Tuesday, October 31, 2017

এরা কি অদ্ভুত প্রজন্মের মধ্যে পড়বেন?

Ipsita জনৈকের একটি আবেগ জর্জর লেখা তুলেছেন---
"চারপাশে অদ্ভুত একটা প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দেখি - যারা উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, বিভূতিভূষণ, মানিক... মায় সত্যজিৎ, বুদ্ধদেব, সুনীল অবধি পড়েনি।
এই অপরাধের ক্ষমা নেই।
হে সুকুমার, এদের ক্ষমা করে দিও।"
...
এবারে আমাদের ছোটলোকেদের পাল্টা উত্তর-
পলাশীর পরে যে ১০টা প্রজন্ম - আচ্ছা আচ্ছা পলাশী নয় বাংলা ভাগের পর ৩টি প্রজন্ম --
১) লেটো, জং, জারি, মোর্শিয়া, আলকাপ, ডোমনি, ডাংপুতুল, বনবিবি, সত্যপীর, খন, হালুয়া-হালুয়ানি দেখাতো দূরস্থান নামও বোধহয় জানে না
২) শোলার মুখা, কাঠের মুখা, রাবণকাটা মুখা, ছম মুখা নাচ দেখেনি...
৩) মেল্লি, ধোকড়া, পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ, কাকে বলে জানে না
৪) যাদের জীবনে ঝাঁকসু, কে কে হাজরা, হরকুমার গুপ্ত, জিতেন বর্মন,সুবল দাস বৈরাগ্য, মাধাই দাস মহান্ত দীনেশ-দীপ্তি রায়েদের অস্তিত্বই বেবাক নেই
৫) বাংলায় যে কয়েক হাজার দেশি ধান ছিল তার ১০টার নামও বলতে পরবে না সে চালও চিনতে পারবে না
৬) যাদের জীবন সহরাই, বাঁদনা, গাজন, নীল, মহরম, ঈদ, সয়লার মত পরবে জোড়ে না
৭) যাদের কাছে মধুমঙ্গল মালাকার, নিতাই চন্দ, সাঞ্জুলাল সরকার, নেপাল সূত্রধর, গীতা কর্মকার, ননীবালা, শীতল ফৌজদার, হরিপদ বসাকদের নাম, তাদের কাজের অস্তিত্ব শূন্য
তাদের ক্ষমা করবে কোন সুকুমার?
এরা কি অদ্ভুত প্রজন্মের মধ্যে পড়বেন?

গরীব কাহারে কয়৯ - উন্নয়নের বিশ্ব রাজনীতি তত্ত্ব

এনকাউন্টারিং ডেভেলাপমেন্টঃ দ্য মেকিং এন্ড আন্মেকিং অব দ্য থার্ড ওয়ার্লডঃ আর্তুরো এসকোবারএর বই থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়
THE PROBLEMATIZATION OF POVERTY – তিন বিশ্বের কথা এবং উন্নয়ন
আমাদের সময়ে দারিদ্র একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। প্রত্যেকেই এই শব্দটিকে নিয়ে বিপুলভাবে ধর্ষণও করেছেন আবার ব্যবহারও করেছেন। দরিদ্রের নামে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ হয়। গরীবদের সমস্যার সমাধান করতে হাজারে হাজারে বই ছাপা হয়, বিশেষজ্ঞরা তাঁদের বহুমূল্য রায় দিয়েই থাকেন নিয়মিত। মজার হল যাদের জন্য এই সব আয়োজন, সেই গরীব এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা দারিদ্র দূরকরার মানুষজনও জানেন না আসলে দারিদ্র কাকে বলে। দারিদ্র বিষয়ে বিশ্বজোড়া যে সব সংজ্ঞা আজ চলছে সেগুলি অধিকাংশ ‘উনতা’ বা ‘অনটন’ – এই দুই বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলছে। এটা আসলে দারিদ্র বিষয়ে ভাবনার দারিদ্র। প্রয়োজনটা আদতে কি এবং কার জন্যে? এবং কে এই বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করার কাজে উপযুক্ত – এটা ভাবা দরকার?(Majid Rahnema, Global Poverty: A Pauperizing Myth, 1991)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সব থেকে বড় যে পরিবর্তনটা ঘটে সেটা হল, প্রথম বিশ্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় দারিদ্র্য খুঁজে পেল। তুলনামূলকভাবে অস্পষ্ট এবং বাস্তবিকতায় যুক্তিসম্মত এই আবিষ্কারে বিশ্বজোড়া সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ঘটে গেল বিপুল পরিবর্তন। যুদ্ধ নতুন সামাজিক বাস্তবতায় প্রবেশ করল এবং যুদ্ধ শুরু হল নতুন ভৌগোলিক এলাকায় – তৃতীয় বিশ্বে। পিছনে পড়ে রইল ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই। বিশ্বায়িত আমেরিকার ক্ষমতায়ন নতুন সময়ে ঢুকে পড়ে, শুরু হল সারা বিশ্বজুড়ে নতুন এক লড়াই। তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এক্কেবারে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের সামনের সারিতে এসে বসল। নতুন যুদ্ধের সমর্থনে নানান ধরনের মনোলোভা তথ্য অস্ত্রশস্ত্ররূপে পরিবেশিত হতে থাকল, ‘১৫০০০০০ মিলিয়ন মানুষ, মোটামুটি বিশ্ব জনসংখ্যার দুইতৃতীয়াংশ, শনাক্তযোগ্য অপুষ্টির কবল আর অবর্ননীয় দারিদ্রের কবলে পড়ে আছে। এই ক্ষুধা হল দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর দুঃখের কারণ ও প্রভাব(উইলসন, ১৯৫৩)’ ইত্যাদি।

গোটা চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশক জুড়ে এই ধরণের এজাহারি চলতে লাগল(Orr 1953; Shonfield 1950; United Nations 1951)। নতুন জিগিরে বোঝা বোঝা যেতে শুরু করল যেন, বিভিন্ন দরিদ্র দেশে বাড়তে থাকা পৌনপুনিক দারিদ্র এবং তার ফলে উদ্ভুত সামাজিক হিংসা আদতে প্রথম বিশ্বের কাছে হুঁশিয়ারি স্বরূপ। এর ফলে গরীব এলাকার সমস্যাগুলি ক্রমশঃ আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে ঠাঁই পেতে শুরু করল। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৪৯ সালে আবিষ্কার করল আমেরিকার মাথাপিছু আয় ১৪৫৩ পাউন্ড আর ইন্দোনেশিয়ার ২৫ পাউন্ডও নয়। ভাবা হতে শুরু করল বিশ্বে স্থিতিশীলতা আর অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই নতুন কিছু উদ্যম নেওয়া দরকার। প্রথম বিশ্ব হাত বাড়িয়ে বলল, ধনী আর গরীব দেশগুলোর নিয়তি একসঙ্গে জুড়ে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে বিশ্বের এক বিশেষজ্ঞ দলের মন্তব্য, ‘বিশ্বের সত্যিকারের সমৃদ্ধি অবিভাজ্য’। ‘বিশ্বের এক প্রান্ত যদি দারিদ্র আর অস্বাস্থ্যের মধ্যে ডুবে থাকে তাহলে সমৃদ্ধি অন্যপ্রান্তে বেশি দিন সমৃদ্ধ থাকতে পারে না(Milbank Memorial Fund 1948, 7; see also Lasswell 1945)’।

বিশ্বজোড়া দারিদ্র আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ের আবিষ্কার। স্যাক্স আর রাহেনমা সুত্রে আমরা জানতে পারছি, দারিদ্রের ধারণা আর তার নির্মূলীকরণের নিদান ১৯৪০এর আগে আলাদা রকমের ছিল। উপনিবেশ ভাবত নেটিভদের অর্থনৈতিক বিকাশের কোন লক্ষ্য নেই, এবং যতদিননা নেটিভেরা উপনিবেশের দ্বারা আলোকিত হচ্ছে, ততদিন তাদের অর্থনৈতিক দারিদ্র থেকে মুক্তি নেই। নেটিভদের বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিকাশ শূন্য ভাবা হত(Adas 1989)।

আদাস তাঁর Machines as the Measure of Men বইতে বলছেন, এশিয়, আফ্রিকিয় এবং লাতিন আমেরিকিয়ূ এমন কি অধিকাংশ ইওরোপিয় ইতিহাসে, পরম্পরার সমাজ দারিদ্রকে রুখত, সংযম, সামাজিকতা আর স্বনির্ভরতার সূত্রে। তাদের পরম্পরাকে আদর্শ হিসেবে নাও দেখে, বলা যায়, আধুনিক অর্থে বিপুল দারিদ্র বলতে যা বোঝায় সেটির উদ্ভব হয়েছিল বাজার অর্থনীতির বিস্তার, কোটি কোটি মানুষকে জীবন, জীবিকা, ভূমি, জল আর অন্যন্য সম্পদ থেকে বিচ্যুত করার পরেই। পুঁজিবাদের শেকড় চারিয়ে যাবার পর থেকেই মানুষের কাঙ্গালিকরণের সময়ের শুরু।

দারিদ্রের প্রত্নতত্ত্বে প্রবেশ না করে, রাহেনমা বলছেন, দারিদ্রের ধারনা আর ব্যবস্থাপনাকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে গেলে বুঝতে হবে, এটি প্রথমে শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতকে ইওরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এবং তৃত্রীয় বিশ্বের ধারনাটির বিকাশের মাধ্যমে। রাহেনমা বলছেন উনবিংশ শতকে বিভিন্ন নৈর্বক্তিক সঙ্গঠনগুলি দারিদ্রের ধারনাটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে। এই রূপান্তরের সময়ে লোকহিতৈষণা(Philanthropy) একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে(Donzelot 1979)।

গরীবকে গ্রাহক হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন ঘটল। দারিদ্রের ‘আধুনিকতা’য় দেশিয় সম্পর্কগুলো শুধু ভেঙ্গে গেল তাই নয়, নতুন ধরণের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনার সময় শুরু হল। ক্রমশ গরীবদের সামাজিক অসুবিধে হিসেবে দেখা হতে শুরু করল, এবং এটাও ভাবা হল যে সমাজে এর জন্য নতুন ধরণের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দারিদ্র আদতে জীবন, অর্থনীতি, অধিকার এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা শুরু করল। ‘কাঙ্গালপনা, রাজনৈতিক অর্থনীতি আর সমাজের আবিষ্কার পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত(Polanyi 1957)।’

Monday, October 30, 2017

ইওরোপ পদপ্রান্তে লুঠের কাজে দক্ষ - ছোটলোক কৃষ্টি অর্থনীতি নিধনে বিশেষজ্ঞ - ভদ্র ইংরেজিশিক্ষিত বাঙ্গালি চিরজীবি হোক

কিভাবে উন্নয়ন নামক উপনিবেশ শহুরেদের মাথায় বাসা বাঁধে তার উদাহরণ দিতে আমরা অনুবাদ শুরু করেছি এসকোবারের এনকাউন্টারিং ডেভেলাপমেন্টঃ দ্য মেকিং এন্ড আন্মেকিং অব দ্য থার্ড ওয়ার্লড বইটি। কিন্তু উন্নয়ন বিষয়ে আমরা ছোটলোকেরা যা বলছি বহুকাল ধরে তা আবার এই মুহূর্তে বলা গেল Dipankarদার তাড়নায়।

তৃতীয় বিশ্বে এসে প্রথমে মেকলে-ট্রেভলিয়ান-মূলার, পরে মার্ক্স বুঝিয়ে দিলেন এই উপনিবেশের ইংরেজি শিক্ষিত গাণ্ডুরা, যারা এখনও পরম্পরা থেকে বেরোতে পারে নি - নিজের দেশ সম্বন্ধে যা ভাবে তা ঠিক নয়, ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চা যা বলে দেবে সেটাই আপ্ত বাক্য হবে।

মার্ক্স ভারতের/বাংলার গাঁইয়াদের সম্বন্ধে তার যৌবনে যে সব অমার্জনীয় অশ্লীল উক্তি করেছিলেন, তার জন্য কোন দিন ক্ষমা চান নি, বা বলেন নি, ভুল বলেছেন।

আর মেকলে, ট্রেভলিয়ান খিস্তি করলেন ইংরেজ শিক্ষিতিদের, কি করে ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা সুসভ্য ইংরেজ জাতির কাছে শিক্ষিত হয়েও, দেশের এই অজ্ঞ, অদক্ষ, অশিক্ষিতদের সঙ্গে বাস করে, তা তাদের মাথায় ঢোকেনা। শিক্ষিতদের নবজাগরণীয়দের মধ্যে নিজের কৃষ্টি, সমাজ অর্থনীতি সম্বন্ধে হীনমন্যতা জাগল। ঠিক যে রকমভাবে স্বাধীনতার পরে ইওরোপ আমেরিকা যখন বলত(আজও বলে) এই বিপুল সংখ্যার অশিক্ষিতকে নিয়ে কি করে দেশ নতুন সহস্রাব্দে ভারত যাবে, তার প্রতিক্রিয়ায় বাম ডান মধ্যরা দেশ জুড়ে নানান ধরণের শিক্ষা কেন্দ্র খুলতে লাগল - কেউ বলল না প্রথাগত বিদ্যার বাইরে জ্ঞান আর শিখাটাও শিক্ষা - কারণ প্রথাগত শিক্ষা মানুষকে কর্পোরেট অনুগামী করায় - তাই প্রথাগত শিক্ষায় রাষ্ট্র আর স্বেচ্ছাসেবিদের এই জোর। আজও এই সাম্রাজ্য আর ঔপনিবেশিকতাবাদ কোন শিক্ষিতর মাথা থেকে যায় নি।

ম্যাক্সমুলার এলেন স্তুতির বকলমে খিস্তির বন্যা নিয়ে। বললেন আর্যরা এ দেশে সভ্যতা নিয়ে এসেছিল বেদ লিখে, তারপর তারা চলে যাওয়ায় দেশ অন্ধকারে ডুবে যায়। বর্তমান সময়ে ইংরেজরা এসেছে নতুন আলোর সভ্যতা নিয়ে। তারাই তো সে দিনের আর্য, তারা আদতে ভারতীয়, তারা আবার এসেছে ভারত উদ্ধারে - এদের বিরুদ্ধে তোমরা বলছ কেন? এরাই ত তোমাদের পুরনো রাজা, তোমাদের আবার সভ্য করতে এসেছে, এদের অনুগামী হও, সভ্য হও।

মার্ক্স বললেন ব্রিটিশ ভারত ধ্বংস করে দারুণ কাজ করেছে, এটা খারাপ, অমার্জনীয় অপরাধ হলেও বাঞ্ছনীয় কর্ম, দেশে বিপ্লব এল বলে, ভদ্রদের ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপার।
---
মার্ক্স, মেকলে-ট্রেভলিয়ান আর ম্যাক্ষ্মূলরের ত্রহোস্পর্শে ইওরোপিয় ভদ্র-মধ্যবিত্তের দেশ লুঠ, দেশ ঘেন্নার দীক্ষা লাভ শুরু।

ফলে যা কিছু দেশিয় তার সবই ত্যজ্য - যা কিছু ইওরোপিয় নিদান তার সব কিছুই না হলেও অধিকাংশই মাথা নামিয়ে গ্রাহ্য - নিয়মমাফিক কিছু কিছু ছদ্ম বিরোধতা চালিয়ে যেতে হয়।

আমরা ছোটলোকেরা উল্টোটা বললাম। ইওরোপ তো সেদিনের যোগী। আড়াইশ বছরেই তারা বিশ্বেকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে ফেলেছে। কিন্তু সারা বিশ্বে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়েও বাংলার কারিগর আর চাষী প্রচুর সামাজিক সম্পদ রেখে গেছেন যে সামাজিক জ্ঞান আর পার্থিব সম্পদগুলি রাষ্ট্রের হাত দিয়ে দখল করে সব প্রায় শেষ করে দেওয়ার খেলায় নেমেছে কর্পোরেটরা। পরম্পরার সমাজ হাজার হাজার বছর নিজের, বিশ্বের চাহিদা পূরণ করেও সম্পদ আগলে রেখেছিল। পরম্পরার সমাজ ব্যবস্থাপনার নীতিগুলি, যেগুলি কর্পরেট লুঠের জন্য খিস্তি করে পিছিয়ে পড়া, অসভ্য, অবৈজ্ঞানিক দাগিয়ে দিয়েছিলাম, যে সব বাঁধন ছিল সামাজিক সম্পদ ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ। সেই বাঁধনগুলোকে সম্পদ লুঠের জন্য ছিঁড়ে ফেললাম। ভদ্রদের মনের মধ্যে, যে কোন বাঁধন মানেই পিছিয়ে পড়া ভাবিয়ে তোলা হল। সে পরম্পরার প্রথা, নিয়ম, বাঁধনগুলোকে আবার মান্য করার কাজ করতে হবে। আমরা ছোটলোকেরা মনে করি পরম্পরার সমাজ ব্যবস্থাপনার নীতিগুলি অনুসরনীয়, যদি মনে হয় বিশ্ব বাঁচানো দরকার।

ফলে হায়নার মত করে লুঠেরা কর্পোরেটদের আমরা ভদ্ররা সাহায্য করলাম সামাজিক সম্পদ লুঠে নিতে - নিয়মগিরিতে অনিল আগরওয়াল যা করার পরিকল্পনা করেছিল তার বহুগুণ দখল হয়েছে তার আগের আড়াইশ বছরে আমলা দালাল ভদ্রদের মার্ফত। তার জন্য ভদ্রদের মাথা মুড়িয়েছে ইওরপিয়রা দীর্ঘদিন ধরে।
---
মোক্ষ লাভ ইওরোপে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। যারা ব্রিটিশদের পছন্দ করত না তারা হয় ফ্রান্স না হয় রেনেঁসার ইতালি না হয় মুজতাবার মত জার্মানিতে শিক্ষিত হতে আশ্রয় নিলেন, খুব খারাপ হলে(ইওরোপে যেতে না পারলে) জাপানে। মুজতাবা চাচা কাহিনীতে বললেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ হারলে বিশ্বাসঘাতকতা লোপ পাবে কিন্তু ফ্রান্স হারলে শিল্প কলা, জার্মানি হারলে বিজ্ঞান ইতালি হারলে কি কি যেন লোপ পাবে আমাদের মনে নেই। শেকড়ে পা রাখা রবীন্দ্রধন্য ভদ্রদের প্রতিভূ মুজতাবাই যদি এই মনোভাব পোষণ করেন, তাহলে অন্যান্য ইংরেজবিদ্য বাঙ্গালি দেশকে নিয়ে কি ভাবত! বলে দেওয়া হল যা কিছু প্রগতিশীল সবই ইওরোপধন্য, তার বাইরে কিস্যু নাই।

আমাদের আজকের বাংলাবাদী দাদারাও তাই, তারা ইংরেজির বাইরে কিছু বুঝতে চান না। ইংরেজি খারাপ তো ফরাসি, ইতালি না হয় জারমান নিদেন পক্ষে রুশ ভাষ শেখ। বাংলায় বরাবরই ইওরোপি ভাষা শিক্ষার রমরমা ব্যাপারটা থেকেই গিয়েছে, সেটা একটা আভিজাত্যিক ব্যাপারস্যাপার – রামকৃষ্ণ মিশনও এই ভদ্র অন্তরটিপুনিটা ধরে ফেলেছে – গোলপার্কে ইওরোপমন্য ভদ্রছানাপোনাদের বড় ভিড়।

দেশভাগের পরে ইওরোপিয় বুলডোজার নিয়ে দেশকে আধুনিক করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাম, ডান এবং মধ্যপন্থী নেহরু।
---
ভদ্রদের মনের মধ্যে যে কোন দেশজ বাঁধন মানেই পিছিয়ে পড়া ভাবিয়ে তোলা হল। ইওরোপ(আর উত্তর আমেরিকা) হল নব্য ইওরোপিয় লুঠেরা সামরিক জ্ঞানচর্চায় শিক্ষিতদের শেষতম গন্তব্য, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সেখানে গিয়ে।

যে রকমভাবে ব্রিটিশ লুঠ বিরোধিতার প্রথম তাত্ত্বিক রামবাগানের রমেশ দত্ত সুসভ্য লন্ডনে শেষ জীবনে কাটান আর জগদীশচন্দ্রকে মন্ত্র দেন এ পোড়া দেশে না ফেরার জন্য – রবীন্দ্রনাথ জগদীশের পাশে না দাঁড়ালে তিনি ব্রিটেনেই হয়ত থেকে যেতেন। আদতে সারা বিশ্বে লুঠ চালাচ্ছে কর্পোরেটরা, এবং সে সব সম্পদ নিয়ে এসে জড়ো করছে সেখানে তারা।

ইওরোপিয়দের লুঠ করার কাজে ২৫০ বছরের ঐতিহ্য সম্পন্ন সাহায্যকারী নিবেদিতপ্রাণ ভদ্ররা কর্পোরেটদের বিশ্ব লুঠ ধ্বংস খুনের কাজে সাহায্য করিয়ে দিতে না পারলে শান্তি পান না। তাই দলে দলে পশ্চিম গমন।

আমরা পরম্পরাকে কোন দৃষ্টিতে দেখি, সেটা নিচের উদাহরণে বোঝাব - কারন Dipankarর যুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে এই বস্তাপচা বিষয়কে টেনে এনেছেন আধুনিক শিক্ষাবিদেরা - যে সব যুক্তি বড় পুঁজি তার লুঠের কাজ সমাধা করতে হামেশাই দিয়ে থাকে।
---
ওয়াপাগের স্বাস্থ্য বিধায়ক নারায়ণ মাহাত নৈবেদ্য চিকিৎসা করছেন - এই উদাহরণ দিচ্ছি কেন না ইওরোপমন্যবাবুদের বোঝানো হয়েছে চরণামৃত, নৈবেদ্য ইত্যাদি মানেই গণ্ডগোলের, টিকার থেকে বৈজ্ঞানিক আর কিছুই নাই। দেশিয় পরম্পরা, তথ্য, জ্ঞান বিষয়ে কোন রকম না জেনে না বুঝে তারা কোমর বেঁধে ট্রেভলিয়ান, মেকলে, ম্যাক্ষ্মুলর আর মার্ক্সের দেখানো পথে নেমে পড়েছেন পরম্পরার নিন্দা করতে।

নৈবেদ্য আর চরণামৃত নামে যা দেওয়া হয়, তা আদতে ওষুধ আর চিরায়ত মানুষকে সুস্থ করার গাছগাছালি সংরক্ষণের নিদান। চরণামৃততে থাকে দুধ ছাড়া যে কটা জিনিস থাকে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ন হল কর্পুর (ভদ্র বাঙালির বিবাহিত জীবনে ক্যাটারার নামক সমাজ ধ্বংসাত্মক কৃষ্টি আসার আগে বিয়েতে পাড়ার ভুতো, ফুটো ইত্যাদিরা পরিবেশন করত। সে সময় জলে যাতে বিষক্রিয়া না হয় তার জন্য জলে কর্পুর দেওয়া হত - পুরোনো যদি কোন মানুষের সে সব সুখস্মৃতি স্মরণে থাকে মনে করুণ), বেলপাতা (শৈবদের ভগবান), তুলসী পাতা(বৈষ্ণবদের ভগবান) - প্রত্যেকটাই এই যৌগতে বিষক্রিয়া নষ্ট করার জন্য, এবং নিদান, এটি তৈরি করা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে পান করে ফেলতে হবে। সমস্যা হল বড় পুঁজি, বড় পুঁজির সংবাদমাধ্যম এটিকে ব্রাত্য করে দেওয়ার প্রচারের বাইরে এই যৌগ সম্বন্ধে আমরা কিস্যু জানি না প্রায়।

বড় পুঁজি যা বলতে শেখায় সেটাই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিই কারণ আমার বাড়ির ছেলে মেয়ে নাতি নাতনির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আছে বড় পুঁজির চাকরি তৈরি করার ক্ষমতার ওপর, নিদেন পক্ষে দালালি, সেটা হয় ছোটলোকেদের অর্থনীতি কৃষ্টি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা ধ্বংস করেই।

ফলে সে ছোটলোকেদের অশিক্ষিত অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলতে আমাদের যতটা উৎসাহ, ততটা বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখা যায় না ছোটলোকেদের যেগুলো বড় পুঁজি কুসংস্কার দাগিয়ে দিয়েছে সেগুলির মূল খুঁজে বার করার।
---
যদি কেউ বড় লুঠেরা পুঁজির যুদ্ধ নির্ভর প্রযুক্তি বিজ্ঞান যুক্তিবাদের ওপর নির্ভর করে সেই জ্ঞানচর্চায়, আধুনিক পরজীবি জীবনযাত্রায় সুখ পান তো আমাদের কোন অসুবিধে নেই - কারণ ভদ্রদের এই লুঠের কাড় কাঠি হয়ে কাজ করার পরম্পরা চলে আসছে আড়াইশ বছর ধরে ব্রিটিশদের জামানায়। ইওরোপ পদপ্রান্তে থাকা লুঠের কাজে দক্ষ, ছোটলোক কৃষ্টি অর্থনীতি নিধনে বিশেষজ্ঞ ভদ্র বাঙ্গালি চিরজীবি হোক।

তবুও আমরা বলব ছোটলোকেরা যা পালন করেন, বলেন, করেন সেটাই সভ্যতা, সেটাই বিশ্বকে বাঁচানোর হাতিয়ার।
বিশ্ব এখন ধ্বংসের মুখোমুখি।
আপনাকে পথ বেছে নিতে হবে আপনি কোন দিকে।