Saturday, October 14, 2017

উপনিবেশবাদ-বিরোধী একটি বিতর্ক

আমাদের ধারণা এটা তাত্ত্বিক আলোচনা
বিতর্কটা বেশ বড় হয়েছে - মাথা ধরলে এড়িয়ে যাবেন
---
Sayanকে বলেছিলাম ডিকলোনাইজেশন বুঝতে বাংলা তথা ভারতের গ্রামে ঘুরলেই হবে। তার জন্য বিশ্ব ভ্রমনের প্রয়োজন নাই।
সায়ন উত্তর দিলেন - না, বিশ্বেন্দু, এই কথাটা ঠিক নয়। তুমি যেটা বলছো সেটা শস্তা আন্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজম। ভেবে দেখো, আমরা তুলনামূলক সাহিত্য (কম্পারেটিভ লিটারেচার) কেন পড়ি ? কারণ, বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ থেকে একটা বস্তুকে দেখলে, তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়, যেটা একটা-মাত্র পার্সপেক্টিভ থেকে পাওয়া যায় না। ধরো, কলোনিয়ালিজম। কলোনিয়ালিজম-কে বুঝতে হলে, বিভিন্ন কলোনাইজড সমাজকে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে আমাদের যে ধারনাটা জন্মাবে, সেটা একটা মাত্র অবস্থান থেকে দেখলে আসবে না। এইজন্যেই, রবীন্দ্রনাথ যেটাকে বলেছেন "বিশ্বমুখী বৃত্তি" — সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই বিশ্বমুখিতার সঙ্গে বঙ্গীয়তার কোন বিরোধ নেই কিন্তু। আমাদের চর্যা সঙ্কীর্ণ ছিল না, ঐতিহাসিকভাবে।
‘রবীন্দ্রনাথের গল্প; সবাই জানেন:
সকলই প্রস্তুত, মেরাপ-বাঁধানো উঠান প্রাঙ্গণ,
ভিয়েনে আগুন জ্বলে, দেউড়িতে সানাই,
বাতাস ভরপুর করে...
আত্মার দুয়ারে, মনের রাস্তায়,
দেহে মনে প্রাণে দুস্থ, হয়তো বা অর্থে নয়, ক্ষমতায় নয় –
বরযাত্রী নানান রকম,
শুধু বর নেই।
বর খুঁজে ফেরে সত্তা, আত্মপরিচয় —
এ উপমা বহুমুখ, স্তরে স্তরে প্রয়োগে সরল,
ব্যক্তিতে, সমাজে, দেশে,
প্রজ্ঞায় সংহত, কালের বাগানে'
(বিষ্ণু দে)
আমরা একটু রেগেই বললাম - বাংলার কারিগরদের বিশ্বমুখীনতা কে বোঝাবে? ইওরোপের বুদ্ধিবৃত্তি? হাঃ। তাও শুনব। শুনতেই হবে। অনেকেই দারুণ কাজ করছেন, কিন্তু পৌনপুনিক ইওরোপকেন্দ্রিকতা থেকে বেরোনো খুব বেশি সম্ভব হচ্ছে না, এটাই বাস্তব, হাঁড়ির চাল ভাত হল কিনা তার জন্য গোটা হাঁড়ির চাল পরীক্ষা করার দরকার নেই। ভারতবর্ষের উপনিবেশবিরোধী তাত্ত্বিক ধরমপাল একটা স্পষ্ট কথা বলে দিয়ে গিয়েছেন, মৌলিকভাবে ইওরোপিয়রা খুনি মানসিকতার।
বাংলার কারিগরদের গত আড়াইশ বছর আগে বিশ্ববাজার থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে। তারপরে লুঠ খুন আর অমানবিক সব অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন বাংলার চাষী আর কারিগরেরা।
আমরা বরেণ্য শোলাশিল্পী মধুদার বাড়িতে একটা গল্প পেয়েছি, যেটা কোন পুঁথি ভিত্তিক নয়, পারিবারিক কথা ভিত্তিক। যেটা হল বাংলার পৌণ্ড্রবর্ধন এবং অন্যান্য অঞ্চলের কারিগরদের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের কথা - সুলতান জালালুদ্দিনের সময়ের - মাত্র ছয়শ বছর আগের - কিভাবে জালালুদ্দিন বাংলাকে জৌনপুরের সুলতানের হাত থেকে বাঁচতে চিনের মিং এবং তুর্ক শাহারুখের সাহায্য চেয়েছিলেন এবং বাংলা আর চিনের যৌথ বাহিনী বাংলার মাটি দিয়েই জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল তার কাহিনী - আমাদের ধারণা যে জন্য আজও পুণ্ড্রবর্ধনের সাঁওতালেরা বিয়ের সময়ে ঘোড়া নাচ করেন - এবং সাঁওতাল কোনদিন যুদ্ধ জাতি ছিল না - তারা লোহার পিণ্ড তৈরি করত - অথচ ঘোড়ার মত যদ্ধের কজে লাগা একটি প্রাণীকে অযুদ্ধ জাতি সাঁওতালেরা কেন তাদের পারিবারিক উতসবে আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন - এবং এই ঘোড়া তৈরি করেন মধুদার পরিবার অন্তত ১০০ কিমি জুড়ে সাঁওতালেরা আজ যে ঘোড়ার ছবি দিয়েছি, সেই ধরণের কিনে নিয়ে যান বিয়ের সময়? নানান কথায় বিশ্ববাণিজ্যের বীজ আজও লুকিয়ে আছে বাংলার কারিগরদের বাড়িতে। এই তথ্য চৈনিক নানান পুঁথিতে লিখিত আছে।
কলোনাইজেশন কি, আর কাকে বলে সেটা বোঝার জন্য বাংলার কারিগরদের বাংলার ছোটলোকের শিল্পউৎপাদন ধ্বংসের ইতিহাস বোঝাই যথেষ্ট। এর থেকে বেশি বুঝতে আপনারা ইওরপের দিকে তাকান। আমরা আপনাদের অভিজ্ঞতা শুনব।
শস্তার আন্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজমএর অভিযোগের উত্তরদিয়েই শুরু করব ভেবেছিলাম। ভাবলাম সেটা বড্ড প্রতিয়াক্রমণ হয়ে যাবে তাই দ্বিতীয় স্তবকে ধরলাম। ভাই অন্তত বাংলার বাঘা ইন্টালেকচুয়ালদেরকে (যাদের সক্কলের শেকড় ঢুকে আছে সারাবিশ্ব থেকে জ্ঞান, সম্পদ লুঠে পুষ্ট ইওরোপের মাটির গভীরে) সম্মান জানিয়েই বলি, বাংলার কারিগর অর্থনীতি বাঁচাতে, নিদেনপক্ষে বুঝতে, নিদেনপক্ষে কর্পোরেট আগ্রাসন আটকাতে মহানদের কি অবদান, জানতে বড্ডই উৎসুক রইলাম।
উপনিবেশ বিরোধী তাত্ত্বিক বহু আছেন - আমরাও তাদের অনেকেরই অনুগামী - তাঁরা মাথায় থাকুন - তাদের শিক্ষায় শিক্ষিতও হব, কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষক বাংলার গাঁইয়ারা। তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যা শিখেছেন, সেইটুকুই যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলেই অন্তত প্রচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদীদের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে নিজেদের বিচ্যুত করতে পারব।
সায়ন বললেন - "প্রচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদী" বলাটা "দাগিয়ে দেওয়া"র রাজনীতি।
আমাদের উত্তর ছিল - অন্ততঃ আমরা আপনাকে প্রচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদী এখুনিই বলছি না। আমাদের বাংলার ভদ্রদের চরিত্র বিশ্লেষণে আপনার অবদান আছে, অন্তত আমাদের কাজে এটা স্বীকার করি।
এর উত্তরে সায়ন বললেন - সব ট্রেডিশন কি বাঁচানোর যোগ্য ? এই মানসিকতা থেকেই কিন্তু বাল্যবিবাহের প্রতি তোমার সমর্থন (যা তুমি প্রকাশ করেছ), এসে থাকে।
আমরা বললাম - এই খিস্তিটা মেনেই তো নিয়েছি। এই লড়াইটা বহু আগেই হয়ে গিয়েছে। আমরা স্বীকার করি যে সমাজ(যে শুধু বাংলার নয়, সারা বিশ্বের গাঁইয়াদের, আমরা বাংলাকে অল্প কিছুটা হলেও চিনি তাই বাংলাকে দাদ দিই) হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বকে বাঁচিয়ে এসেছে, তাদের কোন কিছুকে প্রশ্ন করার অধিকার অন্তত আমাদের মত ঐতিহ্যবিনাশী, বিশ্ববিনাশী ইওরোপপন্থী, খুনি, অত্যাচারী, লুঠেরাদের ছোটতরফ ভদ্রদের বিন্দুমাত্র নেই।
সায়ন বললেন - এখানেই সমস্যা : কোন বস্তুকে সমালোচনা-বহির্ভূত করে দেওয়াটা একধরণের গা-জোয়ারী। বিজেপি বলবে, রাষ্ট্রের বা ধর্মের সমালোচনা করা যাবে না। ট্রেডিশন-কে সমালোচনা-বহির্ভূত করে দেওয়াটাও গুণগতভাবে এক-ই গোত্রের চিন্তা।
আমরা বললাম - এ তো চোরই বিচারকের আসনে বসে বিচারের রায় দিল। যাদের হাতে ঐতিহ্য বিনাশের রক্ত লেগে আছে, তারাই ঐতিহ্যের সমালোচনা করবে? লাও ঠ্যালা। তাদের সমালোচনা শুনতে হবে?
সায়নের প্রতিউত্তর ছিল - সমালোচনা-কে প্রতি-আলোচনা, প্রতিযুক্তি দিয়ে এনগেজ করতে হবে। সমালোচনার যুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে — সমালোচকের গোষ্ঠীগত "দাগ" এখানে অপ্রাসঙ্গিক সেটা বুঝতে হবে।
তা না হলে কিন্তু "বাঙালি-গাঁইয়া" -ভিত্তিক রাজনীতি, ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠবে শেষ পর্যন্ত — হিন্দুত্ব-ভিত্তিক রাজনীতি-র মতোই।
আমরা বললাম - তারা সমালোচনা করবেন কেননা ক্ষমতার পাঁচনবাড়ি তাদের হাতে। আমরা তো সেই নবজাগরণ হয়ে আজ পর্যন্ত অহরহই শুনে আসছি বাংলার পরম্পরা কতই প্রতিক্রিয়াশীল, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে (আদতে ইওরোপিয়দের কাছে, যারা তাদের লালন পালন করে বড় করেছে) সমস্ত ভদ্রর মুখ পুড়ে ঝামা হয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের কাজ সমাধা হচ্ছে না।
আমরা বাঙ্গালি-গাঁইয়া ভিত্তিক রাজনীতি করি কে বলল? বাংলার কারিগর অভিকর শিল্পীরা কারিগর অর্থনীতির রাজনীতি করেন। ভদ্র বাঙালির আড়াইশ বছরের যা ট্র্যাক রেকর্ড, সাঁওতাল, মেচ, রাভা, মুণ্ডা, কুর্মি রাজবংশীরা বাঙ্গালি ভদ্রদের থেকে যা সম্মান পেয়েছে, তাতে তাদের বাঙ্গালি বললে, অপমানে ঝঁটা মারতে আসবে।
ভদ্রদের ভাগ্য ভাল গাঁইয়ারা অসাধারণ নরম আর বুঝদার, গণতান্ত্রিক মানুষ বলেই, তারা আড়াইশ বছর ধরে, তাদের নিয়ে, তাদের পরম্পরাকে যা খুশি তাই বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন।
গ্রাম বাংলা ফ্যাসিস্ট হলে ভদ্রদের কথা বলতে হত না।
শুনছি, শুনব, মানে শুনতেই হবে। কিন্তু কি করব আমরা জানি।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর13 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Saikat Bhattacharyya atokkhon hejanor ki chilo?
sob perspective niye aka ami ki kaj korbo?
amay kaj korte gele kono akta perspective thekei korte hobe.
...আরও দেখুন
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর13 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Sayan Bhattacharyya What does "অভিকর" mean?
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর12 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda পার্ফরমিং আর্টিস্টস
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর12 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Tarun Chakraborty আপনার লেখা পড়ে আমি সমালোচনা করছি না । তবে আমি আমার একটি তথ্য পেয়েছি গনেশের ছেলের সংগে চিনের সম্পর্ক। আপনি কি কিছু হদিশ দিতে পারেন গনেশের সময় বাংলার বানিজ্য কেমন ছিল। মমতাজুর (বাংলাদেশের ইতিহাসের অধ্যাপক ) দু-চার লাইন শেষ করে দিয়েছেন ।আমি বিস্তারিত বিবরন চাই আপনার কাছে কি কোনো তথ্য আছে।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর12 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda আপনি আমাদের ব্লগের এই লেখাটা দেখতে পারেন
http://lokfolk.blogspot.in/2017/03/blog-post_3.html
বাংলা-চিনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে একটা গল্প শোনানো…
LOKFOLK.BLOGSPOT.COM
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তরপূর্বরূপ মুছে ফেলুন
2
12 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda এটা নিয়ে আমাদের পরম পত্রিকা্র রেশম পথ সংখ্যায় বিশদে লেখা আছে।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর12 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
খুব ভালোআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
10 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Susovan Maity সাঁওতাল কোনদিন যুদ্ধ জাতি ছিল না - wrong .. , war is eternal .. , all ppl of all regions fought with each other in all over history ..
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর9 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Susovan Maity বাল্যবিবাহ - there were many rules on that also .. , boys cannot live with girls before adulthood (18-20) , even if they r married .. some biihari also follow that tradition ..

No comments: