Tuesday, September 4, 2018

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল আর চৌথুপির চর্যাপদ পাঠ প্রতিক্রিয়া এবং নালন্দা বিতর্ক

Souvik প্রীতম বসুর দুটি উপন্যাস পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল নিয়ে এর আগে লিখেছেন। হালেও চৌথুপির চর্যাপদ নিয়েও বিশদে সমালোচনা লিখেছেন। স্বাভাবিক তার প্রতিবাদ হয়েছে। উনি আমাদের ট্যাগ করেছিলেন। আগ্রহী হয়েই বসুজাপাঠভাষ্য লিখেছিলাম। সেটি তুলে দেওয়া গেল। 
---
তবুও আমাদের মতে জ্ঞানচর্চার উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রীতম বসু মাইলস্টোন। বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চা নিয়ে যাদের উৎসাহ আছে তাদের অবশ্যই বইদুটি পড়তে হবে - এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
প্রীতম বসুর দুটো উপন্যাসকে কিভাবে দেখব এই বিতর্কে ঢোকার আগে বসুজার সঙ্গে আমার যোগাযোগের তুলে ধরি, তাহলে তার মনোজগত হয়ত কিছুটা বোঝা যাবে। ফেবুতে তিন বছর আগে পাঁচমুড়ো... নিয়ে লেখার পরে উনি ব্যক্তিগতভাবে আমায় ফোন করেন। কয়েক মাস ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা হয় - সে বিষয়ে মন্তব্য করব না কারণ সেগুলো খুবই ব্যক্তিগত। তখন পরম হই হই করে বেরোচ্ছে। কথা হল বাংলার অঙ্কচর্চা এবং শ্রীধর এবং আরও কিছু বিষয় নিয়ে উনি লিখবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে সময়ই নানান চিনা সূত্র পড়ে আমরা একটা বিষয় আন্দাজ করতে থাকি যে রাষ্ট্র ও শ্রেষ্ঠী পোষিত বৌদ্ধপন্থ ধ্বংস হয় এই দুই স্তম্ভ সরে যাওয়ার পরেই - যে বিশাল কাঠামো তৈরি হয়েছিল তা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা ছিল না সাধারণ মানুষের দান দিয়ে। অথচ পীরের মাজার মসজিদ মঠ সত্র বছরের পর বছর টিকে থাকে জনগনের দানে। অসমে বিপুল বিশাল ৫০০র বেশি অর্ধসহস্রাব্দের বৈষ্ণব সত্র আজও টিকে থাকে অসম্ভব গরীমায়। মনে রাখতে হবে নালন্দার তুলনায় ওদন্তপুরী এবং বিক্রমশীলা অনেক বেশি বিনিয়োগ পেত পাল রাজাদের কোষাগার থেকে।
যদি ধরেই নি মুসলমান আগ্রাসনে নালন্দা ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে, আমরা কারিগরেরা মনে করি, তাদের পাশে যদি জনগণ থাকত তাহলে সেগুলিকে নতুন করে গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল না। শশাঙ্ক নালন্দা ধ্বংস করেন, তারপরেও তো নালন্দা গড়ে উঠেছে পাল রাজাদের হস্তক্ষেপে। অথবা জনগন ছিল বলেই চৈতন্য নববৈষ্ণব পন্থ বাড়িয়েছিলেন রাষ্ট্র/কাজির বিরোধিতা সত্ত্বেও আর চৈতন্যের হাত থেকে কৌম পন্থগুলো বেঁচেছিল জনগণের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যেই (শ্রীচৈতন্য গাঁইয়া অন্ধকারের পুজোগুলো না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন অনুগামীদের)। নালন্দা ইত্যাদিতে মুসলমান আক্রমন হয়ত হয়েছিল কিন্তু রাজারা আর শ্রেষ্ঠীরা সরে যাওয়ায় বিপুল সম্পত্তিওয়ালা বৌদ্ধপথ আর দাঁড়াতে পারেনি। মিনহাজের বর্ণনা গুরুত্ব দিয়েও এই রাজ আর শ্রেষ্ঠী পোষণের ধারনাটা আমি ক্রমশ লিখছিলাম। তারপরেই কিন্তু তিনি হঠাত আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন। গত দুবছর ওনার সঙ্গে একটাও কথা হয় নি - আমি বহু চেষ্টা করেছি - পারিনি। উনি ফেবু থেকেই কোন কারণে সরে গ্যাছেন। ওনার লেখার মধ্যে বাংলায় প্রচলিত ধারনার ইসলামোফোবিয়া যথেষ্ট আছে। আমার প্রিয় লেখক দীনেশ সেনের লেখায় ছত্রে ছত্রে আছে - অথচ আমি মনে করি বাংলার ইতিহাসে বৃহতবঙ্গ অসাধারণ বই।
আমরা মনে করি জ্ঞানচর্চা মানেই কয়েকটা পুঁথি নয়, বিশাল বিপুল বৌদ্ধস্তুপ নয়, রাষ্ট্র-শ্রেষ্ঠীপোষণ নয় জ্ঞানচর্চা মানে স্মৃতিও বটে, যা কৃহত্তর জনগণের মনে ছবি হিসেবে ধরা থাকে। ধরুণ বখতিয়ারের আক্রমনের আগের দুদশকে কয়েক শত বা হাজার ছাত্র নালন্দা থেকে কৃতকার্য হয়ে বেরিয়েছিল তারা তো সেই জ্ঞানচর্চার ধারক, তাদের মাথায় তো বইগুলো থাকবে। তাহলে জ্ঞানচর্চা দৈহিকভাবে ধ্বংস করলেই ধ্বংস হয় না, মন থেকে মুছে ফেলতে হয়। নালন্দা ধ্বংস হয়ে গেলে তারা কেন সেই পুড়ে যাওয়া বইগুলো নতুন করে লেখার কাজ করতে দাঁড়ালেন না? কারণ ছাত্রদের অধিকাংশই এশিয়াজোড়া রাষ্ট্র পোষিত বৌদ্ধ বিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। বৌদ্ধপন্থটা ছিল শ্রেষ্ঠীদের বিদেশে ব্যবসা ছড়াবার হাতিয়ার। নালন্দায় কি ঘটছে কার মাথা ব্যথা? দেশে কেন টিকল না বিদেশে কেন টিকল, এরকম আরও হাজারো কথা বলা যায়, এখন থাক।
আমাদের বলার কথা ইসলাম ফোবিয়া দিয়ে প্রীতমবাবুর লেখা দুটি উপন্যাসেই ব্যবহৃত অন্যান্য তথ্যের মূল্যায়ণ করতে যাই নি। পাঁচমুড়া বা চৌপথী যখন পড়ব তখন বাংলার জ্ঞানচর্চার ধারার ইতিহাস হিসেবেই পড়ব - মোড়কটা হয়ত থ্রিলার কিন্তু আমি পড়ব জ্ঞানচর্চার বই হিসেবে। হ্যাঁ অনেক জায়গায় তথ্যবিচ্যুতির অভিযোগ থাকবে, তথ্যের প্রয়োগের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলার জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে এর আগে খুব বেশি উপন্যাস লেখা হয় নি - ব্যতিক্রম হরপ্রসাদ, অন্য কেউ যদি বাংলায় করে থাকেন - জানতে পারি ভাল লাগবে।
ব্যক্তিগতভাবে উপমহাদেশের কারিগরিচর্চা, জ্ঞানচর্চার এক সাধারণ তৃণমূলস্তরের কর্মী হিসেবে আমি অন্তত মনে করি প্রীতম বসু বাংলা ইতিহাসচর্চায় অসম্ভব ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি প্রাতিষ্ঠনিক জ্ঞানচর্চাটা করেই কিন্তু উপন্যাস লিখতে বসেছেন। অঙ্কটা, ছন্দটা, লিপিবিবর্তনের ঔপনিবেশিক ধারাটা এবং আরও অন্যান্য বিষয় গুলে খাওয়ার ফল এই দুটি উপন্যাস। অন্যন্য সাহিত্যিকের মত(যেমন সমরেশ বসুর মুর্শিদকুলিকে নিয়ে একটা বাঁহাতে লেখা উপন্যাস আছে - না পড়লেও চলে) তিনটে ঐতিহাসিক বইএর তথ্য অবলম্বন করে একটা সাহিত্যিক উপন্যাস লিখতে বসেন নি, মন দিয়ে জ্ঞানচর্চাটা করেই তাকে সাহিত্যের মোড়োকে উপস্থাপন করেছেন। হ্যাঁ তার মধ্যে কিছুটা আম-বাঙ্গালির বেড়েওঠার সময় যে বিদ্যালয়ী ইতিহাস চর্চার কিছুটা ছুপা কিছুটা প্রকট ইসলাম বিদ্বেষ আছে(বামেদের মধ্যে বেশ প্রকট সেটি), সেটাও তাঁর মধ্যে আছে এবং অনেকের মত তিনিও সেই ধারণা নিয়েই বেড়ে উঠেছেন, সেটা তার জ্ঞানচর্চায় ছাপ ফেলেছে।
তিবুও তাঁর দুটি উপন্যাস আম-ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম - কারণ লেখক সেই জ্ঞানচর্চার অংশ হয়েই সময়কে দেখছেন।
বইদুটো পড়ুন।

No comments: