Saturday, August 23, 2014

বাংলার গ্রামশিল্প, জেলাওয়ারি সমীক্ষা৪২, Handicrafts of Bengal - District Wise Survey42

 হাওড়া
উদয়নারায়ণপুরের মাদুর
উদায়নারায়ণপুর আর আমতা অঞ্চলে জোড়া মাদুর তৈরি হয় মাদুর বোনার সময় দুটি মাদুরকাঠি নিয়ে একটি টানার অর্ধেক বোনার পর অপর কাঠি বুনে টানার শেষ পর্যন্ত নিতে হয় প্রথম কাঠির ডগা ধার বাঁধার মত রেখে গোড়া যেখানে শেষ হয়, সেখানে টানার নিচে ঢুকিয়ে দিতে হয় তাই মাঝখানে জোড়া মাদুরের আয়তন বেশ বড় হয় সাধারনের চোখে বোঝা না গেলেও তবে নজর করে মাঝখানটা হাত দিলে একটু মোটাই লাগে

দার্জিলিং
নকশালবাড়ির কাঠের কাজ
বিশ্বায়নের আগের সময়ে, অন্তত নয়ের দশকের প্রথম পর্যন্ত, বাংলায় বিদেশি দ্রব্য, মেড ইন বিদেশ লেবেল ফেলে-ছড়িয়ে পাওয়া যেত না কলাকাতার খিদিরপুর আর শিলিগুড়ির ফ্যান্সি বাজার ছাড়া; এর বাইরে শস্তায় বিদেশে গিয়ে বাঙালি চাকুরিজীবি মধ্যবিত্ত যে শহরে আকছার ফোরেন গুডস কিনত সেটি ছিল ভারত-নেপাল সীমান্ত শহর ধুলাবাড়ি। আটের দশকের শেষের দিকে বন্ধু আনিন্দ্যর বাবা কাজ করতেন শিলিগুড়িতে। তাঁর হাত ধরে একবারই গিয়েছিলাম পানিট্যাংকি হয়ে ধুলাবাড়ি। এই ধুলাবাড়ি যেতে হত শিলিগুড়ি শহর থেকে নেপালের পথে শিলিগুড়ি-পানিট্যাংকি রাস্তায় প্রখ্যাত নকশালবাড়ি হয়ে – বাসে যেতে যেতে চোখে পড়েছিল নকশালবাড়ি নামটি। বামপন্থী রাজনীতি করা বাবা-মায়ের বহু বর্ণিল বন্ধু-বান্ধবই নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন – কিন্তু তখনো জানতামও না, ধারণাও ছিল না, নকশালবাড়ি একটি স্থান নাম। যাওয়ার সময় স্থানমাহাত্ম্যের দিব্য দর্শন হল। চোখ ফেড়ে ফেড়ে দেখেছিলাম নকশালবাড়ি এককালে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ উঠেছিল এই এলাকা থেকেই – কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম একটি ছোট সীমান্তবর্তী ছোট গঞ্জ নকশালবাড়ির সেই মাহাত্ম্যটি ফুরিয়েছে – যেমন দেহপটসনেনটসকলিহারায়
আজ কিন্তু নকশালবাড়ি শহরটার এসব নিয়ে যেন সত্যিই মাথা ব্যথা নেই। যে একালার রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে একদা জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদার, কানু সান্যালের মত নামগুলো জড়িয়ে ছিল পরত্র পরতে, সেই এলাকায় পারম্পরিক হস্ত শিল্পী সঙ্ঘের বেশ দারুন সংগঠন, কার্যকলাপ গড়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছর ধরে এখানে ধিমাল সনাজের সঙ্গে তাদের নাচ গান আর কাঠের কাজের একটা সাংগঠনিক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে
স্থানীয় কাঠ খোদাই শিল্পী আশু বাগচী, ভবানী বিশ্বাসসহ বেশ কিছু মানুষ বিগত কয়েক দশক ধরে নকশালবাড়ি এলাকায় গড়ে তুলেছেন  নতুন কাঠ খোদাইএর অনুপম ঐশ্বর্য আর পুরোনো খোদাই দ্রব্য বাজারজাত করার আপ্রূপ প্রচেষ্টাযেহেতু এই একালায় এখনও সাঁওতালসহ নানান আদিবাসী মানুষের বসতি রয়েছে, এবং তাদের জীবনধারণের যাত্রায় নিজস্বতার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, ফলে এই মানুষদের নানান সাংস্কৃতিক কাজ, দক্ষতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তৈরি এবং বিক্রি হচ্ছে, নানান কাঠের কাজ যেগুলি আবার অন্যদের থেকে বেশ আলাদা। যেগুলির সাংস্কৃতিক শেকড় চারিয়ে গিয়েছে এক্কেবারে দেশের, সমাজের অভ্যন্তরে।

ছম মুখোশ
বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত মুখোশ এই এলাকার অন্যতম শিল্প। এই মুখোশগুলির নাম ছম। এই মুখোশগুলি সাধারণত তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে তৈরি হয়। পেদংএ এই মুখোশ পরে নৃত্যও করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।

থাংকা  ছবি
বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান শিল্প। সুতি, রেশম বা মিশ্র কাপড়ের ওপর বিভিন্ন বৌদ্ধ দেব মূর্তি, বৌদ্ধ জাতকের গল্পের কোনও দৃশ্য বা তান্ত্রিক মণ্ডল আঁকা হয়। সাধারণত তেল বা এক্রেলিক দিয়ে আঁকা হয়। থাংকা ঠিকমত আঁকা হলে বহুকাল থাকে তবে এগুলি শুকনো এলাকায় রাখতে হয়। বড় থাংকাকে জড়ানো পট বলে।

কুকরি
বাংলায় আন্যতম প্রধান লোহা-ইস্পাত শিল্প যাতে কখনও জং পড়ে না। প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৯০৮ সালে ওয়াটসন বাংলার লোহা ইস্পাত শিল্পের যে মনোগ্রাফ রচনা করেছিলেন তাতে বিশদে কুকরি তৈরির বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু সেই ধরণের কুকরি তৈরির দক্ষ কারিগরের আভাবকেও তিনি চিহ্নিত করেছেনতবে আজও যে কুক্রি পাওয়া যায়, তাঁর মানও খুব খারাপ নয়। 

চা-গাছের আসবাব
চা বাগানে যখন প্রায় শতাব্দ প্রাচীন চা গাছ উপড়ে ফেলে নতুন গাছ লাগানো হয়, তখন সেই বনসাই গাছগুলির শেকড় বেশ মোটা হয় এবং নতুন শিল্পীরা এই গাছ ব্যবহার করে মধ্যবিত্তের বসার ঘরের কাঁচের মাথাওয়ালা নানান ধরণের আসবাব তৈরি করছেন। এগুলির চাহিদা বেশ ভাল। দামও বেশ মাঝারি ফলে প্রথমে শিলিগুড়িতে শুরু হলেও, এখন গোটা ডুয়ার্স জুড়ে চড়িয়ে গিয়েছে এই শিল্পটি।

হুগলি
বালিদেওয়ানগঞ্জের কাঁসা পিতল
আরামবাগ-বালিদেওয়ানগঞ্জ রাস্তায়। এখানে বেশ পুরনো কাঁসা পিতলের কাজ হয়। এতদিন ঘটি তৈরি হত। সম্প্রতি তাঁরা কিছু কিছু নতুন জিনিস উৎপাদন করতে শুরু করেছেন।


কলকাতা
বড়িশা, দক্ষিণ বেহালা শীলপাড়া অঞ্চলে বেশ দারুন পাটের শৈল্পিক কাজ হয়। পাটের থলে, ঘর সাজানো নানান জিনিসপত্র, চপ্পল, জ্যাকেট, পাটের বিনুনির থলে ইত্যাদি তৈরি করেন অন্তত কয়েক হাজার  শিল্পী।

বাগবাজার, শ্রীমানী বাজার
শাঁখের কাজ বেশ পুরোনো দিনের। বলা হয় বিষ্ণুপুরের পর কলকাতার বাজার এবং শিল্পীর দক্ষতা।

কুমোরটুলি
উত্তর কলকাতার প্রবাদপ্রতীম এলাকা। মূলতঃ মাটির মূর্তি বানানোর কাজে আতীব দক্ষ মানুষ জনের সমাবেশ হয়েছে এই স্থানে। মূর্তি ছারাও পাওয়া যায় নানান ধরণের সাজ সজ্জার জিনিসপত্র – বিশেষ করে শোলার নানান জিনিস। মাটির, শোলার, থার্মোকল, গ্লাস ফাইবার ইত্যাদির ছোট মূর্তিও পাওয়া যায়। পাশেই বাবু বাজার। সেটিও অতীব প্রখ্যাত বাজার। মাটির নানান কাজ এই বাজারে পাওয়া যায়। উনুন তৈরির তন্দুর এখানের সঙ্গে কুমোরটুলিতেও পাওয়া যায়। 

উল্টোডাঙ্গায় বাসন্তী কলোনী
উল্টোডাঙ্গার চার নম্বর প্ল্যাটফফর্মের নিচে নেমেগেলে খাল, তাঁর পাড়ে বিশাল মাটির নানান জিনিস তৈরির বাজার। কলকাতার আশেপাশে যে ধরণের রেড অক্সাইড প্রলেপ লাগানো নানান জিনিস পাওয়া যায়, সেগুলি বাসন্তী কলোনীতে তৈরি হয়। মাটির গয়না তৈরিতে বাসন্তী কলোনি প্রখ্যাত।

আলিপুরদুয়ার
বাঁশের কাজ
নতুনতম জেলা। রাজাভাতখাওয়া জঙ্গলে সাঁওতাল সম্প্রদায় বেশ ভাল বাঁশের কাজ করেন।

(কিছু তথ্যের সূত্রঃ দীপঙ্কর ঘোষ, অঞ্জন সেন, মধুমঙ্গল মালাকার, সোমা মুখোপাধ্যায়)

বাংলার গ্রামশিল্প, জেলাওয়ারি সমীক্ষা৪১, Handicrafts of Bengal - District Wise Survey41

জলপাইগুড়ি
জলপাইগুড়ি বিপুল বিশাল ঐতিহ্যের শহুর। জলপাইগুড়ি এমন এক শহর যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইংরেজ আমলের সন্ন্যাসী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম দুই নায়ক ভবানী পাঠক আর দেবী চৌধুরানীর নাম।

রাভা মুখোশ
রাভা বস্তি মানে রাভা সম্প্রদায়ের বসবাসের স্থান হল গয়েরকাঁটা জঙ্গলের ভেতরে, সেখানে রাভা সম্প্রদায়ের কয়েক জন বাংলার একমাত্র বাঁশের চাটাই বুনে কালির মুখোশ বানান
জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মোড়। জলপাইগুড়ি-ধুপগুড়ি হয়ে একটি রাস্তা কোচবিহারের দিকে চলে গিয়েছে, জলপাইগুড়ি-ধুপগুড়ি হয়ে অন্য একটি রাস্তা ভূটানের দরজা জয়গাঁ পর্যন্ত গিয়েছে। এই ধুপগুড়ি থেকে স্থানীয় বাস বা ট্রেকারে যেতে হয় খুট্টিমারি – একটাই বাস – কখন যায় তাঁর ঠিক ঠিকানা নেইসেখান থেকে হাঁটা পথ, প্রায় দুই থেকে তিন কিমি।
প্রথম যে দিন যাই বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ধুপগুড়িতেই প্রায় সন্ধ্যে সাতটা। পৌছতে পারব এমন আশা ছিল না। দূর দেশে যা হয় বিপত্তারণ হয়ে দাঁড়ালেন সেই বাসটির কর্মীরা যে বাসটি যায় খুট্টিমারি। সেদিন তার যাওয়ার কথা ছিল না। আমাদের কথা আর আমরা রাভাবস্তির মুখিয়া গনাত রাভার গ্রামে যাব শুনে তাঁরা ঠিক করলেন আমাদের পৌছে দেবেন খুট্টিমারি। ধুপগুড়ি থেকে খুট্টিমারির দূরত্ব প্রায় দশ কিমি। কি করে যেন তাদের বাসও ভর্তি হয়েও গেল। ধূপগুড়িতেই আমাদের পরিকল্পনা শুনে আনেকেই বলেছিলেন, যাওয়ার দরকার নেই। গয়েরকাটা জঙ্গল থেকে খুট্টিমারির পথে হাতি বেরোয়। কয়েক দিন আআগেই হাতি বেরিয়ে প্রচুর ফসন নষ্ট করে দিয়েছে তাদের বাঁধা হাঁটা পথের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে। আর সামনে কিছু মানুষ দেখলে তাঁরা কী করবে নিশ্চয়তা নেই।
তো রাত আট্টায় নামলাম খুট্টিমারি। নামিয়ে দিয়ে বাসটি চলেগেল তাঁর রাতের গন্তব্য। আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি নিশুত নিঝুম অন্ধকারে। কয়েকটি ঝুপড়ি দোকান। সেগুলি থেকেও একফোঁটাও আলোর আশা নেই। হালকা জ্যোৎস্না। কাছের ঝোপঝাড় পেরিয়ে দৃষ্টি পেরিয়ে দূরে নজর সন্নিবিষ্ট করলে দেখা যায় বিপুল বিশাল গাছের সারি। ওটাই খুট্টিমারি রেঞ্জ, জঙ্গলসেখানেই থাকে উত্তরবঙ্গের হাতির দল।
সঙ্গী ছিলেন বিধান বিশ্বাস। একটাই সান্ত্বনা তিনি এঈ গ্রামে এসেছেন একবার। বেশ কয়েক বছর আগে। খুট্টিমারিতে নেমে সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, সেই সময় খুট্টিমারীতে একটাও দোকান ছিল না। তাঁর সঙ্গে হাঁটা শুরু করলাম। পথ দেখাচ্ছে খুবই আবছা আলো আর জোনাকির ঝিকিমিকি। মনে আশংকা এই হাতির পাল বেরোল।
তো আমরা সেই রাতে পৌছলাম, রাভাবস্তি। রাভাদের খুবই প্রিয় ছোট কচু দিয়ে রান্না খেয়ে রাত কাটালামপ্রায় সব তরকারির অনুপান সেটি। গনাতদার পালিতা কন্যা সিতিন রাভা বেশ ভাল নাচেন। তাদের নাচের দলও রয়েছে।
সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল, মুখোশ বানানো শেষ কয়েকজম মানুষও খ্রিষ্টান হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা ঠিক করেছেন আর বানাবেন না। তবে আমাদের সম্মানে বানিয়ে দিলেন মুখোশ কয়েকটি। পরেরদিন সেখানে সারা দিন কাটানো আর আমাদের ফেরা, সে এক অন্য গল্প।

বেতের আসবাবপত্র
শিলিগুড়ি হয়ে জলপাইগুড়ি আর জলপাইগুড়ি- ধুপগুড়ি কোচবিহার রাস্তার দুপাশে বেতের আসবাব, ঘর সাজানো জিনিস নিয়ে আস্থায়ী দোকান দিয়ে বসে রয়েছেন বহু কারিগর। তাদের আনেকে সেই এলাকায় থাকেন।

পোড়ামাটি

তিস্তার আববাহিকায় দারুণ মাটি পাওয়া যায়, যে মাটি পোড়ালে বাঁকেও না চুরেও না। সেই মাটিতে নানান ধরণের পোড়া মাটির ঘর সাজানোর নানান জিনিস পাওয়া যায়, যেগুলোর আধকাংশ কলকাতার নানান দোকানে দেখতে পাবেন। পোড়ামাটির চাইমস, পোড়ামাটির নতুন নতুন আকারের টব, পোড়ামাটির আলোদানি আপনাদের ভাল লাগবেই। কিছু দেখতে পাবেন শিলিগুড়ি বিমানবন্দর ছাড়িয়ে শিলিগুড়ির দিকে যেতে শিবমন্দির এলাকার আশেপাশে। আর কিছু দেখতে পাবেন জলপাইগুড়ি শহর থেকে জাতীয় সড়কে এলে তার ওপরে বিশেষ করে  দেবী চৌধুরানী শ্মশান পেরিয়ে। 

বাংলার গ্রামশিল্প, জেলাওয়ারি সমীক্ষা৪০, Handicrafts of Bengal - District Wise Survey40

নতুনগ্রামের কাঠের কাজ
এই গ্রামে যাওয়া যায় হাওড়া কাটোয়া রেলরাস্তায় পাটুলি বা দাঁইহাঈ স্টেশন থেকে। নতুন গ্রাম বিখ্যাত তাঁর কাঠের প্যাঁচা, রাধাকৃষ্ণ, ইত্যাদি। বহু গবেষক যাঁরা বিশ্বাস করেন না, এ দেশে কোনও কিছু নিজস্ব তৈরি হতে পারে বিদেশী প্রভাব ছাড়া,  এগুলিকে মমি পুতুল আখ্যা দিয়েছেন – তাদের ধারণা ছিল এগুলি মিশর দেশ প্রভাবিত। কেনন এর আকার প্রায় তিন কোণা, প্রায় মিশরের মমির মত।
বাংলার পুতুল বিষয়ে একটি দীর্ঘ লেখা তৈরি করতে গিরে প্রয়াত গবেষক, রঘুনাথ গোস্বামীর সহযাত্রী, তারাপদ সাঁতরা নতুনগ্রামের পুতুলের বিলুপ্তির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘অধুনা বিলুপ্ত কালীঘাটের কাঠের পুতুলের সঙ্গে নতুন গ্রামের পুতুলের বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ কালীঘাটের পুতুল হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে, হয়ত নতুনগ্রামের পুতুলটিও বিলয় প্রাপ্তি ঘটবে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তাঁর আশংকা সত্যি করে কিন্তু নতুনগ্রামের পুতুলও মরে নি, শিল্পীরাও নতুন জীবন পেয়েছেন পুতুলকে নানান আসবাবে ব্যবহার করে। এক কালে পুতুলের চাহিদা যখন কমে গেল তখন কছু মানুষ, তাঁর মধ্যে প্রয়াত রঘুনাথ গোস্বামীও ছিলেন, এই শিল্পের মানুষদের নতুন এক উষায় বাঁচিয়ে তুলতে খুব খেটেছিলেন। হাইকোর্ট পাড়ায় তাঁর বিজ্ঞাপন কোম্পানির দপ্তরে সেই ৯৩, ৯৪ সালে দেখেছিলাম নতুন ধরণের নকশা তুলছেন কাগজে যাতে শিল্পীরা সেগুলো রূপায়ণ করতে পারেন – তখন আমরা কয়েকজন তাঁর সঙ্গে সঙ্গ করছিতিনি মারা যান তার কয়েক বছরের মধ্যেই। তিনি  যে ফল ফলাতে চেয়েছিলেন সেই কাজটি তিনি দেখে যেতে পারেন নি। আজ কিন্তু পুতুলের জন্য বিখ্যাত বর্ধমান জেলার নতুনগ্রামের বহু শিল্পী আসবাবপত্র করে বেঁচে গিয়েছে
তারাপদবাবুর সত্যি আশংকা মিথ্যে করে আজও নতুন গ্রামের প্যাঁচা বহাল তবিয়তে বিক্রি হচ্ছে মেলায় মেলায় এমনকি কলকাতার গর্বিত বুটিকেওআসবাবপত্রে ফুটিয়ে তোলা হতে থাকে রাজা-রানি, রাধা-কৃষ্ণ, কিংবা পেঁচার অবয়ব। তার উপর দেওয়া হয় উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ।
বর্ধমানের নতুনগ্রাম, দাঁইহাট, পাটুলি, কাষ্ঠশালী সব জায়গা এখন কাঠের প্যাঁচা সারা বছর জেগে থাকে - রংদার হুতুম,গম্ভীর হুতুম, দায়িত্বশীল হুতুম,নিরীহ হুতুম,বেচারা হুতুম হাজার প্রকার তার ভাবভঙ্গি৷  কলকাতার ঘরে ঘরে কাঠের প্যাঁচার কদর হয়েছে৷ তার গোল গোল চোখ, রঙিন নকশার ডানা সব কিছু নিয়ে সেও বড় আদরের বাহনবাবু৷ ওদিকে দশকর্মার দোকানেও প্যাঁচা পাওয়া যায়৷ তার আবার গায়ের রং লাল৷ পুজোর সময় তাকে বসতে হবে মায়ের আসনে৷ সে আবার অত গোলগাল নয়৷ তার আবার চেহারা লম্বাটে৷ সব মিলিয়ে এখন প্যাঁচার বাজার বেড়ে চলেছে শুধু কলকাতায় নয় জেলাতেও 
ইদানীং কালে থিম পুজোর দৌলতেও নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলের কিছুটা হলেও রমরমা বেড়েছে। কখনও পেঁচার আকারে মণ্ডপ, কখনও বা পুতুলের আকারে দুর্গা প্রতিমা। শহুরে নাগরিকের কাছে নতুনগ্রামের কাজের চাহিদা তুঙ্গেবাঙালির বসার ঘরে এই ধরণের আসবাব বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে আর দামও খুব একটা বেশি নয়। সাধারণ সোফা সেটের দামই পড়ে যায় কুড়ি হাজার টাকার কাছা কাছি, তখন দুটো একসঙ্গে তিন জনের বসার চেয়ার, দুটো এক জনে বসার চেয়ার একটা টিপয়ের দাম এই বাজারে হাজার পনের টাকা। আসবাবে নানান ধরণের রঙের ব্যবহার বাঙালির বসার বা শোয়ার ঘরে যে নতুন ধরণের শিল্প শৈলীর ছোঁয়া দিয়েছে, নতুন পরিচয় দিয়েছে পরিবারকে সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
এর ফলে প্রায় লুপ্ত হবার থেকে বেঁচে গিয়েছে বহু শিল্পী পরিবার। আজও সেই গ্রামগুলি গেলে, মানুষগুলিকে নিরন্তর কাজ করতে দেখলে, প্রয়াত নীরব এক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শিল্পপৃষ্ঠপোষক রঘুনাথ গোস্বামীর চেষ্টার কথা, শিল্পের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা বার বার মনে পড়ে। তাঁর হাত ধরে বাংলার শিল্প বহুনবার সাগর পাড়ি দিয়েছে – কখনও রাশিয়া, কখনও আমেরিকা, কখনও ইওরোপের কোনও দেশ। তিনি বিলাসবহুর পাঁচতারা সরাইএর সাগ গোজের পরিকল্পনা করতে বাংলার আলপনা যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন, তার শুধু ব্যতিক্রমীই নয়, নয়নভিরামীও বটে। তাঁর কাজ নতুন পথ দেখাবার কাজ করেছিল, কিন্তু তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী হল না।

আদতে ইতিহাস প্রমাণ কখনও কখনও একজন মানুষের প্রচেষ্টা পাল্টে দিতে পারে একটি সম্প্রদায়ের জীবন, থামিয়ে দিতে পারে বিশ্বায়নের লুঠেরা রথ, সেই অন্তত বেশ কয়েকটি কাজ আজও গ্রাম বাংলার অর্থনীতি, ঐতিহ্য, পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার রঘুনাথবাবুর কাজ অন্তত সক্কলে ভুলে গেলেও কিছু মানুষের মনে থেকে যাবেন চিরকাল।