Friday, April 13, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৫৬ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

ভারত ‘জানা’র ইওরোপিয় ব্যাখ্যাপূর্ণ রণনীতি ১৬০০-১৭৫০
ভারতে শয়তান আর অপদেবতা(ডেভিল এন্ড সাটান) খোঁজা খুব ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। ইওরোপিয়রা মনে করে তারা ভারতের রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। নতুন বিশ্ব – এশিয়া, আফ্রিকার মানুষদের নিয়ে ইওরোপিয় ধারণা বিষয়ে নতুন গবেষণা বলছে, তারা এখানকার মানুষদের যতটানা অদ্ভুত অন্য বলেছে তার থেকে বেশি এদের মনে করেছে এরা অনেকটা তাদের মত মনে করেছে। মাইকেল রায়ানের কলমে এক্সটিককে এই ধরণের বিতর্কে অন্তর্ভূক্ত করিয়ে নিতে পারি, কেননা ভারত্রীয়রা হয় হিদেন, না হয় পাগান – নো ম্যাটার হাউ বিজার এন্ড অফবিট হি আপিয়ার্ড দ্য আনব্যাপটাইজড এক্সটিক ওয়াজ জাস্ট দ্যাট – আ হিদেন। যখন অন্য কোন দেশে বেড়াচ্ছি, এবং হয়ত পুরোনো শত্রুর সঙ্গে বৈঠক করছি, তখন যেন চেনা শয়তানের সঙ্গে থাকাও আনন্দের।
ইওরোপিয়রা বিশ্বকে চিহ্ন আর করস্পন্ডেন্স দিয়ে চেনে। সারাবিশ্বে যখন সে দখলে আনতে ব্যতিব্যস্ত, সে সময়ে সে গ্রিস আর রোমের পাগান অতীত নিয়েও খোঁড়াখুড়ি করছে। ভারতকে জানার আরেকটা তরিকা শুরু হল প্রাচীন অতীতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিস, মিশর আর রোমের তুলনায়। অদ্ভুত, উদ্ভট এবং প্রাচীন সভ্যতা সব এক; ব্রাহ্মণ, সাধু আর যোগীরা সক্কলে পিথাগোরাসের আত্মার অবিনশ্বরতা আর ট্রান্সমাইগ্রেশনের ধারনার অনুসারী জিমনোসোফিস্ট। এই সাধুপুরুষেরা কৃপালু ভূমিকায় যেন মধ্যযুগীয় ইওরোপিয় পরম্পরার নগ্ন দার্শনিক যারা প্রাকৃতিক ভালত্বের প্রতিনিধি, হু এমবডিড দ্য পসিবিলিটি অব স্যালভেশন উইদাউট রেভিলেশন... আউটসাইড দ্য এস্টাবব্লিশড চার্চ। কেউ কেউ আবার বললেন যোগী আর সাধুরা কুসংস্কার ছড়ানোর যন্ত্র, যারা শুধু তার নিজেদের চ্যালাদেরই অন্ধ অনুগামী করে তোলে না, সারা ভারতের হিন্দুদেরও অন্ধ বিশ্বাসী বানিয়ে তোলে। অষ্টাদশ শতকেই যোগী, সন্ন্যাসী সাধু আর ফকিরেরা জীবন্ত শয়তানে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে এবং তাদের পুজকেরা রূপান্তিরত হয়েছেন গ্রীক আর রমিয় ধর্মের প্যান আর পারিয়াপাসের অনুগামী হিসেবে।
সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতকের প্রথমপাদের সাহিত্যের মূলবস্তুতে নানান ধারণা ক্রিয়াশীল থাকলেও, সেটা ভারত আর পশ্চিমের কাঠামোগত সম্পর্ক নির্ধারন করে দিয়েছিল – ইওরোপ প্রগতিশীল সদা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ভারত স্থানু। ভারত যেন ইওরোপিয় অতীতের জীবিত জীবাশ্মের বিছানা, যেন জাদুঘর, যা ইওরোপিয়দের আগামি দুশ বছর ধরে ইওরোপিয় সংস্করণে ইতিহাস লেখার তৈরির মাঠ ছেড়ে দেবে। ভারত হল কঠোর কিন্তু আইন না মানা চক্রাকারে চলতে থাকা প্রাচ্য স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের বিচরণভূমি, যারা অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না করায় যে নৈরাজ্য, আইনহীন পরিবেশ তৈরি করে তাতে সে নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।
ব্রিটিশেরা ভারতের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে যে ইন্ডিক সময়ে উপস্থিত হল সেটা ক্ষয় নষ্ট আর নৈরাজ্যের ঢালের দিকে গড়াচ্ছে। তাদের ইতিহাস সংস্করণে ভারতে যুক্তিবাদী স্বৈরিতান্ত্রিকতার কথা বলে ভারতের ইতিহাসের ক্রমের স্থায়িত্ব তারা তৈরি করে। স্থানীয় প্রশাসনের অপরিবর্তনীয়তাও তাদের চোখ এড়ায় নি। পরম্পরাগত ভারত রাষ্ট্রকে বলা হল এপিফেনোমিনাল যার কোন রাজনৈতিক স্থিরতা নেই বরং ভারতকে অপরিবর্তনীয়, জাতিবাদী এবং গ্রামীন প্রশাসনের সমাহার বলা হল। ইওরোপের ধ্রুপদী ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় তুলনামূলক পদ্ধতির ইতিহাসের ভাগ্য খুলে গেল। এরফলে ইওরোপিয়রা ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বান্তির রচনা করে তাকে অনুপরমাণুতে ভেঙ্গে ফেলল। অগ্রগতির কিছু বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হল; সামুহিক বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির থাকা না থাকা, কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর আত্মীয়তা(কিনশিপ), পশুচারণ বা স্থায়ী বসতির কৃষিকে প্রগতিবা প্রগতির অভাব হিসেবে চিহ্নিত হল।
ব্রিটিশদের মনে হল ভারতের কিছু অংশ সামন্ততান্ত্রিক বিকাশের স্তরে আছে। ভারতের উতপাদন প্রক্রিয়া শিল্পবিপ্লবপূর্ব সময়ে থমকে আছে; ভারতের পণ্যগুলি আদতে ইওরোপ শিল্পবিপ্লবে যা হারিয়েছিল তার জাদুঘর।

প্রত্যক্ষ্যবাদী ঐতিহাসিকদের হাতে পড়ে ভারতের ইতিহাস একটা ঐতিহাসিক ক্রমে সেজে উঠল। রামের তারিখ নির্ধারিত হল, বিভিন্ন লেখগুলোয় উল্লেখ থাকা রাজাদের সময়ক্রম তৈরি হল, আর সাহিত্য হয়ে উঠল অতীতের ইতিহাস পাঠের আয়না। ইওরপিয় চেষ্টায় প্রত্যেক স্তরের লুকোনো ইতিহাস বার হয়ে আসতে থাকল, প্রত্যেকটি ঘটনা একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র স্থাপিত হল, শ্রেণিবদ্ধকরণের কাজ চলতে থাকল, এবং অক্লান্ত ভাবে অতীতের তথ্য মহাফেজখানা তৈরির কাজে চলতে থাকল ইওরোপিয়দের দৃষ্টিতে ভারত আর ভারতীয়দের ইতিহাস নির্মান। 

No comments: