Monday, January 21, 2013

Traditional Houses of Bengal5, বাঙলার বাড়ি৫


বাঙ্গালা দেশে যে এইরূপ ঘর অনেক ছিল, তাহার প্রমাণ শুধু পল্লী-গীতিকায় নহে আইন-ই-আকবরিতেও আছে আবুল ফজল লিখিয়াছেন, বাঙ্গালীদের ঘরগুলি প্রধাণতঃ বাঁশ দ্বারাই নির্ম্মিত হইয়া থাকে ইহাদের কতগুলি ৫০০০টাকা বিংবা ততোধিক অর্থ ব্যয়িত হয় এই ঘরগুলি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় একখানি ঘর প্রস্তুত করিতে ৫০০০ এবং ততোধিক টাকা সে সময়ে ব্যয় হইত, এখনকার দিনে ঐ টাকার মূল্য অনেক অধিক
ভেলুয়া নামক গীতিকায় সদাগরের বাড়ী ও জাহাজগুলির যে বর্ণনা পাওয়া গিয়াছে, ভাবিয়াছিলাম উহা নিছক কল্পনা, কিন্তু এখন মনে হইতেছে ঐ বর্ণনায় অতিরঞ্জন থাকিলেও তাহা সত্যের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত
ছাওয়ার জান মিঞার বাড়ীর মত সাবেকী ধরনের ঘর এখনও বঙ্গদেশের নানান স্থানে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় নিগৃহীত হইয়া পড়িয়া আছে দৃষ্টান্তস্থলে আমরা বীরভূমের অন্তর্গত সীমাত্ গ্রামের একজন ব্রাহ্মণের বাড়ীর ঘরের আলাদা উল্লেখ করিতে পারি গ্রামখানি বোলপুর হইতে ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত ঘরের মধ্যে নানান কারুকার্য, তাহা বেতের বাঁধনে ময়ূর, ফুল ও নানানরূপ মূর্ত্তি তুলিয়া সম্পাদিত হইয়াছে কাঠের কাড়ার মধ্যে নানানরূপ মূর্ত্তি খোদাই করা ঐ ঘরখানি ২০০ বত্সর পূর্ব্বে তৈয়ারী হইয়াছিল ত্রিপুরা এস্টেটের রাজধানী আগরতলায় কর্ণেল মহিমচন্দ্র ঠাকুরের ঐরূপ একখানি ঘর ছিল, তাহার ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান খুলনা জেলার আসাসনি গ্রামের নিকট কোনও এক পল্লীতে প্রতাপাদিত্যের সময়কার কাঠের একখানি ঘর ছিল, তাহাতে কাষ্ঠনির্ম্মিত নানান দেবদেবী ও মানুষ এবং পশুপক্ষীর মূর্ত্তি গৃহের খুঁটি ও প্রাচীরের শোভা বর্ধন করিত, তাহার কিছু কিছু উপাদান আমার কাছে আছে বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রের গ্রামে ডাক্তার দেবেন্দ্রনাথ হাজরা, এম এ ও তাঁহার জ্ঞাতিবর্গের বাড়ীতে সারওয়ার জান মিঞার ঘরেরমত এখনও একখানি প্রাচীন ঘর বিদ্যমান যিনি আমাকে এই সংবাদ দিয়াছেন, তিনি বললিলেন এই ঘরখানির শিল্প-কার্য্য অদ্ভুত বেতের বাঁধনে ও কাঠের কাজের মনুষ্য ও পশুপক্ষীর মুখ অতি উত্কৃষ্টভাবে নির্ম্মিত হিয়াছে বর্মবৈচিত্র্যে, সূক্ষ্ম কারুকীর্য্যসম্পদে, ও অভ্রখচিত নানারূপ মনোহর চারুকলায় প্রাচীন ঘরখানি এখনও দর্শনীয় হইয়া আছে এই একখানি খড়ো ঘর নির্ম্মাণ করিতে যে অর্থ ব্যয় হইয়াছে তাহাতে অনায়াসে একখানি দ্বিতল বাড়ী নির্ম্মিত হইতে পারিত
কবিবর নবীনচন্দ্র সেন, আমার জীবন পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডে(৬ পৃষ্ঠা) ৬০ বত্সর পূর্ব্বে নির্ম্মিত এইরূপ কতগুলি ঘরের উল্লেখ আছে তিনি লিখিযাছেন, রাজার ঝি দীঘির পাড়ে(নোযাখালি, ফেণী মহকুমায়) এই গৃহগুলি দেশায় ঘরামীরা ১৮৭৪ খৃঃ অব্দে নির্ন্মাণ করিয়াছিল প্রত্যেক ঘরের স্বতন্ত্র আকৃতি, প্রত্যেক ঘরের পনের কি বিশ চাল, নানারূপ কোন চক্রে প্রত্যেক ঘরের স্ব৬তন্ত্র শোভা এ অঞ্চলে কি কোন অঞ্চনে এমন কবিত্বপূর্ণ বাঁশের ঘর কেহ কখনও দেখে নাই বাঁশের কুটীর যে এমন সুন্দর হইতে পারে, এ ধারণাও কাহারও ছিল না এ অঞ্চলে এ সকল ঘর লইয়া মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গেল বহুদূর হইতে দলে দলে লোক এই সকল গৃহ দেখিতে আসিতে লাগিল
...এই সকল শিল্পীদের আমরা কেনও উত্সাহই দিই নাই তাহারা শুকাইয়া মরিতে বসিয়াছে আমরা কারিন্থিয়ান ও গথিক স্থাপত্যের আলোচনায় ততক্ষণ প্রাজ্ঞ হইয়া ডাক্তার উপাধির জন্য বিলাত পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিয়ায়াছি শিল্প-লক্ষ্মীর যে বাড়ির এত কাছে, তাহার সন্ধান লই নাই

Traditional Houses of Bengal4, বাঙলার বাড়ি৪


যিনি নিজ চক্ষে এই ঘরখানি না দেখিবেন, তিনি এই শোভার একটা ধারনা করিতে পারিবেন না প্রতি অবকাশ স্থল, প্রত্যেক রুয়া, ছাটন, ফুরশি এমন সামঞ্জস্য-সহকারে নিয়মিত এবং প্রত্যেক জিনিষের ব্যবধান এরূপ সুনিয়ন্ত্রিত যে মনে হয় যে কারিগর প্রতি সূক্ষ্ম কার্য্যের জন্য গজকাঠি হাতে করিয়া কাজ করিয়াছেন কিন্তু আমাদের দেশের এই শিল্প শিক্ষা বংশানুক্রমে এরূপ বিশুদ্ধভাবে হইয়া আসিয়াছে, যে কোন গজকাঠি বা মানদণ্ডের সাহায্য ব্যতিরেকে সমস্ত জিনিষ কারিগরের স্বতঃসিদ্ধজ্ঞাণে সম্পাদিত হইয়াছে চালটা পূর্ব্বে দুই হস্ত পরিমিত পুরু ছিল, এখন উহা অত পুরু নাই এই পুরু চালের মধ্য মধ্যে সুদর্শন আবের চিত্রিত ছবির কারিগরী সর্ব্বত্র অপরূপ বিবরণ ৪ খানি চালা, চালা হইতে মুখপাত পর্য্যন্ত এক একটি ধয়ো ৪০ হাত ঘরের দৈর্ঘ্য ৩৫ ফিট এক একটি আঠনও ৩৫ ফিটন ঘরখানি প্রস্থে ৩০ ফিট, খাডাই ২৪ ফিট এক একটি  চালে ৯০টি ধয়ো, ৫৪টি আঠন ১৮৫টি ফুরশি, ৪৫০টি ছাটন, ১৭০টি সনা, ১৪টি পট, ৭টি পুখপাত, ৫টি পাড়, ৪০টি ডাফ, ১০টি খুঁটি, বারান্দায় ৮টি খুঁটি(ভিতরে) ও ২০টি তীর উপরিভাগে একটি ঢালা
ছাওয়ার জান মিঞা এখন জীবিত নাই তিনি অতি বৃদ্ধ বয়সে মারা গিয়াছেন তাঁহার পুত্রেরই বয়স প্রায় ৫০ এই ঘরখানি প্রায় ৮০ বত্সরের উর্দ্ধকাল হইল নির্ম্মিত হইয়াছে পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে, সেই সময় ইহাতে ব্যয় পড়িয়াছিল ১২,০০০(বার হাজার) টাকা তখন বাঁশ, বেত প্রভৃতি উপকরণের মূল্য এবং শিল্পীদের দক্ষিণা অতি অল্প ছিল সেই সময়কার একখানি খড়ো ঘরে যে বার হাজার টাকা ব্যয় হইতে পারে তাহা অসম্ভব মনে হইবে, কিন্তু ঘরখানি ভিতর দাঁড়াইলে মনে হইবে যে এখন যদি উহা কেহ নির্ম্মাণ করিতে চাহেন তবে উহা অপেক্ষা অনেকগুণ খরচ করিয়াও কারিগরের অভাবে তিনি সফলকাম হইবেন না কথিত আছে কোন বড় লোকের মেয়েকে ছাওয়ার জান বিবাহ করেন, তিনি পিত্রালয়ে বড় পাকা বাড়ীতে বাস করিয়া স্বামীগৃহের খড়ো ঘরের কথা শুনিয়া একটি ক্রুর ইঙ্গিত করিয়াছিলেন মিঞা মনে বড় দাগা পাইয়া তাঁহার জন্য এমন একখানি খড়ো ঘর তৈরী করাইলেন, যাহা একন বহু দূর হিতে লোকে দেখিতে আসে, অথচ ছাওয়ার জানের শ্বশুরের প্রাসাদোপম গৃহের শেষ ইষ্টকখানাও এখন বিলুপ্ত হইয়াছে, খড়ো ঘরের মহিমায় লোকে এখনও মুগ্ধ হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেবারাধনা বা রমনীর প্রেমের প্রেরণা পাইয়া চিরকাল বিকাশ পাইয়াছে
চালের খুব পুরু ও শক্ত গাঁথুনির দরুন ঘরের নিচের দিকটায় বহু বত্সেরও একফোঁটা জলও প্রবেশ করিতে পারিত না, এই জন্য চালের নিম্নভাগ নানানরূপে সজ্জিত করা হইত অনেকসময় ময়ূরের পাখা এবং সময়ে সময়ে মাছরাঙ্গা পাখীর পালক দিয়া তাহা সাজানো হইত(মাছুয়া পক্ষের পাখা দিয়া সাজুয়া বানায় মলুয়া, পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা, ২য় ভাগ, ১ম খণ্ড, ৬২ পৃঃ) উত্কৃষ্ট ঘরগুলি যে সকল বাঁশ ও বেত দিয়া নির্ম্মাণ করা হইত তাহা সাধারণ বাঁশ ও বেত অপেক্ষা অনেক ভাল, কারন তাহা গৃহস্থেরা আলাদা রকমের চারা তৈয়ারী করিয়া যত্নের সহিত উত্পাদন করিত সময়ে সময়ে একটি সুদ্ধি বেত ২৩শত হাত লম্বা হইত এখনও পূর্ব্ববঙ্গের কোন না কোন পল্লীতে সেরূপ বেত জন্মান হয় খাঁটী বাঙ্গালী ঘরের সকল কাজই বাঁশ, বেত ও ছন দিয়া সম্পাদিক হইত, ূতা দিয়া কাঁথা বা শালে নানারূপ ফুল, লতা ও জীবজন্তু প্রস্তুত করা হয়, শুধু শুদ্ধিবেত দিয়া সেইরূপ কারুকার্য্য হইত, সেই বেত চাঁচিয়া সরু সুতারমত সূক্ষ্ম করা হইত বাঁশের দ্বারা নানানরূপ জীবজন্তুর মুখ ও অবয়ব নির্ম্মিত হইত সুতরাং খাঁটী বাঙ্গালী গৃহস্থ খুব কমই কাঠ প্রভৃতি অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করিতেন যত অল্প ব্যয়ে সম্ভব, পুরাণ শাড়ীর সুতা বাহির করিয়া যেরূপ কাশ্মীরা শালেরমত কাঁথা তৈরী হইত, এই সামান্য সামান্য উপকরণে তদ্রুপ বাঙ্গালার পল্লীর সুদর্শন অপূর্ব্ব কারু খচিত ঘর তৈয়ারী হইত এককালে বঙ্গ দেশে এইরূপ ঘর অনেকেই প্রস্তুত করিতেন এদেশে পাকাবাড়ী নির্ম্মাণ নিরাপদ ছিল না, অথচ যে সকল শিল্পী অজন্তা-গুহা ও মগধের রাজপ্রাসাদ কারুকার্য্য-খচিত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা সেই পৈতৃক শিল্প-বিদ্যার যাদুকাঠি ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত হন নাই রাজার ঐশ্বর্য্য ও মর্ম্মর এবং কৃষ্ণপ্রস্তরের আসবাব তাঁহারা কোথায় পাইবেন সুতরাং বেত ও বাঁশের সামান্য উপকরণ লইয়া তাঁহারা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিতে লাগিলেন এদেশ দেবী ভারতীর নিজস্থান, তাই প্রকাণ্ড বিহারগুলির শ্মশানে খড়ো ঘরের টোল বসিয়াগেল, - ভারতীয় আসন টলিল না যে সকল শিল্পী তাঁহাদের অত্যাশ্চর্য শিল্প-মহিমায় জগত বিষ্মিত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা অমূল্য উপকরণের অভাবে, ছেঁড়া কাপড়, ছুঁচ, সুতা, পিঠালী, বাঁশ, বেত, ও খড় লইয়া বসিয়া গেলেন এই স্থান শিল্পের জন্মস্থান, যতবার সেই শিল্প নষ্ট করিবে ততবার তাহা ভিন্নরূপ লইয়া মাথা গজাইবে

Traditional Houses of Bengal3, বাঙলার বাড়ি৩


ছাওয়ার জান মিঞার খড়ো ঘর, পোঃ মধুখালি, গ্রাম বনমালদিয়া, জেলা ফরিদপুর এই ঘরখানি প্রথমে ওস্তাদ রাজলোচন ঘরামী প্রস্তুত করিতে উদ্যত হইয়া শেষে ভয় পাইয়া মিঞার নিকট অস্বীকার করে কিন্তু তাহার এক আনাড়ী সাগরেত্ মহিম নমঃশূদ্র এই ঘর অতি প্রশংসা ও গৌরবের সহিত সমাধা করে ইহা প্রস্তুত করিতে প্রায় একশত বত্সর পূর্ব্বে ১২,০০০টাকা খরচ পড়িয়াছিল পূর্ব্বে এই ঘরে একটিমাত্র আলো জ্বালাইলে সমস্ত ঘরখানি মিনাপাত এবং অভ্রে প্রতিবিম্বিত হইয়া আলোকিত হইত কিন্তু বর্ত্তমানে মিনাপাত একেবারেই নাই, অভ্র কিছু আছে যে ঘরামী দিনে একটিমাত্র রুয়ো প্রস্তুত করিতে পারিত সে চাকুরী পাইয়াছে, এবং মহিম নাকী প্রতিটি জিনেষরই পরীক্ষা করিবার জন্য জিনিষগুলির উপর দিয়া একগাছি রেশমী সুতো টানিয়া লইয়া যাইত, যদি সুতোটি ছিঁড়িয়া যাইত তবে বুঝা যাইত যে জিনিষ ভালভাবে মসৃণ হয় নাই পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে, এই চিত্রবিচিত্র সর্ব্বাঙ্গসুন্দর শিল্পীর তপস্যার ফলস্বরূপ ঘর খানি দেখিলেই অজন্তার কারিগরদিগের কথা মনে পড়িবে সে সার্ব্বভৌম রাজচক্রবর্ত্তীরা আর নাই, সুতরাং পাথরের সেই বিরাট স্বপ্ন গড়িবার পরিকল্পনা কে করিবে! কিন্তু তথাকার কারিগরের বংশধরেরা যে সেই অপূর্ব্ব শিল্প তাঁহাদের দীন দরিদ্র উপকরণ লইয়া এইরূপ শ্রদ্ধা ভক্তি ও তপস্যার অর্ঘ্যে সাজাইয়াছে, তাহাতে কে সন্দেহ করিবে! ধন্য সেই শিল্পীকুল তাহারা নাম যশ অর্থ চাহে নাই কিন্তু বহু কষ্ট, দারিদ্র্য ও অভাব উপেক্ষা করিয়া যুগ যুগান্তরের তপস্যার ফল লইয়া আসিয়া আমাদিগকে দিয়াছে যদি তাহারা অর্থ কি প্রতিষ্ঠা চাহিত, তবে এ তপস্যার ফল দেশের দুর্দ্দিনে আমরা পাইতাম না শিল্প ছিল তাহাদের হোমকুণ্ড, অনাহারে, অর্দ্ধনগ্নদেহে এই অহিতাগ্নিগণ সেই হোমানল জ্বালাইয়া রাখিয়াছে আমরা মূঢ়, দুপাতা ইংরেজী শিখিয়া ইহাদিগকে ঘৃণা করিতেছি, কলাকক্ষ্মী মুখ ফিরইয়া একটু অশ্রু মুছিতেছেন

Traditional Houses of Bengal2, বাঙলার বাড়ি২

চার চালা বিশিষ্ট, সে দেশে ইহাকে চৌরী ঘর বলে পূর্ব্ববঙ্গে এরূপ ছন জন্মে তাহাকে উলুছন বলে এই উলুছনের উল্লেখ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকায় অনেক-স্থলে পাওয়া যায় সাধারন ছন হইতে এই উলুছন দীর্ঘ, সূক্ষ্ম ও অনেককাল স্থায়ী এই উলুছনকে খুব কায়দা করিয়া কুলিছন তৈরী করিতে হয় মুঠির মধ্যে উলুছন এক এক আঁটি ধরিয়া তাহা ছাঁটিতে হয়, কোন একটি খড় বড় বা ছোট না হয় এই ভাবে বাছাই হয় এবং সমান করিয়া কাটিতে হয় তত্পরে এই কুলি ছনের এক একটি আঁটি বিস্তৃত করিয়া সাজানো হয় চালের উপর ছন খুব পুরু করিয়া প্রত্যেকটি স্তর নির্ম্মিত হয়, প্রত্যেক ছনের ছয় ইঞ্চি ব্যাপক ছনের স্তরের উপর আঁঠন(বাঁশের চটা উহা খুব সরু করিয়া গোলাকৃতি করে তাহারই নাম ছাওনা কাঠি) এইরূপ স্তরে স্তরে কুলিছন চালের সঙ্গে বাঁধিয়া ঢালা (উপরের দিক) পর্য্যন্ত লইয়া যাওয়া হয় উপরের দিকটা ঐ ছনই মোড় দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া এমন করিয়া বাঁধে যে তাহা দেখিতে খুব সুন্দর হয় এই ঢালের নীচের দিকটা অতি সরু কারুকার্যময় পাটী থাকে এই পাটীকে পূর্ব্ববঙ্গে শীতলপাটী বলে ইহার দাম খুব বেশী কখনও কখনও একখানির দাম ৫০০ টাকাও হইয়া থাকে শীতলপাটীতে আটকাইবার জন্য ছাটান(সূক্ষ্মভাবে চাঁচা বাঁশের চটা) ব্যবহৃত হয় পাশাপাশি প্রত্যেক চার আঙুল পরে পরে ছাটান ছাটান থাকে, ছটানগুলির সঙ্গে ফুরোসা(ছাটান হইতে বড় অর্দ্ধ গোলাকৃতি চাঁচা বাঁশ) বক্র এবং আড়িভাবে আবদ্ধ থাকে এই ফুরোসার সহিত দড়ি(তাইতা) দিয়া চালের উপরকার আঁটন আবদ্ধ থাকে এই সমস্ত বাঁধনে কুলি ছন খুব শক্তভাবে আঁটা থাকে ফুরোসার সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন পাকা বাঁশের নাতিস্থূল গোলাকৃতি রুয়ো আড়াআড়িভাবে বাঁধা হয়, ইহাতে চাল এতই শক্ত হয় যে কেহ চালের উপর তাণ্ডব নৃত্য করিলেও তাহা হেলে না রুয়োকে আটকাইবার জন্য বাঁশের চটা সর্বনিম্নে আবদ্ধ হয়, এই প্রশস্ত চটাকে মুখজোত বলে চালের একেবারে সম্মুখের সাজানো দিকটাকে মুখপাত বলে এখন ঘরের মধ্যে গিয়া উর্দ্ধে তাকাইলে যে দৃশ্য দেখা যায় তাহা বর্ণনাতীত, যে সকল বাঁধ ও আঁটনের কথা বলা হইয়াছে, সেই সমস্তই নানান বর্ণের রঞ্জিত ও তাহার প্রত্যেকটিতে অসীম ধৈর্য্যের পরিচায়ক শিল্পকার্য্য আছে বিচিত্র বর্ণের ফুল ও লতাতে উপরকার দৃশ্য অতি মনোরম হয় নানান কারুকার্য্য মণ্ডিত খুঁটির সঙ্গে কাঠের ডাফ দিয়া চাল আঁটা হয় এই ডাফগুলির কোনটি নরাকৃতি, কেনটি হাতীর শুঁড়ের মত, কোনটীতে পরী ও অন্য কোন জীবজন্তুর মূর্ত্তি গড়া থাকে যেখানে যেখানে বেতের গোরা, সেইখানে সেইখানে বিচিত্রবর্ণ পশুপক্ষী ও ফুল পল্লবের কারিগরী সুন্ধী বেত অতি সূক্ষ্ণভাবে চাঁচিয়া তাহাতে নানান কায়দা করিয়া লতাপাতা বা ফুলের আকারের গেঁড়োগুলি (গ্রন্থি) গড়া হয় নিম্ন হইতে ঊর্দ্ধে তাকাইলে মাঝে মাঝে শীতলপাটী ও বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত গেঁড়ো এবং ঠেকাগুলি অদ্ভুত অদ্ভুত মূর্তিতে এমন শোভাময় দেখায় যে চক্ষু সেই চারু দৃশ্যে ভুলিয়া যায় খাম্বা অথবা বাঁশের খুঁটিতে যে বাঁশ থাকে এবং যাহার সঙ্গে চাল আঁটা থাকে তাহাকে পাড় বলে আবার ঘরের ভিতর চালাকে শক্ত ও উঁচু করিয়া রাখিবার জন্য ডাফের যে সরু বাঁশ দিয়া চালা বাঁধা থাকে তাহাকে রুয়ো আঠান বলে এই শিল্প-শোভা প্রতিপদে অজন্তার ছাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়

Traditional Houses of Bengal1, বাঙলার বাড়ি১


আমাদের ডাক ও খনা এ বিষয়ে নীরব নহেন, তাঁহাদের সূত্র বাঙ্গালার কৃষকগণের মুখে মুখে পূবে হাঁস(পার্ব্বদিকে জলাশয় কথায় হংস বিচরণ করিবে), উত্তরে বাঁশ, পশ্চিমে ঘিরে, দক্ষিণে ছেড়ে, বাড়ী করগে ভেড়ের ভেড়ে বংশীদাসের পদ্মপুরাণএ তারাপতি নামক কর্ম্মকাররাজের যে লৌহ-গৃহ-নির্ম্মাণের বর্ণনা আছে, তাহা পড়িলে শিল্প-সমারোহের সহিত পুরাকালে আমাদের হর্ম্মাদি নির্ম্মিত হইত তাহার একটা আভাষ চোখের সম্মুখে উপস্থিত হয় ...বংশীদাসের বর্ণনায় স্থপতিশ্রেষ্ঠ তারাপতির রূপবর্ণনা পড়িলে মনে হয় যে এই জাতীয় লোক যে ভিন্ন দেশবাসী, তাহার একটা সংস্কার কবির মনে ছিল 
যখন নদী ভীঙনের ভয়ে পাকাবাড়ী তৈরী করা নিরাপদ বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, তখন বঙ্গদেশের স্বাভাবিক শিল্পানুরাগ খড়ো ঘরেই যথাসাধ্য প্রযুক্ত হইয়াছিল পূর্ব্বকালে ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে এই খড়ো ঘরগুলির জন্য লোকেরা মুক্ত হস্তে অর্থব্যয় করিতেন তাঁহাদের স্বভাবিক শিল্প-শক্তির এমন সকল নমুনা এই খড়ো ঘরে প্রদর্শিত হইত যে, এখনকার দিনে তাহার একটা ধারনা করা শক্ত পূর্ব্বঙ্গের গীতিকায় অনেকস্থলে সূক্ষ্ম শিল্পকলা খড়ো মন্ডিত ঘরের উল্লেখ পাওয়া যায় মলুয়া গীতিকার নায়ক চাঁদ বিনোদ এবিষয়ে একজন ওস্তাদ ছিলেন তাঁহার খড়ো ঘরের রচনার কথা সেই গীতে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হইয়াছে মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে কোন কোনটিতে সাহু বেনের স্ত্রী অমলার উদায়তারা নামক ঘরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়, তাহার কারুকার্য মণিমুক্তার ঝালর ও সোণার টুনি প্রভৃতির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহাতে মনে হয় যে বাঙালী বণিকের বিশ্ব-ব্যাপক বাণিজ্য ছিল, তথন ঐ সকল খড়ো ঘরের পাছে অজস্র অর্থ ব্যয় হইত ...পূর্ব্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার নদুখালি গ্রামে(উক্ত স্থানে থানা ও বি আর এর ষ্টেশন আছে) স্বর্গীয় ছাওয়ার জান মিঞার বাড়ীতে ওইরূপ একখানি ঘর আছে ময়মনসিংহ-এঞ্চলে কোন কোন স্থানে দুই একটি তদ্রুপ ঘর আছে বলিয়া আমরা শুনিয়াছি ...এখন পাকাবাড়ী অন্ততঃ টিনের ঘর লোকের আদরণীয় হইয়াছে খড়ো ঘরের জন্য কে আর এত শ্রম অর্থব্যয় করিবে! ...যেসকল গুণ এদেশের ভূষণ ছিল, যাহা মিগাস্থিনিস, হিউনসাঙ্গ, ফাহায়েন প্রভৃতি বিদেশী পর্যটকেরা শতমুখে প্রশংসা করিয়াছেন, সেই সত্যবাদিত্ব, সারল্য ধর্ম্মভয় বাঙলা দেশ হইতে তিরোহিত হইবার মধ্য আসিয়াছে১০ হাজার টাকা খরচ করিয়া অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় ...ছারোয়ার জান মিঞার বাড়ীর কতকটা ধারনা  নিন্মলিখিত বিবরণে পাওয়া যাইবে

Sunday, January 20, 2013

SOUTH & SOUTH EAST ASIA HAAT: Asian Rural Culture and Technology Exposition


SOUTH & SOUTH EAST ASIA HAAT: Asian Rural Culture and Technology Exposition At Gurusaday Museum Ground, West Bengal, Bharat, 10th to 20th May, 2013
Looking Inwardly – Call for Grass-root-level Crafts Technology Collective Activism

Bongiyo Paromporik Kaaru O Bastra Shilpi Sangho is a grass-root non-funded organization of the State of West Bengal, Bharat, organizing fellow artisans, craftspersons, weavers and performing artists for last three years. More than 2000 artisans have been organized throughout the state. This is the first initiative of Bharat where artisans came together themselves to address various issues of livelihood as also protect their rights. Last year it has organized North Bengal Festival, UTTORRONGO 12, without any institutional funding with a great success.
THE vital part of cultural history of Asia is eroding rapidly for last two centuries. Most of the traditional artisan and communities are feeling the heat of the changing scenario. They are evicted from their age old professions & loosing their identity fast. They are the majestic communities from time immemorial playing magical tri-roles as a creative genius, traditional engineer/keeper of people technology & market their own products. These Communities created Iron Pillar of Delhi, cave art of Ajanta-Ellora, Barbudur, AnkorVat, numerous Buddhist Hinyan-Mahayan Stupas, Mandirs across the world.
Of late western centralized technology, new marketplace, new ethos, new technologies driving these people & cultures out from their natural habitat. It is a glorious fact that prior to circa 1800 countries of South & South East Asia was the centre of the earth along with China & Parsia. This region used to produce more than 80% of the world industrial production. Most of the industrial & agricultural exports become monopoly. Even these communities exported technology around the world. The European domination changed the socio-eco-cultural scenario by force, loot, treachery and destruction. It extracted not only money, but steals and then destroyed intellectual resources like knowledge, production process, management patterns which are the foundation of South-East Asias’ Culturescape.
Sitting on these unfathomable looted resources and ideas, the West per se, planned a destructive and centralized industrial revolution. It is a no denying fact that so-called industrial revolution going to doom the world. Scientists fear that the world human civilization may be extinct in less than 100 years. The centrally controlled mass producing technologies and the urge of making filthy profit of the dominating west, where human are treated as a surplus, are killing the mankind day by day. The English speaking socio-political elites imposed world-destructive western technology in Asia.
The answer of this centralized culture is Asia’s own time tested rural not-for-filthy-profit-making technology and lifestyle. Still the world has not understood its potentiality. Even today the hand weaving Sarees are the best in quality, the iron products of the traditional metalsmiths do not attract rust, food prepared by fire wood test best, traditional agriculture are coming again with a bang, even the home remedy can cure various ills.
The need of the hour is to look & act inward. Small is beautiful. It is not the alternative technology, this is Asia’s own technology. We need to break the shackle.
The craftspersons of Bangladesh, Bharat are calling all the grassroot level initiatives of Asia working hand in hand to save their tradition, technology & culture. They need to come together to make a mark & to change the course of the pattern of development. The need of the hour is to make a loose international federation of all the grassroot level organizations working to strengthen and revive their own traditional culture. As a grassroot organization undersigned six organization’s of Bharat I Bangladesh are calling the village dwelling sisters & brothers of the South East Asia to come together to save the world, to save the humankind, to save own culture & resources. To make this possible a South East Asian Rural Cultural Federation is need of the hour, before it is too late. Before doing this venture, we need to know each other, we need to talk each other, we need to understand the process of coming together.
In this initiative we certainly love to have more and more organizations/federations of South & South East Asia to put their footprint to make this a true peoples’ initiative. To make this possible the undersigned are proposing a SOUTH & SOUTH EAST ASIA HAAT: Asian Rural Culture and Technology Exposition in the state of West Bengal at the Courtyard of Gurusaday Museum from 10th to 20th May, 2013, where these grassroot organization’s will come together, share their experiences and make this idea of federation a reality.
As a true grassroot organization we could not offer you passage money, but the local hospitality - 10 day stay, food, fair stall and local sight scène.

For the grassroot level technology initiative, Abul Hussain, International Federation of Hawkers & Urban Poor, Bangladesh, Biswendu Nanda, Kalaboti Mudra, West Bengal, Bijan Mondal, Gurusaday Museum & Banglar Bratachari Samity, Madhumangal Malakar, Bongiyo Paromporik Kaaru O Bastra Shilpi Sangho, West Bengal, Om Pradhan, Nepal Artisan Association, C Bhutia, Bhutan Crafts Organization

Friday, January 18, 2013

What Sold in a Bengal Market in Pre-British Period, ব্রিটিশপূর্ব সময়ে বাঙলার বাজারে কী বিক্রি হত

১৭৫০ নাগাদ সুতালুটী বাজার আর শোভা বাজারে কী কী বিক্রি হচ্ছে এবং সেসময় কোন কোন দোকানের জন্য কর চাওয়া হচ্ছে, অথবা রপ্তানির জন্য কী কী মালের ওপর কর নেওয়া হচ্ছে, কোলকাতা সেকানের একালের থেকে এবং আরও অন্য সূত্র থেকে ১) কড়ি, ২) সরষের তেল, ৩) সুতো, ৪) ওষুধ, ৫) লোহার নানান দ্রব্য, ৫) টায়ার(চাকা!), ৬) দুধ, ৭) জ্বালানী কাঠ, ৮) তালগুড়, ৯) খড়-বিচালি, ১০) মিঠাই, ১১) মাদুর, ১২) কামারের দোকান, ১৩) বাঁশ, ১৪) রূপোর স্যাকরা, ১৫) কাংশ্য দ্রব্য, ১৬)পান, ১৭) সুপারি, ১৮) ফলমূল, ১৯) ফলমূল ও শাকসব্জী, ২০) গাছ, ২১) আখ, ২২) তাঁতি, ২৩) কলা, ২৪) তেঁতুল, ২৫) চাল, ২৬) মাছ বিক্রেতা, ২৭) পশুমাংস, ২৮) সিদ্ধচাল, ২৯) ধনে, ৩০) কুম্ভকার,  ৩১) চুনের দোকান, ৩২) কাপড় বিক্রেতা, ৩৩) তামাকের দোকান, ৩৪) বেনামী দোকান ৩৫) ধান, ৩৬) ছোলা, ৩৭) জপের মালা, ৩৮) চট, ৩৯) কার্পাস, ৪০) সিঁদুর, ৪১) ফটকিরি, ৪২) তুঁতে, ৪৩) সিদ্ধি, ৪৪) আফিম, ৪৫) আতসবাজী ৪৬) নীল, ৪৭) সোরা, ৪৮) মদ, ৪৯) মধু, ৫০) মোম, ৫১) কাঠ, ৫২) দামি ধাতু, ৫৩) নারকেল, ৫৪) সুতো, ৫৫) সুরকী, ৫৬) ধুনো, ৫৭) গালা, ৫৮) নানান খণিজ দ্রব্য ৫৯) হাতির দাঁত ৬০) চামড়া ৬১) শিংএর দ্রব্য, ৬২) আবলুষ কাঠ, ৬৩) সাদা চিনি ৬৪) গৌড়ি(গুড় থেকে প্রস্তুত), ৬৫) তেজপাতা, ৬৬) গন্ধ দ্রব্য নার্দ(Nardostachys grandiflora), ৬৭) শাঁখের নানান দ্রব্য, ৬৮) জুয়েলারি, ৬৯) কাজু, ৭০) নারকেল, ৭১) বিভিন্ন রং, ৭২) ফুল থেকে তৈরি সজ্জাদ্রব্য, ৭৩) সোনা, ৭৪) ঘি, ৭৫) পাটি

বাঙলায় জাহাজ নির্মাণ, Ship Industry of Bengal


জাহাজ নির্মাণ
কবিকঙ্কণ আর বংশীদাসে বিশদ বর্ণনা আছে কোষা নামক ডিঙির কথা পল্লী গাথায় পাওয়া যায় ইশা খাঁর গীতিতে এই কোষার বর্ণনা আছে ...জাহাজগুলিতে যেটিতে স্বয়ং সওদাগর থাকিতেন এবং যাহা সুসজ্জিত হইত তাহা মধুকর নামে অভিহিত হইত আমরা কাব্যগুলিতে জাহাজের বহু নাম পাইয়াছি তাহার কোন কোনটি বেশ কবিত্বময়, যথা রাজবল্লভ, রাজহংস, সমুদ্রফেনা, শঙ্খচূড়, উদয়তারা, গঙ্গাপ্রসাদ, দুর্গাবর কোন কোন নাম প্রাকৃত-যুগের, যথা গুয়ারেখী, চিয়াঠুটি, বিজু সুজু(বিজয় গুপ্ত) ইহা পুরাকালে যে বৃহদাকৃতি হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই তখন রাজপুত্র ও সওদাগরের পুত্রের মর্য্যাদা প্রায় তুল্য ছিল চাঁদ সওদাগর রাজদণ্ড কেন ব্যবহার করেন, লঙ্কার রাজা এই প্রশ্ন করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, বাঙ্গালা দেশে বণিকেরা রাজারমতই সম্মানিত সপ্তগ্রাম বাঙ্গালার প্রাচীন বন্দর ছিল এখানে জাহাজ নির্ম্মিত হইত সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালে সরস্বতী নদী হইতে বণিকেরা মিঠা পানি তুলিয়া নিত ঐ নদী শুকাইয়া যাওয়ার পর সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য্য হরণ হয় এবং চট্টগ্রাম বঙ্গদেশে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয় চট্টগ্রামে নির্ম্মিত জাহাজে চড়িয়া বাঙ্গালীরা এককালে লঙ্কা, লাক্ষাদ্বীপ, মাটাবাটান প্রভৃতি দেশে যাইতেন নিলক্ষা শব্দ বোধহয় লক্ষাদ্বীপকে, প্রলম্ব প্রম্বনমকে ও আবর্ত্তনা মাটাবানকে বুঝাইছে ...চট্টগ্রাম ও তাম্রলিপ্ত বঙ্গদেশের এই দুই বন্দর বিশ্বশ্রুত চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তারবাসী বালামী নামক এক শ্রেণীর লোক জাহাজ নির্ম্মাণ করিত এখনও বালামীদের বংশধরেরা ছোট জাহাজ নির্ম্মাণ করিয়া থাকে বালামী নোকো ইহাদের নামানুসারে পরিচিত চিন পরিব্রাজক মাহুন্দের লিখিত বিবরণ হইতে জানা যায় একদা তুরস্কের সুলতান আলেকজান্ডিয়ার জাহাজ-নির্ম্মাণপদ্ধতিতে অসন্তুষ্ট হইয়া চট্টগ্রাম হইতে অনেকগুলি জাহাজ নির্ম্মাণ করাইয়া লইয়াছিলেন আরবী লেখক ইদ্রিশ দ্বাদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সহিত বাণিজ্য-সম্বন্ধের উল্লেখ করিয়াছেন তিনি সে দেশের নাম করিয়াছেন কর্ণবুল এই শব্দ কর্ণফুল শব্দের অপভ্রংশ ১৪০৫ খৃঃ অব্দে চীন দেশের মন্ত্রী চেং হো বাণিজ্য-সম্বন্ধে কতগুলি প্রশ্নের সমাধানার্থ স্বয়ং চট্টগ্রামে আসিয়াছিলেন, এবং ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে সুপ্রসিদ্ধ আরবীয় পর্য্যটক ইবনবতুতা চট্টগ্রামের জাহাজ চড়িয়া জাবা ওবং চীনে গমন করিয়া ছিলেন ১৫৫৩ খৃঃঅব্দে পর্ত্তুগীজ নানু ডি চোনা(গোয়ার শাসনকর্ত্তা) তাঁহার সেনাপতি দি মান্নাকে চট্টগ্রামে তাঁহাদের একটা বাণিজ্য-কেন্দ্রস্থাপনার্থ পাঠাইয়া দিয়াছিলেন  ...চট্টগ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক জাহাজের মালিকদের নাম লোকে বলিয়া থাকে তাঁহারা জগতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালাইতেন মুসলমান রজত্বের শেষভাগে তাঁহারা জীবিত ছিলেন রঙ্গ, বসির, মালুম, মদন কেরানি, দাতারাম চৈধুরী প্রভৃতি জাহাজধক্ষ্যদের কেন কেন জনের শতাধিক জাহাজ ছিল ইঁহারা হার্ম্মাদদিগের অত্যাচারের সময় বৃহত্ নৌসঙ্ঘ লইয়া অগ্রসর হইতেন এই শ্রেণীবদ্ধ জাহাজগুলিকে শ্লুপবহর বলা হইত যিনি হার্মাদদিগকে দমন করিয়া খ্যাতি লাভ করিয়ীছেন, তাঁহাকে বহরদার বলা হইত উনবিংশ শতাব্দীর আদিকালেও নাবিকগণের কেহ কেহ জীবিত ছিলেন, পিরু সদাগর, নসুমালুম, রামমোহন দারোগা প্রভৃতির নাম এখোনও শোনা যায় রামমোহন দারোগার জাহাজ বাণিজ্যদ্রব্য লইয়া স্কটলন্ডএর টুইড বন্দরে গিয়াছিল চট্টগ্রাম-নির্ম্মিত কতকগুলি জাহাজের বিবরণ সংক্ষেপে আমরা একানে দিবঃ-
বালাম নৌকা ইহা পূর্ব্বে যত বড় হইত, এখন আর তত বড় হয় না সাধারণতঃ ইহারা ১৬ দাঁড়ে পাল উড়াইয়া চলে ইহাদের মধ্যে বড় গুলি ২০০ এমন কি ২৫০ টন ধান্য বোঝাই লইয়া যাইতে পারে কিন্তু ৫০ টনের অধিক মাল লইয়া ইহাদিগকে সমুদ্র-পথে যাইতে দেওয়া হয় না এই ক্ষিপ্রগামী বালাম নৌকা যন্ত্রাদির সাহায্য বিনাও অনায়াসে ভারত-সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ কাটিয়া চলিয়া যায় এক সময় ইহারা অতি প্রকাণ্ড হইত
গোধা নৌকা ইহাও অতি প্রাচীন এই নৌকাগুলি সচরাচর অতি দীর্ঘ হয় ইহারা সাধারণতঃ শুঁটকি মাছের কারবারের জন্য ব্যবহৃত হয় বর্ত্তমান কালে ইহারা সমুদ্রপথে সোনাদিয়া, লালদিয়া, রাঙ্গাবালী প্রভৃতি বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জে মত্স্যের কারবার উপলক্ষ্যে যাতায়াত করে এই নৌকাগুলি লোহার পেরেক দিয়া আটকানো হয় না গল্লক নামক বেত দিয়া নৌকাগুলি বিভিন্ন অংশ জোড়া দেওয়া হয়, এবং সেই বেতের অবকাশে শ্যামাগুলি(ছিদ্র) দড়ি, ধুনা প্রভৃতি দ্বারা এমন শক্ত করিয়া আটকান হয় যে, তাহাতে জলপ্রবেশের কোন সম্ভাবনা থাকে না গোধা নৌকার ভিন্ন ভিন্ন অংশ খুলিয়া রাখা হয় বর্ষাকালে সেগুলি জোড়া দিয়া নৌকা সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়, ইহাদের গলুই হাঙ্গরমুখো করা হয় যখন বর্ষাকালে সমুদ্রপথ পর্য্যটন করিয়া বিপুল মত্স্যের পশার লইয়া শত শত গোধা নৌকা কর্ণফুলী নদীতে আসিয়া নোঙর করে, তখন সেই মত্স্যব্যবসায়ীদের আত্মীয়স্বজন দামামা, দগড়, ঢোল পিটিয়া ও বাঁশী বাজাইয়া তাহাদিগকে যেরূপ অভিনন্দন করে তাহা একটা দর্শনীয় ব্যাপার
শ্লুপ নৌকাগুলি অনেকটা বালামের মতই, পর্ত্তুগীজ প্রভাবে কতকটা রূপান্তরিত হইয়া ঐ নাম পরিগ্রহ করিয়াছে একটি বড় গাছ কুঁদিয়া নির্ম্মিত হয়
সারেঙ্গা নৌকা কতকটা ডোঙ্গা বা সালটির মত এগুলি সমুদ্রে যাইতে সাহসী হয় না,
সাম্পান অনেকটা হাঁসেরমত আকৃতি, ইহা চীনা নৌকার ধরণে প্রস্তুত
কোন্দা চট্টগ্রামে অরণ্যসমূহের সর্ব্বাপেক্ষা বৃহত্ বৃক্ষ কুঁদিয়া এই শ্রেণীর নৌকা তৈরী হয় ইহা বহু মাল লইয়া যাতাযাত করে, মাঝিরা ইহা লগিদিয়া ঠেলিয়া চালাইয়া থাকে
...অধুনা মাধব, কালীকুমার ও দ্বারকানাথ জাহাজ নির্ম্মাণে খ্যাতি লাভ করিয়াছেন আমাদের স্বদেশী নেতাদের ইঁহাদিগকে উত্সাহ দেওয়া উচিত, দুঃখের বিষয় ইঁহাদের  নাম পর্য্যন্ত অনেকেই জানেন না
পল্লী-গীতিকা-সাহিত্যে নসর মালুম নামক গাথায়(পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা, ৪র্থ খণ্ড, ১-৪৪ পৃঃ) জাহাজ ও সমুদ্রযাত্রাসম্বন্ধে অনেক তত্ব লিপিবদ্ধ হইয়াছে মালুমেরা সমুদ্রপথের সমস্ত বিষয় অবগত হইতেন, তাঁহারা দীর্ঘ পর্যটনের প্রাক্কালে মানচিত্র আঁকিয়া লইতেন এবং নক্ষত্র দেখিয়া দিক নির্ণয় করিতে পারিতেন ...জাহাজের অংশগুলির যে নাম চট্টগ্রামে প্রচলিত আছে, তাহার কয়েকটি এখানে দিতেছিঃ- বাক(রিব), কাহন(ফ্লোর), ইরাক(কিল), সুকানকিলা(কীলসন), গুদস্তা(স্টার্ন পোস্ট), রাজ(স্টেম), মাস্তুল(মাস্ট),মাস্তুলের চালুতা(রেক অব দ্য মাস্ট) ইসকা(ব্যাটেন) নুরন্নেহা ও কবর নামকগাথায়(ঐ, ৯৩-১৩০) নৌ-সৈন্য লইয়া জাহাজের বহর কি ভাবে যুদ্ধ করিতে যাইত তাহার একটা উল্লেখযোগ্য বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে