Wednesday, September 26, 2018

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী১১

২.২ নবাবি বাংলা, ১৭০০-১৭৫৭
১৭০০ সালে বাংলায় এসে মুর্শিদকুলি খাঁ একাদিক্রমে ১৭২৭ সালের তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত(মাঝখানে ১৭০৮-০৯ দু বছর বাদ দিয়ে) সুবার গুরুত্বপূর্ণতম প্রশাসক হিসেবে আজও পরিগণিত হন। প্রথম থেকেই তিনি দেওয়ান ছিলেন, ১৭১৭র পরে তিনি সুবাদারও হন। দেওয়ান পদে যোগ দিয়ে তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধি। এই দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি রাজস্ব-প্রশাসনে পকড় দৃঢ় করেন এবং যে উদ্বৃত্ত জমিদার এবং অন্যান্য ছোট জমিদার/সুবাদার উসুল করছে, সেগুলো রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে আসার ব্যস্থা করেন। তিনিটি সহজ পদ্ধতিতে তিনি রাজস্ব আদায় কাঠামো নির্নয় করেন। প্রথমত তিনি বাংলার উর্বরতম যে সব জমি সুবাদারদের জায়গির দেওয়া ছিল সে সময় সেগুলি সব কটা তিনি কম উর্বর উড়িষ্যায় সুবাদারদের বরাদ্দ করেন। রাষ্ট্র সব পড়ে থাকা জায়গির জমির দখল নেয়। দ্বিতীয়ত তিনি জোর দিয়ে জমিদারদের বরাদ্দ রাজস্ব প্রদান করতে বাধ্য করেন। যে কোন কারণে তারা সেগুলো দেওয়ায় ব্যর্থ হলে তিনি তাদের কয়েদ করতেন অথবা তাদের ওপর বিপুল অত্যাচার করতেন। তিনি, অবসর নেওয়া এবং অন্যান্য কার্যকরী আমলাদের প্রত্যেক রাজস্ব প্রদায়ী এলাকায় পাঠান যাতে তারা সেই এলাকার রাজস্বের সঠিক সমীক্ষা/জরিপ করতে পারেন। তাদের সাহায্যে তিনি বাংলার সঠিক রাজস্ব খাত তৈরি করেন এবং প্রত্যেক জমির উর্বরতা নির্ধারণ করে প্রতিটি রায়ত/কৃষক সম্ভাব্য সর্বোচ্চ কত রাজস্ব দিতে পারে, সে অঙ্ক কষলেন(Riyaz, 248-49, 255-56; Salimullah, Tarikh-i-Bangala, pp. 32-33, 43-45)। তার সময়ে পারস্যের ঐতিহাসিক সালিমুল্লার বর্ণনা অনুযায়ী যদিও জরিপের অতটা গভীরে যেতে পারে নি মুর্শিদকুলির উদ্যম, কিন্তু আজ আমরা বলতে পারি, পুরোনো সমীক্ষা এবং তার সময়ের জরিপের নানান তথ্য অবলম্বন করে মোটামুটি ঠিকঠাক রাজস্বখাত তৈরি করলেন।
নবাব মুর্শিদকুলির বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী জমিদারদের এখন সমস্ত রাজস্ব প্রদান করতে হবে, না হলে তারা হয় মহাজনের হাতে অথবা সরকারকে জমিদারি তুলে দিতে বাধ্য হবে। খাজনা বকেয়া থাকা অবস্থায় যদি কোন জমিদারির দখল ন্যায় রাষ্ট্র, তাহলে অন্য কোন জমিদার যদি সেই বর্ধিত খাজনার গোটাটা শোধ করে দ্যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দ্যায় তাহলে সেই জমিদারি তাকেই সরকার দিয়ে দেবে(Risala, ff. 7a-9b; also quoted in Calkins, p.803.) এই সিদ্ধান্ত নেয়। এই নীতিতে অধিকাংশ দুর্বল এবং ছোট জমিদার জমিদারি থেকে হঠে যায়। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে মুর্শিদকুলি বড় জমিদারির পক্ষেই রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাটা তৈরি করেন এবং বড় জমিদারদের ক্ষমতা আর কলেবর বৃদ্ধিতে মন দিলে বাংলা জুড়ে বেশ কিছু বড় জমিদারি তৈরি হয়। এই ধরণের জমিদারির বড় উদাহরণ রাজসাহী জমিদারি। বর্ধমান, নদীয়া, দিনাজপুরের মত বড় জমিদারেরা মুর্শিদকুলির সময়ে নতুন সংস্কারের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান জোরদার করেন(জমিদারির বৃদ্ধি নিয়ে জানতে পড়তে হবে নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের Economic History of Bengal, vol. II, pp. 119-22.) । ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলি যেদিন মারা যান, সে সময় বাংলার মোট রাজস্বের অর্ধেক অংশ পূরণ করে ১৫টি বড় বাংলার জমিদারি (জমিদারদের জমিদারির বিশদ বিবরণ এবং সেই জমিদারির রাজস্ব জরিপ নিয়ে বিশদ পাবেন (James Grant, 'Finances of Bengal', in W.K. Firminger (ed.), Fifth Report, vot. II, pp. 194-9)।

মুর্শিদকুলি খার নতুন রাজস্ব সংস্কার নীতির উপজাত ফল হিসেবে উঠে আসে মহাজন এবং ব্যাংকিং শ্রেণীরা। এরা সেই সময় বাংলায় বিপুল বড় ভূমিকা পালন করেন। মুর্শিদকুলির নতুন নীতিতে কাজের সুযোগ পেয়ে একদল মহাজন একজোট হয়ে একদল জমিদারকে অর্থ সাহায্য দিতে শুরু করে, যাদের মাথাব্যথা ছিল সঠিক সময়ে রাজস্বভাণ্ডারে পূণ্যাহের দিন প্রয়োজনীয় রাজস্ব জমা দেওয়া(Risala, ff, 7a-7b; also quotecf in Calkins, p.804.)। এই মহাজনদের মধ্যে ক্ষমতা আর প্রভাবে জায়মান হয়ে উঠতে শুরু করেন জপগতশেঠেদের গদির গৌরব। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও বলতে হবে জগতশেঠদের কুঠি বাংলায় প্রধানতম ব্যাঙ্কিং গদির অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারার পিছনে অবশ্যই আছে নবাব নাজিম মুর্শিদকুলির অভয় হস্ত। কুঠির একটা বড় রোজগার হত জমিদারদের দেওয়া ঋণের প্রাপ্ত সুদ থেকে(পঞ্চম অধ্যায় দেখুন)। ১৭৩০এর মধ্যে জগতশেঠেরা নবাব নাজিমের তোষাখানা হয়ে ওঠে। জগতশেঠেরা রাজস্ব বকেয়া রাখা জমিদারদের জামিন হতেন। 

Tuesday, September 25, 2018

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী১০

যেহেতু নতুন গঠিত স্বার্থগোষ্ঠীর সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছিল পুরপুরি ব্যক্তি স্বার্থপূরণের ওপর নির্ভর করে, তাই প্রত্যেক দলের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিজের স্বার্থের তাঁবুটার সুরক্ষা যতদূরসম্ভব বজায় রাখা, যদি স্বার্থ রক্ষা অসম্ভব হয়, তাহলে তারা দলও পরিবর্তন ঘটাত। এই বিষয়টা আমারা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি শতাব্দের প্রথম পাদে। মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তার ইচ্ছায় নাতি সরফরাজ খান মসনদে আরোহন করেন। সে সময়ের সরফরাজের পিতা ওডিসার উপসুব্বাদার মসনদ তার নিজের জন্যে চেয়ে বসলেন। সরফরাজ মুর্শিদকুলির স্ত্রীর(Riyaz, p. 2_88.) হস্তক্ষেপে মসনদ ছেড়ে দ্যান এবং এই অবস্থায় নতুন অভিজাতরা কিছুই করাতে পারল না। ব্রিটিশ কুঠির কাজগপত্র সূত্রে জানতে পারছি, বিপুল বিশাল প্রতিপত্তিওয়ালা ব্যাঙ্কার জগতশেঠ শুরুতে বুঝতে পারছিলেন না এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি করা উচিত(BPC, vol. 6, f.490, 14 Aug. 1727.)। এই গোষ্ঠীস্বার্থ যে সম্পূর্ণ ব্যক্তি যোগাযোগ আর স্বার্থে গড়ে উঠেছিল তার আরও একটা প্রমান, দুই প্রখ্যাত ভ্রাতা হাজি আহমদ এবং আলিবর্দি খান, যারা তার পরের সময়ে বাংলার রাজনীতিতে বিপুল বড় ভূমিকা পালন করবেন, তারা সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে বৃত হন(Riyaz, pp. 294-95.)। এরা যখন প্রশাসনিক সেবায় আসছেন, তখন এদের মধ্যে কেউই গুরুত্বপূর্ণ মনসবদার বা জমিদার গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন না।
এই যে নতুন স্বার্থগোষ্ঠীবদ্ধ মানুষেরা কিন্তু একদেহী হলেন না। বিভিন্ন সময়ের চাপেরে মুখে পড়ে গোষ্ঠীবদ্ধ বিভিন্ন মানুষ নানান রকমে সমঝোতা করতে শুরু করলেন। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে যখন সরফরাজ নবাব হলেন, তিনি তার পিতার পুরোনো মনসবদারদের পদোন্নতি ঘটাতে চাইলেন। কিন্তু সেই সময়ের বাংলার গুরুত্বপূর্ণ ত্রিমূর্তি হাজি আহমদ, দেওয়ান আলমচাঁদ এবং জগতশেঠ, যাদের তিনি তার পিতার শেষ ইচ্ছে শিরোধার্য করে নিজের পরামর্শ দাতা নিয়োগ করেছেন, তারা তার এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। দরবারের স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্যের সূচনা হল। প্রখ্যাত এই তিনমূর্তি তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের ১৭৪০ সালের বিপ্লব সংগঠিত করে আলিবর্দিখানকে মসনদে বসান। কয়েকজন মানুষের ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং শুধুই ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণের জন্যে সরফরাজ খাঁ সিংহাসনচ্যুত হন, তাঁর অদক্ষতা বা দুর্নীতির জন্যে নয় অথবা সামগ্রিক নতুন শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থেও আড় হয়ে দাঁড়ানোর জন্যেও নয়। রিয়াজের লেখক লিখছেন, This Revolution in the Government threw the City (Murshidabad-the capital) as well as the Army and the people of Bengal, into a general and deep convulsion.' (Ibid., p.320.)। এমন কি গিরিয়ার যুদ্ধে, ঘাউস খান, মীর সারাফুদ্দিন, মীর মহম্মদ বাকির খান, বিজয় সিংহ, রাজা ঘনদরব সিং ইত্যাদিকে সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সরফরাজ মারা গেলেও তার সৈন্যবাহনীর আরেকটি দল আলিবর্দির দলের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার মনসবদার-জমিদার জোটেও মধ্যেও একতা ছিল না, সারা জোট আবর্তিত হপ্ত ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যপূরণের(Ibid., pp. 311, 314-15, 319-20.) চেষতায়। ব্যক্তিগত উচ্চাশাই ছিল যে কোন জোটের মুল লক্ষ্য জোটের জোটসঙ্গীদের সার্বিক বিকাশ নয়, এটা প্রমানিত হয় আলবর্দির প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের ১৭৪৭এ আলিবর্দী বিরোধী চক্রান্তে(K.K. Datta, Alivardi, p. 81.)।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৯

অষ্টাদশ শতকের শুরুতে দিল্লির কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে ঢিলে হতে শুরু করায় এই ক্ষমতার সম্পর্কর ব্যবস্থাপনা করতে নতুন ধরণের প্রশাসনিক কাঠামোয় সফলভাবে গৃহীত হল। এর আগে আমরা বলেছি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কেন্দ্র থেকে সুবায় যেমন সরে এল, তেমনি, সুবাতেও ক্ষমতার সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটল (ঐ রিসালা)। আগের জানামায় যে সব মুঘল মনসবদার অসম্ভব ক্ষমতাধর অভিজাত হিসেবে প্রশাসনে গুরুত্ব পেয়ে আসছিলেন, ক্ষমতার সমীকরণ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতাহীন হয়ে গেলেন কেননা কেন্দ্র থেকে আর তাদের পক্ষে কোন সমর্থন আসল না। ফলে তারা স্থানীয় ক্ষমতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় করতে শুরু করলেন। যে সব আর্থিক-সামাজিক গোষ্ঠী এতদিন বাংলার মাথা নামিয়ে ছিল তারা নতুন অবস্থায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। এই ধরণের গোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল মুর্শিদকুলির নব্য প্রশাসনিক সংস্কারে উদ্ভুত নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসা ক্ষমতাধর বড় জমিদারেরা। রাষ্ট্রের রাজস্বের দাবি যত বাড়তে থাকে, জমিদারদের ক্ষমতাও বাড়তে থাকল। বলা দরকার বড় জমিদারদের ইতিহাস আমাদের বলে, উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে মুর্শিদকুলি তার পক্ষে থাকা বড় জমিদারদের ক্ষমতাশালী করে তাদের ক্ষমতা বাড়াবার কাজ করে গিয়েছেন। নতুন ক্ষমতার গষ্ঠীতে এরা নতুন জোট হিসেবে আবির্ভূত হলেন। একইভাবে সওদাগর-ব্যবসায়ীরা যারা মুর্শিদকুলির নব্য প্রশাসনিক রাজস্ব সংস্কারে বিপুল ভূমিকা পালন করলেন, তারাও এসে নতুন ক্ষমতার গোষ্ঠীকেন্দ্রে যোগ দিলেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় একটি নতুন ক্ষমতা গোষ্ঠী তৈরি হল।

তবে মনে করা ঠিক হবে না যে নতুন ক্ষমতা গোষ্ঠীটি তৈরি হল, সেটি প্রশাসনিক পরিকাঠাম হিসেবে কাজ করল বা একদেহী গোষ্ঠীস্বার্থভূত হয়ে উঠল। এরা বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন ব্যক্তির, নানান পরস্পর বিরোধী ব্যক্তিস্বার্থ সম্পাদন করতে নিজামতের তলায় একজোট হল। বাংলার রাজনীতির নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনায় তাদের উদ্দেশ্য হল একদিকে নবাবের হাত শক্ত করা, অন্যদিকে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা। নাজিম বা নবাব তার নিজের হাত শক্ত করতে দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন মনসবদার, সওদাগর ব্যবসায়ী আর জমিদারদের তাঁর পাশে চাইলেন প্রশাসনিক কাঠামো সরলভাবে চালাতে এবং অর্থনৈতিক সম্পদ তৈরি করতে। মুর্শিদকুলি খাঁ দেখলেন এই স্বার্থগোষ্ঠীর নানান ক্ষমতাশালী মানুষ তাঁকে প্রশাসনের প্রধান হিসেবে, তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে দেখছেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদ থেকে বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলায় যে বিপুল শূন্যতার সৃষ্টি ঘটল, তিনি এবং তার উত্তরাধিকারীরা এই দলের সেবা ব্যবহার করে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে গিয়েছেন। বাংলার ক্ষমতাকেন্দ্রে একটা পিরামিডের মত কাঠামো তৈরি হল যেখানে নবাব চূড়োয় বসে রইলেন এবং শাসক জোটের সদস্যরা তার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষমতা আহরণ করতে থাকলেন।

এটা স্পষ্ট নিজামতের পক্ষ থেকে বুঝেশুনেই হয়ত এই স্বার্থগোষ্ঠীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে অংশীদার করে নেওয়ার কোন সচেতন চেষ্টা করা হয় নি। বড় জমিদারদের উত্থান ঘটেছিল মুর্শিদকুলির রাজস্ব তোলার প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে। সওদাগর-ব্যাঙ্কিং শ্রেণীর উত্থ্যান ঘটল প্রশাসনিক উথালপাথালের ফলে যে ব্যবসাবানিজ্যের বিস্তার ঘটল তাকে সামাল দিতে। কেন্দ্রিয় শক্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ায় মনসবদারেরা বাংলায় তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে ক্ষমতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। নিজামতের সঙ্গে এই গোষ্ঠী সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যক্তি স্তরেই ঘটছিল(M. Mazibor Rahman, 'Nizamat in Bengal', unpublished M. Phil. thesis, JNU, 1988.)। এই গোষ্ঠীসমঝোতা রাষ্ট্রীয় দাবি মান্য করেও নতুন দিনগুলির আহ্বানে নতুন দুঃসাহসী সময়ের উন্মেষ ঘটাল। একই সময়ে এই অবস্থাকে মান্য করে যারা লাভবান হচ্ছে, রাষ্ট্র তাদের সম্পূর্ণ সহায়তার সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সময়ের গোষ্ঠীবন্ধনের ব্যক্তিস্বার্থিক সব থেকে বড় উদাহরণ হল জগতশেঠের গদির বাড়বাড়ন্ত। সাধারণ সুদের ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন শুরু করে নিজামতের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে, তার অক্ষয় হাত মাথায় নিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রের প্রধান beneficiary'। এবং এই সুযোগ নিয়েই বাংলায় সব থেকে ধনবান ব্যাঙ্কিং গদি তৈরি করে ফেললেন জগত শেঠের পরিবার।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৮

দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, পরস্পরের ওপর নজরদারি করে ভারসাম্য রাখার জন্যে কেন্দ্র থেকে বাংলা সুবায় যে আমলাদল পাঠানো হত, সেই নিয়মতান্ত্রিক কাণ্ডটির ছেদ পড়ল ১৭১৩ সাল থেকে(J.N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol.II, p.410.)। দিল্লি থেকে আসা সুবাদার এবং দেওয়ানের সঙ্গে একদল আমলা বাংলার প্রশাসনে আসত এবং তারা কেন্দ্রিয় সরকার আর সুবায় রাজ্য প্রশাসনের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করত। কিন্তু কেন্দ্র থেকে আমলা পাঠানোর প্রথার ছেদ ঘটায় কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে বাংলার যে স্বাভাবিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল শতকের প্রশাসনিক প্রথায়, সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ল। এরপর থেকে মুর্শিদকুলি বা তার উত্তরাধিকারীদের মাথায় আর কোন উত্তরভারতীয় কেন্দ্র থেকে আসা আমলার জুড়ে বসার ঘটনা ঘটল না। সারা ভারত জুড়ে যে অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলায় তার সরাসরি ফল ফলল বাংলার প্রশাসন জোরদার হওয়ায়। বাংলার নিজামত আরও শক্তিশালী হল। বাংলার নবাবেরা নিজেদের পছন্দ মতই আমলা নিয়োগ করতে শুরু করলেন মুঘল সাম্রাজ্য নিরপেক্ষ হয়ে তার স্থানীয় স্তরে এবং নিজেদের পরিবার থেকেই। বাংলা শেষ পর্যন্ত যদিও মুঘল সুবার অংশ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল ঠিকই, ওপরের স্তরের প্রশাসনিক মাথাদের আর দিল্লির প্রতি আনুগত্য দেখানোর দরকার পড়ল না। আমলারা বাংলার নাজিমকে কাজ বুঝিয়ে দিত এবং তার নির্দেশেই কাজ করত। বছরের পর বছর ধরে এই কাণ্ড ঘটে চলায় নিজামের হাত শক্ত হল এবং এর ফলে বাংলায় নতুন নিজামতের পত্তন ঘটল স্থানীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে।
বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা অন্যান্য এলাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে অনেক আলাদা কারণ অধিকাংশ জমির দখল নিয়েছিল স্থানীয় ভিত্তিতে দেশিয় জমিদারেরা। বছরের পর বছর রাজস্ব আদায় বাড়তে থাকায় এই জমিদারদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। জমিদারেরা স্থানীয় স্তরে রাজস্ব আদায় করতেন এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। গুরুত্বপুর্ণ বড় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ করে প্রাদেশিক প্রশাসন ছোট ছোট জমিদার সামন্ত এবং রায়ত/প্রজাদের পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করত। জমিদার আর রায়ত/চাষীদের মধ্যে বহুস্তরীয় মধ্যস্থ ছিল। অধিকাংশ সময়েই জমিদারদের সংগৃহীত রাজস্ব নবাবের কাছে পৌঁছত এই মধ্যস্থদের মাধ্যমেই। সপ্তদশ শতকে মনে হয় অধিকাংশ জমিদারই খুব ছোট আকারের ছিল(James Grant, 'Finances of Bengal' in W.K. Firminger (ed.), Fifth
Report, vol. II, pp. 176-91) এবং মুঘলদের পক্ষেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শুরুতে মুর্শিদকুলির রাজস্ব সংস্কারে বড় জমিদারদের আবির্ভাব ঘটল। এদের উদ্ভবে সুবায় ক্ষমতার কাঠামোর কোন পরিবর্তনটা ঘটল সেটা আমরা খুব তাড়াতাড়ি দেখব।

দেওয়ান হিসেবে মুর্শিদকুলির নিযুক্তি বাংলার ইতিহাসে খুব বড় বৈপ্লবিক ঘটনা। তিনি শুধু বাংলায় নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরিই করলেন না, তিনি সামগ্রিক রাজনৈতিক বোধেও পরিবর্তন আনলেন। তার প্রশাসনিক ক্ষমতা পরীক্ষিত। তাই তাকে সুচিন্তিতভাবেই আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল একটিই ছোট্ট নির্দেশ দিয়ে, বাংলার রাজস্ব বাড়াও। মুঘল প্রশাসন বহুকাল ধরেই মনে করত বাংলা থেকে দীর্ঘকাল ধরে কেন্দ্রিয় ভাণ্ডারে কম রাজস্ব যাচ্ছে এবং এই বাড়তি রাজস্ব লুটেপুটে খাচ্ছে মনসবদার আর জমিদারেরা(Risala, f.8b; also quoted in Calkins, 'Ruling Group', p.801)। রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতিতে বাংলার জমির দখলের পরিমানে এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন ঘটাল যেন তারা একটা নতুন প্রাদেশিক গোষ্ঠীবদ্ধ হল(formation of a new, regional group)। পরিবর্তনটিকে এইভাবে বলা যায় emergence of big zamindaries with a consequent decline in the total number of zamindaries, the increasing importance of larger zamindaries in the political system of the province and the enhancement in the power of the moneylender and banking class (ঐ)।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৭

দ্বিতীয় অধ্যায়
রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা
২।
অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বিপুল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের মোটামুটি পতন ঘটে যায়। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও পতনের দেওয়াল লেখা স্বপ্নভঙ্গের বেদনার ইঙ্গিত মিলছিল আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ সময় থেকেই, তারা তাঁর মৃত্যুর পর অবাঞ্ছিত গতিতে উর্ধ্বমুখে বেড়ে চলতে লাগল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অরাজক অবস্থা এবং বিশৃঙ্খলারই রমরমা দেখা দিল। ভারত জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক দুর্গতির পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল, বাংলা সে পরিবেশে এক্কেবারেই ব্যতিক্রম হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অষ্টাদশ শতকের সমগ্র প্রথম পাদ, বাংলার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশটি বজ্রমুষ্টি এবং দক্ষতা সম্পন্নভাবে চালিত করা হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও বাংলা সুবার প্রশাসনিক ব্যবস্থা মজবুতই ছিল। এই সময়ের প্রশাসনের চরিত্র নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, an elite ruling group which was representative of the political realities of the day coalesced and maintained rather high standards of administrative efficiency (P.B. Calkins, 'The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740',JAS, vol.XXIX, no.4, 197d, p.799.)। 
২.১ প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো
সপ্তদশ শতকে বাংলা সুবার প্রশাসনিক কাঠাম গড়ে উঠেছিল প্রমিত মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায়। ওপরের অংশটি দখল করেছিল মনসদবদারেরা, যারা কেন্দ্রের মুঘল সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি। তাদের এক সুবা থেকে অন্য সুবায় নিয়মিত বদলি করা হত, এই ভাবনায় যে কোন সুবাতেই যেন তাদের উদ্যোগে কোন স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে না ওঠে। কেন্দ্রের সরকার সুবাগুলির ওপর কড়া পকপড় বজায় রাখত উচ্চপদের আমলাদের নিয়মিত বদলি নীতি আর একে অপরের নজরদারির ভারসাম্য বজায় রাখার(checks and balances) ব্যবস্থাপনার নীতি অনুসরণ করে। সুবার প্রশাসন দুটি অংশে বিভক্ত – প্রশাসনিক বা ফৌজদারি এবং রাজস্ব বা দেওয়ানি – প্রত্যেকেই কেউ কারোর ওপরে নির্ভরশীল নয়। প্রথম পদটির নাম ছিল নবাব-নাজিম অথপবা সুবাদার এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল দেওয়ানের ওপর। সাম্রাজ্যিক ফরমানে দুটি পদের আমলাই নিযুক্ত হতেন, এবং প্রশাসনিক নির্দেশনামা চালিত হত সম্রাটের নির্দেশে তৈরি দস্তুরউলঅমল নামক নির্দেশনামা দ্বারা(Riyaz, p.248)।

কিন্তু দ্বৈত প্রশাসনে, পরস্পরের ওপর নজদারি আর ভারসাম্য রাখার দীর্ঘকালীন মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এই সুবায় অষ্টাদশ শতকে বাংলা সুবায় ভেঙ্গে পড়ল দুটো কারণে। প্রথমটা হল ১৭০০ সালে মুর্শিদকুলিখানকে দেওয়ান হিসেবে বাংলায় পাঠানোয়। আওরঙ্গজেব জানতেন মুর্শিদকুলি যোগ্য প্রশাসক, তাঁর আশা মুর্শিদকুলি তাঁকে নিয়মিত এবং প্রয়োজনীয় রাজস্ব বাংলা থেকে পাঠাবেন। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে যুদ্ধে জেরবার আওরঙ্গজেবের যেহেতু অন্যান্য সুবার রাজস্ব আদায় সূত্র প্রায় শুকিয়েই গিয়েছিল, তিনি মুর্শিদকুলিকে নিযুক্ত করে নির্দিষ্ট পরিমান রাজস্ব দাবি করলেন। মুর্শিদকুলি তার নিয়োগকর্তাকে নিরাশ করেন নি, প্রথম বছরেই তিনি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সুবায় রাজস্ব গণনা এবং আদায় করে ১ কোটি টাকা(যা পরের বছরগুলিতে বাড়বে) রাজস্ব পাঠালেন কেন্দ্রিয় তোষাগারে। দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত বৃদ্ধ আওরঙ্গজেবের কাছে নিয়মিত যাওয়া এই অর্থ আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে দাঁড়াল এবং তিনি তার কর্মচারীকে বাংলায় মুঘল প্রশাসনিক রীতিনীতি উল্লঙ্ঘন করে যা খুশি করার ছাড়পত্র দিলেন। মুর্শিদকুলি সুবায় তাঁর অবস্থান জোরদার করলেন ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে দেওয়ানি মুকসুদাবাদে(যা পরে মুর্শিদাবাদ রূপে পরিচিত হবে আগামী দিনে) স্থানান্তরিত করে।  এই কাজটা তিনি করলেন সুবাদার শাহজাদা আজিমউশ্বানকে উপেক্ষা(ঐ) করেই। সময়ক্রমে দেওয়ানের ক্ষমতায় আরোহন এবং তাঁর সম্মান আরও বাড়ল ১৭১৭ সালের ফরমানে তিনি সুবাদার নিযুক্ত হওয়ায়। মুঘল সুবায় এই প্রথম এই দুটি পদ একজনকেই অর্পন করা হল। সপ্তদশ শতকে বাংলায় যে ধরণের প্রশাসনিক কাঠামো ছিল, সেটির বিপুলাকার পরিবর্তন ঘটেগেল অষ্টাদশ শতকের প্রথমপাদেই।  এটই মুঘল প্রশাসনিক প্রথার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। 

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৬

ভূমিকা
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা অষ্টাদশ শতকের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করব। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করব ইওরোপিয় কোম্পানির কাজকর্ম। চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে কোম্পানিগুলির বাণিজ্য কর্ম এবং সওদাগর সমাজ নিয়ে আলোচনা হবে। ষষ্ঠ সপ্তম অষ্টম পর্বে সুতি ও রেশম বস্ত্র কাঠামো ও সংগঠন নিয়ে আলোচনা। নবম অধ্যায়ে ইওরোপিয় এশিয় বাণিজ্যে অন্যান্য পণ্যের প্রভাব আলোচিত হবে। দশম অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়ে পণ্যের দামের ঝোঁক নিয়ে আলোচনা করব। একাদশ অধ্যায়ে বাংলায় ব্রিটিশ বিজয় আলোচিত হবে এবং দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচিত হবে আমরা যে আলোচনা করলাম বিভিন্ন অধ্যায়ে, সেগুলি থেকে কোন সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি সেগুলি।
এই বইতে আমরা কতগুলি বিষয় উত্থাপন করব, সেগুলি হল, অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় আইন শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিলেও নবাবি নেতৃত্বে বাংলায় রাজনৈতিক স্থায়িত্বর জন্যে বাংলায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। বলা দরকার অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে স্থায়ী এবং শক্তিশালী সরকারের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। এর পরে যে ব্রিটিশ দখলদারি এবং উপনিবেশ তৈরি হল, তার জন্যে বাংলার কোন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট দায়ি নয়। দায়ি কোম্পানির আমলাদের উপউপনিবেশিক(sub-imperialism) উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এশিয় এবং অন্যান্য ইওরোপিয় বণিকদের প্রতিযোগিতায় লড়তে না পেরে ব্রিটিশ আমলাদের প্রায় ডুবতে বসা ব্যক্তিগত ব্যবসা বাঁচানো এবং একইসঙ্গে বাংলাকে দোহন করার জন্যে উপনিবেশ তৈরি করার উদ্যম।
দ্বিতীয়ত এই বইতে আমরা তর্ক করেছি, বাংলায় ভৌগোলিকভাবে অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে কোন আর্থনৈতিক পতন ঘটে নি। মধ্যঅষ্টাদশ শতাব্দে বাংলায় বিন্দুমাত্র কোন আর্থিক সঙ্কটের চিহ্ন ছিল না, বরং বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটছিল। বাজারে লক্ষ্যণীয় এবং দীর্ঘসময়ধরে কোন দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ঘটে নি। সমগ্র ১৭৩০এর দশক বা ১৭৪০এর দশকের প্রথম দিককার বিপুল রপ্তানির তুলনায় ১৭৫০এর দশকে বাংলা থেকে ইওরোপিয় রপ্তানির মূল্যমানের কোন ঘাটতি বা পতন দেখা দেয় নি। এই সময়ে এশিয় বণিকেরা বাংলা থেকে বিপুল পরিমানে সুতি আর রেশম বস্ত্র রপ্তানি করছে। এটাও মনে রাখা দরকার পলাশীর আগের সময়ে বাংলায় ব্যাপক পরিমান দামি ধাতু আমদানি করত এশিয় ব্যবসায়ীরা, ইওরোপিয়রা নয়।
তৃতীয়ত এটাও আলোচিত হয়েছে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই বাংলায় যখন ব্রিটিশ পকড় সম্পূর্ণ হল, তখন থেকে বাংলার অর্থনীতি দ্রুতলয়ে পতন হতে শুরু করল। বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড কারিগরদের অবস্থার দুর্দশা শুরু হল। তাঁতি, চরকা কাটনি, রেশম কারিগর এবং অন্যান্য পেশাজীবিরা, যারা তাদের দক্ষতা কোন রকম চাপে এবং নিপীড়নের বাইরে দাঁড়িয়ে উতপাদনে বিনিয়োগ করতে পারত, পণ্য তৈরি করতে পারত, তারা কোম্পানির শাসনে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় দাসে পরিণত হল। এশিয় ব্যবসায়ীরা যারা রপ্তানি বাণিজ্যে এতদিন প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিল, তাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাংলার ব্যবসার অর্থনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। এর ফলে বাণিজ্য এবং শিল্প উভয়ের পতন ঘটল। অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে নবাবি শাসনে যে বাংলা সমৃদ্ধির চরম শিখরে উঠেছিল, সে পলাশীর পর অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে শুরু করল। কোম্পানি এবং তার আমলারা শাসন ক্ষমতা দখল নেওয়ায়, বাংলার অর্থনৈতিক দুর্গতির শুরু হল এবং বাংলার পরম্পরার ব্যবসা এবং শিল্পএর ধ্বংস সাধন ঘটল। এই সব ঘটনা একসঙ্গে মিলে উপবিংশ শতকের শুরুতে বাংলায় ডেকে আনল অবর্ননীয় ব্যপক দুর্দশা।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৫

ভূমিকা
পঞ্চম অধ্যায়ে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির বাংলায় কাজকর্ম আলোচনা করে দেখব, ১৭৫০এর দশক পর্যন্ত বাংলায় ইওরোপিয় রপতানি ক্ষেত্রে কোন বড় পতনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। ১৭৩০ এবং ১৭৪০এর দশকে ব্রিটিশ কোম্পানির রপ্তানির হিসেবে কিছুটা ঢালএ গড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু এই উপাত্ত থেকে মনে করা ঠিক হবে না এর কারণ বর্গী হামলার পরের বাংলার আর্থিক সঙ্কট ঘণিভূত হচ্ছিল। এটাও আমরা দেখাব নানান ঐতিহাসিকের লেখায় মারাঠা আক্রমনের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়েছে, যদিও সেটা তার প্রাপ্য ছিল না। মারাঠা হ্যাঙ্গাম বাংলার অর্থনীতিতে কিছুটা প্রান্তিক প্রভাব ফেলেছিল কিন্তু সেটাও খুব কম সময়ের জন্যে। তথ্য দিয়ে আমরা দেখাতে পারি যে ইওরোপিয় বা এশিয় বাণিজ্যের পরিমান এবং মোট্ট মূল্যের খুব বেশি দৃষ্টিগোচর হয় নি ১৭৪০ এবং ৫০এর দশকগুলিতে। ১৭৫০এর দশকের প্রথম দিকে ইওরোপিয় বাণিজ্যের পতন ঘটলেও সেটা বাংলার পুষিয়ে যায় ডাচ রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায়।

ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির বাংলা কুঠির রপ্তানির বিপুল অংশ যেহেতু বস্ত্র ছিল আমরা সপ্তম অধ্যায়ে ব্রিটিশ এবং ডাচ বস্ত্র রপ্তানির বিশদ বিবরণ গভীরে গিয়ে উপস্থাপন করব। এবং এই ফল আমাদের ইন্টারেস্টিং ফল প্রদান করবে। ১৭৪০ এবং ৫০এর দশকে সুতি বস্ত্রের দাম বিপুল বেড়েছিল, সেই তথ্যাবলীও যে সত্য নয় সেটাও আমরা দেখাতে পারব(Brijen K. Gupta, Sirajuddaulfp,h, p. 33; l)..N. Chaudhuri, Trading World, pp. ,99-108; PJ ¥arshall, East ITJ,dianF ortun1s, p. 35; Bengal, pp. 73, 142-43, 163-64, 170)। একইভাবে অষ্টম অধ্যায়ে ডাচ এবং ব্রিটিশ কোম্পানির রেশম রপ্তানির বিশদ বিবরণ আলোচনা করব অষ্টম অধ্যায়ে; এবং আমরা দেখব, মধ্য অষ্টাদশ শতকে এশিয় বণিকদের রেশম বস্ত্র রপ্তানি ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির থেকে বেশ বেশি ছিল। ৫০এর দশকের প্রথম দিকে এশিয় বাণিকদের রেশম ও সুতি বস্ত্রের রপ্তানির মোট মূল্য, দুটি ইওরোপিয় কোম্পানির মোট মূল্যের সমান।

কিছু কিছু ঐতিহাসিক(S. Bhattacharyya,EastlndiaComp'any, p. 17. Marshall.Bengal, p. 80.) যুক্তি দিয়েছিলেন ১৭২০ এবং ১৭৪০এর দশকে বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলের অর্থনীতির একটা বড় অংশ ইওরোপিয়/ব্রিটিশ কোম্পানির দখলে চলে গিয়েছিল। এটা কোনওভাবেই সত্য নয়। আমাদের বিশ্লেষণে আমরা দেখাতে চেষ্টা করব, পলাশীপূর্ব সময়ে বাংলার অর্থনীতিতে ইওরোপিয়দের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে এশিয় বণিক তাদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি বাংলায় মাল কেনার জন্যে যে বিনিয়োগ, যাকে তারা ইনভেস্টমেন্ট বলত সেটা জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যেত। এই বিষয়টা আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এটাও আমরা দেখাব যে ইওরোপিয় কোপম্পানিগুলির পুঁজি পৌনপুণিকভাবে কম পড়ত, তারা স্থানীয় ধারের বাজার থেকে বিপুল পরিমানে অর্থ ধার করত। স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের নিয়ে আসা দামি ধাতু এবং মশলাকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করে সেটাকে পণ্য কেনার উপযোগী অর্থে রূপান্তরিত করার কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছিল, তাই দিয়ে তারা স্থানীয় অর্থনীতিকে কতটা প্রভাবিত করতে পারত সেটাও আমরা আলোচনা করব।

Monday, September 24, 2018

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৪

ভূমিকা
বাংলার সওদাগরদের চরিত্র বিষয়ে ভ্যান লেউর যা বলেছেন, আমাদের গবেষণাও তাই বলছে, তারা মূলত শাসক অভিজাত নির্ভর ব্যবসায়ী ছিল(].C. van Leur, Indonesian Trade and Society, p. 204.)। বাংলার সওদাগর সম্রাটদের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন এবং যে মহত্ব তারা অর্জন করেছিল অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত, তার একটা বড় কারণ তারা বাংলার নবাবদের বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। আমাদের পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচনায় দেখাব কিভাবে দরবারকে ভিত্তি করে এই সওদাগর সম্রাটদের উত্থান এবং বাড়বাড়ন্ত ঘটেছিল এবং যখনই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ঘটল, পলাশীর পরবর্তী সময়ে তারা এবং তাদের সমস্ত ব্যবসা হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে উদ্বায়ী হয়ে গ্যাল। আশ্চর্যের হল সম্প্রতি গুজরাট এবং সুরাটে দুজন ব্যবসায়ীর ওপর কাজ হয়েছে, সেখানে দেখা গিয়েছে তারা প্রশাসন নিরপেক্ষ হয়ে ব্যবসা বাড়িয়ে তুলেছে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা সরকারের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়াই নিজেদের খাড়া রাখতে সাহায্য করেছে(M.N. Pearson, Merchants and Rulers; Ashin Das Gupta, Indian Merchants)। ঠিক এই উদাহরণের বিপরীতে আমরা দেখাতে পারছি, কিভাবে হাতে হাত ধরে শাসক অভিজাত আর ব্যবসায়ীরা এক যোগে কাজ করেছ্যিল।

এই বইতে আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, ব্রিটিশদের বাংলা বিজয়। মোটামুটি সব ঐতিহাসিকই পলাশীর চরিত্র এবং বিজয়ের কারণ একই ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন – ব্রিটিশ বিযুক্তি। খুব সাম্প্রতিক গবেষনাতেও বলা হয়েছে বাংলার আভ্যন্তরীণ আর্থিক এবং রাজনৈতিক দুর্যোগের জন্যেই ব্রিটিশেরা অবশ্যম্ভাবীভাবে বাংলায় এসেছিল। এ প্রসঙ্গে বার বার বলা হয়েছে, ব্রিটিশদের পক্ষে কোন রকম রণনৈতিক পরিকল্পনা ছিল না, এবং বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে পরাজিত করতে পলাশীর চক্রান্তের শুরু করতে এবং ঘটাতে তাদের ভূমিকা ছিলই না। তারা বলেন যে ইওরোপিয়রা ব্যবসার মাধ্যমে যে বিপুল পরিমানে দামি ধাতু আনতেন, সেটির সঙ্গে বাংলার সামরিক, সওদাগর-ব্যাঙ্কার এবং জমিদারদের স্বার্থ জড়িয়েছিল। ফলে ১৭৫৬ সালে কলকাতা থেকে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে শাসক অভিজাত মেনে নিতে পারে নি, তার ফলে পলাশীর চক্রান্ত ঘটয়ে ব্রিটিশকে দিয়ে প্রশাসন দখল করে উপনিবেশ তৈরি করল (P.J. Marshall, Bengal, 56, 63, 65, 67, •77, 91; C.A, Bayly, Indian Society, 49-50; Rajat Kanta Ray, 'Colonial Penetration and Initial Resistance', IHR, vol. XII, nos. 1-2, 1986, pp. 4, 6, 7, 14.)। রাজনৈতিক সঙ্কটের তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে এটা দেখাতে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই অভিজাতদের সঙ্গে নবাবদের বিচ্ছিন্নতা ঘটে গিয়েছিল এবং তার ফলে নতুন শ্রেণীবিন্যাস ঘটে যায়। এটাও বলা হল, যে ব্রিটিশ দখলদারির আগে বাংলার আর্থিক দুর্গতি ঘটতে থাকে(P.J. Marshall, Bengal, p. 91)। এছাড়াও বহু ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন ১৭৪০ এবং ৫০এর দশকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাহ্যত এবং দীর্ঘকালীন মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকে(Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 33; K.N. Chaudhuri, Trading World, pp. 99-108', 159, 311-12; .P.J. arshall ,EastlndianFortunes, p. 35; Bengal, pp. 7r, 73, 91, 142-43, 163-64, 170)।

কিন্তু আমরা এই বইতে দেখানোর চেষ্টা করেছি ব্রিটিশ বিজয় কোনভাবেই অনিচ্ছাকৃত বা হঠাত ঘটে যাওয়া ঘটনা ছিল না। একাদশ অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছি, কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা স্বার্থেই পলাশী এবং বাংলায় দখলদারি ঘটেছে। ফরাসী কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার বাড়বৃদ্ধির জন্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা মার খাচ্ছিল। তাই ফরাসীদের ধ্বংস করা(পলাশীর আগে চন্দননগর আক্রমন) যার ফলে ব্রিটিশ বিরোধী বঙ্গ-ফরাসী জোট তৈরি হওয়ার দিকে সময়টা এগোচ্ছিল সেটিও বাধাপ্রাপ্ত হয় আরেকদিকে নবাবকেও ক্ষমতাচ্যুত করার দরকার হয়ে পড়ে কারণ তিনি ব্রিটিশদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা আর দস্তকের যথেচ্ছ বেআইনি দুর্ণীতিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে বহু অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলছিলেন নিয়মিত। ফলে কোম্পানির আমলাদের উপউপনিবেশিকতা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। বাংলার অভিজাতদের সঙ্গে ইওরোপিয়দের নতুন করে শ্রেণী সমঝোতা গড়ে ওঠার বিরুদ্ধে একটাই মন্তব্য করা যায়, যে সওদাগর সম্রাট যারা পলাশীর বিপ্লবে অন্যতম কুশলী ছিলেন, তাদের মুল রোজগার কিন্তু ইওরোপজাত ব্যবসা সঞ্জাত উদ্বৃত্ত ছিল না। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাজনৈতিক কাঠামো আলোচনা করতে গিয়ে যে নতুন শ্রেণী সমঝোতা তৈরি হল, তার ভিত্তি হল ব্যক্তিগর স্বার্থ সাধন, কোন সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল না, এবং এই জন্যে এই সমঝোতা ক্ষণস্থায়ী হল। এছাড়াও আমরা দশম অধ্যায়ে দেখব যে সময়ের আলোচনা আমরা করছি সে সময়ে যে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছিল তাকে কোনো ভাবেই উল্লেখাযোগ্য এবং দীর্ঘসময়ের বলা যায় না।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৩

ভূমিকা
মধ্যঅষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি বাংলার সমৃদ্ধি বিষয়ে এত সচেতন হয়ে পড়ে যে তারা বাংলাকে জয় করার পরিকল্পনার স্বপ্ন ছকতে থাকে। বহু উদাহরণে আমরা দেখাতে পারি, ১৭৫০এর আগে বাংলা দখলের পরিকল্পনা করে লেখালিখি করতে থাকে(Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp."35-37.)। ফলে ব্রিটিশদের হাতে পলাশী বিজয় কোন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনাও নয় বা এটা হঠাতও ঘটে নি। পলাশী ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পত্তনের সূচনাবিন্দু। বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন, ইওরোপিয়দের কাছে এমন একটি সুযোগ এনে দিল, যেখান থেকে ব্রিটিশেরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করে সারা ভারত দখল করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে যে বাংলা ছিল সমৃদ্ধশালী ভৌগোলিক এলাকা, সেটি নিতান্তই গরীব এক উপনিবেশের পরিণত হল ব্রিটিশদের হাতে পড়ে। ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলা বিশ্বের উতকৃষ্টতম কারিগরি শিল্পকেন্দ্র থেকে রূপান্তরিত হল শুধু একটি কাঁচামাল রপ্তানির কেন্দ্র হিসেবে। এই পরিবর্তনের মাত্রা বুঝতে আমাদের উপনিবেশপুর্ব র সময়ের ব্যবসা, শিল্প, বাজার এবং সওদাগরদের অবস্থা বোঝা জরুরি। এই বইটার উদ্দেশ্যও তাই। উপনিবেশের সময়ে পরম্পরার শিল্প বিশেষ করে তাঁত এবং রেশম, উনবিংশ শতকে এক্কেবারেই পর্যুদস্ত হয়ে যায়, এই তথ্যে আজ আর কোন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় হয় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই দুটি শিল্প অষ্টাদশ শতকের প্রথমপাদ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান বিশ্ববাজারের খাঁই মিটিয়েছে। এরই সঙ্গে আমরা এই শিল্পের কাঠামো এবং সংগঠন বিশদে বুঝব ৬, ৮, ৯ অধ্যায়ে, যার মাধ্যমে অমরা আন্দাজ করতে পারব কিভাবে বাংলার শিল্প এশিয় এবং ইওরপিয় বিপুল চাহিদা পূরণ করত বিন্দুমাত্র উতপাদনের প্রযুক্তি পরিবর্তন না ঘটিয়েই।
এই বইটি এই সময়ের এবং এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বৃহত্তর বিষয় আলচনা করবে। ভারত বিষয়ক অধিকাংশ কাজে বিশেষ করে বাংলা নিয়ে কাজে ইওরোপিয় ব্যবসাকে বিপুল গুরুত্ব দেওয়া হয়(S. Bhattacharya, East India Company ( 1954); S. Chaudhuri, Trade and Commercial Organizataion (1975); K.N. Chaudhuri, Trading World (1978); Om Prakash, Dutch Company (1985); S. Arasaratnam, Merchants, Companies and Commerce (1986))। এই কাজে এশিয় বণিকদের বাণিজ্যের বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়। আমরা অস্বীকার করছি না আলোচ্য সময়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা ইওরপিয় বাণিজ্যের সূত্রে বিপুল পরিমান দামি ধাতু আমদানি ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে এটাও দেখান যাক মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলা থেকে এশিয় বণিকদের এই দুটি দামিতম পণ্য সুতি আর রেশম বস্ত্রের রপ্তানির পরিমান ইওরপিয়দের রপ্তানির পরিমান থেকে অনেক বেশি। এর থেকে এটাও প্রমানিত হয় যে বাংলা থেকে পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ায় পণ্য পাঠানোর ভূপথের রাজপথ বাণিজ্য মুঘল, সাফাভি এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও এক্কেবারে ধ্বংস হয়ে যায় নি, এটাওগুরুত্বপূর্ণ যে ১৭৭০এর দশকে এশিয় বানিকেরা ইওরোপিয় বণিকদের চাপে যখন বিপর্য্যন্ত, তখনও বেশ কিছু পরিমানে রেশম রপ্তানি হচ্ছে লাহোর এবং মূলতানে, বহুকাল ধরে যেটা যাযাবরদের ক্যারাভান করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পরম্পরার মুল কেন্দ্র(নোডাল পয়েন্ট) হিসেবে পরিগণিত হত। ইওরোপিয় এবং এশিয় মহাফেজখানা জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথম পাদের রাজপথীয় বাণিজ্যের বিপুল তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব।
প্রখ্যাত ডাচ ঐতিহাসিক, J.C.van Leur এশিয় বাণিজ্যকে চরিত্রায়িত করেছেন মূলত পথবাণিজ্য(peddling trade) বা হকার বাণিজ্য এবং ধনীদের জন্যে বিক্রিত পণ্যের বাণিজ্যের মিলিত রূপ হিসেবে(J.C: van Leur, Indonesian Trade and Society, pp. 132-33, 197-201, 219-20.)। এই পথ ব্যবসায়ের তত্ত্বটি সাম্প্রতিক গবেষণায় আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরেকজন প্রখ্যাত গবেষকের কাজে, এবং তিনি বিষয়টাকে এমন এক পর্যায়ে নামিয়ে এনে দাবি করেন যে সুরাটের প্রখ্যাত সওদাগর মুল্লা আবদুল গফফর নাকি ছিলেন একজন পথব্যবসায়ী বা হকার(Niels Steensgaard; Asian Trade Revolution, pp. 22-59; Ashin Das Gupta, Indian Merchants, pp. 11-13)। তবে নীলস স্পষ্টভাবে দেখান যে এশিয় বাণিজ্য মূলত ছিল অবিলাসদ্রব্য ভিত্তিক(Ashin Das Gupta, 'The Maritime Merchant, 1500-1800', Proceedings of the Indian History. Congress, Presidential Address, 35th Session, pp. 99-111)। বাংলার ক্ষেত্রেও দেখানো যায় বাংলা থেকে এশিয়া জুড়ে মূলত রপ্তানি হচ্ছে সাধারণ ক্যালিকো, দামিতম মসলিন বা সূক্ষ্ম ক্যালিকো নয়(সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। পথের হকার ব্যবসা হিসেবে বলা যায় আমরা এই বইএর পঞ্চম অধ্যায়ে দেখিয়েছি, বাংলার প্রধান সওদাগর-ব্যাঙ্কার জগত শেঠ, কলকাতার উমিচাঁদ এবং আরমেনিয় খ্বাজা ওয়াজিদকে আমরা কোন ভাবেই, কোন সূত্রেই হকার বণিক বলতে পারি না। তাদের কাজের বিস্তৃতি, তাদের বাণিজ্য সাম্রাজ্য সূত্রে হয়ত তারা মেদিচি, ফুগার্স বা ট্রিপসের সঙ্গে তুলনীয়।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী২

ভূমিকা
বাংলা প্রথম সুবা যেটি প্রথম বিদেশি উপনিবেশে পরিণত হয়, তাই এই এলাকার ঔপনিবেশিক পূর্ব সময়ের ইতিহাস, বিশেষ করে ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প এবং অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বইটি ১৭৫৭র পলাশী যুদ্ধের আগে বাংলার অবস্থা কি ছিল এবং তার পরেই বা তার পরের ঔপনিবেশিক আমলে কি কি পরিবর্তন ঘটেছে সে সব আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ন। যদিও ঔপনিবেশিক শাসন কিভাবে পরম্পরার অর্থনীতির ওপর পড়েছিল, সেই গবেষণা প্রচুর পরিমানে ঘটেছে(এ বিষয়ে কিছু কাজের জন্যে এই বইগুলি পড়তে পারেন N.K.Sinha, Economic History of Bengal, 3 vols.; D.B.Mitra, Cotton Weavers of Bengal; Hameeda Hossain, Company, We~vers of Bengal; T. Rayc_haudhuri, 'The mid-Eighteenth Century Back~round' and S. Bhttacharya 'Regional Economy (1757- 1857): Eastern India' in Cambridge Economic History of India, vol. II.), কিন্তু উপনিবেশপূর্ব সময়ের অব্যবহিত আগে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অবস্থা কি ছিল সে সব নিয়েও খুব বেশি কাজ হয় নি। এই বইটি বাংলার আলোচ্য সময়ের বিশদ বিবরণ পেশ করে। এটাও আমরা বলেছি ব্রিটিশপূর্ব সময়ে বাংলার সমৃদ্ধি(প্রথম পাতার দ্বিতীয় টিকা The word 'prosperity' is used here in the sense indicating a thriving state of affairs, especially in trade and industry, in contradistinction to the decline which was clearly manifest in the second half of the eighteenth century and culminated in the early nineteenth.) নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠা উচিত নয়, এবং পরম্পরার ব্যবসা এবং উতপাদনের অধোগমনের পথ তৈরি হয় অষ্টাদশ শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথম বিষয়টা খুব কম আলোচ্য, তাই আমরা ১৭৫৭ পর্যন্ত সময়ের বিশদ আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে পরের সময়ে সে সব পতনের ইঙ্গিত দেখাযাচ্ছিল তাকে সূত্রায়িত করব। তাই অষ্টাদশ শতকের বাংলা আমাদের কাছে একটি নিদর্শন হিসেবে কাজ করবে, কিভাবে একটি সমৃদ্ধশালী ভূখণ্ড বৈদেশিক শাসনে নিশ্চিতভাবে পতনের দিকে যায়। ভৌগোলিকভাবে মুঘল সুবা আজকের পশ্চিমবাংলা, বিহার, ওডিসা এবং আজকের আধুনিক বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত ছিল।

বিগত দুই শতাব্দ ধরে বাংলা মুঘল আমলের অন্যতম সমৃদ্ধশালী সুবা হিসেবে গণ্য হত। মধ্য সপ্তদশ শতকে, হয়ত তার আগেও এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে ওঠে। এর উর্বর ভূমিতে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ধরণের উতকর্ষময় ফসল উৎপাদন হত, এর সঙ্গে বিপুল দক্ষ অসংখ্য কারিগর এবং তাঁতি এবং চরমভাবে বিকশিত আর্থিক ক্ষেত্র এবং যোগাযোগের ব্যবস্থা তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডে পরিণত করে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমপাদ পর্যন্ত যে বিপুল রাজস্ব বিলেই হোক বা নগদ সম্পদেই হোক নিয়মিত দিল্লির দরবারে পাঠিয়েছে। নিয়মিত বিপুল উদ্বৃত্ত তৈরি এবং এই উদ্বৃত্তকে খুব সহজে নগদী অর্থে পরিণত করার ক্ষমতায় ইওরপিয়রা এই এলাকাকে যে অধিকাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমঃশ তাদের ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে থাকে সেটাও খুব আশ্চর্যের নয়। বাংলা সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে প্রায় সব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এশিয় ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে থাকে এবং বাংলাকে তাদের সম্ভাব্য উপনিবেশ ক্ষেত্র হিসেবে হিসেবে দেখতে থাকে। সোনা দিয়ে বাংলার পণ্য কিনে, বিপুল রপ্তানি উদ্বৃত্ত তৈরি করত সওদাগরেরা, তাতে বাংলার বদনাম ছিল যে সে এশিয়ায় সমস্ত সোনার খাদক হয়ে উঠছে আর এখান থেকে এক কণাও কোথাও বেরোয় না(Alexa,nder Dow, Hindostan, vol. III, p. lxii.)। এই প্রসঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ন তথ্যটিও মনে রাখা দরকার যে শুধুই ইওরপিয়রাই বাংলায় সোনা বয়ে নিয়ে আসত না ব্যবসার জন্যে, এশিয় ব্যবসায়ীদেরও নগদ অর্থ আর দামি ধাতু দিয়ে বাংলায় ব্যবসা করতে হত। আজ আর এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে বাংলা ছিল অতীব স্বনির্ভর, রূপো, (এবং সোনা - অনুবাদক)ছাড়া এ দেশে বিদেশি পণ্য আনায় যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা ছিল। আর যে পণ্যটি আসত সেটি হল তুলো এবং অন্যান্য অদামি ধাতু এবং ধনীদের ভোগ্যপণ্যাদি – রপ্তানির তুলনায় যার মোট মূল্য তুচ্ছই ছিল।

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী১

<ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব শেষ হয়েছে। এবারে সুশীল চৌধুরী। ট্রুস্কের মতই সুশীলবাবুর কাছে আমরা উপনিবেশপূর্ব সময়ে বেশ কিছু ভুল তথ্য অপনোদন করিয়ে দেওয়ার জন্যে কৃতজ্ঞ। এর আগে দুটি অধ্যায় এবং একটি প্রবন্ধ যতদূরসম্ভব পরে সেটি বইএর অংশ হয় সেটি অনুবাদ করা গিয়েছিল। সেটি প্রাথমিক উত্তেজনাবশে। শান্ত হয়ে ব্রিটিশপূর্ব সময়ের নানান ধারনা পাল্টে দেওয়ার জন্য দায়ি বইটিকে অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল। বিশেষ করে পলাশীর সময়ের ইংরেজদের ভূমিকা নিয়ে এবং ইওরোপিয় বণিকদের আর্থিক (অ)সামর্থ্য বিষয়ে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলার আর্থিক ইতিহাসে বইটির গুরুত্ব উপনিবেশপূর্ব সোনার বাংলাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করায়। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের চর্চায় সুশীলবাবুর অন্যান্য বইএর মতই এই বইটাও আমাদের অবশ্যপাঠ্য।>
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
গত দেড় দশক এই বইটির তথ্যসংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে আমি যে সব ব্যক্তি এবং সঙ্গঠনের থেকে সাহায্য, সহযোগিতা এবং সহায়তা পেয়েছি, তাদের সক্কলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। Maurice Aymardএর সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই বই বাস্তবে রূপ পেত না। অন্যান্য সকলের থেকে তার কাছে আমার সর্বাধিক কৃতজ্ঞতা। হেগে Algemeen Rijksarchief কাজ করার সময় সময় D.H.A. Kolff এবং তাঁর স্ত্রী Annemarie,র আতিথ্য ভোলার নয়, যতবার হেগে গিয়েছি, তাদের আতিথ্য আমায় পুর্ণ করেছে, তারা ছাড়া সেখানে কাজ করার স্বপ্ন সফল হত না। কে এন চৌধুরী ব্রিটিশ কোম্পানির মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু বিশদ তথ্য আমায় ব্যবহার করতে দিয়ে আমায় গভীর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির Centre of Advanced Study in History বিভাগের Cartographic Sectionএর কাছে আমি কৃতজ্ঞ মানচিত্রগুলি তৈরি করে দেওয়ার জন্যে। আমায় সহযোগিতা করার জন্যে কৃতজ্ঞ ইরিফান হাবিব এবং তাঁর পুত্র ফৈজের কাছে। যে সব বন্ধু বইটির খসড়া পাঠ করেছেন এবং আমায় নানান ধরণের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এবং পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের সক্কলকে ধন্যবাদ। এদের মধ্যে আছেন, Maurice Aymard; Gautam Bhadra, Wayne 'te Brake, Basudeb Chattopadhyay, Benoy Bhusan Chaudhuri, D.H.A. Kolff, Michel Morineau এবং Immanuel Wallerstein। বইটি তৈরির ভাবনার সময় যে সব সহকর্মীর সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি তাদের কাছেও কৃতজ্ঞতা কম নয়। আমি যাদের কথা এই মুহূর্তে মনে করতে পারি তারা হলেন, C.A. Bayly, Richard Barnett, Paul Butel, J.R. Bruijn, Satish Chandra, K.N. Chaudhuri, Ashin Das Gupta, Rich~rd Eaton, F.S. Gaastra, Irfan Habib, Philippe Haudreres, Eugene Irshick, Keram Kevonian, De'nys Lombard, P.J. Marshall, Shireen Moosvi, Frank Perlin, Om Prakash, Tapan Raychaudhuri, Dietmar Rothermund, H. van Santen, Sanjay Subrahmanyam, Agnes Vercamann and Andre Wink।
এই কাজ সফল করতে বিভিন্ন মহাফেজখানায় আমায় প্রভূত সময় কাটাতে হয়েছে, সেই কাজে আমায় দরাজহাতে সহায়তা করেছেন বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ব্রিটেনের কমনওয়েলথ কমিশন আমাকে Commonwealth Staff Academio Fellowship পেতে সাহায্য করে ১৯৭৮-৭৯ সালে আমায় ব্রিটিশ মহাফেজখানায় কজের জন্যে। এছাড়াও British Council, Indian Council of Historical Research, Indian Council of Social Scienc«r Research, University of Leiden and Maison des Sciences de l'Homme, Paris, ইত্যাদি সঙ্গঠনগুলির আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতায় আমার দেশে বিদেশে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমার বিশেষ ধন্যবাদ রইল Royal Netherlands Academyর কাছে যারা আমায় ১৯৯০-৯১ সালের এক বছর Netherlands Institute of Advanced Studyতে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেখানে আমি বইটির প্রথম খসড়া করি। Netherlands Institute of Advanced Study থাকার সময় D.J. van de Kaa আমায় অসাধারণ সহায়তা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গঠনেরই Eves de Roo আমার বিপুল পরিমান সংগৃহীত তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্যে লোটাস ১২৩টি শেখান। এছাড়াও তিনি আমায় হাভার্ড গ্রাফিক্সে ছবি তৈরি করার শিক্ষা দ্যান। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। পুত্র শিলাদিত্যর থেকে বেশ কিছু কম্পিউটারের প্রোগ্রাম চালানো শিখি, সেও আমার কাজের বিভিন্ন সময়ে সহয়ক হয়েছে।
বইএর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে নানান শিক্ষাকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে সেমিনার/সম্মেলনে উপস্থাপন করার সুযোগ হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka; University of British Columbia, Vancouver; University of California, Berkeley; Centre d'Etudes de l'Inde et de l'Asie du Sud, Paris; Columbia University; Heidelberg University; University of Leiden; Oxford University; School of Oriental and African Studies, London; University of Virginia, Charlottesville; University of Washington, Seattle। এইসব সময়ে যে সব গবেষক আমার উপস্থাপন শুনে বিভিন্ন মন্তব্য ও এবং পরামর্শ দিয়ে আমায় বাধিত করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আমার কৃতজ্ঞতা।
এই পাণ্ডুলিপির বপড় একটা অংশ কম্পিউটারিকৃত করেছেন Pilar van Breda-Bergueiio , Anne Simpson, NIAS থাকাকালীন সময়ে অপূর্ব দক্ষতায় এবং শান্তচিত্তে। তাদের দুজনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার সহকর্মী অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্ত্রী মহাশ্বেতা আর কন্যা পরমা পান্ডুলিপির নানান সংশোধনে সহায়তা করেছেন। মনোহরের রমেশ জৈনের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ মন দিয়ে প্রকাশনাটি সম্পাদনার জন্যে। ইন্দ্রনাথ মজুমদার এই বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী, তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা। এই বইটির নানান কাজকর্ম দেখাশোনা করেছেন আমার স্ত্রী অসম্ভব দৃঢ়তায় এবং শান্তচিত্তে। এই বইটি আমি তাঁর উদ্দেশ্যে উতসর্গ করলাম।

ক্ষমতাকে খাদ্য কর - পাল্টা নয় আলাদা হও

আমরা কি ক্ষমতার বিরুদ্ধে পাত্তা পেতে পাল্টা ক্ষমতা তৈরি করতে যাচ্ছি, যে তোরা আমাদের খিস্তি করেছিস, নে আমরা তোদের পাল্টা দিলাম না আমরা আলাদা হলাম।
সে যে নানান ভারতীয় সাহিত্যে নেই, তা নিয়ে তার কোন হীনমন্যতা ছিল না - বাকি ভারত তাকে নিয়ে কি ভাবত, না ভাবত তাতে বাংলার কোন দিনই কিস্যু আসে যায় নি, সে নিজের মত করে কয়েক হাজার বছর করে আলাদাভাবে বেড়েছে - আলাদা কৃষ্টি, আলাদা জীবনযাত্রা, আলাদা রাজনীতি, আলাদা (পাল্টা নয়) উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করেছে, হাজার হাজার উৎপাদন, হাজার হাজার বিক্রেতার, আর্থ-সামাজিক সাম্যাবস্থার জন্য বাংলায় মহিলাদের উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহন অনেক বেশি ছিল সেদিনও, আজও আছে। আকবর পাদশা দিনিইলাহির জন্য বাংলা থেকে পর্তুগিজদের নিয়ে যান কিন্তু বাংলার ভারত বিখ্যাত নৈয়ায়িক বা বাংলা-বৃন্দাবনের গৌড়িয় বৈষ্ণবদের ডাকেন নি। তাতে কি নৈয়ায়িক বা গৌড়িয় বৈষ্ণবদের আদর কমেছে? না তারা আকবর পাদশাহর পাল্টা ধর্ম দরবার তৈরি করেছিল? না তার নিজস্বতা হারিয়ে গিয়েছিল?
কুড়মালি সমাজের বন্ধুরা নিজেদের উতসাহে চিসই লিপি তৈরি করেছেন, প্রাইমার ছাপিয়েছেন, ৫০টার বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালাচ্ছেন গ্রামে গঞ্জে নিজেদের উদ্যমে, নিজেদের খরচে, এক্কেবারে রাষ্ট্রীয় উদ্যমের বাইরে দাঁড়িয়ে, একবারও রাষ্ট্রকে বলতে যান নি আমাদের স্বীকার কর, রাষ্ট্র স্বীকার করবে কি না করবে সেটা রাষ্ট্রের বিষয়। রাজ্য সরকার কুড়মালি আকাদেমি করল, এই আলাদাভাবে কাজ করা মানুষেরা তার অংশ নয়। তারা কি গোঁসা করে তাদের কাজ থামিয়ে দিয়েছে? বরং সীমিত সাধ্যে আরও বড় কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।
ক্ষমতার কাজটাই হল, তার বিরুদ্ধ মতকে পাল্টা আঘাত দিয়ে তার মত করে চালনা করা - অথপবগা পাল্টা হিসেবে দাঁড় করয়ে তার গুরুত্ব বাড়ানো। আমরা ক্ষমতার এই এজেন্ডা ধরে ফেলেছি।
আমরা পাল্টা নই আমরা আলাদা।

আওরঙ্গজেবঃ দ্য লাইফ এন্ড লেগাসি অব ইন্ডিয়াজ মোস্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল কিং৬৪ - অড্রে ট্রুস্কে



কি কি বই – একটি প্রবন্ধ২
তার লেখা বিপুল চিঠিই তাঁর নিজের চরিত্র চিত্রণ – আমি সেই সূত্রধরে তাঁর বক্তব্য অনুসরণ করে, অধিকাংশ মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকদের তৈরি করা আওরঙ্গজেবের চরিত্রর বাইরে নতুনভাবে তাঁকে খুঁজে পেয়েছি। আজ আওরঙ্গজেবের দুহাজার চিঠি আমরা পড়তে পাই ফারসিতে। চিঠির যে সব সংকলন বার হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আদাবইআলমগিরি, কালিমাতইতাইয়াইবাত, রাকিমইকারামি এবং রুকাতইআলমগিরি (আমি মূলত বিলমোরিয়ার অনুবাদ ব্যবহার করেছি, তবে মাঝে মধ্যে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে)। এছাড়াও ছাপা না হওয়া দস্তুরঅলআলমাঘহায়ি এবং আহকমইআলমগিরি(যদুনাথ যে এনেকডোটস অব আওরঙ্গজেব অনুবাদ করেছেন, এটা সেটা নয় চিঠির সঙ্কলন)। যদুনাথ সরকারের এনেকডোটস অব আওরঙ্গজেব (কলকাতা ১৯১৭)তে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বেশ চালু, মনোহরণ, চটপটে কিছু গপ্প আছে, কিন্তু অনেকগুলোর ঐতিহাসিক ভিত্তি গণ্ডগোলের। যদুনাথ জানতেন বলেই নিজেই প্রতিটা গল্পের টিকায় সঠিক তথ্য উল্লেখ করেছেন। আমি যদুনাথের এনেকডোট...টা সন্তর্পনে ব্যবহার করেছি, বিশেষ করে তার কথিত দ্বিতীয় ইচ্ছের(উইল) কথা আমি স্বীকার করিনি(Anecdotes, 51–55)।
আওরঙ্গজেব নিজের কথা বলেছেন বেশ কিছু ফরমানে এবং নিশানে। আমি জ্ঞান চন্দ্রের আওরঙ্গজেবের ফরমান বিষয়ে প্রবন্ধ ব্যবহার করেছি – ঐ, আবার সন্তর্পণে তথ্য তুলেছি, বিশেষ করে হিন্দু মন্দির ধ্বংস বিষয়ে এবং S. A. I. Tirmizi’s Mughal Documents (Delhi, 1995)ও ব্যবহার করেছি।
আওরঙ্গজেবের সময়ের খবর সমীক্ষা(নিউজ রিপোর্ট বা akhbarat) বেশ কিছু মহাফেজখানায় থেকে গিয়েছে, আমি সেগুলোর পরোক্ষ সূত্র থেকেই ব্যবহার করেছি। মুনিস ফারুকির প্রিন্সেস অব দ্য মুঘল এম্পায়ার বইতে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রাখা আখবারাতইদরবারইমুয়াল্লার তথ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।
---
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে পরোক্ষ তথ্য প্রচুর কিন্তু আশংকার হল সেগুলি গভীরতাহীন। উনিবিংশ শতকে এলফিনস্টোনের(১৮৪১) এবং স্ট্যানলি লেন-পুল(১৮৯৩)এর ছাপার সংস্করণ পাওয়া যায় কিন্তু তথ্যে গন্ডোগোল আছে। আমি এই বই ব্যবহার করি নি। স্বশিক্ষিত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার(১৮৭০-১৯৫৮)। বিংশ শতকে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যত কাজ হয়েছে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনিই করেছেন। তিনি ইংরেজিতে আওরঙ্গজেবের চিঠি অনুবাদ করেছেন, এবং অবশ্যপাঠ্য পাঁচ খণ্ডে হিওস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব লিখেছেন। বহুকাল ধরে যদুনাথ আওরঙ্গজেব বিষয়ে শেষ কথা বলতেন। কারণ তাঁর আগে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিশদ গবেষণা কেউই করেন নি প্রায়। আস্তে আস্তে যখন গবেষকেরা আওরঙ্গজেবের সময় জানতে বুঝতে শুরু করলেন, তখন দেখলেন আওরঙ্গজেবকে যদুনাথ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, মানুষটা তার থেকে অনেকটা আলাদা। তার প্রতি সম্মান জানিয়েই বলা দরকার তার তৈরি করা আওরঙ্গজেবের চরিত্র সাম্প্রদায়িক রঙ্গে রাঙ্গানো এবং কিছু কিছু জায়গায় খুব বড় ঐতিহাসিক ভ্রান্তি আছে। যারা যদুনাথ সরকারের কাজের পদ্ধতি এবং ভাবনা বিষয়ে বিশদে জানতে চান তাদের অবশ্যই দীপেশ সরকারের The Calling of History: Sir Jadunath Sarkar and His Empire of Truth (Chicago, 2015) পড়তে হবে।
খুব সম্প্রতি আওরঙ্গজেবকে নিয়ে গবেষণা অনেকদূর এগিয়েছে। আগে যাদের নাম করেছি, তাদের সঙ্গে অবশ্যই পড়তে হবে M. Athar Ali, Satish Chandra, S. M. Azizuddin Husain, Irfan Habib, Harbans Mukhia, and John Richards কে। বহু গবেষক আওরঙ্গজেবের সময়ের নানান বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন যেমন, Catherine Asher (architecture), Richard M. Eaton (temple desecration), Louis Fenech (relations with Sikhs), Yohanan Friedmann (banning of Sirhindi), Jos Gommans (battles and Deccan years), Stewart Gordon (Mughal-Maratha conflict), B. N. Goswamy (Hindu ascetics), J. S. Grewal (Hindu ascetics and Sikhs), Alan Guenther (Fatawa-i Alamgiri), Robert Hallissey (relations with Rajputs), Shalin Jain (relations with Jains), Heidi Pauwels (Keshava Deva Temple), Katherine Butler Schofield (née Brown) (music), and Taymiya Zaman (Bhimsen Saxena)। বিনয় লালের ওয়েবসাইট মানস ((www.sscnet.ucla.edu/southasia/)) আওরঙ্গজেবের সময়ের নানান বিতর্কিত বিষয় নিয়ে নানা প্রবন্ধ সঙ্কলন করেছে। এছাড়াও আওরঙ্গজেবকে কিভাবে বৃহত্তর মুঘল সাম্রাজ্যের পরিসরে দেখা যায় সেই বিষয় নিয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে, Michael H. Fisher, A Short History of the Mughal Empire (London, 2016); John F. Richards, The Mughal Empire (Cambridge, 1993); and Francis Robinson, The Mughal Emperors and the Islamic Dynasties of India, Iran, and Central Asia, 1206–1925 (New York, 2007)।
এই বইটি লিখছি লেখার সময় বেশ কিছু অগ্রন্থিত বন্ধু-সহকর্মী কাজ যেমন, Supriya Gandhi (Dara Shukoh), Yael Rice (painting) ইত্যাদি দেখি। এছাড়াও জুরিখে আয়োজিত European Association for South-Asian Studies Conference সম্মেলনের আওরঙ্গজেব বিষয়ে প্যানেলের বহু গবেষকের কাজ দেখেছি। আজ আমরা অনেকে নতুন করে আওরঙ্গজেবকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি, বহু গবেষক বর্তমানের বহু পরোক্ষ তথ্য অবলম্বন করে সেই সময়ের এই মানুষটাকে জানতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছেন। 
---
শেষে আওরঙ্গজেব বিষয়ে কিছু কাজ এবং দুর্বলতা উল্লেখ করা যাক। আজকে হয়ত আওরঙ্গজেবের ওপরে মুঘল পরিবারের সদস্যদের তুলনায় সব থেকে বেশি কাজ হয়েছে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র অবলম্বনে লিখিত হয়েছে যেমন আখবারাত, যা সাধারণত গবেষকদের আওতার বাইরেই থেকে যায়। এছাড়াও নিয়মিত বেশ কিছু নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে আওরঙ্গজেব বিষয়ে। উদাহরণস্বরূপ ২০১১ সালে আলিগড় মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলমারি থেকে তাঁর একটি তরোয়াল টপকে এ সময়ে নেমে পড়েছে। ক্রিস্টিজে নিলামে ওঠা ফরমান ২৭৫০০ ডলারে পাওয়া গিয়েছে। যারা আওরঙ্গজেবকে নিয়ে গভীর গবেষণা করতে চান তাদের তথ্য সম্পদ নিয়ে কোন সমস্যা নেই।
সাধারণ পাঠক এবং গবেষক উভয়কেই ভাবতে হবে ঐতিহাসিক তথ্য আর বৈধ ঐতিহাসিক দাবি কাকে বলে। যারা আওঙ্গজেবের বর্বরতা্র ‘নিদর্শন’ দিয়ে থাকেন, তারা আদতে আধুনিক সময়ে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের মধ্যে ঢুকে পড়ে মিথ্যা প্রচারে খুবই উৎসাহী হন এবং নির্ভর করেন ভুল অনুবাদে এবং মিথ্যা তথ্যে। যারা আওরঙ্গজেবকে দোষ দ্যান তাদের অধিকাংশেরই ইতিহাসকে কিভাবে দেখতে হবে সে বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই এবং আধুনিকপূর্ব ফারসি বিষয়ে তাদের জ্ঞান শুন্যের কোঠায়। জনগণতান্ত্রিকভাবে লিখিত জনপাঠ্যগুলি বর্জন করুণ চোখবুজে, যেগুলি বাজারে ছেয়ে গিয়েছে বিপুলভাবে। এই বই পরিচিতিটি লিখলাম, বিপুল বিশাল তথ্য পরিসরে খুব কম সত্যভিত্তিক চরিত্র চিত্রিত সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগিরকে উদ্দেশ্য করে।

আওরঙ্গজেবঃ দ্য লাইফ এন্ড লেগাসি অব ইন্ডিয়াজ মোস্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল কিং৬৩ - অড্রে ট্রুস্কে

কি কি বই – একটি প্রবন্ধ
আমরা আওরঙ্গজেবের জীবনীটি দাঁড় করিয়েছি আধুনিক এবং প্রাগাধুনিক ঐতিহাসিকদের কাজের ওপর ভিত্তি করে। কোন কোন বইএর প্রতি ঋণী এই লেখাটা তৈরি করতে পারলে আমি একই সঙ্গে বোঝাতে পারব আওরঙ্গজেবের জীবনী নির্মানের জন্যে কোন কোন বই পড়া দরকার। আমি পাণ্ডুলিপির মহাফেজখানা খুব কম ব্যবহার করেছি, আমার অধিকাংশ প্রাথমিক সূত্রই হল ছাপা সংস্করণ। যারা আরও গভীরে যেতে চান, নির্দিষ্ট কিছু উদ্ধৃতি ইত্যাদির সূত্র জানতে, তাদের জন্যে এই প্রবন্ধের সঙ্গে আরও একটা প্রবন্ধ জুড়ে দিয়েছি।
---
আমি প্রথমেই জানিয়েছি এই কাজের মুল সূত্র হল ফারসি ইতিহাস। আওরঙ্গজেবের আগের সময়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ের ইতিহাস শাহজাহানের সময়ের বা তার পরের বইগুলি থেকে আহরিত যেমন আবদুল হামিদ লাহোরির পাদশানামা, ইনায়ত খানের শাহজাহাননামা, মহম্মদ সালেহ কম্বুর অমলইসালিহ এবং তবতাবায়ির শাহজাহাননামা।
আওরঙ্গজেবের সময়ের ইতিহাস বেশ কিছু লেখক লিখেছেন, আবদুল হাই এবং খাদিম হুসেইনের সুসম্পাদনায় মহম্মদ কাজিমের আলমগিরিনামা(কলকাতা ১৮৬৮)য় একমাত্র আওরঙ্গজেবের সরকারিভাবে প্রথম জীবন এবং দরবারের ইতিহাস পাই। বখতাবর খানের(মৃ ১৬৮৫) মিরাটঅলআলম একটি সাধারণ ইতিহাস বই যেখানেও আমরা আওরঙ্গজেবের প্রথম জীবন পাই। পার্সপেক্টিভস অন মুঘল ইন্ডিয়া(করাচি)য় সাজিদা আলভি জানাচ্ছেন আলমগিরিনামা থেকেও কিছু বেশি সূত্র আমরা মিরাট...এ পাই, কিন্তু বইটি খুব বেশি পঠিত নয়। আকিল রাজি খান(মৃ ১৬৯৬/৭)এর ওয়াকিয়তইআলমগিরি সিংহাসন দখলের লড়ায়ের তথ্য পাওয়ার জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, আমি মৌলভি জাফর হাসানের (দিল্লি ১৯৪৬) সংস্করণটি ব্যবহার করেছি। এছাড়াও কিছু কাজ ছাপা হয় নি যেমন হাতিম খানের আলমগিরনামা, মুহম্মদ মাসুমের তারিখইশাহজাহানি এবং আবুল ফজল মামুরির তারিখইআওরঙ্গজেব, আমি বইটি লেখার সময় দেখতে পেরেছি।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর এক দশক পর বেশ কিছু বই লেখা হয়। কাফি খানের মুন্তাবাখাবঅললুবুব(১৭৩০), সাকি মুসতায়েদ খানএর মসিরইআলমগিরি(১৭১০) বহু ঐতিহাসিক ব্যবহার করেছেন, অংশত কারণ অনুবাদের সহজলভ্যতা; যথাক্রমে অনুবাদ করেছেন মনিউল হক(করাচি ১৯৭৫) এবং যদুনাথ সরকার (কলকাতা ১৯৪৭), আরও বড় কারণ এইদুটি বই আওরঙ্গজেবের জীবনের অধিকাংশ সময়ের ঘটনা এই দুটিতে উল্লিখিত হয়েছে। তাদের জন্ম তারিখ এবং বিপুল অলঙ্কারের ব্যবহারের জন্যে আমি খুব সাবধানে সেগুলির তথ্য কাঁচিয়ে তুলেছি এবং তথ্যগুলো অন্যান্য সূত্রের সঙ্গে তুলনা করে নিয়েছি। কাফি খানের অনুবাদ হিসেবে এলিয়ট আর ডসনের বইটার তথ্যকে আমি সর্বাংশে বর্জন করেছি। মাসির... যেহেতু খুব সর্বজনগ্রাহ্য তাই তার অনুবাদ হিসেবে যদুনাথ সরকারের কাজটাই উল্লেখ করেছি এটা মাথায় রেখে যে যদুনাথ সরকারের অনুবাদ অসম্পূর্ণ এবং বেশ কিছু ভ্রান্তিও আছে(এইটির অনুবাদ পড়তে ২০১৬ সালের ইওরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের পিএইচডি প্রবন্ধ Tilmann Kulkeর A Mughal Munsi at Work অনুসরণ যোগ্য)।
ভীমসেন সাক্সেনার তারিখইদিলখুসা দাক্ষিনাত্যের অসাধারণ তথ্যাবলী উল্লিখিত হয়েছে, আমি যদুনাথ সরকারের অনুবাদের সঙ্গে ব্রিটিশ লাইব্রেরির পাণ্ডুলিপিটি(Or. 23) মিলিয়েছিলাম এবং কয়েকটি পাতা নতুন করে অনুবাদ করে নিয়েছি। নগরের ব্রাহ্মণ এবং যোধপুরের মুঘল প্রশাসনিক আমলা ঈশ্বরদাস ফুতুহাতইআলমগিরি লিখেছিলেন ১৭০০ সালে, যদিও ভুলভাবে যদুনাথ একে ১৭৩০এর কাজ বলেছেন। ফুতুহাত (বরোদা ১৯৯৫)এ যদিও কিছু ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য আছে যা অন্যান্য সূত্রে পাওয়া যায় না। ১৭৫৪ সালের এক্কেবারেই কম ব্যবহার হওয়া মিরাটইআহমদি আওরঙ্গজেবের গুজরাট সময়ের জন্যে ব্যবহার করা যায়। আবদুর রহিম এবং মির্জা আশরফ আলির(কলকাতা ১৮৮৮-৯১) সম্পাদনায় শাহ নাওয়াজ খানের মসিরউলউমরায় ১৭৮০ পর্যন্ত মুঘল অভিজাতদের খুব সংক্ষিপ্ত জীবনী পাই। এর বেভারিজ আর বাণীপ্রসাদের আরও একটি অনুবাদ আছে(পাটনা ১৯৭৯)।
ফারসি কাজ ছাড়া আমি বেশ কিছু হিন্দি কাজ ব্যবহার করেছি যেমন ভূষণের শিবরাজভূষণ(অনুবাদের জন্যে ধন্যবাদ এলিসন বুশ)। জ্ঞান চন্দ্রের গবেষণায় দেশি ভাষায় জৈন লেখকদের কাজ দেখেছি(এর জন্যে বিশদে দেখুন আকরম লারি আজাদএর Akram Lari Azad’s Religion and Politics in India [Delhi, 1990], 234–37 বইটি)। আমি কিছু পরোক্ষ সূত্রে শিখ ইতিহাস দেখেছি। রাজপুত দরবারের কিছু হিন্দি কাজে আওরঙ্গজেবের জীবনের বহু বিশদ ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে; এর সঙ্গে লক্ষ্মীপতির সংস্কৃত কাজ অবদুল্লাচরিত এবং নৃপতিনীতিগর্বিতভৃত্ত আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের কথা বলে।
ঐতিহাসিকেরা বহুকাল ধরেই আওরঙ্গজেবের জীবনের নানান তথ্য আহরণ করছেন মুসাফিরদের লেখা থেকে যেমন উইলিয়াম আর্ভিংএর অনুবাদে নিকোলি মানুচির স্তোরিয়া দা মোগোর(লন্ডন ১৯০৭-৮), আর্চিবলড কনস্টেবল এবং ভিনসেন্ট স্মিথের অনুবাদে ফ্রানসিস বার্নিয়ের ট্রাভলস ইন দ্য মোঘল এম্পায়ার(লন্ডন ১৮৮৯) এবং ভি বলের অনুবাদে জাঁ ব্যাপটিস্ট তাভার্নিয়ের ভয়েজেস(লন্ডন ১৮৮৯)। এখানে খুব বিখ্যাত নন এমন কিছু মুসাফিরদের কাজ ব্যবহার করেছি Gemelli Careri, Peter Mundy, William Norris, John Ovington, Jean de Thevenot। বিদেশি মুসাফিরেরা মুঘল আমলের দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু গবেষকেরা ভারতীয় সূত্রের থেকেও বিদেশিদের কাজ থেকে নিষ্কর্ষ তথ্যে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, এটা মনে না রেখেই, কিভাবে পশ্চিমি মুসাফিরেরা একই সঙ্গে বাস্তব এবং খোশখেয়ালকে একেঅপরের পিঠেপিঠি ব্যবহার করেছেন।

আওরঙ্গজেবঃ দ্য লাইফ এন্ড লেগাসি অব ইন্ডিয়াজ মোস্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল কিং৬২ - অড্রে ট্রুস্কে

মধ্যযুগে ফারসি পাঠ্য বিষয়ে কিছু কথা
আওরঙ্গজেবের জীবন আর সময় বুঝতের বিভিন্ন বিপুল নথিপত্র বর্তমান। মূলত ফারসি ভাষায় লিখিত ইতিহাস, সাম্রাজ্যিক নির্দেশ, খবর, চিঠি, ভ্রমনকাহিনী ছাড়াও আরও বহু তথ্যাবলী মধ্যযুগের সম্রাটের জীবনপঞ্জী গড়ে তোলার জন্যে যথেষ্ট পরিমানে উপস্থিত। এই বিপুল পরিমান তথ্যাবলী থাকা সত্ত্বেও ইতিহাস তার প্রতি সুবিচার করে নি।
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যে সব তথ্য আছে সেগুলি সব ঐতিহাসিকের কাছে সহজলভ্য নয়। বিপুল সংখ্যার পাণ্ডুলিপি ছাপাখানার মুখ দেখে না, মহাফেজখানায় বা গ্রন্থাগারে মুঘ গুঁজে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। এগুলি পড়তে গবেষকদের শুধু সময় বা অর্থ থাকাও যথেষ্ট নয়, দুটোই পর্যাপ্ত পরিমানে থাকতে হবে যাতে তিনি দক্ষিণ এশিয়া আর ইওরোপের নানান গ্রন্থাগারে ঘুরে সেগুলি অধ্যয়ন করতে পারেন। বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ছবিতোলা আজও নিষিদ্ধ বলে তাদের সংরক্ষিত তথ্যগুলির সম্পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরে আছে ভাষা শিক্ষা। আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য, সে সময়ের দরবারি ভাষা ফারসিতে লিখিত, সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ প্রায় হয়নি বলা চলে। প্রয়োজনের তাগিদে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ফারসির মুল পাঠের না গিয়ে ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করেন। এর ফলে গ্রন্থাগার যাওয়ার সুযোগ কমে যায় ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ফারসি অনুবাদের গুণমানে প্রশ্নচিহ্ন লেগে গিয়েছে, ভুল অনুবাদের সঙ্গে রয়েছে সঙ্খিপ্তিকরণের রোগও এটাও মথায় রাখা দরকার। এই পরিবর্তনগুলি অনুবাদকদের রাজনৈতিক এজেন্ডা(উদ্দেশ্য)কে পুর্ন করার জন্যে করা হয়, বিশেষ করতে ঔপনিবেশিক অনুবাদকদের যারা দেখাতে চায় ইন্দো-মুসলমান সম্রাটেরা ব্রিটিশদের তুলনায় খুব খারাপ(এই তত্ত্বের প্রখ্যাত বই এলিয়ট এবং ডসনের হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া এজ টোল্ড বাই ওন হিস্টোরিয়ান্স)। এগুলি উপনিবেশের মননকে ন্যাংটো করে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দ্যায় ঠিকই, কিন্তু মুঘল ভারত সম্বন্ধে তীব্র অসত্য বচন প্রকাশ করে।
যদিও গবেষকেরা আওরঙ্গজেবের সময়ের তথ্যাবলি নিয়ে আজ ভালভাবেই কাজ করতে পারেন, কিন্তু এগুলির যথোপযুক্ত ব্যখ্যা করাটাই সমস্যার মুল ক্ষেত্র হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের সময়ের তথাকথিত গুরুত্বপুর্ণ ঐতিহাসিকদের মধ্যে কাফি খাঁ মুন্তাখাবুললুবাব এবং সাকি মুস্তায়েদ খাঁ মাসিরিআলমগিরি লেখা হয়েছে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর বেশ পরে এবং তারা সেই সময়ের নানান মানুষের স্মৃতি এবং শোনা ঘটনাকে নতুন করে উপস্থাপন করেছ্যেন পাঠকের সামনে। এই পদ্ধতি ইতিহাস ভাষ্যে অবশ্যম্ভাবী ভুলের সুযোগ তৈরি করে দেবে, যদিও তারা প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বয়ান তুলে ধরছেন। যদি সাম্রাজ্যিক নির্দেশ বা ফরমান বা চিঠি ইত্যাদিও গবেষকদের ভুলপথে এগিয়ে দিতে পারে, ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থিত করতে পারে। এবং আমরা দেখেছি, বহু ফরমান জারি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে রূপায়িত হয় নি।
আর মধ্যযুগের অধিকাংশ লেখকই তথ্যের সত্যতা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। আওরঙ্গজেবের সময় অতীতকে ভুলভাবে দেখা একটা স্বাভাবিক ক্রিয়া ছিল – যারা মনে করতেন তারিখ(ফারসিতে ইতিহাসের প্রায় প্রতিশব্দ) ইতিহাসের থেকেও বেশি সাহত্য রচনার প্রতি নিবিষ্ট থাকা অনেক নেশি জরুরি। তারা তাদের সাহিত্যিক লক্ষ্যপুরণ করতে ইতিহাসকে ব্যবহার করতেন, যেমন কাফি খাঁ যে ফুলেল ভাষায়, ব্যঙ্গের কষাঘাতে তার পছন্দ বা অপছন্দের এক ঘটনার তীব্রতা তাদের মত করে উপস্থিত করতেন। এই বিশেষ স্তরীভূত উতসাহের জন্যে সেই সময়ের ইতিহাসের ব্যাখ্যা আধুনিক কালের ইতিহাসের তুলনায় ন্যুন হয়ে যায় না, কিন্তু আমরা সেই কাজগুলি থেকে তথ্য আহরণ করার সময় সাবধান থাকব – তার সাহিত্যিক এবং একইসঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্য বিচার করে তৌল করে দেখব, কারণ মুঘল আমলের ইতিহাস দায়িত্বপুর্ণভাবে গঠন করতে আমাদের দ্বায়িত্ব সর্বাধিক।
অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিক ফারসি পাঠগুলির পাশাপাশি আধুনিকপূর্ব অন্যান্য ভাষার পাঠ বিশেষ করে ইওরোপিয় মুসাফিরদের লেখা, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার ইতিহাস এবং (খুব কম) সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি। এই সব কটি নিয়েও একই কথা বলা যায় যে সেগুলিতেও তথ্যের সঙ্গে মিথ ও গল্পকথা জুড়ে থাকে। ইওরোপিয় ভ্রমনকথাগুলি এ প্রসঙ্গে আলাদা করে বলা দরকার হয়, কারণ বহু মুঘল আমল নিয়ে কাজ করা গবেষক, এইগুলি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন, এইগুলি কেন সোজাসাপতা ভাবে না বলে এগুলিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বিসেষ ধরণের পড়ুয়া(বিসেষ করে পুঁজিবাদী সমাজের)দের জন্যে।
আধুনিক ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক তথ্যকে খুব ভাল ওজন করে বিচার করে। তার মানে হল আমরা আমাদের ভাষ্যকে বৃহত্তর সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করব বিভিন্ন প্রমানকে কঠোরভাবে বিচার করে, এবং পাঠগুলিকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করেই। ঐতিহাসিকেরা আঁকা ছবি, প্রাসাদ বা টাকাকড়ির মধ্যেও তথ্য সন্ধান করেন। শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিকেরা প্রাথমিক পাঠ্যকে চরমভাবে তৈল করে একটি বৈধ ভাষ্য খাড়া করে যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক চরিত্র, সংগঠন বা ঘটনার একটা প্রার্থিত বিশ্লেষণ উপস্থিত করে। ইতিহাস নিয়ে মতৈদ্বৈধতার প্রচুর অবকাশ আছে, এবং পালটা ভাষ্য বহু সময় আমাদের কোন কিছু নির্দিষ্ট গঠনমূলক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দ্যায়। কিন্তু আওরঙ্গজেব আর তার সময় নিয়ে ঐতিহাসিক সূত্র সংগ্রহ, বিচার এবং ঐতিহাসিক সত্যিকে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা অততা জটিল নয়।

Saturday, September 22, 2018

আওরঙ্গজেবঃ দ্য লাইফ এন্ড লেগাসি অব ইন্ডিয়াজ মোস্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল কিং৬১ - অড্রে ট্রুস্কে

(মুল বইটির পরিসমাপ্তি ঘটল এই কিস্তিতে কিন্তু আরও লেখা বাকি)
তবুও বলা দরকার সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেব যে কোন সরল সাধারণীকরনীয় চরিত্রমাত্র নন। তিনি বিপুলভাবে পরস্পর বিরোধী ও বিভ্রান্তিকর চরিত্রের মানুষ যাকে গভীরে গিয়ে পড়াশোনা করে বুঝতে হয়। আওরঙ্গজেব নিজে ছিলেন প্রচুর অধৈর্য নির্দেশদাতা যেমন রাস্তার নিরাপত্তা নিয়ে বড্ড চিন্তিত – কিন্তু নিজের পিতাকে তিনি বহু বছর বন্দী করে রাখেন, যে কাজটা সে সময় এশিয়াজুড়ে নিন্দিত হয়েছে। তিনি দারা শুকোর মত পারিবারিক সদস্যকে যেমন খুন করেন তেমনি শম্ভাজীর মত শত্রুকেও বাস্তবিকভাবে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে নির্দেশ দ্যান। একই সঙ্গে তিনি নিয়মিত ফেজ টুপি সেলাই করে নিজের ধার্মিকতাকেও বজায় রাখেন। তিনি পছন্দ করতেন না দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা, পচা আম এবং অনুপযুক্ত পুত্রদের। তিনি সঙ্গীতের রসিক সমঝদার, এমন কি যুবা বয়সে একজন রূপসী সঙ্গীতকলাকার হীরাবাঈএর প্রেমে পড়েন, কিন্তু পরিণত বয়সে নিজেকে সে রসে বঞ্চিত করে রাখেন। তবে তার শেষ বছরগুলো আরেক সঙ্গীতপ্রেমী উদিপুরী মহলের সঙ্গে কাটাতে হয়। তিনি বিশ্বের সব থেকে বড় মসজিদ বানান, কিন্তু নিজেকে আনামা কবরে শয়িত রাখতে নির্দেশ দ্যান। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে সব থেকে বড় চেহারা দিতে দিতে মারা যান কিন্তু মনে করতেন তার জীবনটাই ব্যর্থতায় ভরা।
আওরঙ্গজেবের জীবন হেঁয়ালিতে ভরা। তাঁর সময়ের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি খাঁএর উক্তি উদ্ধৃত করব, যিনি আওরঙ্গজেবের সময়কে পারস্যের প্রখ্যাত শাসক জামশিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, তিনি বলেন, To attempt a summary of the major events of a fifty-year reign of an emperor the equal of Jamshid is to measure the ocean’s water with a pitcher। এই ভাষাতেই ভারতের বিতর্কিত সম্রাটের বিচার করা দরকার। যদি আমরা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে জুড়ে থাকা মিথগুলি ছিঁড়ে ফেলতে পারি, তখন আমরা সম্রাট হিসেবে, মধ্যযুগের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, তিনি যে আকর্ষনীয় ধাঁধাগুলি ছেড়ে গিয়েছেন, সেগুলিকে উদ্ধার করতে পারব।