Tuesday, September 25, 2018

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল - সুশীল চৌধুরী৯

অষ্টাদশ শতকের শুরুতে দিল্লির কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে ঢিলে হতে শুরু করায় এই ক্ষমতার সম্পর্কর ব্যবস্থাপনা করতে নতুন ধরণের প্রশাসনিক কাঠামোয় সফলভাবে গৃহীত হল। এর আগে আমরা বলেছি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কেন্দ্র থেকে সুবায় যেমন সরে এল, তেমনি, সুবাতেও ক্ষমতার সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটল (ঐ রিসালা)। আগের জানামায় যে সব মুঘল মনসবদার অসম্ভব ক্ষমতাধর অভিজাত হিসেবে প্রশাসনে গুরুত্ব পেয়ে আসছিলেন, ক্ষমতার সমীকরণ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতাহীন হয়ে গেলেন কেননা কেন্দ্র থেকে আর তাদের পক্ষে কোন সমর্থন আসল না। ফলে তারা স্থানীয় ক্ষমতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় করতে শুরু করলেন। যে সব আর্থিক-সামাজিক গোষ্ঠী এতদিন বাংলার মাথা নামিয়ে ছিল তারা নতুন অবস্থায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। এই ধরণের গোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল মুর্শিদকুলির নব্য প্রশাসনিক সংস্কারে উদ্ভুত নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসা ক্ষমতাধর বড় জমিদারেরা। রাষ্ট্রের রাজস্বের দাবি যত বাড়তে থাকে, জমিদারদের ক্ষমতাও বাড়তে থাকল। বলা দরকার বড় জমিদারদের ইতিহাস আমাদের বলে, উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে মুর্শিদকুলি তার পক্ষে থাকা বড় জমিদারদের ক্ষমতাশালী করে তাদের ক্ষমতা বাড়াবার কাজ করে গিয়েছেন। নতুন ক্ষমতার গষ্ঠীতে এরা নতুন জোট হিসেবে আবির্ভূত হলেন। একইভাবে সওদাগর-ব্যবসায়ীরা যারা মুর্শিদকুলির নব্য প্রশাসনিক রাজস্ব সংস্কারে বিপুল ভূমিকা পালন করলেন, তারাও এসে নতুন ক্ষমতার গোষ্ঠীকেন্দ্রে যোগ দিলেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় একটি নতুন ক্ষমতা গোষ্ঠী তৈরি হল।

তবে মনে করা ঠিক হবে না যে নতুন ক্ষমতা গোষ্ঠীটি তৈরি হল, সেটি প্রশাসনিক পরিকাঠাম হিসেবে কাজ করল বা একদেহী গোষ্ঠীস্বার্থভূত হয়ে উঠল। এরা বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন ব্যক্তির, নানান পরস্পর বিরোধী ব্যক্তিস্বার্থ সম্পাদন করতে নিজামতের তলায় একজোট হল। বাংলার রাজনীতির নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনায় তাদের উদ্দেশ্য হল একদিকে নবাবের হাত শক্ত করা, অন্যদিকে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা। নাজিম বা নবাব তার নিজের হাত শক্ত করতে দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন মনসবদার, সওদাগর ব্যবসায়ী আর জমিদারদের তাঁর পাশে চাইলেন প্রশাসনিক কাঠামো সরলভাবে চালাতে এবং অর্থনৈতিক সম্পদ তৈরি করতে। মুর্শিদকুলি খাঁ দেখলেন এই স্বার্থগোষ্ঠীর নানান ক্ষমতাশালী মানুষ তাঁকে প্রশাসনের প্রধান হিসেবে, তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে দেখছেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদ থেকে বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলায় যে বিপুল শূন্যতার সৃষ্টি ঘটল, তিনি এবং তার উত্তরাধিকারীরা এই দলের সেবা ব্যবহার করে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে গিয়েছেন। বাংলার ক্ষমতাকেন্দ্রে একটা পিরামিডের মত কাঠামো তৈরি হল যেখানে নবাব চূড়োয় বসে রইলেন এবং শাসক জোটের সদস্যরা তার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষমতা আহরণ করতে থাকলেন।

এটা স্পষ্ট নিজামতের পক্ষ থেকে বুঝেশুনেই হয়ত এই স্বার্থগোষ্ঠীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে অংশীদার করে নেওয়ার কোন সচেতন চেষ্টা করা হয় নি। বড় জমিদারদের উত্থান ঘটেছিল মুর্শিদকুলির রাজস্ব তোলার প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে। সওদাগর-ব্যাঙ্কিং শ্রেণীর উত্থ্যান ঘটল প্রশাসনিক উথালপাথালের ফলে যে ব্যবসাবানিজ্যের বিস্তার ঘটল তাকে সামাল দিতে। কেন্দ্রিয় শক্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ায় মনসবদারেরা বাংলায় তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে ক্ষমতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। নিজামতের সঙ্গে এই গোষ্ঠী সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যক্তি স্তরেই ঘটছিল(M. Mazibor Rahman, 'Nizamat in Bengal', unpublished M. Phil. thesis, JNU, 1988.)। এই গোষ্ঠীসমঝোতা রাষ্ট্রীয় দাবি মান্য করেও নতুন দিনগুলির আহ্বানে নতুন দুঃসাহসী সময়ের উন্মেষ ঘটাল। একই সময়ে এই অবস্থাকে মান্য করে যারা লাভবান হচ্ছে, রাষ্ট্র তাদের সম্পূর্ণ সহায়তার সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সময়ের গোষ্ঠীবন্ধনের ব্যক্তিস্বার্থিক সব থেকে বড় উদাহরণ হল জগতশেঠের গদির বাড়বাড়ন্ত। সাধারণ সুদের ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন শুরু করে নিজামতের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে, তার অক্ষয় হাত মাথায় নিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রের প্রধান beneficiary'। এবং এই সুযোগ নিয়েই বাংলায় সব থেকে ধনবান ব্যাঙ্কিং গদি তৈরি করে ফেললেন জগত শেঠের পরিবার।

No comments: