Wednesday, September 5, 2018

আহকমইআলমগিরি৩ - হামিদুদ্দিন খাঁ বাহাদুর

যদুনাথ সরকারের অনুবাদ
(ছবিতে যুবা আওরঙ্গজেব ও হীরাবাঈ)
এই সময়ে তার জীবনের একমাত্র প্রেমে পড়ার ঘটনা ঘটল। তিনি নর্তকী হীরা বাঈ জৈনাবাদীকে মামার হারেম থেকে উদ্ধার করেন। দেখামাত্র প্রেমে পড়ার এটাই সর্বোতকৃষ্ট উদাহরণ এবং প্রথম যৌবনে তিনি প্রেমে পড়ে প্রায় বাতুলের মত আচরণ করতে থাকেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে ইসলামে দীক্ষিত তিনি মদ্যও পান করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই হীরা বাঈ মারা গেলে আওরঙ্গজেব বিষাদ সাগরে ডুবে যান। সেই তার প্রথম ও শেষ প্রেম।
তিনি দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডার উজির মীর জুমলাকে বহুকাল ধরে প্ররোচিত করে তার পক্ষে নিয়ে আসেন। ভারতে কাজ খুঁজতে আসা পার্সিদের মধ্যে যোগ্যতম আমলা ছিলেন মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের সুপারিশে শাহজাহান মীর জুমলাকে মুঘল আমলা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে তাকে রাজকীয় নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেন, ফলে মীরজুমলা বীজাপুরী সুলতানের রোষমুক্ত হন। মীর জুমলার পরিবার আর সম্পত্তি রক্ষা করতে আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদ অভিযান করেন(২৪ জানুয়ারি ১৬৫৬); সুলতান গোলকুণ্ডায় আশ্রয় নিয়ে মুঘলদের সঙ্গে বিপুল ক্ষতি আর অসম্মানের চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হন। ২০ মার্চ মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দিয়ে দিল্লি পৌঁছলে তাঁকে ৭ জুলাই উজির পদে বৃত করা হয়, ১৭৫৭য় ১৮ জানুয়ারি দাক্ষিনাত্যে ফিরে তিনি আওরঙ্গজেবের বাহিনীতে যোগ দ্যান(মীর জুমলা নিয়ে বিশদে অসাধারণ কাজ করেছেন জগদীশ নারায়ণ সরকার – এই বইটিও আমি অনুবাদ করি – এটির একাংশ থেকে সে সময়ে বাংলা আর আসামের ছবি পাওয়া যায়)।
আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডায় অপ্ররোচিত হামলা করার পরে পালিয়ে থাকা সুলতান আদিল শাহ মৃত্যু বরণ করলে তিনি শাহজাহানের অনুমতিক্রমে বিজাপুর জানুয়ারি ১৬৫৭তে আক্রমন করে ২৯ মার্চ বিদর এবং ১ আগস্ট কালিয়ানি দুর্গ অধিকার করে আরও বড় এলাকা দখল করার প্রস্তুতি নিতে নিতেই উপমহাদেশের রাজনৈতিক রং পরিবর্তন ঘটে গেল।
পাদশাহ শাহজাহান ৬৬তম বর্ষে পদার্পণ করলে ক্রমশঃ দ্রুত স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তাঁর বড় ছেলে এবং তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো দারাশুকো মূলত মুঘল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন। আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে বিজাপুর দখলের জন্যে অতিরিক্ত যে বাহিনী পাঠানো হল, তাকে তুলে নেওয়া হল এই যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দেখিয়ে যে বিজাপুরের সুলতান, পাদশাহের আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন, এবং তার শান্তির জন্য তিনি তার রাজ্য এবং বিপুল সম্পদ পাদশাহর পায়ে দেবেন প্রতিশ্রুত হয়েছেন। ফলে বিজাপুরের জন্যে বাহিনীর প্রয়োজন নেই। প্রথমত বিজাপুরের সুলতানকে চুক্তির শর্তে রাজি এবং সেটি দীর্ঘ সময়ের জন্য মানতে বাধ্য করাতে বড় বাহিনী তার চোখের সামনে রাখা জরুরি ছিল, আওরঙ্গজেবের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসল – তাঁর জয়ের ফল উপভোগ্য হল না। দ্বিতীয়ত তার আরও রাজ্য জয়ের পরিকল্পনাও এর ফলে বিপর্যন্ত হল।
সিংহাসন দখলের যুদ্ধ
৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে শাহজাহানের স্বাস্থ্য খুব ভেঙ্গে পড়ে। কেউ কেউ তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায়। দারা পাদশাহের সঙ্গে দিন রাত এক করে সেবা করা ফাঁকে ফাঁকে সিংহাসন দখলের দিকে এগোনোর কাজে নিজের অবস্থান দৃঢ করতে লাগলেন। তিনি ডাকবাহকদের রাস্তায় নামা বন্ধ করে দিলেন এবং ভায়েরা যাতে দিল্লির দরবারের কাজ কর্মের কোন খবর না পায় সে ব্যবস্থাও করলেন। তার এই হঠকারী পদক্ষেপে সে সময়ের ঘটনা দ্রুত দারার হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। সারা দেশজুড়ে গুজবের পর গুজব দাবানলের মত ছড়াতে থাকে; জনগণ ধরেই নেয় দিল্লিতে সম্রাট মৃত। সুবাগুলির আমলারা প্রশাসনিক কাজ ছেড়ে সিংহাসনে কে যাবেন তাই নিয়ে ঘুটি সাজাচ্ছেন। দেশজুড়ে স্বাধীন হতে চাওয়া রাজারা দুষ্কৃতিরা শাস্তির ভয় না থাকায় আইনভাঙ্গা শুরু করলেন। মুরাদ গুজরাট আর সুজা বাংলা সুবা থেকে নিজেদের পাদশাহ ঘোষণা করলেন।
বেশ কিছুকাল মানসিক চাপ এবং অবসন্ন থাকার পর সিংহাসন দখলের খেলায় পা দেওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন আওরঙ্গজেব। তিনি দারাকে ইসলাম ত্যাগী ঘোষনা করলেন তার কবল থেকে সম্রাটকে উদ্ধার করতে। আর মুরাদ বক্সের সঙ্গে সিংহাসন দখলে জোট সঙ্গী হলেন কুরান শপথ করে পাঞ্জাব থেকে পশ্চিমের এলাকার দখল দেওয়ার শর্তে।

No comments: