Saturday, April 28, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭২ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
জাতি, কারিগর, পেশাদার ইত্যাদিদের সাধারণত অপ্রাসঙ্গিকভাবে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে ছবি আঁকা হত। তাদের ছবি আঁকা হত কোন রকম পশ্চাদপট ছাড়াই। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি অবশ্যই পুরুষ হত, বড় জোর তার সঙ্গে তার স্ত্রী থাকত, সঙ্গে থাকত তার কাজের হাতিয়ারগুলি, আর কিছু দ্রব্য যেগুলি ভদ্র ভারতীয় আর ইওরোপয়দের ভোগ্য। ব্রিটিশেরা আরও কিছু আঙ্গিকের ছবি সংগ্রহ করত যেমন বিশালকায় প্রাসাদের ছবি, হাতির দাঁতের ওপর আঁকা ছবি, ধর্মীয় আচারের ছবি – সে আচার যত ইওরোপিয়দের চোখে অদ্ভুত লাগে তত ভাল যেমন পিঠে বঁড়শি লাগিয়ে মন্দিরের সামনে চড়ক দোলা বা বিভূতি মাখা সাধু ইত্যাদি। এছাড়াও বারি ঘরদোরের চাকরবাকর আর কারিগরদেরও এঁকে বহু ছবি বিক্রি হয়েছে।
ব্রিটেনে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার জন্যে এবং ভারতীয় স্থাপত্য বিষয়ে ব্রিটিশদের অব এবং অশ্লীলমূল্যায়নের জন্যে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এবং উনবিংশ শতকে স্থাপত্যগুলি অত্যন্ত বেশি খরচ দিয়ে সাগর পার করাতে ইওরোপিয়রা খুব বেশি উৎসাহিত হয় নি। চার্লস টাউনলি এবং রিচার্ড পাইন নাইটের স্থাপত্য সংগ্রহ বিষয়ে পার্থ মিত্র বিশদে লিখেছেন অন্তত এই দুজনের তাদের সংগ্রহের আকর্ষণের অন্যতম ভিত্তি হল যৌনাচার এবং প্রাচীন অদ্ভুত ধর্মীয়তার ছবি আর স্থাপত্য।
এদের মধ্যে সব থেকে আকর্ষণীয় সংগ্রহ ছিল চার্লস স্টুয়ার্টের, যার আরেক নাম হিন্দু স্টুয়ার্ট যিনি বাংলায় ১৭৭৭ থেকে মৃত্যুর বছর ১৮৩০ পর্যন্ত বসবাস করেছেন। পার্ক স্ট্রিট সমাধিখানায় ওনার সমাধি আজও আছে। সমাধির ওপরে একটি মন্দিরের আকারে ইন্দো-আর্য আঙ্গিকের স্থাপত্য আছে। এটির দেওয়ালে ভারতীয় দেবদেবীর ছবি শোভিত রয়েছে। এতে দুটি লেখ লাগানো আছে একটি হল একটিতে লেখা আছে ইন্দো-আর্য মন্দির অন্যটি প্রাচীন ব্রহ্মার মন্দির। ১৮৩০এ মৃত্যুর পর তার সংগ্রহের বিশাল পরিমান লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এগুলি ক্রিস্টিজ নিলাম করে ১৮৭২এ। এই সংগ্রহটিতে থাকা ১১৫ খানি বস্তু দখল করেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পক্ষে উলস্টন ফ্রাঙ্কস।

চিত্রে থাকতে পারে: আউটডোর
পার্কস্ট্রিটে হিন্দু স্টুয়ার্টের সমাধিমন্দির

কোনো স্বয়ংক্রিয় বিকল্প পাঠ্য উপলব্ধ নেই৷
স্টুয়ার্ট কিভাবে এই সংগ্রহটি তৈরি করেছিলেন তা কিছুটা আলোচনা করেছেন জেমস প্রিন্সেপ। তাঁর সমাধিতে লাগানোর আগে শিলালিপিটি প্রিন্সেপ এশিয়াটিক সোসাইটির অধীনে থেকে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। এটি কোথা থেকে স্টুয়ার্ট সংগ্রহ করেছিলেন সেটাও জানা যায় না। তার মনে হয়েছিল এটি ওডিয়া লিপির কাছাকাছি কোন লিপি হতে পারে। সে সময় লেফটান্যান্ট কিটো ভুবনেশ্বরের মন্দিরের লিপিগুলি পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার মনে হচ্ছিল সে অঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা তার কাজে বাধা দিচ্ছে। যখন তিনি তাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণ প্রশ্ন করলেন, তখন পুরোহিত বললেন যে তাদের প্রচুর লেখ আর মূর্তি এক প্রয়াত কর্নেল সাহেব নিয়ে গিয়েছেন। পরে সোসাইটির খাতা খুলে দেখেন ওডিশিতে লেখা দুটি লেখ স্টুয়ার্ট সোসাইটিকে দান করেছেন। প্রিন্সেপের মনে হল মন্দিরকে সেই দুটি লেখ ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। পরের বছর সেটি করা হল। কিন্তু কিটো এই কাজটি করতে গিয়ে যে ধরণের অভ্যর্থনা আশা করছিলেন তা তিনি পেলেন না। বরং পুরোহিত কিটোকে হারিয়ে যাওয়া মূর্তি আর লেখর একটা দীর্ঘ তালিকা তুলে দিয়ে সেগুলিও এই দুটি লেখর মত ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

আমরা দেখলাম কিভাবে শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ করতে জ্ঞান সঞ্চয় করার জন্যে কোম্পানি এবং ব্যক্তির দ্বারা করা সমীক্ষা এবং অনুসন্ধানের ফলে বিপুল সংগ্রহ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও শিল্পী আর কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতায়ও প্রচুর কারিগরী পুথি আর চিত্রবলী বিদেশে গিয়েছে। ধনীদের জন্য পণ্য বিক্রি করার বিভিন্ন বাজার থেকে নানান ধরণের কারিগরিও সংগৃহীত হয়েছে। ঘুষ, হাতিয়ে নেওয়া, স্রেফ চুরি করে বিপুল শিল্প আর কারিগরির সংগ্রহ তৈরি হয়েছে। 

No comments: