ্যাক্টরি গাইস, উই আর মার্চড ব্যাক এগেইন থ্রু দ্য লাল পুরদার এন্ড ক্রাউডস অব স্পেকটেটরস, এন্ড রি-কন্ডাক্টেড টু দ্য দিওয়ানি খাস, হয়ার উই এগেইন সেপারেটলি আপ্রোচড হিজ ম্যাজেস্টি টু রিসিভ ফ্রম হিম আ টায়ারা অব গোল্ড এন্ড ফলস স্টোনস, হুইচ হি প্লেসড উইথ হিজ ঔন হ্যান্ডস আপন আওয়ার হ্যাটস।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ভারতীয় শাসক আর প্রজাদের মধ্যে উপঢৌকন হাত বদল হত, কিন্তু এই উপঢৌকনের চরিত্র বদলে গেল। কোম্পানির আমলারা সরাসরি উপহার নিতে পারতেন না, কিন্তু খেলাত, অস্ত্র গয়না ইত্যাদি নিয়ে কোম্পানির তোষাখানায় জমা করে দিতেন। এই উপহারগুলি আবার নতুন করে বাঁধাছাঁদা হয়ে কোন রাজার দরবারে অথবা অন্যান্য সরকারি বৈঠক শেষে যখন উপহার হাত বদল হত, সেগুলি কোম্পানির পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসেবে উপস্থাপিত হত। কোম্পানির নীতি অনুযায়ী, প্রত্যেক উপহার এবং প্রতিউপহারের মূল্য একই হতে হবে। এই নীতি শুধু যে তারা নিজেদের আমলাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল শুধু নয়, তারা এগুলি মিত্র রাজাদের ওপরেও চাপিয়ে দিয়েছিল। ছোটকরে বলতে গেলে উপহার দেওয়া নেওয়া শুধু একটা চুক্তিবদ্ধ হাতবদলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। ব্রিটিশেরা ভারতীয় উপঢৌকনের অন্তর্নিহিত তাত্ত্বিক স্ববিরোধটা জানত না তা নয়। ভারতে উচ্চপদাধিকারীরা সবসময় তার অধস্তনর থেকে যা পেতেন, তার তুলনায় অনেক বেশিই উপহার দিতেন। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি হলেও উনবিংশ শতকের ইওরোপিয় সওদাগরেরা কিন্তু যা পেলেন তার বেশি দিতে চাইলেন না।
উনবিংশ শতকের ভারতের শাসনের মৌলিক কর্তৃত্বটা অনির্নীত ছিল। ব্রিটিশদের তত্ত্বে তারা বিজয়ী বলেই ক্ষমতা দখল করেছে। অথচ তাদের নিজেদের রাজা কিন্তু ভারতের রাজা নয়। ভারতে কিন্তু শাসন করছে একটা নথিবদ্ধ কোম্পানি যার ওপর নজরদারি করছে পার্লামেন্ট। ১৮৫৭-৫৮র সিপাহী যুদ্ধে কোম্পানির অবলুপ্তি ঘটল। তাদের রানী ভারতের শাসক হলেন। সংবিধান অনুসারে ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার অংশ হল। ব্রিটেনে তো বটেই ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারত শাসনেরও একচেটিয়া অধিকার পেল। নতুন আইনি ব্যবস্থায় নাইটহুড এবং দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া উপাধি দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা হল।
১৮৬২ সালের ৬ জুলাই রানী এবং তার পরামর্শদাতারা লেটার অব পেটেন্ট এন্ড কন্সটিটিউশন প্রকাশ করলেন ইট হ্যাথ বিন দ্য কাস্টম অব প্রিন্সেস টু ডিস্টিঙ্গুইশ মেরিট, ভার্চু এন্ড লয়ালিটি বাই পাবলিক মার্ক্স অব অনার ইন অর্ডার দ্যাট এমনেন্ট সারভিসেস মে বি একনলেজড এন্ড টু ক্রিয়েট ইন আদার্স আ লডিবল এমুলেশন, এন্ড উই বিং ডিজায়ারাস অব এফর্ডিং পাবলিক এন্ড সিগন্যাল টেস্টিমনি অব আওয়ার রিগার্ড বাই দ্য ইন্সটিটিশন অব এন অর্ডার অব নাইটহুড, হয়ারবাই আওয়ার রেজোলিউশন টু টেক আপন আওয়ারসেলভস দ্য গভর্নমেন্ট অব আওয়ার টেরিটরিজ ইন ইন্ডিয়া।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮২ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
মুঘল সম্রাট আকবর আনন্দসহকারে নানান ধরণের পোষাকের আঙ্গিক এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলার ভাষা তৈরি, সম্মান দেখানোর নানান ভঙ্গিমা ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন। সে সময়ের অন্যান্য শাসকের মতই সম্রাট আকবর তার সাম্রাজ্যের সময়ে পরিধেয়, শস্ত্র এবং রত্ন্রাজির আলাদা আলাদা গুদাম এবং রত্নাগার এবং হিসেব এবং ব্যবস্থাপনার দপ্তর তৈরি করেছিলেন। কর্মচারীরা সেইগুলির হিসেবপত্তরও রাখত। কিছু জামাকাপড়ের মৌলিক চেহারারও বদল ঘটান আকবর। আবুল ফজল লিখছেন, পরিধেয় এবং জামাকাপড় তৈরির কাজে সম্রাট অসাধারণ উৎসাহ দেখিয়েছেন। সাম্রাজ্যের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরেই কাপড়ের কারখানা ছিল যেখানে প্রচুর প্রখ্যাত দক্ষ কারিগর কাজ করতেন এবং আজ কাপড়ের যে সব আঙ্গিক, আকার, বৈচিত্র, ফ্যাশন, বাঁধন অভিজ্ঞ ভ্রমনকারীদের চোখ পড়ে সেটা তার হাতেই বিকশিত হয়েছে। আকবর সারা এশিয়া ইওরোপ এবং গোটা ভারত থেকে কাপড় জোগাড় কারবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেওয়া বা খোলা বাজার থেকে কেনা বস্ত্র এবং উপহার হিসেবে পাওয়া পরিধেয় প্রত্যেক সপ্তাহের দিন এবং প্রত্যেক মাসের দিন চিহ্নিত করে, তার দাম, রঙ এবং ওজন লিখে রেখে আলাদা আলাদা করে শ্রেণিবিভাগ করে আলাদা আলাদা করে রাখা হত দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বস্ত্র আর পরিধেয়র আলাদা আলাদা শ্রেণীবিভাগ ছিল। ফারওয়াদিন মাসের প্রথম দিনে যে বস্ত্রগুলি গৃহীত হত সেগুলি যদি উত্তমমানের হত, তাহলে সেগুলি উচ্চ পদের জন্যে বরাদ্দ থাকত; সেই মানের অন্যদিনে প্রাপ্ত জামাকাপড়গুলি সেই মর্যাদা পেত না; পরিধেয়গুলি যদি যদি একই মূল্যমানের হত তাহলে তাদের চরিত্র আর কোন দিন সেগুলি প্রাপ্ত হয়েছে বা তার অন্যকোন শ্রেণীবদ্ধতা থাকত, সেই শ্রেণী অনুযায়ী সেগুলির মান এবং তার কাজ নির্ণীত হত। দিনের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই অনেক কাপড় এলে হালকাগুলি উচ্চপদাধিকারীদের জন্য বরাদ্দ থাকত; পরিধেয়গুলি যদি একই ওজনের হত তাহলে তাদের রঙ অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ করা হত। লেখক ৩৯টা রঙ, যে রংগুলি ফুল ফল এবং পাখির নানান রঙের সঙ্গে যুক্ত সেগুলির বর্ননা দিয়েছেন। কাপড়ের গুণমান আর আঙ্গিক এবং কাপড়ের ওপর কাজের বৈচিত্র্য ছিল অসীম; তবে কাপড়ের ভাঁজ, কাটা এবং সেলাইয়ের মান এবং পদ্ধতির বৈচিত্রও পরিধেয়র অন্যন্যতা তৈরি করত। ভারতীয় কাপড়ের যে উদ্ভাবনী শক্তি আর বিপুল বৈচিত্র্য তৈরি করেছিল মুঘল আমল, তার একটা নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে mattiebelle gettinger এর প্রদর্শনী থেকে।
আকবর তার উত্তরসূরীর মতই কাপড় পরিধেয় এবং গয়নাগাটির বিশ্বে বাস করতেন এবং ফলে তিনি মুঘল সমাজের নানান শ্রেণীতে কি ধরণের চিহ্ন প্রতীক গয়না কাপড়ের চরিত্র পরিহিত হবে তার বিশদ নীতি ঠিক করে দিয়ে যান। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ যখন সারা ভারত এবং রাজাদের ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে, তারা সেই সার্বভৌমত্বের চিহ্নগুলির সরলীকরণ করে ফেলল এবং নিজেরাই সার্বভৌম হিসেবে গেড়ে বসল।

সম্মানের পরিধেয় রূপান্তরিত হল আংরাখার অধীনতায়

মুঘল দরবারে প্রথম ব্রিটিশ টমাস রো’র ভ্রমণ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত খেলাতের গুরুত্ব কমে নি। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোম্পানি সামরিক শক্তি যতই বাড়তে থাকে, ব্রিটিশেরা সম্রাটের নিরাপত্তায় ব্যবসা করা সওদাগর থেকে ক্রমশ রাষ্ট্রনির্ভর সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। এই পদ্ধতিতে কোম্পানির ব্রিটিশ আমলারা মুঘল উপাধি আর খেলাতে সম্মান পেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা সুবায় কোম্পানির কর্মকর্তারা ভারতীয় সার্বভৌমতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করায়, তারাও তাদের ভারতীয় অধীনস্থদের খেলাত দেওয়ার প্রথা চালিয়ে যায় এবং তাদের প্রভাব ব্যবহার করে মুঘল দরবার থেকে তাদের সাথী আর কর্মচারীদের জন্যে নানান ধরণের সুযোগ সুবিধা উপাধি সম্মান জোগাড় করে নিয়ে আসতে থাকে। উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে, ভারতে বেড়াতে আসা ধনী এবং অভিজাত ব্রিটিশদের প্রথাই হয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে গিয়ে মুঘল সম্রাটের সঙ্গে দেখা করে আসা এবং তাঁর হাত থেকে সম্মান নেওয়া। ভারতের সেনা প্রধান লর্ড কম্বারমিয়র ১৮২৭ থেকে ১৮২৯ পর্যন্ত যখন উত্তর ভারতে সমীক্ষা ভ্রমণ করছিলেন তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন মুনডি। তারা তখন দিল্লিতে। নজর এবং খেলাত পাওয়া ভ্রমণের অঙ্গ হিসেবে ধরা ছিল। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
যে নির্দিষ্ট বস্ত্রখণ্ডগুলির মার্ফত ক্ষমতার অংশ হস্তান্তর হয় তাকে খেলাত বলে। ব্রিটিশ সংজ্ঞায় খেলাত হল রোব অব অনার আর ফরাসী ভাষায় ক্যাপ আ পিয়ে বা মাথা থেকে পা। মুঘল ভারতে খেলাত দেওয়া হত শ্রেণী ভিত্তি করে তিন, পাঁচ ও সাত অংশে। সাত খানা খেলাতে থাকত একটা পাগড়ি, একটি জোব্বা (কাবা), আর লম্বা জামার ওপরে কোট, একটা আঁটোসাঁটো কোট(আলখিলাক), একটি কমরবন্ধ, পাজামা, আরও একটা জামা এবং একটা উত্তরীয়। এই কাপড়ের সঙ্গে আরও অন্যান্য দ্রব্যও থাকত।
সব থেকে শক্তিশালী খিলাত হত সেইগুলো যেগুলি সম্রাট নিজে যে সব জামা বা আলখাল্লার মত পরিধেয় পরিধান করতেন এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি সেগুলির অংশ নিয়ে তার প্রতিনিধি বা প্রজাকে দান করতেন সাম্মানিক হিসেবে। এরপরের গুরুত্বপূর্নতম বস্তুটি ছিল তার পাগড়ি এবং তার দেহের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যান্য গয়না বিশেষ।
ভারতীয় সমাজে সব ধরণের সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে মাথা, হাত আর পা যুক্ত থাকত। আকবরের দরবারে সম্মান জানানোর প্রথা ছিল আভূমি প্রণিপাত হওয়া বা সেলাম জানানো – এগুলি কুর্ণিশ, তসলিম এবং সিজদা তিন ভাগে বিভক্ত। আবুল ফজল লিখছেন, সম্রাট তার প্রজ্ঞান প্রয়োগ করে, জনগণের কাছ থেকে কি ভাবে সম্মান অর্জন করবেন, তার নানান তারিকা উদ্ভাবন করেছিলেন ... মহামহিম(আকবর)এর নির্দেশ ছিল, মাথা নামিয়ে(প্রায় আভূমি) ডান হাতের তোলাটা কপালে ঠেকানো... একে বলে কুর্নিশ, এবং এটা জ্ঞাপিত হয় যে সম্মান দেখানো ব্যক্তি তার মাথাটি(যেটা চেতনা আর মনের অধিষ্ঠান)তে হাতের নম্রতাকে স্পর্শ করে, দরবারে উপস্থিত করানো এবং সম্রাটের যে কোন কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আর্জি জানান।
তসলিম হল বাঁহাতের পৃষ্ঠভূমি মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে আনন্দের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে দেহটাকে খাড়া করতে থাকা যতক্ষণনা শরীরটা সোজা হচ্ছে।
সিজদা হল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আকবরের দরবারে গোঁড়া ধর্মভীরু মুসলমানেরা যেভাবে প্রার্থনা করতেন। আকবরের নির্দেশ ছিল এটি তার সামনে ব্যক্তিগতভাবে করতে হবে জনসমক্ষে নয়। তবে অন্যান্য সম্রাটের সময়েও এটি চলে এসেছে।
আবুল ফজল বলছেন দরবারে যে মানুষটি সম্মান জানাচ্ছেন, তিনি আদতে নিজেকে সঁপে দেওয়ারই কাজ করছেন, তার মাথা মুঘলদের কাছে উপহার দিচ্ছেন। যুদ্ধে আত্মতোতসর্গ ছিল আক্ষরিক। সম্রাট আকবরের সময়ে আঁকা একটি মুঘল চিত্রশৈলীতে দেখতে পাই তার এক যোদ্ধা তার শত্রুপক্ষকে নিয়ে এসে সম্রাটের হাতির পায়ের কাছে জড়ো করে রাখছে। পরাজিত শত্রুদের কারোর মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই, পাগড়িও নেই, মাথাগুলি নামানো, তাদেরকে বিজিতর সামনে আনা হয়েছে।
অষ্টাদশ এবং নবম শতকে কোন ভারতীয় যদি তার শিরস্ত্রান কারোর পায়ের কাছে রাখত, সেটা তার পরাজয় বা আত্মসমর্পন বলেই গণ্য হত। এই আত্মসমর্পণের চিত্রটা রূপকশোভিতভাবে বাক্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতে ভ্রমনে আসা ব্রিটিশদের জন্যে লিখত নির্দেশিকা পুস্তকে লেখা থাকত কোন হিন্দু আর মুসলমানের পাগড়িতে হাত না দিতে, কেননা সেটি অপমান হিসেবে গণ্য হত।
১৮৪০ সালে ব্রিটিশেরা সিন্ধ জয় করে। সেই অঞ্চলটি মুসলমান জমিদারেরা ছিল যাদের কাছে পাগড়িই স্বাধিকারের সমান ছিল। ফারসি আর সিন্ধ ভাষায় দক্ষ এক কোম্পানি কর্মচারী ই বি ইস্টউইক পাগড়ির উপযোগিতা বিষয়ে বিশদে লিখছেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড এলিনবরো জেনারেল নেপিয়ারকে কোন এক বিশেষ শাসককে সমর্থন এবং তার পাগড়ি বিষয়ে লিখছেন, আই হ্যাভ লিটল ডাউট ওয়ান্স এস্টাব্লিশড ইন দ্য পজেশন অপব টার্বান... আলি মুরাদ উইল বি এবল টু এস্টাবলিশ দ্য মোর ন্যাচুর্যাবল এন্ড রিজোনেবল লাইন অব সাক্সেশন টু দ্য টার্বান, এন্ড ক্লোদ দ্য মেজার উইথ দ্য ফার্মনেস অব লিগালিটি।
মধ্য ইওরোপে যেমন শিরস্ত্রানের একটা বড় ভূমিকা ছিল, তেমনি ভারতের মুঘল শাসকেরাও পাগড়ি আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়নাগুলির সঙ্গে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর চরিত্র জুড়ে ছিল। পাগড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়না যেমন কালঘি – সারস বা ময়ূরের পালকের সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নর গুরুত্ব বিপুল ছিল। এইটা সর্বোচ্চ অভিজাতদের দেওয়া হত। জিঘা ছিল সোনায় তৈরি চাঙ্গড়ের ওপর কয়েকটা রত্ন বসানো তার সঙ্গে যুক্ত থাকত ময়ূরের পালক। সরপেঁচ বা সরবন্দ হল পাগড়িতে সেলাই করা সোনা বা রূপোর সূক্ষ্ম তারের কাজের ওপরে রত্নের সমাহার বসানো। পাগড়ির ওপর রত্নের কাজ করা মুক্তো শভিত উষ্ণীষ জড়িয়ে দেওয়া হত। মধ্যযুগের হিন্দু ঐতিহ্যে রাজারা বিশ্ব আর তার উতপাদনের মালিক। মহাকাশীয় বিবরণসূত্রে বলতে পারি পৃথিবীর সারমর্ম হল রত্নরাজি, এবং এগুলি খাঁটি ঘণীভূত এবং পবিত্র বস্তু। ফলে কাপড়, পাগড়ি এবং সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নরাজি আদতে বিশ্বের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

Sunday, April 29, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮০ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

ব্রিটিশেরা যেভাবে নিজেদের দেখাতে চাইল
ভারতীয়দের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় এবং বহিরাবরণে ব্রিটিশত্ব নিয়ে চলার প্রথা ভারতে শুরু হয়েছিল ১৬১৫ সালে রাজা প্রথম জেমসের প্রতিনিধি হিসেবে মুঘল দরবারে পণ্য ক্রয় এবং লাভের উদ্দেশ্যে পাঠানো প্রতিনিধিদের পোষাকে। ব্রিটিশ দূত টমাস রোকে রাজার পক্ষ থেকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল টুবি কেয়ারফুল অব দ্য প্রিজারভেশন অব আওয়ার অনার এন্ড ডিগনিটি, বোথ এজ উই আর সভরেন প্রিন্স এন্ড আ প্রফেসড ক্রিশ্চিয়ান, এজ ওয়েল ইন য়োর স্পিচেস এন্ড রিপ্রেজেন্টেশন অব আওয়ার লেটার্স এজ ইন অল আদার সারকামস্ট্যান্সেস এজ ফার এজ ইট স্ট্যান্ডেথ উইথ দ্য কাস্টমস অব দিজ কাট্রিজ। ভারতীয় দরবারে প্রতিনিধি হিসেবে আসা রো, শক্তিশালী শাসকের দূত হিসেবে যে ধরণের ব্যবহার করার দরকার ছিল তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জাহাঙ্গির ব্রিটিশদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন এরা নিকৃষ্ট ধরণের যোদ্ধা আর শাসক। রো’কে তার পছন্দ হয়েছিল ঠিকই এবং ব্যক্তিগতভাবে তার উদ্ভট নানান বিষয় তিনি মেনেও নিয়েছিলেন, কিন্তু জাহাঙ্গির অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কি করে এক শক্তিশালী ইওরপিয় শাসক শুধু ব্যবসার জন্যে রাজদরবারে প্রতিনিধিত্ব পাঠান। লাভ বাড়াবার আর উপযোগিতার জন্যে রাজা জেমসের বার্তা নিয়ে যেভাবে রো তার সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন সেটা জাহাঙ্গির মোটেই পছন্দ করেন নি।
ব্রিটিশদের ব্যবসা-চুক্তি করার উদ্যম আদতে ব্যবসা হিসেবে ইওরোপিয় ধারনার ফলশ্রুতি, যারা কিছু কৃষ্টিকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করত। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে তারা ভারত থেকে ইংলন্ডে পাঠানোর বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই কাপড়ের বিনিময়ে লন্ডনের জন্যে মশলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে সব পণ্য কিনতে শুরু করে সেগুলির মধ্যে ছিল বিচিত্র ধরণের বস্ত্র। সমস্যা হল ব্রিটিশেরা যে সব পণ্য উতপাদন করত যেমন পশম, ধাতু দ্রব্য, এবং নানান ধরণের অদ্ভুত কিসিমের পণ্যের খুব বড় বাজার ভারতে ছিল না। ভারতীয়দের চাহিদা ছিল রূপো, তামা এবং সোনা। আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতীয় বস্ত্রকে শুধুই কোম্পানির আর কোম্পানির অংশিদারদের লাভ করার জন্যে উপযোগী এবং ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে দেখতে শুরু করায়। ভারতীয়রা যে সব বস্ত্র উতপাদন করত সেগুলির পণ্যমান এবং উপযোগিতা অবশ্যই ছিল, কিন্তু উতপাদনে আর ব্যবহারে আরও নানান বিষয় জড়িয়েছিল, ব্রিটিস যেগুলিকে পণ্য হিসেবে দাগিয়ে দিচ্ছিল ক্রমাগতভাবে।
রো আর তার ছোট দলটিতে তার চ্যাপলেইন হিসেবে ছিলেন রেভারেন্ড টেরি, মুঘল দরবারে গিয়ে বুঝলেন মুঘল দরবারে যে সব কাপড় আসে, ব্যবহার হয়, উপহার দেওয়া হয়, সেগুলির মূল্য বাস্তবিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত পণ্যের পণ্যায়নের থেকে অনেক বেশি। জাহাঙ্গির রো’কে ইওরোপিয় প্রথায় টুপি খুলে আর ঝুঁকে অভিবাদন করতে দেন নি বরং সম্রাটকে শ্রদ্ধা দেখানোর মুঘল রাজসভার রীতিনীতি রো’কে মানতে বাধ্য করেছিলেন। তিন বছর রো আর তার সাথীরা হাল্কা ঠাণ্ডা ইওরোপিয় পোষাকেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভারত ঘুরেছিলেন, তার ভৃত্যরা সকলেই লাল তাফেতা আলখাল্লার মত পরিধেয় পরত। টেরি চ্যাপলেইন সবসময়ে দীর্ঘ কালো ক্যাসক পরতেন।

মুঘল দরবারের জন্যে রো প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে ছিল লাল টকককে কস্তা রঙের কাপড়, যা হয়ত উত্তর আমেরিকার আদবাদীদের বেশি মানাত মুঘলদের উপহার দেওয়ার থেকে। রো আর সেই কাপড় জাহাঙ্গিরকে দেন নি বরং তার নিজের উত্তরীয় আর তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গির তার দেওয়া উপহারের প্রশংসা করে রো’কে বলেছিলেন তার ভৃত্যকে পাঠিয়ে এগুলি ঠিকঠাক করে বেঁধে আনতে। রো বলেছেন বহু সময় জাহাঙ্গির এবং তার কিছু অভিজাত তাকে পরিধেয়, গয়নাপত্র এবং পাগড়ি দিতে চেয়েছ্যিলেন। রো বলেন নি কেন তিনি এই উপহারগুলি নেন নি, আমি আন্দাজ করতে পারি, তিনি এই উপহার দেওয়ার গুরুত্বটা যথেষ্টভাবেই বুঝেছিলেন। এই উপহার গ্রহণ করলে হয়ত তার মুঘলদের অধীন হয়ে পড়ার আশংকা ছিল। কেন জাহাঙ্গির রো’র দেওয়া তরোয়াল আর উত্তরীয়তে খুশি ছিলেন আর কেন রো জাহাঙ্গিরের থেকে উপঢৌকন নিতে সতর্ক থাকতেন, সেটা বিশ্লেষণ করা যাবে মুঘল ভারতের কর্তৃত্বের সংবিধানে।  

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৯ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
সময়ের হস্তাবলেপনে, সেনাবাহিনীর মত করে পরা পাগড়ি শিখেদের সাধারন চিহ্ন হয়ে উঠল, যদিও শিখ সমাজে এই ধরণের পাগড়ি পরিধানকে এক্কেবারেই সাধারণীকরণ করা যাবে না। এবারে প্রভুভক্ত শিখেরা ব্রিটিশ দ্বীপে এল। কিন্তু পুরোনো সময়ে যে চিহ্নটা শিখদের পরিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত করে রাখার জন্যে তৈরি হয়েছিল, সেই পাগড়িটার সেই তাৎপর্য আর তখন নেই। এখন পাগড়ি, বৃহত্তর জনসমাজের মধ্যে ডুবে না গিয়ে, শিখেদের আলাদা চরিত্র বজায় রাখার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অতীতে যে চিহ্ন শাসকেরা তৈরি করেছিল আনুগত্যের শপথ হিসেবে, সাগরের সময়ে সেটাকে দেখা হতে শুরু করল শিখেদের একগুঁয়েমি হিসেবে। ইংলন্ডের বাস কন্ডাক্টরদের পোষাকের চরিত্র বজায় রাখতে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলল। ব্রিটিশদের পক্ষে বলা হতে থাকল শিখেরা কি ইংলন্ডের আইন ভঙ্গ করতে পারে, যে আইনে বলা হয়েছে ব্রিটেনে মোটরসাইকেল আরোহীদের ইস্পাতের হেলমেট পরতে হবে, শিখেরা পাগড়ি পরে বলেই কি সেই আইন তারা অমান্য করতে পারে? আরও সম্প্রতি এই যুদ্ধটা চলে এসেছে ইস্কুলের প্রাঙ্গনে যেখানে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, দাড়ি চুল না কাটা বাবার বাচ্চাকে আদৌ প্রাথমিক স্তরে ভর্তি নেওয়া হবে কি না। এই মামলা ১৯৮৩ সালে শেষ হয় হাউস অব লর্ডসএ। তারা নিচের স্তরের আদালতের রায় বদল করে বলল হেডমাস্টার বেআইনি ভাবে শিখেদের চুল কেটে দিয়ে তাদের পাগড়ি না পরতে বাধ্য করে, শিখদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত করেছে।

ব্রিটিশেরা যেভাবে নিজেদের দেখাতে চাইল
ভারতের নতুন শাসক হয়ে উঠতে উঠতে, ব্রিটিশেরা নতুন ধরণের আচরণবিধি তৈরি করল, যার মাধ্যমে তারা বাহ্যিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং কৃষ্টিগতভাবে ভারতীয় প্রজাদের থেকে আলাদাভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠবে। সপ্তদশ শতকের প্রথমপাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাটে প্রথম কুঠি স্থাপন করার পর থেকেই কোম্পানির আমলারা সমাজের থেকে প্রায়আলাদা হয়েই ঘেরাটোপে বাস করত। ব্যবসা আর লাভের জন্যে মুঘল সেনা আর ভারতীয় বণিকদের জ্ঞানের ওপর এবং ভারতীয় ভৃত্যদের পরিচর্যার ওপর দৈনিক জীবনধারণে নির্ভরশীল হলেও তারা আলাদা হয়েই থাকতে ভালবাসত। পরিধেয় এবং আচার আচরণে তারা ভারতীয় উচ্চপদাধিকারী, সমপদের এবং নিম্নপদের মানুষদের থেকে যে আলাদা সেটা বোঝাতে চাইত। ইওরোপিয়দের যে সব ছবি ভারতীয়রা এঁকেছে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে, তাদের পোষাক পরিচ্ছদে কোথাও বোঝা যায় নি যে তারা ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং বাহ্যিক আবহাওয়াকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বাড়িতে বা দপ্তরে বা মাঠেঘাটে শিকারে বা সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ব্রিটিশেরা নিজেদের মত করে পোষাক পরত।

কয়েকটা ব্যতিক্রম আমরা দেখতে পাই যেখানে মধ্য ভারতে ইওরোপিয় প্রতিনিধিরা নিজেদের কৃষ্টিমাফিক পরিচ্ছেদ বর্জন করে মুসলমান রাজদরবারের মত করে পোষাক পরছে। কিছু ইওরোপিয় যারা এদেশের মেয়েকে বিয়ে করেছিল বা রক্ষিতা রেখে তাদের সন্তানকে নাম দিয়েছিল, যাদের এই অর্ধ-মুঘল বলা হত সেই ইওরোপিয়দের অনেকেই নানান গণঅনুষ্ঠানে ইওরোপিয় পোষাক পরলেও বাড়িতে কিন্তু ভারতীয় বসন পরত। কোম্পানি তার কর্মচারীদের ভারতীয় যে কোন অনুষ্ঠানে ভারতীয় পোষাক পরা নিষিদ্ধ করে ১৮৩০ সালে। উত্তরভারতে আদালতে ভারতীয় পোষাক পরে বিচার করা কোম্পানি আমলা ফ্রেড্রিক জন শোরএর উদ্দেশ্যে আলাদা করে নির্দেশিকা জারি হয়। শোর ছিলেন কিন্তু বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়া ভারতীয়দের চরম সমালোচক, বিশেষ করে স্থানীয় অভিজাত, বুদ্ধিজীবি এবং রাজস্ব এবং বিচার দপ্তরে গুরুত্বপুর্ণ পদে কাজ করা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে তিনি কলম শানিয়েছেন। তিনি শুধু দেশিয়দের বিরুদ্ধেই কলম ধরেন নি, নিজের দেশের প্রত্যেকের চাকরিপাওয়ার জন্যেও লিখেছেন নিরন্তর। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৮ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
শিখ যুদ্ধে জেতার এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকেরা শিখদের সেনা বাহিনীতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। যে সব যোদ্ধা আমলা শিখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বলল কেশধারী শিখদের রেজিমেন্ট বানানো দরকার, খালসা শিখ যারা মাথার চুল ছোট করে না, তাদেরই একমাত্র বাহিনীতে নিতে হবে – কারণ তারা সহি শিখ। যে সব শিখকে, শিখদের মত দেখতে – যারা আদিম চেহারার, চুল দাড়ি কাটে না, তারাই সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। শিখদের ক্ষেত্রে সরকারি নীতি হল তাদের জাতিবাদিতার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করবে না... তাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক চরিত্র বজায় রাখার চেষ্টা হবে।
১৮৫০ সালে শিখ রেজিমেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিপাহী যুদ্ধে ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীর বিপুল অংশ বিদ্রোহ করলেও, শিখেরা মহা উৎসাহে তাদের শত্রু মুঘল সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হারিয়ে দেয় গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে।
১৮৬০ সালের পরের দিকে ব্রিটিশেরা প্রাথমিকভাবে পাঞ্জাবী, বিশেষ করে শিখ বাহিনীর ওপর খুব বেশি ভরসা করতে থাকে। ১৯১১ সালে ভারতের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবের অর্ধেক জনসংখ্যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হয়। শিখেরা ভারতের জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলেও, সেনাবাহিনীর ২০ শতাংশ সেনা ছিল শিখ।
উনবিংশ শতকের শেষের দিকে শিখেদের পাগড়ি অন্যান্য সমাজের যেমন পাঞ্জাবি মুসলমান বা হিন্দু ডোগরাদের পাগড়ির থেকে আলাদাভাবে সেজে উঠল। এবং পাগড়ি ব্রিটিশ সেনার শিখ রেজিমেন্টের অন্যতম চিহ্ন হয়ে উঠল। শক্তকরে কাপড় দিয়ে গোটা মাথা আর কান ঢাকা পাগড়ি পরা শিখদেরই ব্রিটিশেরা তাদের ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করতে শুরু করে। শক্তকরে মাথায় বাঁধা পাগড়ি এবং সুন্দর করে ছাঁটা দাড়িওয়ালা শিখেরা ১৯৪৭ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অন্যতম চেহারা হয়ে ওঠে; এদের অবাধে নেওয়া হতে থাকে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে – তাদের বন্যতা নিয়ন্ত্রিত হত পাগড়িদ্বারা; তাদের অমিত ভয়হীনতাকে শ্বাপদের মত সাহসিকতাপূর্ণ করে তোলা অবিচলিত ভবলেশহীন বৃষদের মত অনুগত থাকার ইচ্ছাশক্তিকে পরিণত করা হল আদেশ দেওয়া ব্রিটিশ আমলা যোদ্ধাদের প্রশ্নহীনভাবে মান্য করতে।  
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, ব্রিটিশেরা তাদের বাহিনীর নানান ঔপনিবেশিক সমাজ থেকে তৈরি হওয়া দলের পরিধেয় পাগড়িকে প্রতিস্থাপিত করে ইস্পাতের হেলমেট দিয়ে, কিন্তু ততদিনে পাগড়ি শিখেদের ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে জুড়ে গিয়েছে, এবং তখন যদি কেউ বলত তাদের ধর্মীয় নিদানে পাগড়ির কোন স্থান নেই, তাহলে সেই যুক্তি ততক্ষণাত বাতিল হয়ে যেত।

ফলে আজকে যে পাগড়িকে শিখদের ধর্মের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে দেখার কথা হচ্ছে, সেই চিহ্নটা তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বার্থ রক্ষায়। ঠিক যেভাবে তারা ভারতের নানান গোষ্ঠীকে উপনিবেশ রক্ষার স্বার্থে গড়ে পিটে নিয়েছিল, শিখেরাও ব্রিটিশদের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে গিয়েছে মন দিয়েই। শিখদের কাছে ব্রিটিশদের চাহিদা ছিল মন দিয়ে সেনার ভূমিকা পালন করা এবং উপনিবেশ, শিখ ধর্মকে যোদ্ধাদের ধর্ম হিসেবে লালল পালন করে গিয়েছে। অষ্টাদশ শতকের ইওরোপিয় সেনাবাহিনীতে এক পোষাক চালু হল যেখানে একই পদের, একই এককের সেনারা প্রত্যেকে একই রকমভাবে দেখতে হবে, যার মাধ্যমে তারা শৃঙ্খলা এবং বশ্যতা স্বীকার করে একই কমাণ্ডের আদেশ পালন করবে। নির্দিষ্ট ধরণের পাগড়ি যেটা পরবে শুধুই শিখেরা, যে রেজিমেন্ট হবে শুধুই শিখেদের নিয়েই, সেই পাগড়িই শিখেদের পরিধেয়র অন্যতম অংশ হয়ে উঠল, যে চিহ্ন ব্রিটিশেরা তৈরি করল শিখেদের থেকে অসীম আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৭ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
শিখেদের ব্যবহৃত প্রতীকগুলির আলোচনায় কোথাও কিন্তু পাগড়ির চিহ্ন দেখা গেল না। যে সব জ্ঞানী, বিদ্বান শিখ সম্প্রদায়ের উদ্ভব এবং বিকাশ নিয়ে লিখেছেন, তাঁরা কিন্তু পাগড়ির বিকাশ এবং পন্থে অন্যান্যগুলি এড়িয়ে কিভাবে শুধু পাগড়িই শিখ চরিত্রের অন্যতম চিহ্ন হয়ে উঠল, সে বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে চুপ থেকেছেন। গুরুগ্রন্থসাহিবের অনুবাদক এবং আলোচক এম এ ম্যাকাউলিফার টিকাতে লিখছেন, যদিও গুরু বলছেন, তার শিষ্যরা যে সব দেশে যাবেন, সেই সব দেশের পোষাক পরলেও তারা কিন্তু টুপি না পরে পাগড়ি পরিধান করবেন যাতে তাদের দীর্ঘ চুল ঠিকঠাকভাবে পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা যায়। ডবলিউ এইচ ম্যাকলয়েড বলছেন, অষ্টাদশ শতক পরবর্তী সময়ের খালসার চিহ্ন হিসেবে যুক্ত হয়েছে পাগড়ি – এবং উনবিনশ এবং বিংশ শতকে শিখেদের আত্মপরিচিতি পাওয়ার অতিরিক্ত উৎসাহ এবং সেই পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি ধারণের ধারণাটি প্রবল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
উনবিংশ শতকজুড়ে ভারতীয় এবং ইওরোপিয় শিল্পীদের আঁকায় দুধরণের পাগড়ির ছবি দেখতে পাই। একটা সাধারণ কাপড় দিয়ে মাথার ওপর খোঁপাটাকে জড়িয়ে নিয়ে শক্ত করে গোটা মাথা বাঁধা। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে আরেক ধরণের পাগড়ি যেটা অনেকটা শাসনের সঙ্গে জুড়ে থাকা শিখেরা পরতেন। গোটামাথায় শক্ত করে কাপড় বাঁধা থাকত, আর সামনে কপালের ওপরে কাপড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকত একটি জিঘা, পক্ষীর পালকের সঙ্গে আঁটা একটি রত্ন। আর থাকত সোনা আর রূপোর সঙ্গে আটকানো একের বেশি রত্ন, যার নাম সারপঁচ। এই রত্নখচিত মুকুট বা পাগড়ি পরা ভারতে জনপ্রিয় করে শাসক মুঘলেরা।
অষ্টাদশ শতকে মুঘলদের রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি ধ্বংস হতে থাকে। পাঞ্জাবে বঃহিশক্তি আক্রমণ করে  এবং আস্তে আস্তে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখ রাজনীতি নতুন করে সংহত হতে থাকে এবং একটি শিখ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিংহের মৃত্যুর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে শিখদের ওপর, শেষ পর্যন্ত প্রাক্তন শিখ রাষ্ট্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ১৮৪৯ সালে বিলীন হয়ে যায়।

শিখ রাষ্ট্র শতচ্ছিন্ন হয়ে ব্রিটিশদের কাছে তারা হেরে গেলেও, শিখ সেনা বাহিনী আটুট থেকে যায়। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিখদের অন্যভাবে দেখতে শুরু করে। বিশেষ করে যে সব ব্রিটিশ শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তারা শিখদের যুদ্ধ করার ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে পড়ে। অন্যান্য সমাজকে জয় করে ব্রিটিশরা অকর্মণ্য, কুসংস্কারী এবং অকেজো, মেয়েলি দেগে দিলেও শিখদের কিন্তু তারা শৌর্যের শিরোপা দিল। ঔপনিবেশিক সেনাদের জন্যে লেখা তথ্যগ্রন্থে ক্যাপটেন আর ডব্লিউ ফ্যালকন লিখলেন এই ধর্মে মূর্তিপুজা, ভণ্ডামি, জাতিবাদিতা, মহিলাদের পুড়িয়ে মারা বা শিশুহত্যার মত জঘন্য কাজ হয় না... শিখেরা যুদ্ধ জাতি, তারা খেলোয়াড়, বুদ্ধিতে একটু খাটো কিন্তু সাহসী, ঋজু এবং সত্যবাদী। এককথায় দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালি, গুর্খা বা উত্তরপশ্চিমের সীমান্তের পাঠানদের মত শিখেরা ব্রিটিশদের হারিয়ে দেওয়ার মুখে চলে এসেছিল এবং পরবর্তীকালে এরাই ব্রিটিশ সেনার মূল স্তম্ভ হল।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৬ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
শিখবাদ হিন্দু ও মুসলমানেদের মধ্যে পঞ্চদশ শতকে উত্তর ভারতে দুই সম্প্রদায়ের মিলনের একটা যৌথ আন্দলনের ফসল। এই পন্থের গুরু, গুরু নানক(আদতে জ্ঞানক>নানক – অনুবাদকার। সূত্র সুহৃদ ভৌমিক মশাই)এর বাণীগুলি লিখিত আকারে সঙ্ঘবদ্ধ হয় গুরু গ্রন্থ সাহিব নামে। এবং এই পন্থে উত্তরাধিকার সূত্রে গুরুদের পন্থ প্রচারকারী এবং আচার বহনকারী এবং ব্যাখ্যাকারী শিষ্য নির্বাচিত হতে থাকেন। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতক থেকে পাঞ্জাবে শিখদের ওপরে মুঘল শাসকেরা সামরিক বিপুল আক্রমন নামিয়ে আনে, কেননা পাঞ্জাব ছিল সামরিকভাবে মুঘলদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন এলাকা – ভারতে বৈদেশিক আক্রমনের রাস্তার ওপরেই ছিল পাঞ্জাবের স্থান। ফলে শিখদের মধ্যে যুদ্ধ প্রবণতা এবং বিদ্রোহের জ্বালা তৈরি হতে থাকে। 
দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখদের যুদ্ধ প্রবণতা এবং বিদ্রোহের জ্বালাকে নির্দিষ্ট আকার দান করলেন সেই সব মানুষদের নিয়ে যারা নিজেদের একসঙ্গে শুদ্ধ একজাতি বা খালসায় থাকাকে জায়েজ মনে করত। এর বাইরে থেকে গেল বিপুল জনসংখ্যা যারা নানান ধরণের পন্থে বিশ্বাস করত। ১৬৯৯ সালে এক নাটকীয় ঘটনায় গুরু গোবিন্দ সিংহ পাঁচজনকে তার পন্থের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনাকারী অনুসারী শিষ্য হিসেবে তৈরি করে নিলেন। এই পাঁচজনই গুরুর নির্দেশে, গুরুর হাতে নিজেদের মাথা কেটে ফেলার মত কঠোর সিদ্ধান্তে অচল রইলেন।
১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিংহ নববর্ষে বৈশাখীর দিন বিপুল শিষ্য সমাবেশ ঘটালেন। প্রত্যেক শিষ্য সেই জমায়েতে হাজির হল তাদের মাথার লম্বা চুল আর বিশাল আকাটা দাড়ি নিয়ে। মেলা উৎসব চললেও গুরু প্রকাশ্যে দেখা দিচ্ছিলেন না। হঠাত তিনি শিষ্যদের ডাক দিলেন গুরুর হাতে গুরুর প্রতি আত্মনিবেদনে মাথা বলিদান দেওয়ার জন্যে। একজন স্বেচ্ছাসেবক আর তার অনুগামীরা খোলা কৃপান হাতে গুরুর সঙ্গে গুরুর শিবিরে প্রবেশ করল। কোন কিছু শক্ত বস্তুর ওপরে তরোয়াল চালানোর শব্দ শোনা গেল, গুরু রক্তমাখা কৃপান হাতে তার শিবির থেকে বেরিয়ে এলেন। এই ভাবে পরপর আরও চারজনকে নিয়ে তিনি শিবিরে ঢুকলেন আর রক্তমাখা কৃপান হাতে বেরোলেন। পরে বোঝা গেল গুরু তার শিষ্যদের হত্যা করেন নি, তিনি পাঁচটা ছাগল হত্যা করেছেন নিভৃতে।
এই পাঁচজন নির্বাচিত হলেন খালসার মূল ধারণার ধারক বাহক হিসেবে। তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট আচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হল, প্রত্যেকে একটি পাত্রে একসঙ্গে পানকরলেন নিজেদের মধ্যে সাম্যাবস্থা প্রদর্শিত করতে। এরপর তারা কিছু নিয়ম তৈরি করলেন, শিখেরা মাথা চুল আর দাড়ি কাটবে না, মদ আর তামাক পরিহার করবে, হালাল মাংস খাবে না, মুসলমান মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গম করবে না। প্রত্যেকের উপাধি হবে সিংহ। আকাটা চুল(কেশ) রাখবে, তারা চুলে চিরুনি রাখবে(কাঙ্গা), হাঁটু পর্যন্ত জামা পরবে(কাচ্ছা), ডান হাতে ইস্পাতের বালা পরবে(কাড়া) এবং তরোয়াল(কৃপাণ) বহন করবে। 
জে পি ওবেরয় এই পাঁচটি আচার পালনের নির্দেশ খুব বিশদে বিশ্লেষণ করেছেন, তার সঙ্গে অব্যক্ত আরেকটা নির্দেশ সুন্নত না করাকেও বিশ্লেষণ করেছেন। এর মাধ্যমে শিখেরা হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায় থেকে আলাদা হয়ে গেল। তিনি দুটি তিনটি তিনটি করে পরস্পর বিরোধী আচার বর্ণনা করলেন প্রথম তিনটি, আকাটা চুল, তরোয়াল এবং সুন্নত না করা লিঙ্গ অনৈতিক(এমরাল) শক্তি, বিপজ্জনকও বটে। আর অন্য তিনটে চিরুণি, বালা আর বিশেষ পরিধেয় নৈতিক এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। এই দুয়ের মিলনে তিনি শক্তির স্ফূরণ তার তাকে নিয়ন্ত্রণের চরিত্র দেখলেন শিখদের মধ্যে।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৫ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

১৯৫৯ সালের লন্ডন। জনৈক শিখ জি এস সাগর ম্যানচেস্টার ট্রান্সপোর্টে গাড়ির চালক হতে আবেদন করেন। তার আবেদন খারিজ হয়ে যায় কেন তিনি না তার সমাজের কৌম চিহ্ন পাগড়ির বদলে স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া প্রত্যেক বাহন কর্মচারীর নির্দিষ্ট পরিধেয়র অংশ টুপিটি পরতে অস্বীকার করেন। সাগরের যুক্তি ছিল এটি তার আবশ্যিক ধর্মীয় পরিচয় বাহক। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, কেন হাজারো শিখ, পাগড়ি পরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে কয়েকশ যুদ্ধে অংশ নিয়ে সাম্রাজ্যকে বিজয়ী করেছে, তাহলে তিনি কি দোষ করলেন। যান ব্যবস্থাপকদের বক্তব্য ছিল, চাকরির যায়গায় পরিধেয় পরতে যদি কোন ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে সেই ব্যতিক্রমের ঠেলা তাদের সংগঠনকে কোথায় নিয়ে ফেলবে তারা বুঝতে পারছেন না। ফলে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে যে পরিধেয় ঠিক হয়েছে, তাকে মান্য করতে হবে।
আমরা জানি কিভাবে চাকরিদাতারা, তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে নৈতিকতা জোর করে কর্মপ্রার্থীদের পরিধেয়, চেহারা এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মেনে চলার ওপর চাপিয়ে দেয়। এই বিতর্কের সাত বছর আগে এই ধরণের পরিধেয় পরা নিয়ে আন্দোলন চলছিল, বিশেষ করে স্কচদের কিল্ট নিয়ে যা তাদের জাতীয় চরিত্র রূপে স্বীকৃত – জাতীয় পরিধেয়, সেটি আইনিভাবে কর্মচারীর পক্ষে পরার ব্যবস্থা করা যায়। শিখেদের যুক্তি হল পাগড়ি পরিহিত কোন শিখের চাকরি না পাওয়ার অর্থই হল ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা। কর্মচারীদের সংগঠন এই বিবাদে কর্তাদের পক্ষেই দাঁড়ায় এই যুক্তিতে যে কোন ব্যক্তিগত কর্মচারী কর্তৃপক্ষের তৈরি করে দেওয়া নিয়মের বিরোধিতা করতে পারে না, যা আদতে কর্মচারী সঙ্গঠন-কর্তাদের মধ্যে দরকষাকষিকরে ঠিক হয়েছিল।
এই বিতর্ক আরেক স্তরে উঠে আসে যেখানে সাদাদের ঐতিহাসিকভাবে অসাদা চামড়ার মানুষ, অদ্ভুত ধর্মীয় আচার পালন করা মানুষ, অদ্ভুতভাবে জামাকাপড় পরা মানুষ, যাদের তারা শস্তার শ্রমিক হিসেবে দেখে তাদের দেশে বাস করার অধিকার দিয়েছে, তারা আদতে সস্তার কাজ করে সেদেশের সাদা সরল দক্ষ সৎ শ্রমিকদের মজুরির স্তর কমিয়ে দিচ্ছে। বাস্তব হল, সাদা ব্রিটিশ শ্রমকেরা পরিষ্কার, তুলনামূলকভাবে সহজ, অপরিশ্রমী এবং বেশি মাইনের কাজে উৎসাহী বলে শস্তার শ্রমিকদের প্রতি এইসব জাতিবাদী মন্তব্য করেছে। এছাড়াও কিছু মধ্যবিত্ত ব্রিটিশ নতুন কমনওয়েলথ থেকে আসা অভিবাসীদের তাদের ব্রিটিশ সমস্বত্ত্বতার কৃষ্টির ওপর আঘাত হিসেবে দেখলেন। ভারত, পাকিস্তানি, বাংলাদেশিদের পরা পাগড়ি, কালো চামড়া, শাড়ি এই আঘাতের চিহ্ন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শিখের পাগড়ি বিতর্ককে আমাদের দেখতে হবে আড়াইশ বছর ধরে ভারতীয় আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে চলতে থাকা আর্থিক রাজনৈতিক এবং কৃষ্টিগত উচ্ছেদের ইস্যু হিসেবে। এই বিতর্ককে বুঝতে আমাদের উনইবিংশ শতকে ব্রিটিশ আর ভারতীয়দের পরিধান বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং আলোচনা করতে হবে; আলোচনা করতে হবে কি করে সাদা শাসক আর কালো শাসিতের মধ্যে বাহ্যিক দূরত্ব তৈরি হল; ব্রিটিশ উপনিবেশে শাসক আর শাসিতের প্রতিনিধিত্বের পোষাক পরিচ্ছদের মধ্যে বিচ্যুতির যে সম্পর্ক তৈরি হল।

পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
সাগরের পাগড়ি পরে কাজ করার অধিকার চাওয়ার মধ্যে ব্রিটেনে যে বিপুল বিতর্ক তৈরি হল সেটা আদতে বেশ কয়েক শতাব্দ ধরে এশিয়া আফ্রিকায় উপনিবেশ হারানো এবং বহু উপনিবেশে স্বাধীনতা চাওয়া প্রজাদের আর মুক্ত উপনিবেশের প্রজাদের প্রাক্তন শাসকদের সমান হয়ে দাঁড়ানোর দাবিতে প্রায় অসহায় সম্বলহীন হয়ে পড়া ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া। ব্রিটেনজুড়ে পরিধেয় বিষয়ে গোটা মধ্য এবং উচ্চশ্রেণীভুক্ত সামাজিক স্তরে বিপ্লব আসছিল। নিচের শ্রেণীর যুবারা, বড় এবং প্রবীনদের পরিধেয়র আঙ্গিকে প্রভাব ফেলছিল, প্রাচীন কালে যে সব পরিধেয় উচ্চমার্গের বলে চিহ্নিত হত সেগুলি নিয়ে ব্যঙ্গ, বাতিল করার মাধ্যমে এই নিম্নবিত্ত যুবারা নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

এই দীর্ঘ ব্রিটিশিয় প্রাক্তন শাসক আর প্রাক্তন শাসিতের মধ্যে পরিধেয় নিয়ে চলতে থাকা লড়াইতে শিখদের পাগড়ি আরেকটি বিদ্রোহী আঙ্গিক হিসেবে যোগ হল। অথচ মজার তথ্য হল শাসক ব্রিটিশেরাই উনবিংশ শতাব্দে শিখদের পাগড়িকে শিখ সমাজের পরিচয় চিহ্ন হিসেবে তৈরি করেছিলেন। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৪ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
উনবিংশ শতকের প্রথমপাদের প্রত্যেকটি ব্রিটিশ যুদ্ধ এবং বিজয় স্মারক আর বিজয়চিহ্ন লন্ডনে গিয়ে হয় রাজ পরিবারের টাওয়ার স্থিত অস্ত্রাগারে উপঢৌকন হিসেবে গিয়েছে নয় কোম্পানির ছোট্ট মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছে – ড্রাগনের মত কামান রেঙ্গুন থেকে, মারাঠা যুদ্ধের তরোয়াল, ঢাল আর ড্যাগারগুলি; অথবা শান্তির উপহার হিসেবে ভাবলে রবার্ট গিলের অজন্তা গুহার ফ্রেস্কোগুলি। কোম্পানির মিউজিয়ামে ১৮৫৩ সালে বিজয় স্মারক হিসেবে সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল শিখ যুদ্ধের স্মারকগুলি – বিশেষ করে রঞ্জিত সিংহের স্বর্ণ সিংহাসন এবং কোহিনুর, যা ব্রিটিশ রাজপরিবারের মুকুটে বসানো ছিল। গভর্নর জেনারেল ভাবলেন, উদ্ধার হওয়া গুরু গোবিন্দ সিংহ ব্যবহৃত একটি করে হাতিয়ার এবং বল্লম শিখদের ফিরিয়ে দেওয়া অবিবেচকের কাজ হয়ে যাবে, ফলে এটিও টাওয়ারের প্রদর্শনীতে পাঠানো হল। যুদ্ধে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলি লন্ডনে পাঠানো হল এবং এগুলি শিখদের শৌর্য হিসেবে প্রদর্শিত হল। এই অস্ত্রগুলির প্রত্যেটির কুলুজি আছে এবং রঞ্জিত সিংহের শিখজাতি তৈরির হাতিয়ার এই অস্ত্রগুলি। ব্রিটিশেরা শুধু শিখদের ধর্মনিরপেক্ষ চিহ্নগুলি ধারন করতে উৎসাহী হল তাই নয়, তারা গুরুগ্রন্থ হাতে পেতে এবং সেটি ইংরেজিতে অবিলম্বে অনুবাদ করতে অতিউতসাহী হয়ে উঠল। ব্রিটিশদের ভারত ভূমিজয়ের এক একটি বিজয় সূচিত হল জ্ঞানের ওপর বিজয়ে।
১৭৯৯ সালের ব্রিটিশেরা তৃতীয় মহীশূর যুদ্ধে জেতায় ভারত থেকে সব থেকে জনপ্রিয়তম নিদর্শনগুলি গেল। এই উচ্ছ্বাস শেষ হল আরেকটি ধামাকাদার ঘটনায়, সেটি হল সিপাহী যুদ্ধ। যুদ্ধটির খবর লন্ডনে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করল। বিপুল মানুষের অক্ষর জ্ঞান এবং চিত্রিত পত্রিকার প্রতিবেদনিক ঘণঘটায় মুহূর্তের মধ্যে শত্রু আর নায়ক তৈরি হয়ে যাচ্ছিল – ‘পাণ্ডে’ বিদ্রোহী এবং অদ্ভুত আর রহস্যময় ব্রাহ্মণ, যিনি অন্যান্য যুদ্ধে যাওয়া চাষীদের সঙ্গে নিয়ে বাংলা সেনার শিরদাঁড়া হিসেবেও দাঁড়িয়ে ছিলেন যারা তাদের অধীক্ষকদের হত্যা করে তাদের নিরাপরাধ স্ত্রী আর শিশুদের রক্তে হোলি খেলে; বিদ্রোহীদের নেতা জরাগ্রস্ত কিন্তু বিপজ্জনক ব্রিটিশ সম্রাট এবং অর্ধইওরোপিয় লম্পট মারাঠা ব্রাহ্মণ নানা সাহিব। নায়কেরা নিকলসনের মত সক্কলে প্রতিশোধগ্রহনকারী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। মাঠে নেমে যুদ্ধ করা জেনারেল নেইল এবং মেজর হডসন এবং অতিরক্ষণাত্মক জেনারেল নেইল এবং মেজর হ্যাভকল এবং আউট্রাম  অবিসংবাদী নায়কআরও ছিল এংলো ইন্ডিয়ান পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ দপ্তরের কর্মচারী কানিভায়ুগ(Kavinaugh), যাকে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে ভিক্টোরিয়া ক্রস স্মারক তুলে দেওয়া হয়। আর ছিলেন জেনি, একজন সাধারণ সেনার কন্যা, যার লক্ষ্ণৌ নিয়ে স্বপ্ন খাতায় কলমে রূপদান করেন টেনিসন এবং অন্যান্যরা আঁকায়, চিত্রে এবং সেরামিক্সে।
সিপাহী যুদ্ধের সফলতা আবার নতুন করে লুঠের স্মৃতি হিসেবে নানান ভারতীয় কারিগরি লন্ডনের পানে ধাওয়া করল। এই স্মতিচিহ্নগুলির নানান জনমহাফেজখানায় ঠাঁই হল। কিছু ঠাঁই পেল মেমোরেবিলিয়া অব মিউটিনি হিসেবে ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়ামে যার মধ্যে ছিল দ্বিতীয় বাহাদুর সাহ জাফরের ছোরা, মেজর হাডসনের কাছে ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সালে আত্মসমর্পন করা দিল্লির রাজার শামসের এবং তলোয়ার; লর্ড অচিনলেকের দখল করা নানা সাহেবের তামার সুপুরিদানি; নাইন্থ ল্যান্সারের সার্জেন্ট ব্রুকসএর হাতে পড়া কাঠের হাতা; যে গাছের আড়াল থেকে মেজর হাডসন রাজকুমারীকে গুলি করে আহত করেন, সেই গাছের তৈরি টেবল, অযোধ্যার রাজার ব্যবহৃত একটা পোর্সেলিনের পাত্র, লক্ষ্ণৌ অবরোধের সময় হেনরি লরেন্সের ব্যবহৃত ভাঙ্গাচোরা পেয়ালা; লক্ষ্ণৌএর রূপোয় মোড়া ইট; তাঁতিয়া টোপির কুর্তা আর তাঁতিয়া টোপির নস্যি ডিবে যেটায় তার চুল ছিল, জনৈক মৃত সৈনিকের থেকে লুঠ করা রূপোর আংটি, কানপুরের ‘গণহত্যা’য় এক বাচ্চার জুতো; একই জায়গার একই সময়ে পাওয়া একটি ম্যানিকিওর সেট। এইগুলি ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছিল।
একজন বাঙালি এই প্রদর্শিত বস্তুগুলি কিভাবে দেখছেন? রাখাল দাস হালদার ১৮৬২ সালে লন্ডনে পড়তে যান, তিনি ফিফ হাউসের প্রদর্শনী দেখে কি লিখেছিলেন তা পড়া যাক - ইট ওয়াজ পেইনফুল টু সি দ্য স্টেট চেয়ার অব গোল্ড অব লেট লায়ন অব দ্য পাঞ্জাব উইথ আ মেরি পিকচার আপন ইট; শলস উইদাউট বেবিজ; মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস উইদাউট আ হিন্দু প্লেয়ার; জিলাইস এন্ড সোর্ডস উইদাউট সিপাহিজ এবং সওয়ার্স; এন্ড এবভঅল হুকাজ উইদাউট ফিউম অব ফ্যান্টাস্টিক শেপস।

Saturday, April 28, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭৩ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
ব্রিটেনে অথবা ভারতে থাকা ব্রিটিশেরা যুদ্ধের লুঠ, দখল আর হত্যার মধ্যেই আর্জিত নানান ধরণের সব বস্তুকে গুরুত্বপুর্ণ ভাবতে শিখল। উনবিংশ শতাব্দে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মদতে লুঠের মাধ্যমেই প্রচুর মূল্যবান এবং জনপ্রিয় নানান কারিগরি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র লন্ডনে গিয়েছিল। ১৭৯৯(বইতে ভুল ছাপা হয়েছে ১৮৯৯ সাল) সালে টিপু সুলতানের হারের পর শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনের উল্লাসে টিপুর সঙ্গের জুড়ে থাকা বহু দ্রব্য লুঠ হয়ে নিলামের বাজারে চলে এসেছিল। এই লুটে ছিল টিপুর বাঘ, তার মুকুট, দেহবর্ম, সিংহাসন থেকে লুঠ হওয়া বাঘের মাথা, একটি রয়্যাল কার্পেট। এগুলি কোর্ট অব ডিরেক্টর্স এবং রাজপরিবারের সদস্যদের উপঢৌকন দেওয়া হয়। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই সেগুলি লিডেনহল স্ট্রিটের মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্যে হাজির হয়।
১৮২০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে শ্রীরঙ্গপত্তনমের বিজয় দেখানো চিত্রকলার চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে এবং তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট জাদুঘরটিতে। জেনারেল ডেভিড বার্ডের টিপুর মৃতদেহ সনাক্তকরণ, টিপুর মৃত্যু এবং টিপুর দুই ছেলের আত্মসমর্পণ বর্ণনা করে আঁকা ছবি বিপুল্ভাবে লন্ডনের অভিজাতদের বাড়িতে চাহিদাবন্ত হয়ে উঠল। টিপুর হার আর চিরাচরিত শত্রু এবং শয়তান বাঘ টিপুর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জিত বর্ণনা করে হাজারো নাটক, ব্যঙ্গ, গীতিকবিতা, ছড়া ইত্যাদি ছেয়ে গেল লন্ডনে।
১৮২০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত যে সব জনপ্রিয় লন্ডন ঘোরার নির্দেশনামা লেখা বইতে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস এবং তার সংলগ্ন মিউজিয়াম সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আলোচনা করেছে। সপ্তাহে মাত্র কয়েকদিন খোলা থাকা মিউজিয়ামে ঢুকতে হত গাঁটের কড়ি খরচ করে। দারোয়ানকে কিছু উপরি দিলে আরও বেশি কিছু দেখার ব্যবস্থা হয়ে যেত। যদিও ফারগুসন এই মিউজিয়ামে অমরাবতী স্থাপত্য দেখেছিলেন বলে দাবি করছেন, কিন্তু সে সময়ের নথি বলছে এই মিউজিয়ামে এধরণের কোন স্থাপত্য ছিল না, শুধু টিপুর হারের আর শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনে ব্রিটিশ বিজয়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু স্মৃতিচিহ্ন।
নিচের তালিকাটি তৈরি করেছেন ব্রিটন এন্ড পুগিন ১৮৩৮ সালে। এই তালিকা থেকে আমরা বুঝতে পারি কোম্পানি কি ধরণের বস্তু তার মিউজিয়ামের জন্যে সংগ্রহ করত
জাভার টাপির, চারপায়ের জন্তু হগের মত, কিছুটা লম্বা ঝুলন্ত শুঁড়, অনেকটা দক্ষিণ আমেরিকার ট্যাপিরের মত। জাভায় হর্সফিল্ডের গবেষণায় এই নতুন ধরণের জন্তু আবিষ্কৃত হয়েছে
জাভা থেকে সংগৃহীত বিড়াল আর হনুমান প্রজাতির চতুস্পদ জন্তু
জাভা থেকে সংগৃহীত পাখি, পালকের সৌন্দর্যে চোখ টানে, একই দ্বীপপুঞ্জ থেকে; এছাড়াও ভারত আর সিয়াম আর কোচিন চিনের পাখি; আর উত্তমাশা অন্তরীপের পাখি।
ভারত থেকে আনা সিংহের চামড়া, যেটা এশিয়ায় বেশি দেখতে পাওয়া যায় না বলে এর অস্তিত্ব স্বীকৃত হচ্ছিল না এতদিন,
জাভার পোকা, কিছুটা প্রজাপতির মত দেখতে
সিঙ্গাপুরের সমুদ্রজাত কাপ অব নেপচুন, একখণ্ড প্রবাল
কাঠের ওপর কাঁসা পাথর তৈরি চিনা নৈসর্গ দৃশ্য; হাতির দাঁতের আর রূপো এবং মাদার অব পার্ল দিয়ে তৈরি মন্দির তার সঙ্গে মানুষ, পাখি, গাছ
চিনা অঙ্কন, যার মধ্যে একটা চিনা উৎসব, সাধারণ চিনা ছবির তুলনায় গভীরভাবে আঁকা
টিপু সাবের সোনায় তৈরি বাঘের মাথার আকারে চারপায়া সিংহাসন, চোখ আর দাঁতগুলি ক্রিস্টালের। অসাধারণ সিংহাসন, যা টিপু মহীশূরের সিংহাসনে বসেই তৈরি করান। এটি নিরেট সোনার তৈরি, বসার আসনটা মাটির থেকে তিন ফুট উঁচুতে। বিশাল বিশাল সৌন্দর্যের আর আকারের ক্রিস্টাল, মণিমুক্তো খচিত সোনার স্তম্ভের মাথায় একটা চাঁদোয়ার মত করা। বিজিতরা এটি খণ্ড খন্ড করে কেটে উপহার হিসেবে সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিল
একটি গানগাওয়া বাঘ, টিপুর প্রাসাদ থেকে পাওয়া। একটা এক ধরণের হ্যান্ড অর্গান, বাঘের আকারে তৈরি করা। বাঘের তলায় একজন মানুষ শুয়ে রয়েছে, বাঘ গর্জন করছে আর মানুষটার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।
টিপু সাহেবের অস্ত্রশস্ত্র। সেলাইকরা সুতি আর সবুজ রেশমে আবৃত মাথা আর গায়ের বর্মের সঙ্গে, যে বর্ম যে কোন আঘাত সহ্য করতে সক্ষম

প্রাচীন ব্যবিলনের ইউফ্রেটিস নদের ত্যীরের পাহাড় থেকে আনা ইঁট। তাতে নখে আঁকা লিপি খোদায় করা হয়েছে। এই লিপিগুলি চিনাদের মত লম্বভাবে না ইওরোপিয়দের মত শুইয়ে পড়তে হবে তা নিয়ে জ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭২ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
জাতি, কারিগর, পেশাদার ইত্যাদিদের সাধারণত অপ্রাসঙ্গিকভাবে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে ছবি আঁকা হত। তাদের ছবি আঁকা হত কোন রকম পশ্চাদপট ছাড়াই। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি অবশ্যই পুরুষ হত, বড় জোর তার সঙ্গে তার স্ত্রী থাকত, সঙ্গে থাকত তার কাজের হাতিয়ারগুলি, আর কিছু দ্রব্য যেগুলি ভদ্র ভারতীয় আর ইওরোপয়দের ভোগ্য। ব্রিটিশেরা আরও কিছু আঙ্গিকের ছবি সংগ্রহ করত যেমন বিশালকায় প্রাসাদের ছবি, হাতির দাঁতের ওপর আঁকা ছবি, ধর্মীয় আচারের ছবি – সে আচার যত ইওরোপিয়দের চোখে অদ্ভুত লাগে তত ভাল যেমন পিঠে বঁড়শি লাগিয়ে মন্দিরের সামনে চড়ক দোলা বা বিভূতি মাখা সাধু ইত্যাদি। এছাড়াও বারি ঘরদোরের চাকরবাকর আর কারিগরদেরও এঁকে বহু ছবি বিক্রি হয়েছে।
ব্রিটেনে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার জন্যে এবং ভারতীয় স্থাপত্য বিষয়ে ব্রিটিশদের অব এবং অশ্লীলমূল্যায়নের জন্যে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এবং উনবিংশ শতকে স্থাপত্যগুলি অত্যন্ত বেশি খরচ দিয়ে সাগর পার করাতে ইওরোপিয়রা খুব বেশি উৎসাহিত হয় নি। চার্লস টাউনলি এবং রিচার্ড পাইন নাইটের স্থাপত্য সংগ্রহ বিষয়ে পার্থ মিত্র বিশদে লিখেছেন অন্তত এই দুজনের তাদের সংগ্রহের আকর্ষণের অন্যতম ভিত্তি হল যৌনাচার এবং প্রাচীন অদ্ভুত ধর্মীয়তার ছবি আর স্থাপত্য।
এদের মধ্যে সব থেকে আকর্ষণীয় সংগ্রহ ছিল চার্লস স্টুয়ার্টের, যার আরেক নাম হিন্দু স্টুয়ার্ট যিনি বাংলায় ১৭৭৭ থেকে মৃত্যুর বছর ১৮৩০ পর্যন্ত বসবাস করেছেন। পার্ক স্ট্রিট সমাধিখানায় ওনার সমাধি আজও আছে। সমাধির ওপরে একটি মন্দিরের আকারে ইন্দো-আর্য আঙ্গিকের স্থাপত্য আছে। এটির দেওয়ালে ভারতীয় দেবদেবীর ছবি শোভিত রয়েছে। এতে দুটি লেখ লাগানো আছে একটি হল একটিতে লেখা আছে ইন্দো-আর্য মন্দির অন্যটি প্রাচীন ব্রহ্মার মন্দির। ১৮৩০এ মৃত্যুর পর তার সংগ্রহের বিশাল পরিমান লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এগুলি ক্রিস্টিজ নিলাম করে ১৮৭২এ। এই সংগ্রহটিতে থাকা ১১৫ খানি বস্তু দখল করেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পক্ষে উলস্টন ফ্রাঙ্কস।

চিত্রে থাকতে পারে: আউটডোর
পার্কস্ট্রিটে হিন্দু স্টুয়ার্টের সমাধিমন্দির

কোনো স্বয়ংক্রিয় বিকল্প পাঠ্য উপলব্ধ নেই৷
স্টুয়ার্ট কিভাবে এই সংগ্রহটি তৈরি করেছিলেন তা কিছুটা আলোচনা করেছেন জেমস প্রিন্সেপ। তাঁর সমাধিতে লাগানোর আগে শিলালিপিটি প্রিন্সেপ এশিয়াটিক সোসাইটির অধীনে থেকে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। এটি কোথা থেকে স্টুয়ার্ট সংগ্রহ করেছিলেন সেটাও জানা যায় না। তার মনে হয়েছিল এটি ওডিয়া লিপির কাছাকাছি কোন লিপি হতে পারে। সে সময় লেফটান্যান্ট কিটো ভুবনেশ্বরের মন্দিরের লিপিগুলি পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার মনে হচ্ছিল সে অঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা তার কাজে বাধা দিচ্ছে। যখন তিনি তাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণ প্রশ্ন করলেন, তখন পুরোহিত বললেন যে তাদের প্রচুর লেখ আর মূর্তি এক প্রয়াত কর্নেল সাহেব নিয়ে গিয়েছেন। পরে সোসাইটির খাতা খুলে দেখেন ওডিশিতে লেখা দুটি লেখ স্টুয়ার্ট সোসাইটিকে দান করেছেন। প্রিন্সেপের মনে হল মন্দিরকে সেই দুটি লেখ ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। পরের বছর সেটি করা হল। কিন্তু কিটো এই কাজটি করতে গিয়ে যে ধরণের অভ্যর্থনা আশা করছিলেন তা তিনি পেলেন না। বরং পুরোহিত কিটোকে হারিয়ে যাওয়া মূর্তি আর লেখর একটা দীর্ঘ তালিকা তুলে দিয়ে সেগুলিও এই দুটি লেখর মত ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

আমরা দেখলাম কিভাবে শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ করতে জ্ঞান সঞ্চয় করার জন্যে কোম্পানি এবং ব্যক্তির দ্বারা করা সমীক্ষা এবং অনুসন্ধানের ফলে বিপুল সংগ্রহ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও শিল্পী আর কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতায়ও প্রচুর কারিগরী পুথি আর চিত্রবলী বিদেশে গিয়েছে। ধনীদের জন্য পণ্য বিক্রি করার বিভিন্ন বাজার থেকে নানান ধরণের কারিগরিও সংগৃহীত হয়েছে। ঘুষ, হাতিয়ে নেওয়া, স্রেফ চুরি করে বিপুল শিল্প আর কারিগরির সংগ্রহ তৈরি হয়েছে। 

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
উনবিংশ শতাব্দীর ইংলন্ডে বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকলা সংগ্রাহক ছিল, তাদের মধ্যে একজন বিপুল পরিমানে ভারতীয় স্থাপত্য সংগ্রহ করেন। ১৭৭৪ সালে কোম্পানির কর্মকর্তা, উইলিয়াম ওয়াটসনের হাতে রোহিলা যুদ্ধের সময় প্রচুর পরিমান ভারতীয় স্থাপত্য এসে যায়। আজকে এটি মনলি রাগমালা নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। রবার্ট ক্রান এর তারিখ নির্ণয় করেছেন সপ্তদশ শতাব্দ ধরে। ১৮১৫ সালে ওয়াটসন তার কন্যাকে ছবিগুলি দিয়ে লিখে যান, গিভস য়ু আ পারফেক্ট আইডিয়া অব দ্য কাস্টমস, ম্যানার্স এন্ড দ্য ড্রেস অব দ্য মেন এন্ড ওমেন ইন বেঙ্গল, পারসিয়া এন্ড মোস্ট পার্টস অব দ্য ইস্ট ইন্ডিজ... অলসো অব দেয়ার বার্ডস, ট্রিজ এন্ড প্ল্যান্টস। তিনি প্রত্যেকতা ছবির টিকাও করে দিয়ে যান।
কয়েকটি ধারাবাহিক প্রকাশনায় মিল্ডার্ড আর্চার অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষণার যে ইতিহাস লিখছেন, তাতে দেখি, এই চিত্রকলাগুলিতে বিশদে ভারতীয়দের সামাজিক প্রথা, জামাকাপড়, পেশার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ব্রিটিশ যে কটা শিল্প ভারতীয় শিল্পীদের বরাত দিয়ে অথব খোলা বাজার থেকে খুব বেশি করে সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে চিত্রকলা অন্যতম। গৃহস্থ বাড়ির একমাত্র ভৃত্যরাই ইওরোপিয়দের হাতে নাগালে ছিল। যারা প্রথম ভারতে আসতেন তাদের একদল চাকরবাকর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করতেন।
ভারতে ভ্রমন করার প্রথম নির্দেশিকা লেখক দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া ভাদে মেকুম(লন্ডন ১৮১০) ক্যাপ্টেন টমাস উইলিয়ামসন লিখলেন ভারতে বিপুল সংখ্যায় চাকরবাকর দেখা যায় কারন তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে থাকে যাকে আমরা কাস্ট বলি। উইলিয়ামসন বাড়ি আর দপ্তরে কাজের জন্য ৩১ রকমের ভৃত্যের প্রকার লিখেছিলেন। উইলিয়ামসনের এই ভাগকে আমরা উচ্চ ও নীচ এই দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। উচ্চতমপদে কাজ করা ভৃত্যদের নকরোঁ বলা হত। এদের মালিকেরা ভরসা আর বিশ্বাস করতেন। এরা সাধারণত পরিশ্রমের কাজ করতেন না, মূলত নজরদারি আর খবরদারির কাজ করতেন। নিচুস্তরের ভৃত্যরা যাদের চৌকিরঁ বলা হত তাদের নিজস্ব স্তরীভবন ছিল। এদের যে অংশ বাড়ির ভেতরের কাজ করতেন তারা সাধারণ বাড়ির কাজ, টেবলে অপেক্ষা করা, রান্না করা, মদ্য ঠাণ্ডা করার কাজ, হুঁকা বরদার, আসবাব ঠিক রাখা ইত্যাদির কাজ করতেন। যারা বাড়ির বাইরের কাজ করতেন, তদের মধ্যে মালি, পালকিবাহক, সহিস, ধোবি, পিয়ন, দারোয়ান আর নজরদার(ওয়াচমেন)।
এই বাড়ির কাজ করার ভৃত্যাবলীর পদের অবস্থানের মডেলের সূত্রে দিয়ে ব্রিটিশেরা ভারতীয় সমাজকে বিশ্লেষণ করেছিল। ধরে নেওয়া হল জাতিব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জাতির নির্দিষ্ট কাজ ধার্য করা আছে, এবং সেই কাজ অন্য সমাজ করবে না। জাতিব্যবস্থার উচ্চাবচ নির্ধারিত হল কাজের সূত্র ধরে যেখানে বলা হল বিশ্বস্ত ভৃত্যদের ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্ন থেকে নেওয়া হত। মুসলমানেদের লেখক আর শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হত। টেবলে যারা অপেক্ষা করতেন তারা সাধারণত মুসলমান ছিলেন, যাদের সাধারণত খাদ্য, বিশেষ করে বিদেশি খাওয়ার ছোঁয়াছুঁয়ির অতটা বাছবিচার ছিল না। রাঁধুনিরা নিচু জাতের, অস্পৃশ্য বা পর্তুগিজ, কারণ মনে করা হত উচ্চবর্ণ হিন্দুরা গরুর মাংস ছোঁয় না। খানসামা বা প্রধান পরিচালক উচ্চবর্ণ বা উচ্চবর্ণ মুসলমান হতেন, কিছু ধনীগৃহে এই পদ অলঙ্কৃত করতেন পর্তুগিজ বা এংলোইন্ডিয়ান। আয়ারা সাধারণত নিচু শ্রেণীর হতেন। টেলরেরা মুসলমান। মালি, ধোবা এবং জলবাহক এই কাজের সংগে যুক্ত সমাজ থেকে আসতেন। অচ্ছুত চামারেরা সাধারণত আস্তাবলে কাজ করতেন তারাই কুকুর এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশুরও দায়িত্বে থাকতেন। প্রত্যেক কাজের জন্যে নির্দিষ্ট কিছু সমাজের মানুষ আলাদা করে বাড়ির পাশে কুঁড়ে ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে থাকতেন।

উনবিংশ শতাব্দ জুড়ে গৃহভৃত্য এবং তাদের কাজকর্ম ইত্যাদি উপস্থাপন করা ঔপনিবেশিক চিত্রকলার অন্যতম বিষয় ছিল, যে ছবিগুলি ব্রিটিশ আর ভারতীয় আঁকিয়েদের দিয়ে আঁকানো হয়েছিল। যে সব আমলা বা ব্রিটিশ দেশে ফিরে যেতেন, তারা ভারতের স্মৃতি হিসেবে এই চিত্রকলাগুলি এবং এর সঙ্গে ভারতীয় দামি বস্ত্রও নিয়ে যেতেন। ভৃত্যদের কাজকর্ম, তাদের জাত, বিচিত্র পরিধেয় ইত্যাদি ভারতে এবং বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল।