Tuesday, March 21, 2017

বাংলার বাণিজ্য চর্চা - তারানাথ তর্কবাচস্পতি

খুব সম্প্রতি সরকার নির্ভর পুঁজিবাদ নিয়ে খুব তর্ক বিতর্ক উঠছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশে পলাশীর কুশিলবেরা কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে বড় মানুষ হয়ে উঠছেন - কোম্পানির রাজত্বের কর্ণধারদের সঙ্গে ওঠা বসার সুযোগে ধনবান হয়ে উঠছেন দ্বারকানাথ-রামমোহন জুটি - এমনকি বিদ্যাসাগর মশাইও ব্যবসায়ে সরকার নির্ভরতার পথ ধরতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।

অথচ তারানাথ বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে পড়েও তাঁর সহধ্যায়ীদের মত চাকুরিজীবিও হননি, আবার সরকারি সুযোগ সুবিধে নিয়েও ধনী হননি। চিরাচরিত ব্যবসায়ী বাংলার অতীত ঐতিহ্য মেনে কলকাতার বাইরে চালিয়েছেন বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সেই মানুষটির প্রতি ছোট ব্যবসায়ীদের উইভার্স, পার্ফরমিং আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফরমিং আর্টিস্টস গিল্ডএর শ্রদ্ধার্ঘ-

---
কালিদাস সার্বভৌমের পুত্র তারানাথ তর্কবাচস্পতি ১৮১২ খৃষ্টাব্দে কালনায় জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগরের চেয়ে তারানাথ প্রায় আট নয় বছরের বড় ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের ততকালীন অধ্যক্ষ, বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন মশায়ের সঙ্গে কালনার 'বাঙাল ভট্টাচার্য' পরিবারের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।

রামকমল প্রায়ই কালনায় যেতেন। তিনিই তারানাথ ও তাঁর জৈষ্ঠতাতপুত্র তারাকান্তকে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেন। তারানাথ প্রথমে অলংকার শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক নিমচাঁদ শিরোমণির কাছে ন্যায়শাস্ত্র আধ্যয়ন করেন। যখন তিনি ন্যায়শাস্ত্রের ছাত্র, তখন বিদ্যাসাগর আলঙ্কার শ্রেণীর ছাত্র। প্রতিদিন বিকেলবেলা ছুটির পর বিদ্যাসাগর, তারানাথের ঠনঠনিয়ার বাসায় যেতেন। তখনকার কলকাতার বড় বড় পণ্ডিতসভায় তারানাথ বিচারের জন্য আমন্ত্রিত হতেন এবং বালক ছাত্র বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি যেতেন সভায়। বিদ্যাসাগরকে দিয়েই তিনি সবায় প্রায়ই 'পূর্বপক্ষ' করাতেন। পনের বছরের বালক বিদ্যাসাগরের 'পূর্বপক্ষ' করা দেখে সকলে বিস্মিত হতেন। পরে তারানাথ উঠে সভাস্থ পণ্ডিতদের বিচারে পরাস্ত করতেন।

কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পর বাচস্পতি মশায় বর্ধমানের সদর আমিন পদের নিয়োগপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। বৃত্তিভোগ করা বা চাকুরী করার মতন মনোভাব তাঁর কোনকালেই ছিল না, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে উন্নতি করাই বাচস্পতি মশায়ের কাম্য ছিল। ...কালনায় নিজ বাড়িতে টোল ...খুললেন ...এবং কাপড়ের দোকান খুললেন বাজারে। তখন বিলেতী কাপড়ের আমদানি পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় নি। বিলেতী সুতো কিনে আম্বিকা-কালনায় প্রায় বারোশ তন্তুবায়কে দিয়ে তিনি কাপড় বুনিয়ে ব্যবসা করতেন এবং বাইরেতেও কাপড় চালান দিতেন। কিছুদিন পরে তারানাথ মেদিনীপুর জেলার রাধানগর গ্রামে কাপড়ের কুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। কাশী, মির্জাপুর, কানপুর, মথুরা, গোয়ালিয়র প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি কাপড় পাঠাতেন। তখনও কিন্তু রেলপথ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গরুর গাড়িতে আথবা মুটের মাথায় পণ্ডিত মশায় লক্ষ লক্ষ টাকার কাপড় চালান দিতেন। কলকাতার বড়বাজারেও তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। কাশী-আমৃতশহর থেকে তখন প্রায় ছয় লক্ষ টাকার শাল বাংলাদেশে আমদানি হত। তাঁর মধ্যে প্রায় এক লক্ষ টাকার শাল বাচস্পতি মশায় নিজে আমদানি করতেন। এ-ছাড়া হীরা-জহরত, সোনা-রূপার আলঙ্গারেরও তাঁর ব্যবসা ছিল। বীরভূমের দশ হাজার বিঘে জঙ্গল কিনে তিনি চাষ আরম্ভ করেন এবং পাঁচশ গরু কেনেন দুধ-ঘিয়ের ব্যবসার জন্য। মুটের মাথায় করে কলকাতায় ঘি এনে তিনি বিক্রী করতেন। কালনাতে তিনি নেপালে ও তরাই অঞ্চল থেকে কাঠ আমদানি শুরু করেন এবং কাঠের ব্যবসাতেই কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। এই সময় কালনাতে তিনি প্রাসাদের মত বিরাট অট্টালিকা তৈরি করেন বসবাসের জন্য। কাপড় কাঠ ছাড়া চালের ব্যবসা করতেও বাচস্পতি মশায় ছাড়েননি। কালনায় কয়েক শত ঢেঁকি বসিয়ে তিনি ধান ভানতে আরম্ভ করেন, কারণ চালের কল তখনও তেমন আমদানি হয় নি। ঢেঁকির শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে কালনাবাসী যখন অভিযোগ করেন, তখন তিনি তাঁর ঢেঁকিশাল বা ঢেঁকির কারখানা দূরের গাঁয়ে সরিয়ে নিয়ে যান।

বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি্র থেকে(বই কৃতজ্ঞতাঃ সৌমেন নাথ)

প্রাকৃত বাংলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা - বাংলার পরম্পরাগত চিকিৎসা ব্যবস্থা

সহায়তায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিটিক্যাল ইনস্টিটিউটের ঘিলু ল্যাব
এটা আবার কি? আয়ুর্বেদ? নয় কেন? কেন প্রাকৃত বাংলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা?
সত্যি তো,আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থা ছেড়ে কেন গ্রাম্য প্রাকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাল ওয়াটাগ, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘ, কলাবতী মুদ্রা, কনকটি বোড়ো কৃষ্টি আফাত এবং আরও বেশ কিছু সংগঠন?
সঙ্গঠনগুলো থেকে তাত্ত্বিকভাবে আমরা মনে করি রোগ আঞ্চলিক - নির্ভর করে জীবনযাত্রা, দেহতন্ত্র, পরিবেশ, পেশা এবং ভূপ্রকৃতির ওপর। দূর দেশে কোন ওষুধ তৈরি হলে, সেটি যে বিশ্বজনীন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এই তথ্য আমরা বড় পুঁজির সঙ্গবাদমাধ্যমের প্রচারে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। এলোপ্যাথির মতই আয়ুর্বেদ কেন্দ্রিয় শাস্ত্র নিদান নির্ভর। কিন্তু প্রাকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায়োগিকভাবে ভীষণভাবে আঞ্চলি জ্ঞান-প্রযুক্তি-সম্পদ-পরিবেশ নির্ভর, রোগী/অসুস্থতা কেন্দ্রিক এবং সংহত।
ঠিকই আয়ুর্বেদ নিয়ে কাজ করাটা খুব সোজা ছিল। তার একটা দেশজ-আন্তর্জাতিক ব্রান্ডিং আছে। বড় পুঁজির স্নেহধন্য। মানুষকে বোঝাতেই হত না কেন আয়ুর্বেদ? এবং আমাদের মত চাঁদা নির্ভর সংগঠনে এটা আশীর্বাদ হত, খাটনি কম হত, চরক শুশ্রুত বা বাঙালি ভগভট্টের সংস্কৃত নিদান তুলে দিলেই কেল্লা ফতে - দুবার প্রশ্ন করার সুযোগই থাকত না।
তাহলে? পরম্পরার প্রাকৃত চিকিৎসাটি বাংলার, ভীষণই রোগীকেন্দ্রিক। রোগ যদি আঞ্চলিক হয়, তা হলে সেই অঞ্চলেই তাঁর প্রতিষোধক প্রকৃতি দিয়ে রেখেছে। চিকিতসাকর্মীর দায় সেই অঞ্চলের নির্দিষ্ট ভেষজ, খণিজ বা প্রাণীজ উপাদানটি ব্যবহার করা। তাত্ত্বিকভাবে প্রাকৃত চিকিৎসা যদিও আয়ুর্বেদের ত্রিদোষ তত্ত্ব বা পঞ্চতত্ত্বের কাছাকাছি কিন্তু প্রায়োগিকভাবে অনেক স্বাধীনিতা পান প্রাকৃত চিকিৎসায়। চিকিৎসক/সেবকের দায় থাকে রোগীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেওয়ার। আমরা জেনেছি, প্রাকৃত চিকিৎসক চেষ্টা করেন প্রাথমিকভাবে খাদ্য, তাঁর পরিবেশ/জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে নিরাময়ের। সর্বশেষে ওষুধ প্রয়োগ। সব থেকে বড় জোরের যায়গা হল তাঁর জ্ঞানের বৈচিত্র্য - সমাজে সমাজে, সমাজের মধ্যে পরিবারে পরিবারে যা আদতে বড় পুঁজির আতঙ্ক - বেঁচে থাকাটাই হুমকির সম্মুখীন।
এই জ্ঞান আর প্রজ্ঞা সারা বাংলার বিভিন্ন সমাজে ছড়িয়ে রয়েছে। মেচ, রাভা, গারো, টোটো, রাজবংশী, সাঁওতাল, মুসলমান, কুর্মী সহ আরও বেশ কিছু সমাজের হাজার হাজার বছরের পরম্পরার প্রাকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নথি করার কাজ করেছেন নারায়ণ মাহাত কয়েক বছর ধরে। পরম পত্রিকার গ্রাম্য চিকিৎসা ব্যবস্থা সংখ্যার আমন্ত্রিত সম্পাদক ছিলেন নারায়ণ। পারিবারিকভাবে এবং পেশাগতভাবে প্রাকৃতিক চিকিৎসা শিখেছেন তিনি। বহু প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁর একটা বই দেশজ ভেষজতে তিনি গাছ-গাছড়া এবং রোগ-অসুখ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন তিনি।
এই বৈচিত্র্যময় জ্ঞানকে সঙ্গঠনগুলি এবারে তাদের বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে প্রায়োগিকতার স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। বলা দরকার এই জ্ঞান সমাজগুলিতে বহুকাল ধরে রয়েছে। শুধু শস্তা নয়, তাঁর এফিকেসির জোরে - যদি আপনারা গাঁইয়াদের অজ্ঞ, মুর্খ, অশিক্ষির না ভাবেন।
গত দুবছর ধরে, বাংলার পরম্পরার প্রাকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা নথি করণ করতে নারায়ণ মাহাতর নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। সেই চেষ্টাটা রূপ পাচ্ছে আগামী ৮,৯,১০,১১ এই চারদিন কলকাতায় নারায়ণের নেতৃত্বে গ্রামীন স্বাস্থ্য বিধায়কদের(গ্রামীন পরম্পরার চিকিতসকেদের এই নাম দিয়েছেন তিনি) প্রথম বৈঠক। সামগ্রিকভাবে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে সেই চারদিনের বৈঠকে। কথা হয়েছে ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিটিক্যাল ইনস্টিটিউটের গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চলা ঘিলু ল্যাব এই প্রক্রিয়ায় সামিল হবে।
ইতোমধ্যে শহরে এই চিকিতসাব্যবস্থা নারায়ণ আর বঙ্গীয় পারম্পরিকের সম্পাদক মধুমঙ্গল মালাকারের নেতৃত্বে পা রেখেছে - প্রাথমিকভাবে কয়েকজন বন্ধু আর তাদের বাড়িতে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে চিকিৎসার কাজ চলছে।
তো এর পরের কাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেওয়া। শুধু ওষুধ দেওয়া নয়, যদি প্রত্যোজন হয় তা হলে খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারণের প্রক্রিয়া বদলে দিয়েও রোগারোগ্য হতে পারে। আদতে শুধু রোগ নিরাময় নয় সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য ফেরানো প্রাথমিক কাজ - ঠিক যে জন্য গ্রাম বাংলা এলোপ্যাথি ছাড়াই বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে।
কলকাতায় এই চারদিনের শেষ দিন বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা আর কিছুটা চিকিৎসার পরামর্শ দান শুরু।
আরও অনেক কথা বলার রইল। আমরা কি করতে চলেছি, তাঁর বিশদ আগামী দিনে পরের কোন প্রকাশনায়।
সঙ্গের ছবিগুলি আজ, ৬ চৈত্র ১৪২৩ সালে দীপঙ্করদার বাড়িতে।
অরূপদা এই বিষয়টা নিয়ে ছবিও করছেন।

Wednesday, March 15, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২ - পঞ্চাঙ্গ প্রভাকর পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য ।। ১৩১২সালে প্রকাশিত

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২
পঞ্চাঙ্গ প্রভাকর
পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য
১৩১২সালে প্রকাশিত

জানি খুব বেশি মানুষ পড়বেন না, তবুও...

এর আগের পর্বে যে সাতটি প্রশ্ন এবং উত্তর এই জ্যোতিষ সম্মেলনে তৈরি করা হয়েছিল সেগুলি উল্লেখ করব লিখেছিলাম।

আমাদের ধারণা সেই প্রশ্ন-উত্তরগুলি দেখলে আজকের যারা মেকলিয় পদ্ধতিতে কর্পোরেট লুঠেরা অন্যকে অস্বীকার করার জ্ঞানচর্চা করেন তাদের ধাঁধা লাগবে। কেন না এই শিক্ষা এবং জ্ঞান দান পদ্ধতি পশ্চিমি শিক্ষা আর জ্ঞানদান পদ্ধতি থেকে আলাদা - এর লব্জগুলো আলাদা, এর সংখ্যা লেখা, ব্যবহৃত চিহ্ন, পাঠপদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা চর্চার বিষয় - ঠিক যেমন পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় তাঁর নিজস্ব ধারা রয়েছে, পূর্বের জ্ঞানচর্চাতেও নিজস্ব ধারা রয়েছে - কিন্তু পশ্চিম যেহেতু এটাকে জ্ঞানচর্চা বলে স্বীকার করে না(যদিও বহু জ্ঞান এখান থেকে সে চুরি করেছে) তাই একে সে মিথ্যা জ্ঞানচর্চা বলতে একটুও বাধে না।

যিনি ছোটবেলা থেকে অন্য জ্ঞানচর্চার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন, তিনি অন্যের জ্ঞানটা নাও জানতে পারেন - না সেটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর জন্য আপনার অজানা সম্পূর্ণ জ্ঞানচর্চা ব্যবস্থাটাকেই কুসংস্কার, মিথ্যা, অলৌকিক বলে দাগিয়ে দেবেন সেটা তো আর চলবে না।

প্রতিশ্রুতি মত নিচে সেই সাতটি প্রশ্ন-উত্তর দিলাম - এবারে বুঝে নিন এই প্রযুক্তি চর্চা আপনার কাছে কুসংস্কার আর বোধ আর গোচরহীন - কোনটা।

প্রথম প্রশ্ন
পঞ্জিকা গণনা করিতে সূর্য্যের বৎসর পরিমান কত দিন, কর দণ্ড, কত পল ইত্যাদি স্বীকার করিতে হইবে? এবং সূর্য্য ভিন্ন অন্য গ্রহের গতির মান(যেমন এক দিনের গতি) কিরূপে স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
সূর্য্য সিদ্ধান্তোক্ত বর্ধমান স্বীকার করিতে হইবে। সূর্য্যাতিরিক্ত গতিতে, বোধোপলব্ধ বীজ(যন্ত্রাদি দ্বারা গ্রহ গতির পরীক্ষা করিয়া যে অন্তর পাওয়া যায় তাহা) সংশোধন করিয়া লইতে হইবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন
বৎসরের অয়ন গতির মান কি, স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
সূর্য্য সিদ্ধান্তোক্ত সূর্য্যের বর্ষপরিমান যাহা স্বীকার করা হইয়াছে, তদনুসারে বর্ষে, অয়নগতি কিঞ্চিত আধিক ৫৮ বিফলা হইবে। তাহাতেও যদি বোধস্থলে বৈগুণ্য উপস্থিত হয়, তাহা হইলে, বোধোপলব্ধ বীজ সংস্কার ক্রিয়া গ্রহণ করিতে হবে।

তৃতীয় প্রশ্ন
আয়নাংশ ভিন্ন ভিন্ন মতে ১৮ হিতে ২৩ অংশের অধিক পাওয়া যায়। গ্রন্থারম্ভ কালে অয়নাংশ, কত স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
আমাদের গ্রন্থারম্ভ কাল শকাব্দা ১৮২৬ হইতে ২২ অংশের অধিক ও ২৩ অংশের কম অয়নাংশ স্বীকার করিতে হইবে।

চতুর্থ প্রশ্ন
আরম্ভ স্থান (ভগনাদি) কি, স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
ক্রান্তিবৃত্ত আরম্ভস্থান, অয়নাংশ অনুসারে সচল ও নিশ্চল, দুইই স্বীকার করিতে হইবে। এবং পঞ্জিকার সায়ন সংক্রান্তি ও নিরয়ণ সংক্রান্তি, দুইই দেখাইতে হইবে। আয়নারম্ভ দ্বয়, প্রত্যক্ষ সিদ্ধ হইবে।

পঞ্চম প্রশ্ন
দৃকপ্রত্যয়ের জন্য বোধোপলদ্ধ নব্য সংস্কার গ্রহণ করা যাইবে কি না?
উত্তর
দৃক প্রত্যয়ের জন্য যে বিষয়ের যে যে সংস্কার আআবশ্যক সে সকলই বীজ সংস্কাররূপে গ্রহণ করিতে হইবে।

ষষ্ঠ প্রশ্ন
তিথি কিরূপে সাধন করিতে হইবে?
উত্তর
স্ফূট চন্দ্র ও সূর্য্য হইতে তিথিমান সিদ্ধ করিতে হইবে, স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয় রীতিতেই করণ গ্রন্থে দেখাইতে হইবে।

সপ্তম প্রশ্ন
মধ্যরেখা কি স্বীকার্য্য?
উত্তর
করণ গ্রন্থে কক্ষত্র সাধন, সাভিজিৎ, নিরাভিজিৎ এই উভয় প্রকারেই দেখাইতে হইবে।

আপনি পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় বড় হয়েছেন, স্বাবভাবিকভাবে এই প্রাযুক্তিক লব্জগুলি জানে না, তাঁর মানে কি এই জ্ঞানটা মিথ্যা হয়ে গেল?

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - পঞ্চাঙ্গ প্রভাকর পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য ।। ১৩১২সালে প্রকাশিত

লুঠেরা কর্পোরেট জ্ঞানচর্চায় আমাদের আপনারা নিলেনই না, তাতে আমার বয়েই গেল।
***তিথি হল এক দিনে চন্দ্র সূর্যের মধ্যে যে কৌণিক পার্থক্য হয় তাঁর মান - ১২ ডিগ্রি। ৩০টা তিথিতে এক মাস। অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি। মেকলে পদ্ধতিতে শিক্ষিতরা একে অঙ্ক বা জ্যোতির্বদ্যা না বলে কুসংস্কার বলেন - সেটা আসলে তাঁর শিক্ষা। এর সঙ্গে সংস্কার-কুসংস্কারের যোগ নেই।***



পশ্চিমি প্রাচ্যবিদ্যার্ণবেদের প্রচারে যে বন্ধুরা মনে করেন দেশিয় জ্ঞানচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন যুগের পরে, মনে করিয়ে দেওয়া যাক চার্লস উইশ ১৮৩৪ সাল নাগাদ তেলেঙ্গা প্রদেশে কলন বিদ্যাচর্চা দেখেছিলেন, লিখেছিলেন জ্ঞানলুঠের জন্য তৈরি এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায়। জ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত এ রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায় - সে কাজটি করেছেন ধরমপালজী তাঁর নানান লেখায় - উতসাহীরা দেখে নিতে পারেন।

বিদ্যাসাগর বা রামমোহন বা দ্বারকানাথ দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবের জন্য কর্পোরেট লুঠেরা, খুনি, অত্যাচারী শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশে প্রণয়নের জন্য ধুয়া তুলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং কর্পোরেট স্বার্থবাহী এবং দেশের স্বার্থ বিরোধী।

এই বইটি প্রমাণ যে দেশে দেশজ জ্ঞান, লব্জ নির্ভর পণ্ডিতি যুক্তি(তা পশ্চিমি পদ্ধতিতে নাও হতে পারে) তর্কের অবকাশ শেষ হয়ে গিয়েছিল এ কথা যারা মনে করেন, তারা হয় লুঠেরা জ্ঞানচর্চার তরফদারি করছেন নয়ত মিথ্যা বলছেন। এর ফলে আমরা মনে করি পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় নাদ, জল্প, বিতণ্ডা(যেগুলোর মানে আপনারা ভুলে গিয়েছেন - মনে রেখেছেন ডিসকোর্স) ইত্যাদির স্থান আছে, দেশিয় বিদ্যা চর্চায় নেই।

পঞ্চানন মহাশয় দেশিয় পদ্ধতিতে অঙ্ক করেই কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশের মত খণ্ডন করেছেন সেটাও উল্লেখ্য - সেটা আজ থেকে ১০০ বছর আগে। তিনি বলছেন, 'কোন সংক্রান্তির কত পূণ্যকাল? কোন মকর সঙ্ক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান করিতে হয় বা তিল দান করিতে হয়, সে ব্যবস্থা স্মার্ত্যরা করিবেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। জ্যোতিষ শাস্ত্র সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণনা করিয়া দিয়া প্রস্থান করিবে।'। পণ্ডিতি আলোচনা মানে ধর্মীয় আলোচনা এমন তথ্য মিথ্যা প্রমান করে এই উদাহরণ।

১৩০০ সালের প্রথম দশকে দ্বারকামঠের অধীশ্বর শ্রীশ্রীশঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে বোম্বাইতে একটি পঞ্চাঙ্গ শোধন মহাসভা আয়োজিত হয়। দৃকপ্রত্যয়সিদ্ধান্ত ও ধর্মশাস্ত্রের শৌত স্মার্ত্ত কর্মানুষ্ঠান, পজিকার গণনা কিভাবে করতে হবে তাই নিয়ে সেই সভায় সারাদেশের ১৫০ জন পণ্ডিতের স্বাক্ষরযুক্ত একটি নির্ণয়পত্র প্রকাশিত হয়। বাংলা থেকেও প্রতিনিধিত্ব করেন ৯ জন পণ্ডিত, তাঁদেরও স্বাক্ষর ছিল (যেমন গুপ্তপ্রেস পত্রিকার গণক বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব, ধীরানন্দ কাব্যনিধি ইত্যাদি)। বিচারের সময় নাদ জল্প এবং বিতণ্ডা হয়.৮ দিন ধরে যে বিচার চলে তাঁর সাতটি প্রশ্ন আর সমাধান তারা ছাপান। সেটি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫ সালে হিতবাদীতে ছাপা হয়।

সংস্কৃত কলেজের জ্যোতিষের অধ্যাপক পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য সেই সমগ্র বিষয়টি নিয়ে একটি বই লেখেন যার নাম পঞ্চাঙ্গ প্রভাকর। এখানে তিনি বিশদভাবে সাতটি প্রশ্নের কূট সমাধান বিষয়ে আালোচনা করেছেন।

সেটি নিয়ে আম জনতার আগ্রহ থাকবে না ধরে নিয়ে পরের লেখাতে দিচ্ছি।

এই প্রকাশনায় শুধু বলতে চাচ্ছি, লেখক এই বইএর উপসংহারে কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশের গ্রহের গ্রহণ, উদয়, অস্ত ইত্যাদিতে সূর্য সিদ্ধান্ত অশুদ্ধ শুদ্ধ করার ইচ্ছেয় সম্মতি প্রকাশ করলেও তিথির সমস্ত পারিভাষিক মিথ্যের দাবিকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি লিখছেন, (এই বইতে) 'তিথি যে মিথ্যা কল্পনা নহে, যথার্থ, ইহার পদার্থ আছে, ইহা উত্তমরূপে বুঝাইয়াছি।...গ্রহণে ও তিথিতে গ্রহস্ফুটীকরণের প্রভেদ দেখাইবার জন্য, কতগুলি সিদ্ধান্ত বাক্য তুলিয়া তাহার সম্পূর্ণ মিথ্যা অর্থ কল্পনা করিয়া, যে কথার উত্থাপন করিয়াছিলেন, আমরা সেই সেই সিদ্ধান্ত বাক্যের যথার্থ অর্থ, করিয়া উত্তমরূপে মীমাংসা করিয়া দিয়াছি, যে প্রসিদ্ধ শাস্ত্র প্রণেতৃগণ তিথি ও গণনার জন্য একই প্রকার স্ফূট গ্রহ ব্যবহার ক্রিয়া থাকেন। স্ফূটী করণ ভেদ কোন সিদ্ধান্ত শাস্ত্রে নাই। যথার্থ উত্তরায়ণ সংক্রান্তির প্রায় বাইশ দিন পরে মকর রাশির স্নগক্রান্তি হয়। এই উভয় সংক্রান্তিতেই সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণিত দ্বারা নিরূপিত হয়া থাকে। কোন সংক্রান্তির কত পূণ্যকাল? কোন মকর সঙ্ক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান ক্রিতে হয় বা তিল দান করিতে হয়, সে ব্যবস্থা স্মার্ত্যরা করিবেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। জ্যোতিষ শাস্ত্র সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণনা করিয়া দিয়া প্রস্থান করিবে।'

আদতে এই বিতর্ক হয় কর্পোরেট পড়াশোনার বাইরের জগতে - যার খবর মেকলে-ট্রেভলিয়নের পপৌত্র মধ্যবিত্ত আজও রাখে না।

আমাদের আপনারা আপনার লুঠেরা কর্পোরেট জ্ঞানচর্চায় নিলেনই না, তাতে আমার বয়েই গেল।

ধন্যবাদ।

Sunday, March 12, 2017

দেশিয় বণিক সমাজের ইতিহাস - গৌড়ে সুবর্ণ বণিক ।। শিবচন্দ্র শীল

অসাধারণ বই। ১০০ বছরেরও বেশি আগের রচনা। বইটির উল্লেখযোগ্য বিষয়, রাঢের সুবর্ণ বণিকদের গাঁই গোত্র সমাজের বিস্তৃত বর্ণনা। আমাদের কাছে উল্লেখযোগ্য লেগেছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশাসন তৈরির উদ্যমের ইতিহাস – যেটি চতুর্দশ কর্ম হিসেবে শেষ স্তবকে উল্লিখিত হয়েছে। এই বইএর ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে কিছু তথ্য-চুম্বক তুলে দেওয়া গেল।

বইটিতে বাংলার রাঢীয় স্বর্ণবণিকদের ইতিহাস লেখার বহু উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। এটি গবেষকদের কাজ - আমরা শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। তিনি একটি বন্দনাংশ উল্লেখ করেছেন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করা হচ্ছে। এর থেকে মনে হয় দেশিয় বণিকেরা শুধু যে শৈব বা শাক্ত উপাসক ছিল এ ধারনা ভুল, তারা বৈষ্ণবও অনুগামীও ছিল। শ্রীচৈতন্যর নববৈষ্ণব ধর্মে উদ্ধারণ দত্তের মত বিপুল সংখ্যক বণিকের স্থান দেখতে পাই। আজকে কাজ হল দল বেঁধে এই গ্রামগুলোয় বণিকদের শেকড় খুঁজে এবং প্রয়োজনে তাদের পরিবারে রাখা পুঁথি পত্র বিধান ইত্যাদি বার করা।

***বইটি প্রকাশ পায় বঙ্গাব্দ ১৩১৭ আশ্বিন মাসে। লেখকই প্রকাশক। ঠিকানা চুচুঁড়া – শীলগলি। বইটি ছাপেন কে বি দত্ত, হিন্দুধর্ম প্রেস, ১২৪ আপার চিতপুর রোড, কলকাতা।***

## ভূমিকার প্রথম স্তবকেই লিখছেন ‘এ পর্য্যন্ত সুবর্ণ বণিকদের প্রকৃত জাতীয় ইতিহাস, একখানি গ্রন্থও প্রকাশিত হয় নাই, তাহাতেই আমার এই ইতিহাস লিখিবার উদ্যম।’##

...কালান্তরে দেখিতে পাই বণিকগণ, রাঢ দেশে ৬টি সমাজভুক্ত হইয়া বাস করিতেছেন। ছয় সমাজের নাম – ১ বিহরণ, ২ সপ্তগ্রাম, ৩ বর্দ্ধমান, ৪ নবগ্রাম, ৫ আজাপুর, ৬ কর্জনাপুর।

১৪১৪ শাকে কর্জনা নিবাসী অমরাক্ষ মল্লিক এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। কর্জনার নিকটস্থ খড়্গেশ্বরী নদীর দক্ষিণ তটে, এক ক্রোশ স্থান ব্যাপিয়া যজ্ঞভূমি এবং তন্মধ্যে সভামণ্ডপ ও বণিকদিগের বাসগৃহ স্থাপিত হইল। ...শুভদিনে সভামণ্ডপে সভার প্রথম অধিবনেশন হইল। পূর্বোক্ত ছয় সমাজের ৪০ খানি গ্রামের ৭৯২ ঘর বণিক সভাস্থলে অধষ্ঠিত হইলে রাজা অমরাক্ষ, কৃতাঞ্জলিপুটে সভার বন্দনা করিলেন...(লেখক বলছেন ‘শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা হইতে বৈষ্ণব ধর্ম্মের প্রভাব লক্ষিত হইতেছে। এ সময়ে ১৪১৪ শাকে শ্রীমান মহাপ্রভুর বয়স ৭ বৎসর মাত্র – সুতরাং একালে তাঁহার বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত হয় নাই’ এবং ‘এই সভা বন্দনায় বিহরণ, নবগ্রাম, আজাপুরের নাম নাই’)।

এখানে আর বিশদে সভাবন্দনার কবিতা উল্লেখ করব না, শুধু ৪০টা গ্রামের নাম বলব যেখান থেকে বণিকদের ৭৯২ ঘর এসেছিলেন – কর্জ্জনা, ব্রাহ্মণভূমি, ভুরসুট, চন্দ্রকোণা, মুক্তিপুর, গঙ্গাপুর, আজাপুর, সপ্তগ্রাম, ফড়িঙগাছি, মঙ্গলকোট(উজ্জয়নী), কৃষ্ণপুর, মেদিনীপুর, নীলপুর, রামপুর, অযোধ্যা, হরিপাল, বেণ্যাটি, মন্দারণ, বালিগিরি, বিহরণ, নবগ্রাম, বর্দ্ধমান, বীরহট, বীরভূমি, বটগ্রাম, বালি, চাম্পানগর, ক্ষীরপাই, কাশিজোড়া, জয়পুর, পানসানি, মহানাদ, গোলাহাট, রাধানগর, বিদুরপাড়া, বাকলসা, বিষ্ণুপুর, মোরগ্রাম, নুদিপুর, চিত্রপুর।

এই বৈঠকে বণিকেরা ব্রাহ্মণ গোবর্ধন মিশ্রকে বণিকদের কুল পুস্তক লিখতে অনুরোধ করলেন – এই বিধান অনুসারে রাঢীয় স্বর্ণ বণিকদের মধ্যে ১২ জন কুলীন, ৬ জন রাঢী, ৩৫ জন বংশজ, ৩৬ জন গৌণ বংশজ, ২২৩ জন মৌলিক, ১২৮ জন কষ্ট মৌলিক, ৩৪৯ জন অতিকষ্ট মৌলিক ও একজন সম্মানিতে ভাগ করা হল।

দ্বাদশ কুলীনের নাম – ১ কৃষ্ণদাস চন্দ্র, ২ অনন্ত আঢ্য, ৩ গোপাল দেয়, ৪ কুলপতি দত্ত, ৫ জগন্নাথ শীল(এই পাঁচ জন কুলীন ও প্রাথমিক – মধুসূদন শীল ও চন্দ্রশেখর শীল{চন্দ্রশেখরের বংশধরগণ, বর্গির হাঙ্গামায় বলগনা হইতে সপরিবারে ঢাকায় পলায়ন করেন।} পশ্চাৎ কুলীন হইয়া জগন্নাথ শীলের সঙ্গে মিলিয়া ছিলেন) ৬ নীলাম্বর দত্ত, ৭ পতিরাজ দেয়(কুলীন কুলরাজ গোষ্ঠীপতি) ৮ চক্রপাণি দত্ত, ৯ বক্রেশ্বর দত্ত, ১০ লম্বোদর দত্ত, ১১ লক্ষ্মণ দত্ত, ১২ কালিদাস দত্ত।

অষ্ট রাঢী
১ মার্কণ্ডেয় সিংহ, ২ মথুরাদাস দাস, ৩ মাধব নন্দী, ৪ অশ্বধর সেন, ৫ শিখরমল্ল লাহা, ৬ রত্নসেন বর্দ্ধন, ৭ খুল্লন পাল, ৮ মিত্রসেন ধর

সম্মানী
১ সাগর বড়াল

জগন্নাথ শীলকে চতুর্দশ কর্মের অধিকারী করা হল –
১ নিমন্ত্রণ, ২ গুবাকগ্রহণ, ৩ কুলকর্ম্মে মধ্যস্থ্য, ৪ কুলকর্ম্মে পণের নিরূপণ করণ, ৫ বিরোধভঞ্জন, ৬ সমন্বয়ের ব্যবস্থা, ৭ অনুচিত কর্ম্মকারীগণের দণ্ড বিধান, ৮ বণিক ভোজন প্রভৃতি কর্ম্মে তত্ত্বাবধায়ণ, ৯ বর প্রদক্ষিণকালে কন্যাসন ধারণের ব্যবস্থা করা, ১০ মাল্যচন্দন ব্যবস্থা, ১১ কর্ম্মান্তে ব্রাহ্মণ দক্ষিণা প্রদান, ১২ মর্ম্মে বণিকের সংখ্যা করা, ১৩ গুবাকের নিরূপণ করা, ১৪ মর্য্যাদা নির্ণয় করা।

এই শেষ চতুর্দশ কর্মের সিদ্ধান্তটাই আত্মশাসনের প্রক্রিয়া, যা যৌথভাবে নেওয়া হল। একজন কুলপতিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হল।

Monday, March 6, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩৪ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এবং ১৯১৯ সালের সংস্কারে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের মূল আন্দোলনটি দাঁড়িয়েছিল জাতিয়তাবাদী ধারার আন্দোলনের সাফল্যের ওপরে। পুনায় নতুন আয়ুর্বেদ কলেজের শুরুর সময়ের রাজনৈতিক ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে কিভাবে পুনর্জাগরণ আন্দলন একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। বলা দরকার আয়ুর্বেদ কলেজগুলিতেও ছাত্র আন্দোলন লেগেই থাকত। অসহযোগ এবং আইনঅমান্য আন্দোলন ছাত্রদের ডাক দিল সব সরকারি বিদ্যালয় এবং বিদেশি পণ্য বর্জন করতে। এর উত্তরে ছাত্ররা সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্জন করে। পুনায় রাজনৈতিক নেতারা লোকমান্য তিলক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে সেখানে অন্যতম বিষয় হিসেবে আয়ুর্বেদের পাঠ্যক্রম শুরু করলেন। ১৯৩২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হল এবং ১৯৩০-৩৪ সালের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে ছাত্রদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এর উত্তরে জাতীয়তাবাদীরা ১৯৩৩ সালে পুনায় আরও একটি আয়ুর্বেদ কলেজের গোড়াপত্তন করেন, যা স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় মান্যতা পায়।

১৯২১ সালে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গৌড়িয় সর্ববিদ্যায়তন একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি আয়ুর্বেদিয় চিকিতসকেদের উতসাহে বেশ কিছু আরও কলেজ স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত আয়ুর্বেদাচার্য কবিরাজ শ্যামাদাস এই কাজে প্রভূত সাহায্য করেন। ১৯২২ সালে কাশিমবাজারের মহারাজার অনুপ্রেরনায় এবং সাহায্যে গোবিন্দ সুন্দরী আয়ুর্বেদ কলেজ স্থাপন করেন কবিরাজ রমেশচন্দ্র মল্লিক, ১৯৩২ সালে বিশ্বনাথ আয়ুর্বেদিয় কলেজ স্থাপিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণ এবং প্রায় সব বিষয়ে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করা।
প্রত্যেকটি শিক্ষাকেন্দ্রে আয়ুর্বেদের পাশাপাশি পশ্চিমি চিকিৎসা বিদ্যাও পড়ানো হয়েছে।

১৯১৬ সালের বাংলায় সংবাদপত্রের দাবি ছিল সরকারের উচিত দেশিয় পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উতসাহিত করা... এদেশের সরকারের দায় হল আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে আধুনিক নীতি অনুসরণ করে গবেষণায় উৎসাহ দানকরা এবং রোগীদের সারিয়ে তোলার দায় গ্রহন করা।
১৯১৭ সালে প্রথমবার মাদ্রাজ প্রাদেশিক সরকার আয়ুর্বেদ নিয়ে উৎসাহ দেখিয়ে ড কোমানকে দায়িত্ব দিলেন রাজ্যের দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে।৯৩ স্টেইনথাল বলছেন আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণীদের আন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মাদ্রাজ সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।

বাড়তে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাপে প্রাদেশিক সরকারগুলি দেশিয় চিকিৎসা বিদ্যা পুনর্জাগরণের বিষয়ে কিছু কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। ১৯১৯এর সংস্কারের পরে যেহেতু বহু ক্ষমতা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিষয়টি, প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে চলে আসে, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপও বাড়তে থাকে। দেশিয় চিকিৎসার অবস্থা সমীক্ষা করতে বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক সরকার কমিটি তৈরি করে।

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেশিয় পেশাদারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল প্রাদেশিক মেডিক্যাল দপ্তরের ওপর; তবে ক্ষেত্র বিশেষে নীতি পালটে যায়। প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে আয়ুর্বেদিক কংগ্রেস তৈরি করা হয়, যে সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাদেশিক সরকারের কাছে দেশজ চিকিতসকেদের দাবিদাওয়াগুলি পেশ করা। ১৯৩১এ বাংলা প্রদেশে চিকিৎসকেরা(মেডিক্যাল মেন) আয়ুর্বেদ চিকিতসায়, শিক্ষাদানের প্রমিতিকরণ এবং স্বীকৃত আয়ুর্বেদিক কলেজগুলিতে পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা দেওয়ার জন্য জেনারেল কাউন্সিল এবং স্টেট ফ্যাকাল্টি তৈরি করে। হয়ত য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যও নিশ্চই এ ধরণের একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তার বাস্তবে বেঁচে থাকার কোন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাদেশিক সরকারগুলি দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এগিয়ে আসবে এমন একটা আশা দেখা গেল। ১৯৩৬ সালে এমসিআই তৈরি হলেও জাতীয়তাবাদীদের দাবি এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেটি থেকে দেশিয় চিকিতসকেদের বাদ দেওয়া হল। এই সময় থেকে পশ্চিমি চিকিৎসকেদের সঙ্গে দেশিয় চিকিতসকেদের দূরত্ব যোজন প্রমান হয়ে গেল – স্পষ্ট বলা হল যদি পশ্চিমি চিকিৎসকেরা অতিন্দ্রিয়, পৌরানিক, আধা-ধার্মিক গল্পগাছার ঘোমোটাওয়ালা এই চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জুড়ে থাকেন, তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হবে৯৬।

সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক সরকার ১৯০০ সাল থেকে দেশে বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিতসকদের এবং পাঠ্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ জারি করতে থাকে। এই ধরণের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার উত্তরে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসকেরা নিজেদের সঙ্গঠিত করে সরকারের কাছে আরও স্বীকৃতি দাবি করলেন৯৭।

সিদ্ধান্ত
আমি মত প্রকাশ করেছিলাম যে ব্রিটিশ ভারতে বাংলা সরকার চিকিৎসা বিদ্যা প্রসারে পৃষ্ঠপোষণা করেছিল। এই কাজে আমরা দেখলাম বিভিন্ন চিকিৎসা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নীতিকে পরাজিত করে পেশাদারি স্বীকৃতি লাভ করার চেষ্টা করেছিল। এর থেকে প্রমানিত হল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটলেও পেশাদারিত্বের বিকাশ নাও ঘটতে পারে। বাংলা প্রদেশ এই ধরণের ব্যার্থতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

আমাদের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হল যে ভারতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিতসকেদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণার উদ্যম ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানে বিবাদের পরিবেশ তৈরি হয় ফলে আমাদের দেশে পেশাদারি মনোপলি অবস্থার বদলে পেশাদারি অলিগোপলি অবস্থা তৈরি হল। স্বাধীনতার সময়ে ভারতে চার ধরণের চিকিৎসক গোষ্ঠী ছিল, যারা তাদের গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থ পূরণ করার চেষ্টা করত। এরা হল

১) মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্র যারা ধনী অভিজাত এবং সেনাবাহিনীর সেবা করত।
২) মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা ব্রিটিশ টেরিটরির সেবা করত
৩) মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা দেশিয় জনগনের সেবা করত।
৪) এর বাইরে ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া দেশিয় চিকিৎসকেরা যারা দেশের সাধারণ মানুষের সেবা করত।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩৩ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৯৩৩ সালে চিকিতসার ডিগ্রি জারি, মানদণ্ড নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল কাউন্সিল তৈরির বিল এল। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট প্রতিপালিত হওয়ার পরে সেই ডিগ্রিগুলি আবার নতুন করে স্বীকৃত হল। ভারত এবং ব্রিটেনে এই ডিগ্রিগুলি পারস্পরিকভাবে মান্যতা পাবে সেটাও স্থির হল।

পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশাসকেরা পুরোনো চিকিৎসা শিক্ষার বদল এনে বাংলায় এবং ভারতের অন্যান্য এলাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজার কাজ যখন করছেন, তখন দেশিয় চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তরা নিজেদের স্বাধিকার বুঝে নিতে চাইলেন। বিংশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে এই চাহিদার পালে হাওয়া লাগে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় রোগীরা পশ্চিমি চিকিতসকেদের কাছে না গিয়ে দেশিয় চিকিতসকেদের কাছে যান, তার জন্য আন্দোলনকারীরা দেশ জুড়ে আবেদন করলেন। ১৯১২ এবং ১৯১৪ সালের মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশন এক্টএ জাতীয়তাবাদীদের রোষ বাড়িয়ে দেয় এবং জাতীয়তাবাদীরা সরকারের ওপর প্রভূত চাপ তৈরি করে। যদিও এই আইনে দেশিয় চিকিতসকেদের নথিভূক্ত করা হয় নি এবং বলা হয়েছিল, শুধু মাত্র সরকারি নথিভুক্ত চিকিতসকেরাই সরকারি চাকরি এবং সরকারি কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা করার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে।

ভারতের ইতিহাসে আয়ুর্বেদ জাগরণের আন্দোলন বড় ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় সেএই আন্দোলন শিক্ষা কেন্দ্র খোলার জন্য দেশ জুড়ে আন্দোলন তৈরি করে। সরকার নিয়ন্ত্রণ নিরপেক্ষ সংস্থা তৈরি হল আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির চিকিতসকেদের জন্য – একদিকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন বৈদ্যদের এবং হেকিমদের নথিকরণের কাজ করতে থাকে, অন্যদিকে বাংলার মহামেডান লিটারারি সোসাইটি এবং ন্যাশলান মহামেডান এসোসিয়েসন হেকিমদের নথিকরণ করার কাজে এগিয়ে আসে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই কাজ সরকারের ওপর যথেষ্ট চাপ তৈরি করে৮৮।
বিংশ শতের শুরু থেকেই সারা দেশে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষার একটা সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হতে থাকে। এই আন্দোলন আরও জোরদার রূপ পায় ১৯০৭ সালে দেশিয় চিকিতসকেদের উদ্যমে অল ইন্ডিয়া আয়ুর্বেদিক কংগ্রেস নামক একটি সংগঠন তৈরি হওয়ায়।

আয়ুর্বেদ পুনর্জাগরণের আন্দোলনের মূলস্বরগুলি ছিল, সরকারি স্তরে রাজনৈতিক সাম্য, স্বীকৃতি এবং সমর্থন। ব্রাস এই আন্দোলনকে এইভাবে দেখছেন, একটি শিক্ষা বিষয়ক গোষ্ঠী, যাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক পদ্ধতিতে স্বীকৃতি এবং পেশাদারিত্ব আদায়।৮৯

কিন্তু আয়ুর্বেদ আন্দোলন পেশাদারিত্ব অর্জনের রাজনৈতিক সমাধানে উস্থাপিত হওয়ার পদ্ধতিটাই তৈরি করে উঠতে পারল না। এই দুর্বার আন্দোলনেও পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থার স্পর্ধিত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকার পরিকাঠামোই তৈরি হল না ভারতে। শিক্ষার অভিন্ন পাঠ্যক্রম বা চিকিতসার পেশাদারি মাপদণ্ড তৈরিও করা গেল না। আয়ুর্বেদ নবজাগরণ আন্দোলনের এই ব্যার্থতার কয়েকটি কারণ ব্রাস তুলে ধরেছতসারদেশিয় চিকিৎসার নবজাগরণের পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মৌলিক বিভেদ ছিল। কেউ কেউ শুদ্ধ আয়ুর্বেদের প্রচার চাইছিলেন, আবার পশ্চিমি চিকিতসা পদ্ধতির সঙ্গে আয়ুর্বেদের ধারনাকে জুড়ে, আয়ুর্বেদের বিকাশের তত্ত্বের মানুষও কম ছিলেন না। শুদ্ধতাবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতের সেই সময়ের গণস্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় যে শূন্যতা রয়েছে, সেটি একা শুদ্ধ আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসায় সমাধান করা যাবে না, এর সঙ্গে পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জুড়ে নিতে হবে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি এমনকি পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থা মহামারীর সময় দেশিয় ব্যবস্থাকে সঙ্গে নিতে পিছপা হয় নি। পাঠ্যক্রমের মৌল বিষয় নিয়ে মতভেদ থাকায় পেশাদারিত্বে উপনীত হওয়ায় চেষ্টা, চেষ্টাই থেকেই গেল।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩২ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

বিংশ শতকের শুরুর দিকে ঘটনাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদ শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণের ধারণার সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নবজাগরণের ধারণাটি জুড়ে গেল। ১৯১২ এবং ১৯১৯এর মধ্যে মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশন এক্ট চালু হওয়ায় বিরুদ্ধাচরণ করলেন দেশিয় চিকিৎসক গোষ্ঠী। এই সময়ে পশ্চিমি চিকিতসাবিদদের সঙ্গে দেশিয় চিকিতসকেদের বিবাদ প্রকাশ্যে এসে পড়ে। ১৯১৪ সালের বেঙ্গল মেডিক্যাল এক্ট বাংলায় একটি মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং চিকিতসকেদের নথিভূক্ত করার কাজ করে। এই ধরণের আইন বম্বে এবং মাদ্রাজে চালু হয়। দেশিয় চিকিৎসার ওপরে এই আইনটির প্রভাব এই ঘটনা ক্রমের প্রভাবে দেখা যেতে পারে-

পশ্চিমি চিকিৎসায় শিক্ষত মাদ্রাজের কৃষ্ণ স্বামী আইয়ার এবং পি পি বৈদ্যর নাম প্রাদেশিক নথিকরণের খাতা থেকে হঠিয়ে দেওয়া হয় ১৯১৫ সালে দেশিয় চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। ড আইয়ারকে বলা হয় তিনি যদি নিজেকে ট্রিপলিকেনের কালাভালা কুন্নুম চেট্টিয়ার ফ্রি ডিস্পেনসারির প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে না নেন, তাহলে চিকিৎসক হিসেবে সরকারি নথি থেকে তার নাম কাটা যাবে। বম্বের একই হুমকি দেওয়া হয় ড বৈদ্যকে। তিনি তার পিতার পিতার স্মৃতিতে চলা একটি আয়ুর্বেদিক পোপট প্রভুরাম কলেজে যুক্ত ছিলেন।
আন্দোলনকারীরা এবং সংবাদপত্র এবং দেশিয় চিকিৎসকেরা কাউন্সিলের এই নীতিকে নিন্দা করেন। দৈনিক ভাষ্কর মিত্র লিখল মাদ্রাজ কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত প্রতিহিংসাপরায়ন এবং অসন্তোষজনক। সঞ্জীবনী এবং হিতবাদী বলল এই ঘটনা আতঙ্ককর এবং দেশিয় চিকিৎসা পদ্ধতির পক্ষে অপমানজনক।

চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলি স্বীকৃতির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পশ্চিমি চিকিৎসা বিদ্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত চিকিতসকেদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতে শুরু করল। বাংলার প্রাদেশিক সরকার ১৯০৬ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলকে স্বীকৃতি দিয়ে বলল সেই বিদ্যালয় থেকে কৃতকার্য হয়ে শংসাপত্র নিয়ে বেরোনো ছাত্ররা নথিভুক্ত হবে। ১৯১৬ সালের ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল(বোগাস ডিগ্রি) এক্টএর প্রভাবে এই ধরণের বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রদের ভর্তি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এই আইন অনুযায়ী ১৮৯৭-৯৮ সালে শুরু হওয়া বেলিগাছিয়ার কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এন্ড সারজনসএর মত প্রত্যেকটি বেসরকারি কলেজের ডিপ্লোমা দেওয়া নিষিদ্ধ করে দিল। আইএমএসএর এক আধিকারিক রায় কালিদাস চন্দ্র বোসের তথ্য অনুযায়ী সে সময়ে কলকাতায় এরকম চারটি শিক্ষা কেন্দ্র ছিল, যারা সারা দেশের জন্য বিপুল সংখ্যক বোসের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী হাতুড়ে(বোগাস) ডাক্তার তৈরি করত।

১৯১৬ সালে বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে তার বিধিনিষেধগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কেউ কেউ৯ বিলে পশ্চিমি চিকিৎসার নিয়ন্ত্রণের ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই আইনে আয়ুর্বেদ, য়ুনানি, হোমিওপ্যাথিকেও যুক্ত করার জোরালো দাবি তুললেন। এমন কি উপনিবেশিক সরকারের মধ্যেও বিলের উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিমত ছিল। সেখানে কেউ কেউ চিকিৎসার স্তরকে উচ্চে তুলতে পশ্চিমি চিকিৎসার সঙ্গে দেশিয় চিকিৎসা পদ্ধতির মিলন ঘটাতে চাইত আবার অন্যেরা দুটি পদ্ধতির স্বাতন্ত্রের পক্ষে ছিল।

১৯১৮-১৯ সালে মন্তেগু(সেক্রেটারি অব স্টেট) এবং চেমসফোর্ড(ভাইসরয়) উপনিবেশিক ভারতের রাষ্ট্র চরিত্রে এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন আনেন। প্রশাসনিক সংস্কারে সৃষ্টি হল দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ নীতি - স্থানীয় সরকারের হাতে কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হল এবং তার মাথায় রইল কেন্দ্রিয় সরকার। তারা বিষয়গুলি দুভাগে ভাগ করলেন - ট্রানসফার্ড এবং রিজার্ভড ক্ষেত্র। ট্রানসফার্ড ক্ষেত্রটির কয়েকটি বিষয় যেমন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের মনোনীত মন্ত্রীদের হাতে থাকবে। অন্যদিকে রিজার্ভড ক্ষেত্রটিতে রইল অর্থ, রাজস্ব, পুলিশ এবং অন্যান্য কিছু যা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রিয় সরকার। যুদ্ধর সময়ে প্রশাসনিক সেবায় ভারতীয়দের ভুমিকা বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে চিকিৎসা জুড়ে গেল ট্রানসফার্ড বিষয়ে – চিকিৎসা সেবাতেও প্রচুর ভারতীয় প্রবেশ করতে লাগল। ১৯১২ সালের রয়্যাল কমিশন অব ইন্ডিয়ায় উপনিবেশের পূর্ত বিভাগে আরও বেশি ভারতীয়কে নেওয়ার সুপারিশ করে।৮১

গ। ১৯২০ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত
মন্তেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার স্থিতি পেলে ভারতীয় মন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ পেলেন। দ্রুত ভারতীয়করণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ এবং বিস্তারে মন্ত্রীদের হাতে বেশি বেশি ক্ষমতা আসায় যে পরিবর্তনটি ঘটল, তার ছোঁয়া লাগল চিকিৎসা ব্যবস্থায়। দেশজ মন্ত্রীরা হয়ত পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে দেশিয় চিকিতসা শিক্ষা ব্যবস্থা জুড়ে দিতে পারেন এই ভয়ে রেগুলেশন অব মেডিক্যাল স্টান্ডার্ড নিজেদের হাতে রাখল সরকার। চিকিৎসা শিক্ষার প্রমিতকরণের কাজে জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল বা জিএমসির নিয়ন্ত্রণ থাকায় শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে অত্যধিক ছাত্র প্রবেশে বাধা ঘটল। ব্রিটেনের ১৮৮৬ সালের মেডিক্যাল এক্টএ মেডিসিন এবং সার্জারিতে দাই এবং সার্জারিতে পরীক্ষার সুপারিশ ছিল। এর ফলে পাঠ্যের সময় বাড়ল এবং পরীক্ষা বিধি আরও কঠোর হল। ১৮৯২ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিগ্রি জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল স্বীকার করল।
প্রাথমিকভাবে জিএমসি ব্রিটেনের মত ভারত উপ্নিবেশে চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্রগুলি পরিদর্শনের কাজ খুব একটা উৎসাহ দেখায় নি; তারা যে ছোট খাট পরিবর্তন প্রস্তাব করত সেগুলি সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রূপায়ন করতে পারত। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘ দিন চলল না। বাংলায় শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে চলার তথ্যের সুযোগ নিয়ে ১৯০৭ সালে জিএমসি দাইদের স্তর উন্নীত করতে তাদের শিক্ষার প্রস্তাব দিল।

ভারতীয় হাসপাতালগুলিতে জিএমসির পরিদর্শনের প্রতিবেদনে দাইদের প্রশিক্ষণের অভাবকে চিহ্নিত করা হল। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জিএমসি প্রশাসকদের বিরোধ বাধল।

১৯২২ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া চিকিৎসা ডিগ্রির ওপরে কোন রকম নিষেধাজ্ঞা জিএমসি জারি করে নি। ১৯২৪ সালে আর এ নিডহ্যামের পরিদর্শন-সমীক্ষা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া কোন ডিগ্রিকে বাতিল না করার সিদ্ধান্ত নেয় জিএমসি। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব মেডিক্যাল এডুকেশন, নিডহ্যামকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ডিগ্রির যোগ্যতা অর্জনের শেষতম পরীক্ষাটি বিষয়ে মন্তব্য করতে বলা হয়। ১৯২২ এবং ১৯২৩এর দাইদের পরীক্ষা নিডহ্যামএর আনুকূল্য অর্জন করে নি। ১৯২৪এর পরীক্ষাতেও একই ঘটনা ঘটলে নিডহ্যাম লিখলেন, গর্ভপাত(লেবার) বিষয়ে ছাত্রদের যথেষ্ট শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ৮৪

১৯২৪ সালের নিডহ্যামের সমীক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝড় তুলল। বিশ্ববিদ্যালয় নিডহ্যামকে তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষণ করতে দিতে অস্বীকার করে এই যুক্তিতে যে তারা ছাত্রদের মেডিসিন, সার্জারি এবং মিডওয়াইফারিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিচ্ছে এবং তাদের ছাত্রদের অর্জিত দক্ষতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সন্তুষ্ট। ১৯২৪এর পর থেকে জিএমসি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সংক্রান্ত ডিগ্রিকে মান্যতা দিতে অস্বীকার করে। ১৯২৭ সালের জুলাইতে জিএমসি নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করে এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল অব মেডিক্যাল কোয়ালিফিকেশনসকে নির্দেশ দেয় নতুন করে সমগ্র বিষয়টি নিরীক্ষণ এবং সমীক্ষা করতে। এর এক বছর পরে জিএমসি ভারতে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া তৈরির প্রস্তাব দেয়। কেন্দ্রিয় সরকার এমসিআই তৈরির প্রস্তাব নিয়ে খুব স্বচ্ছন্দ ছিল না, এবং প্রাদেশিক সরকারগুলি কেন্দ্রকে জানাল যে এই প্রস্তাবে কেন্দ্রিয় কাউন্সিল প্রাদেশিক স্বাধীনতার ওপর অবাঞ্ছিত আঘাত হানছে। প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্রীদের একটি সম্মেলনে এই দৃষ্টিভঙ্গী উঠে এল৮৫। এই বিতর্কে জিএমসি ১৯৩০ সাল থেকে ভারতীয় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা সংক্রান্ত ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা বাতিল করে এই যুক্তিতে যে, হাতে একটা ডিগ্রি থাকা মানেই চিকিৎসকের চিকিৎসার ন্যুনতম জ্ঞান থাকার প্রমানপত্র নয়।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩১ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

বহু কবিরাজ বাংলার বাইরে হরিদ্বার, বেনারস এবং অন্যান্য শহরগুলিতে চিকিৎসা কেন্দ্র খুললেন। এই চিকিৎসকেরা দেশজ চিকিৎসাকে পুনর্জন্ম দেওয়ার ভগীরথ হলেন। কবিরাজ গঙ্গাধর রায়ের সমসাময়িক, পরম্পরার শ্রীখণ্ড বিদ্যালয়ের কবিরাজ চন্দ্রকিশোর সেন শস্তায় ওষুধ বিক্রির জন্য কলকাতায় একটি কেন্দ্র শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে এই কেন্দ্রটির সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে তিনি কলুটোলায় একটি ওষুধ তৈরির কারখানা খুললেন। আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিক চরিত্র উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে তিনি শস্তায় প্রচুর পুস্তক রচনা করেন। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠে এন এম সেন এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা নাম দিয়ে গঙ্গাধর রায় আরও বড় আকারে ওষুধ তৈরির কোম্পানি শুরু করেন। অন্যান্যরাও আয়ুর্বেদিয় ওষুধ বাণিজ্যিকরণের কাজে লেগে পড়েন। ১৯০১ সালের ঢাকার শক্তি ঔষধালয়ের অসামান্য সাফল্যের পর সাধনা ঔষধালয় এবং কল্পতরু আয়ুর্বেদিক ওয়ার্ক্সও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়।

বাংলার দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাসে বোঝা যাচ্ছিল ১৮৮০ সালেও দেশজ চিকিতসার কোম্পানিগুলি জোরদার ব্যবসা করছে। এর পাশাপাশি পশ্চিমি চিকিতসকেদেরও বাড়বাড়ন্ত হয়। শেষের দিকে ১৮৮৬ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলে পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যার পাঠ দেওয়া শুরু করে। এইটি প্রথম ভারতীয়দের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি বিদ্যালয়। ১৯০৫ সালে বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। এরা কারা এবং কি জন্য বিরোধ সে তথ্য আজ আর জানা যায় না। শুধু জানা যায় যে ব্যবস্থাপকেদের মধ্যে কয়েকজন আলাদা হয়ে গিয়ে ১৯০৭ সালে পৃথক একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সে সময় কলকাতায় তিনিটি বেসরকারি পশ্চিমি চিকিৎসা পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার বিদ্যালয় ছিল। এদের মধ্যে কিছু ছিল পয়সা ফেলে ডিপ্লোমা দেওয়ার কারবারি। এই ডিপ্লোমার সঙ্গে চিকিৎসার পাঠ্যসূচী অধ্যনের কোন যোগ ছিল না। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমি চিকিৎসকেদের সংগঠন ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটি কলকাতায় চিকিতসকেদের নথিকরণের প্রস্তাব দেয়। সরকার এই প্রস্তাব গ্রহন করতে অস্বীকার করে কেননা তারা জানত তাদের পক্ষে বৈদ্য আর হেকিমদের বিরুদ্ধতা সহ্য করা সম্ভব হবে না।

উনবিংশ শতকের শেষে চিকিৎসা প্রশাসনে দেশজ চিকিতসাবিদ্যার প্রতি বিরুদ্ধতা প্রকাশ্যে এসে গেল। আইএমএসএর চিকিতসকেরা তাদের চিকিতসাবিদ্যাকে একমাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে বৈধরূপে দাবি করা শুরু করলেন। বাড়তে থাকা স্বীকৃত পশ্চিমি চিকিতসক স্নাতক জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ায় দেশজ চিকিতসকেদের ধারনা হল তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গেল। ব্যবসায়িক এবং কৃষির সমৃদ্ধিতে দুই ধরণের চিকিতসকেদের হাতে সম্পদ জড়ো হতে শুরু করে।৬৬

ব্রিটিশ ভারতে দেশজ আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসাব্যবস্থার সমর্থক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি উনবিংশ শতকের শেষের সিকে য়ুনানিতেও জোয়ার লাগল। প্রখ্যাত য়ুনানি চিকিৎসক হেকিম আজমল খান(১৮৬৩-১৯২৮) য়ুনানি চিকিৎসা শিক্ষার এবং তার পাঠ্যক্রমের বিধিবদ্ধভাবে সংঘবদ্ধ করেন। হেকিম আজমল খানের মূল অবদান হল, য়ুনানি চিকিৎসা(যা অন্যভাবে য়ুনানি-টিব নামে পরিচিত) মুসলমান রাজনৈতিক অস্মিতার অন্যতম চিহ্নরূপে প্রতিষ্ঠা করা৬৮।

আবারও য়ুনানি চিকিতসাবিদ্যার পুনর্জাগরণের মডেল হল পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা। বাড়িতে বসে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা এবং শিক্ষার উদ্যমের বাইরে গিয়ে নির্দিষ্ট কর্মী এবং মাস মাইনে ভিত্তি করে বিধিবদ্ধ বিদ্যালয় স্থাপন করার চেষ্টা হল। য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার সংস্কার অনেকটা আয়ুর্বেদিয় ব্যবস্থা সংস্কারের মত আন্দোলনের রূপ নিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় এইটি চরম রূপ গ্রহন করে।

দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত এল পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত ব্রিটিশ এবং ভারতীয় চিকিৎসকেরা প্রাদেশিক ভিত্তিতে চিকিতসকেদের নথিকরণের দাবি জানালেন যাতে কোন আইনি বিবাদে, পেশাদারদের রোগ সারিয়ে তুলতে এবং অন্যান্য আইনি ঝঞ্ঝাটে দেশিয় চিকিৎসকেদের শংসাপত্রের আইনি বৈধতা না থাকে। ৬৮

১৯০৭ সালে চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের বিষয়টা নতুন করে উঠে এল সরকারের পক্ষে একমাত্র পশ্চিমি পদ্ধতিতে চিকিতসকেদের নথিবদ্ধ এবং স্বীকার করার উদ্যমের মধ্যে দিয়ে। সরকারি প্রস্তাবগুলি ছিল এই রকম –
ক। যাতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রয়োজনে গুণমানযুক্ত যথেষ্ট চিকিৎসক পাওয়া যায়
খ। খুলে দেওয়ার অর্থ হল, বাংলা প্রাদেশিক সরকারের এই বিরাট প্রেসিডেন্সির প্রচুর হাসপাতালে বিশাল সংখ্যক হাউস ফিজিসিয়ান এবং হাউস সার্জেন দরকার হয়, প্রত্যেক বছর সব থেকে মেধাবি ছাত্রদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে,
গ। ব্যক্তিগতভাবে চিকিতসকেদের নিজেদের উতসাহে শিক্ষাকেন্দ্রকে উৎসাহ না দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র স্বীকৃত বিদ্যালয়গুলিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। কলকাতা এবং বম্বেতে এই ধরণের পদক্ষেপ করা হয়েছে। ইত্যাদি...

শুধু পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষিত চিকিতসকেদের জন্য নথিবদ্ধ করণের প্রক্রিয়া ধাক্কা খেল। এই বিষয়ে সরকারকে প্রচুর ঝামেলা সামলাতে হল, বিশেষ করে দেশের অধিকাংশ মানুষই দেশিয় চিকিতসকেদের চিকিৎসার সমর্থক। চিকিতসকেদের নথিকরণের প্রক্রিয়ায় বিরুদ্ধতা বাড়তে থাকল। সরকার সিদ্ধান্ত নিল, যতদিননা পশ্চিমি পদ্ধতিতে চিকিতকেরা গবেষণা এবং প্রভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন, ততদিন নথিকরণের প্রক্রিয়া থমকে থাকবে। স্বাধীন চিকিতসকেদের পসার বাড়াতে প্রাদেশিক সরকার নিজস্ব নীতি গ্রহন করল। বাংলা সরকার লিখল, যখন কোন চিকিৎসক সরকারি সেবায় নিযুক্ত হন তখন তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং সরকারের হয়ে কাজ করার দায় এবং সময় তার বহু সময় নিয়ে নেয়; ফলে প্রাথমিকভাবে সেই চিকিৎসক সরকারি চাকর তার পরে স্বাধীন চিকিতসক।৭২

ভারতে স্বাধীন চিকিৎসক তৈরি করা সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়ালে সে শুধু যে স্বাধীন চিকিতসকেদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল তাই নয়, সরকারি সেবার নীতিতে পরিবর্তন আনতে উদ্যমী হল। কিন্তু সরকারি সেবায় সংস্কারের পথে হাঁটা বিফল হল।
(চলবে)

Sunday, March 5, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৯ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৮৬৪ সালে সরকারি নতুন এক নির্দেশে বাংলা শ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করা হল – নেটিভ এপোথেকারি এবং দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট – যার ফলে বাজারে স্বাধীন চিকিতসকেদের সংখ্যা একটু বাড়ল। প্রথম শিক্ষাটিতে সরকারি চাকরি করানোর জন্য ছাত্র ভর্তি করানো হল, আর দ্বিতীয়টিতে সাধারণ মেডিসিন এবং সার্জারিতে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যাতে দেশের গরীবদের জন্য চিকিতসকেদের সংখ্যা বাড়ানো যায়৫৩।

দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট শ্রেণীদের প্রথম দল পাঠ শুরু করে ১৮৬৬-৬৭ সালের শিক্ষাবর্ষে যেখানে মহিলা, শিশু, দাই এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সও পড়ানো হত। ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীতে উত্তোরণ ঘটল যখন চিকিৎসা পাঠের শ্রেণীগুলিকে শিক্ষা দেওয়ার আলাদা আলাদা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে নির্দিষ্ট নীতি আর আইনের আওতায় নিয়ে আসা হল। ১৮৭৩ সালে বাংলা ভাষার নেটিভ এপোথেকারি এবং দ্য ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েট শ্রেণীকে নতুন বিদ্যালয়ে পাঠানো হল ফলে সেখানে বহু ছাত্র ভর্তি হতে পারল। এই বিদ্যালয়ের নাম হল শিয়ালদা মেডিক্যাল স্কুল বা ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল। শুরুতেই ৮৩২জন ছাত্র নিয়ে তার যাত্রা শুরু করল এই বিদ্যালয়। একই বছরে হিন্দুস্তানি শ্রেণীকে টেম্পল মেডিক্যাল স্কুলে পরিণত করা হল। জেলা সুপারিনটেন্ডেন্টের তত্ত্বাবধানে চলা এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল সেই সব ছাত্রদের শিক্ষিত করা হবে যারা গ্রামে চিকিৎসা করতে উতসাহী। এরা হেকিম আর বৈদ্যদের স্থান গ্রহণ করবে এবং তাদের মাধ্যমে সমাজে ইওরোপিয় চিকিতসাবিদ্যার সুফল পৌছে যাবে৫৫। এই প্রস্তাবটি নেওয়া হয়েছিল ১৮৭৯ সালের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের বৈঠকে।

নতুন দুটি বিদ্যালয় স্থাপনে চিকিৎসা বিদ্যালয়(স্কুল) এবং মহাবিদ্যালয়ের(কলেজ) মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দিল। স্কুলগুলির কাজ হল ডিপ্লোমা এবং সার্টিফিকেট দিয়ে প্রচুর অধস্তন চিকিৎসক তৈরি করে বিভিন্ন সরকারি সেবায় শূন্যস্থান পূরণ করা এবং দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট সময়াবধির পাঠ্যক্রম অনুসরণ করিয়ে ডিগ্রি দেওয়া।

রাষ্ট্র দেশিয় চিকিতসক নিয়োগ করেছে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত। তার পরে ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের শর্ত আরোপ করেছে। এই বিধিনিষেধের উদ্দেশ্য হয়ত ছিল সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ করা। বাংলা শ্রেণীর চিকিৎসকেরা সরকারি চাকরির বদলে প্রেসিডেন্সির গরীব শ্রেণীর মানুষদের সেবা দিতেন।

১৮৫৭ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি পাওয়ার পরে সিনেটের অনুমোদনক্রমে প্র্যাক্টিক্যাল কেমিস্ট্রি আলাদা পাঠ্য হিসেবে বা সাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার চল শুরু হলেও বহুকাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিদ্যা পড়া বা চিকিৎসা করার জন্য রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা এবং প্রাণীবিদ্যা অধ্যয়ন জরুরি শর্ত ছিল না। এই বিদ্যাগুলির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ১৯০১-০২ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাইরে থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল তৈরি হল। চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি পাওয়ার জন্য কোন বিদ্যালয় থেকে ন্যুনতম দুবছরের অবধিতে এনাটমি এবং ফিজিওলজি অধ্যয়ন এবং কোন স্বীকৃত হাসপাতাল থেকে মেডিসিন এবং সার্জারিতে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা জরুরি ছিল। বাড়তে থাকা এনাটমি এবং সার্জারি বিদ্যার বিকাশের ফলে এই দুই বিদ্যা গুরুত্ব পেতে থাকে।

প্রেসিডেন্সির নানান এলাকার চিকিৎসা বিদ্যালয়ের চিকিতসাশিক্ষার গুণমান বাড়ানোর জন্য নতুন করে উদ্যম নেওয়া হল। ১৮৯৬ সালে চিকিতসাবিদ্যার পাঠটি তিন বছর থেকে বাড়িয়ে চার বছর এবং ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার স্তর বাড়িয়ে ম্যাট্রিকুলেশন করা হল। এরপর বিদ্যালয়গুলিকে দেশিয় থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা হয়। এক দশক পর রাষ্ট্র বাংলায় স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি স্থাপন করে বিদ্যালয়গুলি থেকে সফল ছাত্রদের বেঙ্গল কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশনে পঞ্জীকরণ করার কাজ শুরু করবে। চিকিতসাবিদ্যার বিদ্যালয়গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সফল ছাত্র সাব-এসিস্ট্যান্ট সার্জন পদে সরকারি সেবায় প্রবেশ করত।

রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে চিকিৎসা নীতি অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ায় ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা পাঠ্যক্রম সরকারের পক্ষে স্বীকৃতি দেওয়া সহজ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি এক্টএ চিকিৎসা বিদ্যার পাঠ্যক্রম রদবদল ঘটানোর ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে ১৯০৪ সালে সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহন করে। লর্ড কার্জন ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি এক্টকে ফিরে দেখতে চেয়ে বললেন সরকার শুধু যে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যম নিতে পারে তাই নয়, সে যা কিছু অদলবদল করা, কোন কিছু যোগ বিয়োগ করার, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহন করা যে কোন কিছু পরিবর্তনও করতে পারে।

সরকার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করল আবার সেটির প্রশাসন এবং পাঠ্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পদক্ষেপও নিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা পাঞ্জাব, মাদ্রাজ এবং লাহোরের চিকিৎসা কলেজগুলিতেও এই ধরণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হল। বিংশ শতকের আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রক ছিল না, ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা পঠনপাঠন নিয়ন্ত্রণ করত ডায়রেক্টরেট অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন দপ্তর।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৯ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৮৫৮তে রাণি যখন কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার নিজের হাতে নিলেন তখন থেকে সাম্রাজ্যের ভারত সম্বন্ধীয় দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটল। এই সময়ে পশ্চিমি নবজাগরণের(নতুনভাবে তৈরি ব্রিটিশ পেশাদারদের) সুফল ভারতীয়দের কাছে পোঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাম্রাজ্য। এই পরিবর্তনের বহু সীমাবদ্ধতা ছিল – তখনও ভারতীয় সাম্রাজ্যের মূল লক্ষ্য ছিল আইনের শাসন এবং রাজস্ব আদায়।

নতুন সরকারের নীতি পরিবর্তনের দুটি প্রভাব চিকিৎসা সেবায় পড়ল – মফস্বলে সিভিল সার্ভিসে চাকরি করা ইওরোপিয়দের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হল ব্রিটেনে শিক্ষিত ব্রিটিশ চিকিতসকেদের ওপর। ১৮৪০ এবং ৫০এর দশকে আইএমএস(১৯৪৭ পর্যন্ত মূলত সেনাবাহিনীর চিকিৎসা সেবা)এ উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসা স্নাতকদের রমরমা ছিল যাদের পশ্চিমি পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে তৈরি করা নির্দিষ্ট সুউচ্চ ধারণা ছিল। এরা এই সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করত সেই শতকের ৬০ এবং ৭০ দশকেও। হিউম বলছেন এই প্রজন্মের চিকিতসকেরা পাঞ্জাবে ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত হেকিমদের দিয়ে টিকাকরণ এবং স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে এক্সটেন্সানের কর্ম প্রকল্প বন্ধ করে দেন।

নব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে প্রশাসনিক বিভাগগুলিরও বিস্তার ঘটল। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিস্তারের ফলে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত চিকিতসকেদের প্রশাসনিক সেবায় চাহিদা বাড়ল। এই বিস্তারের আগে কোম্পানি আমলে চিকিতসকেরা সাম্রাজ্য জুড়ে কোম্পানির ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মিশনারিরাও চিকিৎসা সেবা দিতেন, তার পরে শেষের দিকে স্থায়ী সরকারি চিকিৎসা সেবা ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবুও ১৯৩০ সাল নাগাদ ভারতে প্রচুর চার্চ হাসপাতালের অস্তিত্ব ছিল।

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের পাশাপাশি গঙ্গাধর রায় এবং গঙ্গাপ্রদাস সেনের মত প্রখ্যাত ভিষগের হাতে আয়ুর্বেদ চর্চিত হচ্ছিল। এই সময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে(অন্তত তিনটি প্রজন্ম) কবিরাজির পরম্পরা যে বয়ে চলেছে তার একটা উদাহরণ নিচে দেখতে পাব -

ক। গঙ্গাধর রায়(১৭৮৯-১৮৮৫) ছাত্রবৃন্দ
১। দ্বারকানাথ সেন(প্রথম প্রজন্ম ছাত্র), যোগীন্দ্রনাথ সেন, উমাচভরণ ভট্টাচার্য, রাজেন্দ্র নারায়ণ সেন, কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন, জয়পুরের লক্ষ্মীনারায়ণ শর্মা, নাগপুরের গোবর্ধন শর্মা(দ্বিতীয় প্রজন্ম)
২। গয়ানাথ সেন(প্রথম প্রজন্ম ছাত্র), সীতানাথ সেন, রামনাথ সেন, বেনারসের সত্যনারায়ণ শাস্ত্রী এবং ধর্মদাস গুপ্ত এবং ত্র্যম্বক শাস্ত্রী, শ্যামাদাস বাচস্পতি(দ্বিতীয় প্রজন্ম)
৩। হারানচন্দ্র চক্রবর্তী(প্রথম প্রজন্মের ছাত্র), জ্যোতিষচন্দ্র সরস্বতী, রমেশ্চন্দ্র চক্রবর্তী, প্রভাকর চ্যাটার্জী(দ্বিতীয় প্রজন্ম), বিমলানন্দ তর্কতীর্থ, রামচন্দ্র মল্লিক, বিজয়কালী ভট্টাচার্য, নিলিনীরঞ্জন সেন(তৃতীয় প্রজন্মের)

খ। গঙ্গাপদ সেনের(১৮২৪-১৮৯৬) ছাত্র আর তাদের ছাত্রদের ছাত্র
১। নিশিকান্ত সেন, বিজয় রত্ন সেন(প্রথম প্রজন্ম), যামিনীভূষণ রায়, বিরাজচরব গুপ্ত, দুর্গাদাস ভট্ট(দ্বিতীয় প্রজন্মের)
২। রামচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ
এই পর্বে অনুবাদের কাজও হয়েছে। বিজয়রত্ন সেন আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণে ভগট্টের অষ্টাঙ্গরদ্ধ অনুবাদ করেন। সে সময় শাসক রাজা বিজয়রত্নকে মহামহোপাধ্যায় উপাধি দান করেন। তিনি দুই চিকিৎসাব্যবস্থার মিলনের পক্ষে ছিলেন। তার এক ছাত্র যামিনীভূষণ রায়ের স্থাপন করা আয়ুর্বেদ কলেজে দুই ধরণের চিকিৎসাবিদ্যা অধিত হত।

খ। ১৮৬০ থেকে ১৯২০
এই পর্বে পেশাদারিত্বের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের অভিমুখেরও পরিবর্তন ঘটে। ভারতে ইংরেজী শিক্ষত শ্রেণী - যাদের অধিকাংশ সফল ব্যবসায়ী, জমিদার এবং নব্য শিল্পপতির - তাদের উদ্ভবে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। এই পর্বে দেশজ এবং পশ্চিমি চিকিতসকেদের পেশাদারিত্বের দিকে যাওয়ার উতসাহ দেখা দেয়।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চিকিৎসা বিষয়ে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। সেই সময়ের চিকিতসা সংক্রান্ত নীতির একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে একদিকে চিকিতসকেদের ব্যক্তিগত পসার বাড়ানোর বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়, আর অন্যদিকে প্রশ্ন ওঠে কিভাবে রাষ্ট্রের দেওয়া চিকিৎসা সেবা বিপুল জনসংখ্যার কাছে পৌঁছবে। একদিকে রাষ্ট্র সরকারি চাকরিতে দেশিয় চিকিতসকেদের প্রবেশের বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে তারা বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ারও অঙ্গীকার করছে। ১৮৫৭র পরে রাষ্ট্রের ঘাড়ে উন্নয়নের বৃহত্তর জোয়াল পড়লেও এই বিপুল সংখ্যাকে সেবা দেওয়ার মত প্রয়োজনীয় চিকিৎসক তার হাতে ছিল না। ফলে বিপুল সংখ্যায় মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে রাষ্ট্র দেশিয় চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে শুরু করে।
আমাদের হাতে যে সব তথ্য রয়েছে তা নির্ভর করে বলতে পারি পাঞ্জাবে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত বৈদ্য আর হেকিমদের লাহোর মেডিক্যাল কলেজে আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানির প্রাথমিক বিষয়ে শিক্ষত করে তুলে বিভিন্ন এলাকায় তাদের চিকিতসক হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করে। এই ধরণের টলারেন্সের কারণ হল, স্টেট মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে উপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক তৈরি করা যাচ্ছিল না। রাষ্ট্রের সেবা যে সব অঞ্চলে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে সেই সব এলাকায় দেশিয় চিকিতসকেদের সেবা ব্যবহার করা হল নানান ত্রাণের কাজে। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ এবং লাহোরের মেডিক্যাল কলেজের চিকিতসক স্নাতকেরা বিপুলাকার প্রশাসনের সেনাবাহিনী, জেল, রেলে চাকরি পেয়েগেলেন। ১৮৭২ সালের বাংলার জনগননায় ৩৭৬৯জন ফিজিসিয়ান, সার্জেন এবং ডাক্তারের যেমন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার তুলনায় দেশিয় চিকিৎসকের সংখ্যা দেখা যাচ্ছে ২৩৭০০।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২৮ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

নতুন শ্রেণীতে এনাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা, মেডিসিন এবং সার্জারি হিন্দুস্তানি এবং উর্দুতে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হল। ১৮৩৯ সালে মাথাপিছু ৫ টাকা বৃত্তিধারী ৫০ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হল। শব্যবচ্ছেদ এবং পাঠ্যসূচী ইওরোপিয় নীতি অনুসারী। ক্লিনিক্যাল শিক্ষার জন্য তাদের মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে নিয়োগ করা হয়৩৮। হাসপাতাল শুরু হয় ১৮৩৮ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায়, যাতে তাত্ত্বিক বিষয়ের সঙ্গে হাতে কলমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব দিক শেখানো যায়। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক, জনৈক ম্যাককোষের পদত্যাগে৩৯ পদটি তুলে দিয়ে যে বেতন বাঁচল, তা বরাদ্দ হল হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলি দেখাশোনার জন্য।

মোটামুটি শুরুর সময় থেকেই মিলিটারি বা হিন্দুস্থানি শ্রেণীটি ভারতীয়দের জন্য চিকিৎসা জ্ঞান আহরণের কাজে উন্মুক্ত করে দেওয়া হল চাকরির শর্ত জুড়ে দিয়ে। ঠিক হল প্রবেশাধিকার পাবে ১৫০ জন। যোগ্য দেশিয় ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরুর আগে তাদের কলেজের অধাপকেদের সামনে পরীক্ষা দিতে হবে৪০। যে সব ডাক্তার অসামরিক স্থানে কাজ করত, তাদের প্রতি আরও একটি শর্ত ছিল সরকারের চাহিদা ও নির্দেশ অনুযায়ী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে হতে পারে। যে সব ছাত্র সেনাবাহিনীতেও কাজ করবেন তাদের জন্যও একই নির্দেশ জারি হল।

মেডিক্যাল কলেজে মিলিটারি শ্রেণীতে দুধরণের বিষয় পড়ানো হত একটি তাত্ত্বিক অন্যটি প্রায়োগিক। প্রথমটি দুবছর এবং তৃতীয়টি শেষ বছরে। তাত্ত্বিক পাঠ্যক্রমে ছিল বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের পরিচয় এবং ব্যবচ্ছেদ ক্রিয়া জ্ঞাপন করিয়ে এনাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা এবং প্রাক্টিক্যাল ফার্মেসির শিক্ষা৪১। তাত্ত্বিক পড়াশোনার দ্বিতীয় বছরের শেষে মেডিসিন এবং সার্জারিও পরানো হত। তৃতীয় বছরে হাতে কলমে ড্রেসার, ডিসপেনসার এবং কম্পাউন্ডারির শিক্ষা দেওয়া হত। যেসব হাসপাতালে ভারতীয় ছাত্ররা ভারতীয় শিক্ষকদের থেকে মেডিসিন এবং সার্জারির প্রায়োগিক শিক্ষা নিচ্ছে সেই সব হাসপাতালে এই শিক্ষা দেওয়া হত। হাসপাতালে ময়না তদন্ত ছিল ক্লিনিক্যাল ইন্সট্রাকশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তৃতীয় বছরের শেষে মিলিটারি শ্রেণীর ভারতীয় ছাত্র ড্রেসার, কম্পাউন্ডার এবং ওষুধ খাওয়ানো এবং সাধারন হাসপাতালের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু তাদের কাজের কেরিয়ার সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।

শতাব্দ যত এগোতে থাকে বাংলায় দেশিয় চিকিতসকেদের চাহিদা বিপুল হারে বাড়তে থাকে বিশেষ করে অসামরিক কাজে। আগের বছরের কলেরা মহামারী এই চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই চাহিদা পূরণ করতে রাষ্ট্র মেডিক্যাল কলেজে ১৮৫১ সাল থেকে আরও একটি শ্রেণী খুলতে বাধ্য হয়। দেশিয় মানুষদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষিত ছাত্ররা অধস্তন চিকিৎসা কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করে।

নতুন শ্রেণীটার নাম হল দেশিয় বা বাঙ্গাল শ্রেণী, দুবছরের শিক্ষানবিশীর প্রশিক্ষণ। ১৮৫৩ সালে ২১ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হল এই পাঠ্যক্রম। সফল ছাত্রদের উপাধি হত হাসপাতাল এপ্রেন্টিস বা ভার্নাকুলার লাইসেন্সিয়েটস ইন মেডিক্যাল এবড সার্জারি। এই শ্রেণীতে ভর্তির জন্য বাংলা ভাষা সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞান থাকা জরুরি ছিল। এই শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর সঙ্গে হিন্দুস্তানি পাঠ্যসূচীর মিল ছিল। তৃতীয় বছরে সফল হয়ে বেরোবার পরে তারা দেশিয় ডাক্তার হিসেবে ডিপ্লোমা কাগজ এবং চাকরি পেতেন বিভিন্ন ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেটের দাতব্য চিকিৎসালয়ে আর জেল হাসপাতালে। এদের একাংশ টিকাকার হিসেবেও কাজ করেছেন৪৩। সেই সময়ে বাংলা জুড়ে কলেরা যে মহামারীর আকার নেয় তা রুখতে এই পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। কয়েকজন বাংলা প্রেসিডেন্সির নানান সংস্থা বা হাসপাতাল বা এক্সটেন্ডেড কলোনিয়াল টেরিটরিতে চাকরি করেছেন৪৪।

যদিও চিকিৎসক তৈরির জন্য মেডিক্যাল কলেজে অতিরিক্ত শ্রেণী তৈরি হচ্ছিল যাতে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য ক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করা যায়, অন্যদিকে রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী মেডিক্যাল কলেজেও পরিবর্তন আসছিল। ১৮৫৬ সালে কলেজের বিশদ ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয়ের দায়িত্ব কলেজ কাউন্সিল এবং সেক্রেটারির হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়, এ কাজে প্রিন্সিপ্যালকে সাহায্যের জন্য একটা কাউন্সিল অব প্রফেসর তৈরি করা হল, পরে প্রইন্সিপ্যাল ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের ফিজিশিয়ান এবং সার্জনের পদে বৃত হন৪৫।

চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের দখলদারির নতুন ধারার প্রবর্তন ঘটল ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। এই শিক্ষার পাঠ্যসূচী তৈরি এবং পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব গিয়ে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার একটি স্বশাসিত বোর্ডের ওপর যেটি আবার সরাসরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত।

১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধ(পুনম এখানে মিউটিনি শব্দটা ব্যবহার করেছেন) ভারতের সামাজিক গঠন এবং সরকারি কাজকর্মে বিপুল পরিবর্তন ঘটাল। সিপাহি যুদ্ধের বহু কারণ – ডালহৌসির দেশিয় রাজ্য গিলে খাওয়ার নীতি – যার ফলে বহু দেশিয় সামন্ত রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে, নতুন রাজস্ব নীতি যাতে দেশিয় চাষীদের ওপর বিপুল আর্থিক চাপ তৈরি হয় এবং দেশিয় হস্তশিল্পের উতপাদনের বাজারকে বিদেশিয় কলের উতপাদনে প্রতিস্থাপিত করার ইত্যাদির জন্য সিপাহি যুদ্ধ ঘটে। ১৮৫৮র গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্টএও পরিবর্তন ঘটল। সরকারের আর্থিক আয়ব্যয়ের হিসেব রাখার দায় পড়ল সরকারের ওপর এবং সেই সঙ্গে দেশের নৈতিক এবং জাগতিক উন্নতির কথাও বলা হল।
(চলবে)