Tuesday, July 26, 2016

ইসলামি জঙ্গিবাদ বিরোধী চর্চা ওয়ালীউল্লাহ 'লালশালু' আর এই সময়

স্বকৃত নোমান
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইট

(বাংলা ট্রিবিউনে স্বকৃত নোমানের একটা অসাধারণ লেখা। লিখেছেন ঐ বাংলার ইসলামি জঙ্গিবাদ বিষয়ে, কিন্তু তাঁর লেখা এ বাংলার জন্যও প্রযোজ্য, বিশেষ করে ফকির-বাউলদের বিরুদ্ধে যেভাবে কট্টরপন্থীরা কয়েক বছর আগে হিংসক আন্দোলন করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে স্বকৃতের এই লেখাটা উতসাহ জাগায়, আমাদের পরম্পরা ফিরে দেখতে সাহায্য করে। লেখাটা একটু বড় কিন্তু ধৈর্য ধরে পড়লে অনেক ধন্ধ কাটিবে বিশ্বাস করি।)

...প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে ধর্মব্যবসাকে আক্রমণ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসলেন। এটি ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তি, কট্টরপন্থী আরবীয় ও সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সুক্ষ্ম ফারাকটাকে না বোঝার ফল।

প্রিয় পাঠক, শুরুতেই আমাকে মূর্খ আর বেয়াদব বলে গালি দেওয়ার আগে পুরো লেখাটা আগে পড়ুন, ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তিটা কোথায় তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। খুব গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে যে, মোদাচ্ছের পীরের কল্পিত মাজারের খাদেম হচ্ছে মজিদ। উপন্যাসে মজিদ যেসব উগ্র কথাবার্তা বলে, কট্টরপন্থী সালাফি অনুসারীদের মতো, বাংলাদেশের কোনো মাজারের কোনো খাদেম এমন উগ্র কথাবার্তা বলে না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এই দেশের মাজারগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে, মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেমদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে এমনকি ভারতের মাজারগুলোতে মজিদ-কথিত ওসব ইসলামি উগ্রবাদ অতীতে কখনো চর্চা হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না। যারা মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেম তারা উগ্রপন্থী নন, তারা সহজিয়া বঙ্গীয় মুসলমান। ঠিক এই কারণেই সিলেট শাহ্ জালালের মাজারে বোমা মেরেছিল জেএমবি। মাজারকেন্দ্রিক যে ইসলাম, তা বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলাম। জামায়াত-হেফাজত-জেএমবির অনুসারীরা বঙ্গীয় ইসলামকে স্বীকার করে না, মাজারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে হিন্দুদের জন্য টয়লেট নির্মাণের কথা বলে। মাজারভক্তরা বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তারা কথায় কথায় কাউকে কাফের বলে না, মজিদ যেমন বলে। ওয়ালীউল্লার বিভ্রান্তিটা এখানেই। তিনি মজিদকে দেখিয়েছেন আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি তিতুমীরের অনুসারী তথা অধুনা জামায়াত-হেফাজত ও জঙ্গিদের অনুসারী হিসেবে। অথচ মজিদকে তিনি যেখানে বসালেন, অর্থাৎ মাজারে, সেই জায়গাটা বঙ্গীয় ইসলামের জায়গা। এই মাজার সমন্বয়বাদের জায়গা, উদারতাবাদের জায়গা, গান-বাজনার জায়গা, হিন্দু-মুসলমানের জায়গা। মজিদ বলছে, গান-বাজনা হারাম। অথচ বাংলাদেশে একটা মাজারও নেই যেখানে গান-বাজনা হয় না, ওরস হয় না, হিন্দুরা যায় না। ‘লালসালু’তে ওয়ালীউল্লাহ সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সঙ্গে কট্টরপন্থী আরবীয় ইসলামের তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসটিতে মারাত্মকভাবে সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক এবং ঐতিহাসিক বিপর্যয় ঘটেছে।

বিপর্যয়টা কিভাবে ঘটেছে? তার আগে বোঝা দরকার বঙ্গীয় ইসলামের স্বরূপ। বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সুফিদের ভূমিকা যে মুখ্য ছিল সেই বিষয়ে এখন আর কোনো দ্বিমত নেই। সুফিরা শরীয়ত অপেক্ষা ঈশ্বরপ্রেমের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং স্থানীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতেন। তাতে শরীয়তপন্থী ওলামাদের চেয়ে সুফিরা অনেক বেশি গ্রহণীয় ছিলেন জনসাধারণের কাছে। সুফিরা আবার সালিক ও মজ্জুব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। সালিকেরা সুফি হলেও শরিয়তে পুরোপুরি বিশ্বাসী, আর মজ্জুবেরা শরিয়তে তত আস্থাশীল ছিলেন না। মজ্জুব বা বেশরা ফকিররাই ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদৃত। কারণ তারা ছিলেন ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ সম্পন্ন, যাকে বলা হয় কারামত। আদৌ তারা অলৌকিক কিছু দেখাতে পারতেন কিনা, এই কালে এসে সেই বিচারে আমরা যাব না। তবে এ কথা সত্য, গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেত। এই বেশরা ফকিররাই বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং মুসলমানদের পাশাপাশি বহু হিন্দুকেও তাঁদের মুরিদ বানান।

সুফিদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ছিল উদার। কট্টরপন্থাকে তারা প্রশ্রয় দিতেন না। তারা ছিলেন সমন্বয়বাদী। তাদের প্রচারিত ইসলামে যারা দীক্ষিত হয়েছিল ইসলাম ধর্ম-শাস্ত্রদি চর্চা না করে তারাও পূর্ব-পুরুষদের মতোই রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করত। হিন্দুরা যেমন গুরুর প্রতি ভক্তিশীল, তেমনই মুসলমানরা গুরুর পরিবর্তে পীরের প্রতি ভক্তিশীল ছিল। ফলে মুসলমানের পীর হলো হিন্দু গুরুর বিকল্প এবং ক্রমে ক্রমে সত্যপীর, মানিকপীর, ঘোড়াপীর, মাদারীপীর ও কুমিরপীর নামে পাঁচ পীরের পূজা আরম্ভ হলো। মাছ ও কচ্ছপকে খাদ্য দেয়া, গাছের ডালে সুতো বাধা ইত্যাদি গ্রামীণ হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানা ‘কুসংস্কার’ বাঙালি মুসলমানরা মেনে থাকে ইসলামের নির্দেশে নয়, পূর্ব-পুরুষের ধারাবাহিক বিশ্বাসে। এভাবে হিন্দুদের বনদুর্গা, ওলাইচণ্ডী প্রভৃতি লৌকিক দেবী মুসলমানদের বনবিবি, ওলাবিবির রূপ নিয়েছে। শ্রীচৈতন্যের শ্রীকৃষ্ণ নাম সংকীর্তনের মতো মুসলমানদের মধ্যেও প্রচলিত হলো মিলাদ অনুষ্ঠান। এই মিলাদ কিন্তু আরবীয় ইসলামে নেই, আছে শুধু বঙ্গীয় ইসলামে।

আবার মিলাদ ‘কেয়াম’ বা মিলাদ পড়াকালীন নবীকে হাজির-নাজির মেনে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করারও একটা নিয়ম প্রচলিত হয়, যা এখনো প্রচলিত। এটির প্রচলন হয় স্পষ্টতই শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তনের রীতি থেকে। শ্রীচৈতন্য ও তার ভক্তরা নাম সংকর্তীন করতে করতে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নৃত্য করতেন। মুসলমানদের মিলাদের মধ্যে এটিও প্রবিষ্ট হলো। মিলাদ পাঠের একটা পর্যায়ে তারা দাঁড়িয়ে যায়। সালিক সুফিরা মিলাদকে ‘বেদায়াত’ বা ইসলামে নতুন আবিষ্কার হিসেবে দেখতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজে মিলাদের রেওয়াজটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে সালিক সুফিরা মিলাদকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারেননি। মিলাদকে স্বীকৃতি দিলেও মিলাদের মধ্যে ‘কেয়াম’কে তারা স্বীকৃতি দিলেন না। কেয়ামের মধ্যে তারা স্পষ্টতই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির, যা শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত, প্রভাব দেখতে পেতেন।

অপরদিকে জন্মাষ্টমির মতোই উদযাপিত হতো নবীর জন্মদিন, যা এখনো উদযাপিত হয়। হিন্দুদের শ্রাদ্ধের মতোই ছিল পীরের মৃত্যু দিন উপলক্ষে ওরস। বিষ্ণুপাদপদ্মের মতো পূজ্য ছিল নবীর পায়ের ছাপ, কদম রসুল। চট্টগ্রামের ‘কদম রসুল’ মসজিদ আজও বর্তমান। গৌড়ের একটি সৌধে আছে পাথরের কদম রসুল বা নবীর পায়ের ছাপ। ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবারের বেরা ভাসান উৎসব আসলে ইসলামি মিথের সমুদ্র শাসক খোয়াজ খিজিরের উপাসনা। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসব বেরা ভাসানে মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদদ্দৌলাও যোগ দিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাব-প্রাসাদে দেওয়ালীও উদযাপিত হতো। দেওয়ালী লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্রের রাজ্যভিষেকের উৎসব। তার মানে এটি হিন্দু সংস্কৃতির উৎসব। মুসলমানরাও এটিকে গ্রহণ করল।

এছাড়া নবীকন্যা ফাতেমাও বিবি ফাতেমা নামে পূজিত হতেন বাংলাদেশে। কারবালার যুদ্ধের মহররম ও হাসান হোসেনের প্রাণদানের কাহিনি প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল বাংলাদেশের জনমানসে। তারই প্রভাবে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করলেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। বেগম রোকেয়াও লিখেছেন হাসান-হোসেনের কাহিনি। হাসান-হোসেন ও অন্যান্য ইমামরা নবী ও তার খলিফাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বাংলার মুসলিম জনমানসে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে। তখন গ্রামীণ সমাজে যাত্রা এবং বারোয়ারী পূজার মতো আমোদ-প্রমোদ হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে সমভাবে উপভোগ করত। মুসলমানরা হিন্দুদের মতো সমভাবে চাঁদাও দিত এসব ব্যাপারে, যদিও হিন্দুরাই ছিল এসব উৎসবের সংগঠক। মূর্তিপূজা এবং হিন্দু পুরাণের বিষয়বস্তু নিয়ে পৌরাণিক পালা ও কবিগান মুসলমানরাও উপভোগ করত। এছাড়া ছিল মুসলমানদের গাজীরামের গান এবং হিন্দুদের কীর্তনের দল। এভাবে গ্রাম বাংলার কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ছিল। পরম শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে বাস করত দুটি সম্প্রদায়। বলা বাহুল্য, মানুষের সহজাত এসব প্রবৃত্তি শরিয়ত বিরোধী, কিন্তু রক্তগত হিন্দু চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই ধরনের হিন্দু মুসলমান সমন্বয় সম্বলিত বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল মূর্তিমান বিচ্ছিন্নতাবাদ-তিতুমীরের শরিয়তী আন্দোলন তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া। তিতুমীরের আগে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ বা কট্টরপন্থার প্রচারক ছিলেন শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি, সায়িদ আহমদ বেরলবি প্রমুখ। বঙ্গীয় মুসলমান আচরিত এসব সংস্কৃতিকে তারা কুসংস্কার হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। এরা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামের পরিবর্তে প্রচার করলেন তথাকথিত বিশুদ্ধ আরবীয় ইসলাম। এই শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের উত্তরসূরী হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশের ওয়াহাবি বা খারেজি বা কওমি তরিকার অনুসারীরা, অধুনায় যারা হেফাজতে ইসলামের অনুসারী এবং জামায়াতে ইসলামির অনুসারী।

জামায়াত ও হেফাজত একই ইসলামী তরিকার অনুসারী। অর্থাৎ তারা শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের অনুসারী। কিন্তু পরবর্তীকালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর কিছু কিছু বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতে না পেরে প্রচণ্ড জামায়াত-বিদ্বেষী হয়ে পড়ে কওমি তরিকার অনুসারীরা। মওদুদীকে তারা কাফের বলতেও ছাড়ে না। বর্তমানে হেফাজত ও জামায়াতের নীতিগত ধারা দুটি হলেও মৌলিক ধারা কিন্তু এক, অর্থাৎ তারা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামকে স্বীকার করে না। তার পরিবর্তে এদেশে আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। হেফাজতের অনুসারী সালিকীয় তরিকার সুফিবাদকে স্বীকার করলেও এবং এই ধারার চর্চা করলেও মজ্জুব তরিকাকে তারা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। মজ্জুবীয় সংস্কৃতিকে তারা বেশরা কাজ বা বেদাত হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। অপরপক্ষে জামায়াতের অনুসারিরা মনে করে, সালিক বা মজ্জুব তরিকা কোনোটাই আরবীয় ইসলামের মধ্যে নেই। জামায়াত এ দুটি তরিকাকেই অস্বীকার করে। তার মানে আদর্শগতভাবে তারা পরিপূর্ণভাবে আরবীয় ইসলামের অনুসারী, যদিও বাস্তবে আরবীয় ইসলামের ছিঁটেফোটাও তাদের মধ্যে নেই।

উপরে সমন্বয়বাদী বঙ্গীয় ইসলামের যেসব সংস্কৃতির কথা বলা হলো, সেসব আগে ছিল, এখন নেই, বিষয়টা এমন নয়। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে এখনো বঙ্গীয় ইসলামের এই সহজিয়া সমন্বয়বাদী ধারা প্রচলিত রয়েছে। যেমন মাজার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত মাজার। যেমন চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের মাজার, সিলেটের শাহ্ জালালের মাজার, রাজশাহীর শাহ্ মাখদুমের মাজার, খুলনার খান জাহান আলীর মাজার। এছাড়াও বাংলাদেশের কত জায়গায় কত নামে কত মাজার যে আছে তার প্রকৃত কোনো শুমার নেই। এসব মাজারকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিটা এখনো জারি রয়েছে। যেমন মাজার ভক্তদের মধ্যে রয়েছে মিলাদ, কেয়াম, ওরস, গান-বাজনার প্রচলন। সাংস্কৃতিকভাবে তারা উদার। মাজারে মুসলমানরা যেমন যায় তেমনি হিন্দুরাও যায়। তাতে মুসলমান ভক্তদের ধর্মানুভূতিতে কোনো আঘাত লাগে না। মাজারভক্তরা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না, ইসলামের কোনো বাড়াবাড়িকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। মাজারে গিয়ে তারা পীরের সমাধীর সামনে সেজদায় উপনীত হয়। অর্থাৎ পীরকে তারা সেজদা দেয়। কারণ পীরের মধ্যেই তারা ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজে পায়। এই কারণে মাজার-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আরবীয় কট্টরপন্থী জামায়াত-হেফাজতের যত ক্ষোভ। সিলেটে শাহ্ জালালের মাজারে জেএমবি বোমা মেরিছিল এ কারণেই। মাজারগুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল জেএমবি এই কারণেই। উল্লেখ্য, জেএমবি কিন্তু সালাফি ইজমের অনুসারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। প্রকাশ্যে না হলেও নৈতিকভাবে জামায়াত এই সন্ত্রাসকে সমর্থন দিয়ে থাকে। আগেই বলেছি, আদর্শগত কিছু কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের মৌলিক আদর্শ এক। উভয়পক্ষই এ দেশকে দারুল ইসলাম বানাতে চায়।

অপরদিকে, মাজার কেন্দ্রিক এই সংস্কৃতিকে আদর্শিকভাবে সমর্থন দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের একটি ইসলামিক দল। গ্রাম বাংলায় তাদেরকে ‘সুন্নি’ বলা হয়। এই সুন্নি কিন্তু সালাফিদের মতো সুন্নি নয়। আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা কিন্তু প্রগতিশীল। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে তারা মনে প্রাণে সমর্থন করে। তারা কখনোই জামায়াত-হেফাজত বা সালাফি ইজমকে সমর্থন করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে। ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো রকমের বাড়াবাড়ি নেই। আহলে সুন্নাতের অনুসারী মৌলানারা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য প্রদান এবং সাঈদীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এই কারণেই চট্টগ্রামে শীর্ষ দশ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জামায়াত। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে জারি রেখে তারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। জামায়াত-হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা নীরবে চালিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। রাজধানী ঢাকায় বসে আমরা যারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলছি, সাদা চোখে আমরা সেই লড়াই দেখতে পাই না, বুঝতে চাই না। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে যে সাংস্কৃতিক মোকাবিলা বা লড়াইটা দরকার সেটা আমরা দিচ্ছি না, দিচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, দিচ্ছে মাজারভক্ত হাজার হাজার বাঙালি মুসলমান।
 
এই হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানের চরিত্র কিন্তু মজিদের মতো নয়। মজিদ যেসব কথাবার্তা বলে, এই মাজারপন্থী মুসলমানরা সেসব কথার ধারে কাছেও যায় না। প্রিয় পাঠক, এবার আপনারাই বিচার করুন ‘লালসালু’র মজিদ কি হেফাজত-জামায়াত বা সালাফিদের অনুসারী, নাকি মাজার কেন্দ্রিক বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলামের অনুসারী? এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, মজিদ সালাফিবাদী কট্টরপন্থার অনুসারী। তার কথাবার্তায় অন্তত তা-ই প্রতিভাত হয়। অথচ ওয়ালীউল্লাহ মজিদকে বসালেন মাজারে, বঙ্গীয় ইসলাম চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। মজিদের চরিত্রের সঙ্গে মাজার কোনোভাবেই যায় না। মাজারের পরিবর্তে যদি মজিদকে একটা মসজিদে বা মক্তব্যে বসানো হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’তে যে সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তিটা ঘটিয়েছেন তার পুনর্পাঠ, পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ে দাবি।

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

চতুর্থ খণ্ড

পূর্বে সিল্ক পিস গুডস বিষয়ে যে আলোচনা করেছি, যেমন ব্যান্ডানোজের সাধারণ এবং বহুমূল্য বৈচিত্রের রেশমের সিল্ক লুঙ্গি রুমালের ওপরে অগ্রিমের হার ৭৬ থেকে ৮০% পর্যন্ত ওঠাপড়া করত। সাধারণ এবং ডোরাকাটা টাফটের ওপরে দাদনের ওঠাপড়া হত ৬৯ থেকে ৭৫% এবং দানাদারে ৭১ থেকে ৭৭%। চাদরবাঁধনি ৮২% এবং জামদানির ওপর দাদন ছিল ৮৯%। গুরায় দাদন ৭০ থেকে ৮৫% এবং দোসুতির ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭০%।

কোরা রেশম এবং সিল্ক পিস গুডস সব থেকে চাহিদাবন্ত লাভের পণ্য যেহেতু প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়ীই এই ধরণের পণ্য কিনতে চাইতেন। এই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন বিনিয়োগের, বলা ভাল তাদের ব্যবসার রোজগারের দিকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করা যাক।

বিদেশি কোম্পানিগুলির তথ্যসাবুদ থেকে বুঝতে পারি যতক্ষণ তাদের লাভের হার না কমছে ততক্ষণ তারা ব্যবসায়ীদের ভাল কি হল না হল, বা বেশি হল কি না, সে সব বিষয়ে দৃষ্টি দিত না। অনেক খুঁজে পেতে আমরা ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে কাশিমবাজার রেশমের ব্যবসায়ে বোধহয় দাদনি বণিকদের লাভের হারটি বুঝতে পেরেছি।

দাদনি বণিকদের রোজগারের হার কি ছিল? ১৭৪১এর ২৯ এপ্রিল যে রেশম বস্ত্রের নমুনায় যা দেখানো হয়, শেষ পর্যন্ত কিন্তু সেই গুণমানের রেশম বস্ত্র সরবরাহ করা হয় নি। এবং কোম্পানি ঠিক করে তারা একজন ফ্যাক্টরকে কুমারুলি আড়ংএ পাঠাবেন এই বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। তারা সেখানে গিয়ে যা বুঝলেন, ব্যবসায়ী দরকষাকষি করে যে দাম ঠিক করেছেন, পরে তিনি দেখেন তিনি সেই দামে সেই গুণমানের বস্ত্র সরবরাহ করতে অপারগ। এবং তার পরেও ব্রিটিশেরা কিন্তু নতুন করা দাম নিয়ে দরাদরি করে নি।

সেই বছরের ব্যবসায়ীরা রংপুর রেশমের দাম দাবি করে ৫.৭৫ টাকা প্রতি সের, যার মধ্যে ১.৯% দালালি এবং ৪.২ শতাংশ কোম্পানির বাটা। ৬ জানুয়ারি, ১৭৪২ সালে পরামর্শদারারা দেখেন যে রংপুরের রেশম তৈরি হয়ে কোম্পানির গুদামে যখন দামের জন্য ওঠে, তখন কোম্পানি দেখল সেটার প্রতিসেরের উতপাদন খরচই হয়েছে ৫.৭০ টাকা। এই দামটি নতুন করে ঠিক করা হল পিরোনো দামের সঙ্গে মিলিয়ে। শীতের (নভেম্বর) উতপাদনের প্রতি সেরের দাম হয়েছে ৫.৪০ টাকা, এবং ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের থেকে ৫.৭৫ টাকা দাবি জানায়। কোম্পানি তথ্য অনুযায়ী আমরা দেখতে পেলাম বণিকের থাকত ১ থেকে ৬ শতাংশের আশেপাশে।

বাস্তবে উতপাদনের খরচের ওপর ব্যবসায়ীদের লাভ ২ থেকে ৪%র মধ্যে থাকত। ৬ এপ্রিল ১৭৩৭এ কোরা রেশমের জন্য ব্যবসায়ীদের রোজগার হয় চার আনা(২৫ পয়সা) প্রতি সের এবং প্রত্যেক সিল্ক পিস গুডসএর জন্য ১ থেকে ৩ আনা। আমরা যদি ধরে নিই ৪০ সেরে ১ মন হয় এবং এক একজন ব্যবসায়ী ২০০ মনের বরাত পায়, তাহলে রোজগার সম্বন্ধ্যে একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা করা যেতেই পারে।

ফলে ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে দালাল হিসেবেই কাজ করছে; শুধু কোম্পানিদের ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত ইওরোপিয় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। ১৭৩০ থেকে বাংলায় কোম্পানি আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা কিছুটা হলেও কোম্পানির প্রতিযোগী হয়ে উঠতে থাকে, ফলে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ব্যবসার বেনিয়ান হিসেবে দাদনি বণিকদের রোজগারও খুব কম ছিল না।

১৭৩৩ সালে লন্ডনের কোম্পানির নির্দেশকেরা বুঝতে পারলেন, যেভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসা বাড়ছে, তাতে প্রতিযোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে; সেই প্রবণতা আটকাতে কোম্পানি কাশিমবাজারে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই জয়েন্ট স্টক কোম্পানিটি কাশিমবাজারে চালু হয় ১৭৪৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে।

এই ব্যবসার শাখাটি বাড়বাড়ন্ত হয়, কেননা এই ব্যবসাটির মাঝেমধ্যেই উল্লেখ পাচ্ছি কোম্পানির নিজস্ব হিসাব রাখার বইতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত দালাল এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের নামোল্লেখে। হারাণ বিশ্বাস ছিলেন স্যামুয়েল হিলচ্যাম্পের বানিয়ান, কিশোর বিশ্বাস, অতিরাম ওয়েন্ট বারোয়েলকে পণ্য সরবরাহ করতেন। ১৭৩৭ সালে হুটু কোটমার নাম উল্লিখিত হয়েছে একজন ব্যাঙ্কারের জুয়াচুরির সঙ্গে জুড়ে থাকার জন্য।

ব্যাংকারদের খুব কাছের দালাল ছিলেন কোটমারা। কাশিমবাজার গুদামে ১৭৩০ এবং ১৭৩৩এ বালি এবং হুতু কোটমা ছিল সেই ব্যাঙ্কারের বানিয়ান। অন্যান্যদের নাম হল উদয় কুশল, রঙ্গনাথ বিশ্বাস এবং কুশলচাঁদ। ১৭৪১এ দেখাযাচ্ছে একজন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী আয়রের নিজস্ব দাদালের নাম ছিল নিমদাস।

কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াও এই ব্যবসায়ীদের আরও একটা কাজ ছিল, বিভিন্ন ইওরোপিয় ফ্যাক্টরি কুঠি থেকে ইওরোপিয় পণ্যের ক্রেতা ছিল। এই পণ্যগুলি বিক্রি করে কোম্পানি বাংলায় তাদের ব্যবসার কিছুটা বিনিয়োগ জোগাড় করত। এই পণ্যগুলি তার পর বিভিন্ন জেলার দাদালদের বিক্রি করত ব্যবসায়ীরা।


এইসব কুঠীর বিভিন্ন ইওরোপিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভাল চাহিদা ছিল বাংলায়, এছাড়াও ইওরোপিয় পশমি বস্ত্রেরও চাহিদা ছিল। ১৭৪০ সালে হুটু কোটমা বিভিন্ন পশমের তৈরি বস্ত্র খরিদ করে, ১৭৪১এ কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি পশমের বস্ত্র বিক্রি করে সাউতু কোটমা, এবং বিশ্বাস পরিবারের নরেন, কুলিয়ান, রঙ্গনাথ এবং হেমো পোদ্দার, ধর্মদত্ত, কুশলচাঁদ, আলুমচাঁদ এবং শর্মা গোষ্ঠীর মধ্যে মাউদেব(মহাদেব?), সবরাম এবং কেবলরাম। এছাড়াও ফতেচাঁদ জগতশেঠ এবং তার নাতি মতুবরায়কেও বিক্রি করে। শেষের দুজন ছাড়া প্রত্যেকে কিন্তু কোম্পানির খাতায় উল্লিখিত ব্যবসায়ী।

এই নামগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি, কাশিমবাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় এই ব্যবসায়ীরা একটু হলেও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে সুবিধাভোগের অবস্থায় ছিলেনঃ এই তথ্য পাচ্ছি বিভিন্ন পরামর্শদানের উদ্ধৃতির সূত্রে। তবে প্রত্যেক ব্যবসায়ীর রোজগারের হার ছিল প্রায় একই রকমের, যদিও মোট রোজগার সবার এক পরিমানে হত না, সেখানে তারতম্য থাকত, সেটাও পরামর্শ সূত্রে জানা যাচ্ছে। কাশিমবাজার ব্যবসায়ীদের মধ্যে পণ্য সরবরাহের বৈচিত্রের এবং ব্যক্তিগত ব্যবসার মোট ব্যবসা দেখাশোনা করার ক্ষেত্রে, রোজগারের তারতম্য বেশ ভালই ছিল, এবনফ এর ফলে গোষ্ঠীর(কোর্টরি) উদ্ভব ঘটে।
{চতুর্থ খণ্ড সমাপ্ত}
(চলবে)

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

চতুর্থ খণ্ড

ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের জীবনের কথা মুখ ফুটে বলেন নি। নিজেদের স্মৃতি কথা বলার অভাব এবং প্রথাগত হিসেব বই রাখার অভাবে আমাদের বারবার বিদেশি কোম্পানিগুলির হিসেব খাতার তালিকায় উল্লিখিত নামগুলির ওপর সরাসরি নির্ভর করতে হচ্ছে। এই সূত্র যে সে সময়ের ব্যবসার পরিবেশ খুব ভালভাবে জানান দেয় তা বলা যাবে না কারণ আমরা শুধু নির্ভর করছি তাদের তালিকায় লিখিত নামগুলির ওপরেই। আর কোম্পানির খাতায় তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িদের যে দক্ষতার উল্লেখ পাই, তা যে শুধু ওপর ওপর শুধু নয়, তা পরোক্ষ সূত্রতো বটেই। তবে এই অপ্রতুলতম হাতের পাঁচ সূত্র ধরে কিন্তু আমরা এই অবয়বহীন বণিকদের অস্তিত্বে হাড় মাংস জুড়ে কাশিমবাজারের ব্যবসায়িদের একখণ্ড জীবন ও তাদের কাজকর্মের বয়ান তৈরি করতে সক্ষম হত। তবে এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, যে নাম ধরে আমরা একজন একটি নামধারী মানুষের অবয়ব গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি, সে সময় এটাও মনে রাখা দরকার যে, হয়ত শুধু এই নামেই সে সময় কোন ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব ছিল না – কেননা সাধারণত ব্যবসায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নানান ধরণের কাল্পনিক নাম ব্যবহার করতেন।

এটা মনে রাখা দরকার যে ব্যবসায়ীর কথা আমরা আলোচনা করব এখানে, সেই ব্যবসায়ী কিন্তু তৃণমূলস্তরের পরম্পরার উতপাদক নন। বংশপরম্পরায় তার পরিবার দূরের গ্রামে বা আড়ং থেকে রেশমি বস্ত্র কিনে নিয়ে অবাঙ্গালি, অভারতীয় ব্যবসায়িদের সরবরাহ করার ব্যবসাটাই করছে মন দিয়ে, এবং আমাদের আলোচ্য সময়ে তারা তাদের এই ব্যবসায় ইওরোপিয় কোম্পানিগুলিকে জুড়ে নিয়েছে। ক্রেতা আর উতপাদকের মধ্যে সংযোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছেন এই বণিকেরা যাদের ইতিহাসে দাদনি বণিক নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের কাজ ছিল কোম্পানিগুলির সেই বছরের জন্য উদ্দিষ্ট পরিমান বিনিয়োগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কিছু বৈচিত্রের নির্দিষ্ট পরিমানে রেশম কাপড় জোগাড়ের সিদ্ধান্তের ওপরে ব্যবসায়ীরা অগ্রিম নিতেন। বাঙ্গালির ব্যবসা পরিবেশে এটা বাংলার নিজস্ব ব্যবসা পদ্ধতি ছিল। সুরাটের বাজারের মত বাংলায় বাজারে গেলেই বিপুল পরিমান তৈরি করে রাখা বস্ত্র পাওয়া যেত না। যে বস্ত্র তৈরি করবে তাঁতি/উতপাদক, প্রত্যেকবার সেই বস্ত্রের দাম ঠিক করা হত অগ্রিমভাবে, দাদনি বণিকদের আনা নমুনা দেখে। এই তথ্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে সুরাট যেভাবে ইওরোপিয় ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জুড়েছিল, বাংলা তখনও সেইভাবে জোড়ে নি(সে তার নিজের নিয়মেই ব্যবসা করে গিয়েছে, ব্যবসায়ীর দায় ছিল সে কিভাবে এই ব্যবস্থায় মানিয়ে নেবে তা ঠিক করা - অনুবাদক)।

প্রচুর কঠোর দরকষাকষির পর ঠিক হওয়া দামের অগ্রিম অর্থাৎ দাদন পেয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা সেই অর্থ তাদের অধীনে কাজ করা বিভিন্ন পাইকারদের মধ্যে বেঁটে দিত। পাইকারেরা বাংলার ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রামে তাঁতিদের সেই অগ্রিম দিয়ে আসত। বাংলার উতপাদন এবং ব্যবসার চরিত্র যেহেতু ছিল যথেচ্ছ পয়সা ফেললেই চাহিদামত তৈরি বস্ত্র পাওয়া যেত না, ফলে তাঁতি না অন্যান্য পরম্পরার উতপাদকেরা সাধারণত সুরাটের মত বাংলায় বিন্দুমাত্র(কয়েকটি পেশা যেমন শাঁখারি – যাদের মূলত কাঁচামাল আসত বিদেশ থেকে - অনুবাদক) শহরমুখীন ছিল না, তারা তাদের উতপাদন কেন্দ্রে ডাঁট নিয়ে বসে থাকত, ব্যবসায়দের দায় থাকত তাদের কাছে উতপাদনের অগ্রিম পৌছে দেওয়া।

অগ্রিম পাওয়ার পর তাঁতিরা তাদের কাজ শুরু করত। তবে একটা বিষয় তাদের মানতে হত, সেটা হল, নির্দিষ্ট সময়ে(ইওরোপ থেকে আসা জাহাজ বন্দরে ভেড়ার আগেই) কোম্পানির কুঠিতে তাদের উতপন্ন দ্রব্য পৌঁছে দিয়ে আসতে হত, এবং ব্যবসায়ীরা হিসেবকরে তাদের বাকি অর্থ প্রদান করতেন। যে নমুনা ক্রেতাদের দেখানো হয়েছে, তার তুলনায় যদি গুণমানে কমা বস্ত্র সরবরাহ করত তাঁতিরা, তাহলে তার মূল্য সেই তুলনায় কমে যেত, বা আমরা খাতাপত্র দেখে বুঝতে পারছ কোম্পানি সেই চেষ্টাটাই করত। কাশিমবাজারের ব্রিটিশ কোম্পানির খাতাপত্র ঘেঁটে রেশম ব্যবসার এই ধারণাটা আমরা পেয়েছি। আমাদের মনে করার কোন কারণ নেই যে, ডাচ বা ফরাসি অন্যান্য ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি এই বাস্তবতার রীতিনীতির বাইরে কাজ করতে পারত।

অগ্রিম দেওয়া হত সাধারণভাবে ঠিক হওয়া দামের ৮০%, তবে তা নির্ভর করত কোম্পানির হাতে থাকা বিনিয়োগের পরিমান, রাজনৈতিক অবস্থা এবং আর কিছু পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর, এবং ব্রিটিশেরা এই রীতি উল্লঙ্ঘন বোধহয় করতে পারে নি বলেই আমাদের ধারণা। ১৭৩৩ থেকে ১৭৫৫ পর্যন্ত কোরা রেশমের যে ব্রিটিশ বিনিয়োগের তালিকা রয়েছে তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি আগ্রিম দেওয়া হয়েছে ৭৫ থেকে ৮৫% পর্যন্ত। ১৭৩৮এ এটা ছিল ৫৯%, শীতকালীন (নভেম্বরের) উতপাদনের ঠিক হওয়া মোট দামের ওপর। ১৭৫২ সালে এই হার প্রচুর কমে আসে, ব্যবসায়ীর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ায়, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা আশংকা করে বেশি অর্থ দাদন দিলে তাদের বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দাদন নির্ভর করত যে সময়ে দরদাম করা হচ্ছে, সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর – যেমন হাতে কত বিনিয়োগ করার মত অর্থ রয়েছে, ব্যবসায়ীদের চাহিদা কি, মরশুমে কখন বিনিয়োগ করা হচ্ছে ইত্যাদির ওপর। ১৭৪০ সালে শীতকালীন(নভেম্বর) উতপাদনে অগ্রিম দেওয়া হয়েছে ৯৪-৯৫% পর্যন্ত।
(চলবে)

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

চতুর্থ খণ্ড

যাদের না্ম দেখলে মনে হয় যে তারা হয়ত অবাঙ্গালি কিন্তু তাদের প্রথম নামটি কিন্তু বাঙালিদের মতই, অর্থাৎ তারা বাংলায় থেকে থেকে বাঙালিদের সঙ্গে সামাজিকভাবে কিছুটা হলেও মিলেমিশে গিয়েছেন। কোটামা বা কাটমারা হলেন কাশিমবাজারের ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে রেশম ব্যবসায় কাজ করা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী। যতদূর সম্ভব তারা বাংলার বাইরে থেকেই এসেছিলেন। তাদের অনেকের প্রথম নাম বেরুফি, বুলচাঁদ বা কিসেনচাঁদ থাকলেও একজনের নাম ছিল পঞ্চু বা শচী।

আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে অষ্টাদশ শতে এসে কোটমারা বিভিন্ন যায়গায় ঘুরতে ঘুরতে বাংলার কাশিমবাজারের কাছের সৈদাবাদের কাঠনাপাড়ায় থিতু হন। উত্তরভারতীয় এই গোষ্ঠীর বাঙালি সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ার তত্ত্ব তাদের বংশকুষ্ঠীর তারিখগুলিতেও পড়েছে। জগতশেঠদের উত্তরপুরুষেরা আজ নিজেদের বাঙালি বলেন। যাইহোক তখন যে সব নাম ব্রিটিশদের বিনিয়োগের খাতায় ছিল তাদের উত্তরপুরুষেরা আজও বাংলায় বাস করেন, এরা হলেন, আচার্য, বিশ্বাস, বোস, চৌধুরী, কেয়ট, কবিরাজ, দাস, দে, দত্ত, গৌতম, ঘোষ, মল্লিক, পোদ্দার, পণ্ডিত, সেন, সরকার, শর্মা, সাহু এবং ঠাকুর। আজ এই দাদনি বণিকদের জাতি পরিচয় খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।

কোথাও কোথাও জাতিবাচক উপাধি সহজে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কোপরি, কোটমা, দে, দাস, গৌতম, মল্লিক, পোদ্দার, পণ্ডিত বা সেন সরাসরি ব্যবসায়িক বা পরম্পরার উতপাদক পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাধি। বোসেরা বোঝা যায় সহজেই কায়স্থা। কেয়ট(কৈবর্ত), চাষী বা জেলে সম্প্রদায়। কবিরাজ উপাধি হয়ত পরম্পরার উতপাদক পরিবারের সঙ্গে আর সেনেরা ব্যবসার সঙ্গে এবং অথবা উতপাদনের সঙ্গে সঙ্গে এই দুটি সম্প্রদায় তাদের প্রাথমিক কাজের সঙ্গে বৈদ্যত্ব ব্যবসাতেও জুড়ে থাকতে পারে। আচার্য, শর্মা এবং ঠাকুর ব্রাহ্মণ, পরম্পরার উতপাদক এবং বিতরক ব্যবসায়ী পরিবারও হতে পারে। বিশ্বাস, চৌধুরী এবং সরকার মুসলমান সময়ের উপাধি, যারা বাংলার ভূমিরাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত থাকত।

ফরাসীরা চৌধুরীদের জমি কেনার কাজে নিযুক্ত করত, বিক্রির কাজে নয়। দিয়ারদানকোর্ট, মাজারাম চৌধুরীকে ১৭২০ সালে ব্যবহার করছেন বড়কুইচিনপুরের জমি কিনতে; গৌরালি কেনা হয় ফরাসি কোম্পানির দেওয়ান গয়াপ্রসাদ চৌধুরীর মার্ফত আর মণিপুর কেনা হয় ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৭৭৩এ বক্সীধর চৌধুরী মার্ফত ৪৫১ টাকায়। এই একই কাজে একই উপাধির মানুষকে ব্যবহারে মনে হয় তারা একই পারিবাক শাখাপ্রশাখার অন্তর্গত ছিলেন।
কোম্পানির দেওয়ান বা দালালের সে যুগে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। বিভিন্ন ইওরোপিয় কোম্পানি বাংলার রীতিনীতিতে যেহেতু অনভিজ্ঞ, সেহেতু তারা একটি নীতি গ্রহন করে যে, স্থানীয়ভাবে কাজ চালাতে তারা নির্ভর করবে স্থানীয় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের মানুষের ওপর, যাদের স্থানীয় সমাজের নানান বিষয়ের ওপর পকড় অনস্বীকার্য ছিল। ব্রিটিশেরা কাশিমবাজারে কোটমা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল ছিল আর ফরাসীরা চৌধুরীদের।

তারা তাদের ব্যবসায়িক সমাজে খুবই প্রভাবশালী ছিল। এই পরিবারের সদস্যরা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িই হতেন, এবং কোম্পানিগুলি এদের ব্যবহার করত স্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির প্রভাব খাটানোর বা দরকষাকষির জন্য। দালাল বা প্রধান ব্যবসায়ীকে মাইনে দিয়ে রাখা হত অন্যান্য ব্যবসায়ীর ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িকে এই কাজে নিযুক্ত করা হত না এই ভয়ে যে, সে হয়ত নিযুক্ত কোম্পানির প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে।

দেওয়ান আর ইওরোপিয় কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা রেশম ব্যবসায় তাদের তুঙ্গে থাকা পণ্য সংশ্লিষ্ট দক্ষতাকে ব্যবহার করে তাদের আর্থিক ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছে এই ব্যবসায়ীরা। ১৭৪৪ সালে ব্রিটিশেরা যখন পরম্পরার রেশম ব্যবসায়ীদের ছেড়ে অন্য ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করা যায় কি না ভাবতে শুরু করেছে, সেই সময় কোম্পানিকে দেওয়া এক প্রায়হুমকিভরা দাবি সনদে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দাবি করে, যে নতুন ধরণের ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতে অনুকূল দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না(তাদের মত দক্ষভাবে), ‘আমরা বাল্যকাল থেকেই রেশম ব্যবসার মধ্যে বেড়ে উঠেছি, আমরা যত শস্তায় দিতে পারব অন্যরা সেই (নিম্নতম)দামে দিতে পারবে না’।

আমরা দেখলাম কাশিমবাজারে দাদনি বণিকদের পরিবেশটাই হল হিন্দু (এখনও অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায় নি), এবং বাঙালি জাতসত্ত্বা আর বাঙালি সমাজউদ্ভুত বণিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর, কেউ পরম্পরার উতপাদক কেউবা আবার কুসীদজীবি এমন কি রাজস্ব আদায়েরও ব্যবসায় জড়িত। এখন ব্যবসায়ি এবং সরবরাহকারী হিসেবে আমরা তাদের কাজ বিস্তৃতভাবে নজর দেওয়ার চেষ্টা করব।
(চলবে)

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

চতুর্থ খণ্ড

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৬৮৫ কাশিমবাজার ব্যবসাকেন্দ্র(ফ্যাক্টরি) থেকে রেশম বস্ত্রের ব্যবসায় জড়িত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাদনি বণিকের গোষ্ঠীর(কার্টেল) নামের তালিকা পাচ্ছি এবং রেশম কেনার জন্য ১৭৫৪ সালে কোম্পানি এজেন্সি(দাদালি) ব্যবস্থা চালু না করা পর্যন্ত, এই দাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রে এই বণিকেরা দৃঢভাবে অবস্থান করেছে। কোটমা, দত্ত, বিশ্বাস, সুরমা, চৌধুরী, সরকার, কোপ্পারিও, ঠাকুর এবং ঘোষেদের নাম ১৭৫০ পর্যন্ত কোম্পানির দাদনি বণিকের তালিকায় প্রত্যেক বছর ঘোরাফেরা করেছে। ১৬৮৪এর বিনিয়োগের খাতায় যে সব উপাধি(sornem) পাওয়া যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ৫ জন বিশ্বাস, ২ চৌধুরী, ১ জন গস(ঘোষ), ১ জন কপ(রি?), ১ জন সরকার এবং ১ জন দত্ত। ১৭০১ সালে একজন করে ঘোষ, সুরমি এবং কোটমা ব্যবসায়ী কাশিমবাজারে ব্রিটিশ কোম্পানিকে কোরা রেশম সরবরাহ করছে। ১৭৫৪ সালে দাদনি ব্যবস্থা থেকে ব্রিটিশেরা বেরিয়ে এসে এজেন্সি ব্যবস্থা চালু করবে, সে সময় অন্তত কাশিমবাজারে যে ১৮৬ জন দাদনি বণিকের নাম ব্রিটশদের খাতায় উল্লিখিত হয়েছে, তাদের মধ্যে উপরোক্ত উপাধিগুলির বণিকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন।

আমরা জানিনা এই দাদনি বণিকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত খাতায় ব্যবসাকার্য চালাতেন কি না। তারা সাধারণত কোম্পানির খাতায় ‘আমাদের ব্যবসায়ী’রূপে প্রতিভাত ছিলেন, একই সঙ্গে ফরাসি, ডাচ এবং ডেন কোম্পানির খাতায় কিন্তু তাদেরই নাম জ্বলজ্বল করছে, এবং এই কোম্পানিগুলির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার সূত্র হিসেবে দাদনি বণিকেরা, নিজেদের লাভের গুড় বাড়াতে ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে রেশমের দাম কড়ায়গণ্ডায় বাড়িয়ে নেওয়ার দরকষাকষির সুযোগ পেয়েছে। ব্রিটিশ কোম্পানির খাতায় পাচ্ছি, দাদনি বণিকেরা ব্রিটিশদের খাতায় কাজ করতে করতে, ডাচ, ডেন, সুইড, পর্তুগিজ ইত্যাদি কোম্পানির এমনকি উত্তরভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও ফাঁকতালে ব্যবসা করে নিয়েছে দুপয়সা অতিরিক্ত কামাবার জন্য, যা ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বেআইনি ছিল।

আশ্চর্যের কথা ১৭৫৪র দাদনি ব্যবস্থা চালু থাকা পর্যন্ত ব্রিটিশদের কাশিমবাজারের ব্যবসাকেন্দ্রের বণিকদের নাম লেখা খাতায় একজনও মুসলমান ব্যবসায়ীর নামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। হয়ত কাশমবাজারের দাদনি বণিকদের মধ্যে একজনও মুসলমান ছিলেন না, হয়ত তারা হুগলি বা পরের দিকে গড়ে উঠতে থাকা কলকাতায় জাহাজে মাল বোঝাই বা খালাসের কাজ করতেন। কিন্তু বেশ কিছু অবাঙ্গালি নাম যেমন কুশলচাঁদ, রতনচাঁদ এবং অন্যান্য রয়েছে কিন্তু তাদের নিয়ে কোন বিশদ বিবরণ নেই, আমরা হয়ত আন্দাজ করতে পারি, ওরা ছিলেন উত্তরভারতের গুজরাট বা রাজস্থানী বণিক, যারা সপ্তদশ শতে বিপুল সংখ্যায় এসে বাংলায় বসবাস করতেন। স্বরূপচাঁদের নাম তালিকায় রয়েছে, তার নামের সঙ্গে বাংলার ব্যাঙ্কার জগতশেঠের নাতি ফতেচাঁদের মিল রয়েছে।
(চলবে)

Monday, July 25, 2016

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

তৃতীয় খণ্ড

যে সব ব্যবসায়ীরা কাশিমবাজারের রেশম ব্যবসায়ে নিয়মিত খরদ্দার ছিলেন তাদের নিজস্ব একটা স্তরবিভক্ত দালাল গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে রপ্তানি বাজারের জন্য রেশম বস্ত্র কিনে আনত। ১৬৮০তে যখন এই রপ্তানি ব্যবসাটা শৃঙ্গে উঠতে শুরু হয় এবং ১৭৪০এ প্রায় শেষ হয়ে যায়, এই ৬০ বছরের মধ্যে সব থেলে লাভ করেছে এই দালাল গোষ্ঠী। যদিও ব্যবসাটা খুব ভালই চলত, কিন্তু সপ্তদশ শতে মুঘল সুবাদার, খেমচাঁদ, মুথুরাদাস এবং শুকানন্দ শাহের মত বড় পুঁজির ব্যবসায়ী এবং শ্রফেরা ব্যবসায় বেশ বড়সড় একচেটিয়া প্রবণতা কিন্তু তার মধ্যেই গজিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। এবং সিল্ক পিস গুডসএর একটি বৈচিত্র ব্যান্ডানোজএর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে ১৭৩০ সালে উঠেপড়ে লেগেছিল কাশিমবাজারের ব্রিটিশদের সব থেকে কাছের দালাল বালি কোটমা।
রেশম ব্যবসার শীর্ষ সময়ে উত্তুঙ্গ উত্তেজনার মধ্যেও ১৭০০ সালের পরের দিকে রেশম ব্যবসা কিছুটা থিতু হয়ে আসার লক্ষ্মণ দেখা দেয়। রেশমের ব্যবসাটা যেহেতু খুব দামি পণ্যগুলির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকা কিছু পণ্য সপ্তদশ শতের শেষের দিকে এই এলাকার কিছু খুব বড় ব্যাঙ্কিং কোম্পানিগুলি এসে জমতে থাকে এবং উত্তুঙ্গ সুদের হার গড় ১৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নেমে আসে গোটা অষ্টাদশ শতক জুড়ে। এবং ইওরোপিয় ব্যবসা যত বাড়তে থাকে, কোম্পানি আমলারা ব্যবসায়ীদের থেকে পণ্যদ্রব্যগুলি নগদ অর্থ দিয়ে কেনার চেষ্টা করতে থাকে। অষ্টাদশ শতে কাশিমবাজারে যে রেশমের ব্যবসায় ইওরোপিয়রা তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কিন্তু কিছুটা হলেও অগ্রিম দিয়ে রাখতে শুরু করে যাতে তারা সঠিক সময়ে তাদের চাহিদা মত দ্রব্য সরবরাহ করতে পারে। এইভাবেই কিন্তু দাদনি বণিকদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল।
{তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত}
(চলবে)

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী



তৃতীয় খণ্ড

কাশিমবাজারে বিশাল বিশাল হর্ম্যের কল্যানে তার পথগুলিতে দিনের উজ্জ্বল আলোতেও কোন দিন সুর্যের রশ্মি ছুঁত না, ফলে বড় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে কাশিমবাজারের পরিকাঠামো তৈরি হয়েই ছিল। একদিকে এটি বাংলার রেশম উতপাদন অঞ্চলগুলির কেন্দ্রে ছিল, অন্য দিকে অষ্টাদশ শতকে এটি ভাগীরথী, পদ্মা আর জলঙ্গীর তৈরি দ্বীপগুলির ত্রিভূজের মধ্যিখানে অবস্থান করছিল। বাংলার খ্যাতি ছিল তার নদীপথের জন্য, বোধহয় বিশ্বে এ বাবদে তার তুলনা কেউই ছিল না, এবং বাংলার নদীপথগুলির মধ্যিখানে ছিল আমাদের আলোচ্য কাশিমবাজার। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ছিল, অষ্টাদশ শতের বাংলার রাজধানীর ক্রোশ দূরেই নবাবের টাঁকশালের খুব কাছেই অবস্থান ছিল কাশিমবাজার রেশম শিল্প কেন্দ্রের। ফলে রাজধানী আর  রাজসভার দালালদের নৈকট্যের সুবিধে পেয়েছিল কাশিমবাজারের রেশম ব্যবসা।

সপ্তদশ শতের পূর্বের কোন ঐতিহাসিক তথ্যে কাশিমবাজারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কয়েকটি পরস্পর সংযোগী কাকতালীয় ঘটনার ফলাফলের প্রেক্ষিতেই বিশ্ববাজারে ব্যবসায়িক কাশিমবাজারের উত্থান। ষোড়শ শতে পূর্ব ভারতের প্রধান বন্দর সাতগাঁয় পলি পরে মজে যাওয়া, সপ্তদশ শতে হুগলি বন্দরের মৃত্যু এবং অষ্টাদশ শতে কলকাতা তখনও কোম্পানির হাতে কলকাতা বন্দর না হয়ে ওঠার মাঝামাঝি ধূসর সময়েই কাশিমবাজার তার বাণিজ্য স্বাক্ষর পেশ করে। সেই সময়ে বাংলার ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছে কাশিমবাজার। মুর্শিদাবাদ যখন বাংলার রাজধানী হয়ে উঠেছে, তার ব্যবসায়িক বন্দর হিসেবে বিপুল ব্যবসা দেওয়ার কাজ করে গিয়েছে কাশিমবাজার। 

সপ্তদশীবং অষ্টদশ শতে কাশিমবাজারে বিপুল ব্যবসাবাণিজ্যের উত্থান ঘটেছে। ভারতের এনং বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ব্যবসায়ির সঙ্গম হত কাশিমবাজারে – কাশ্মীরি, থেকে গুজরাটি থেকে পারসি থেকে তুর্কি ব্যবসায়িদের ভিড় লেগেই থাকত এই শহরে। নদীর ধারের অসম্ভব কারুকার্যময় হর্ম্যগুলি এই বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর অন্যতম সাক্ষ্য ছিল।

কাশিমবাজারের এবং তার পরিবেশ সারা বছর ধরে বিপুল পরিমান রেশম উতপাদন করতে পারত। কাশিমবাজারের রেশম বস্ত্রের উতপাদন ক্ষমতা নিয়ে তাভার্নিয়ের মন্তব্য যদিও কিছুটা অতিরঞ্জিত, এবং আমাদের সক্কলের জানা, তাই আর এখানে সেটি নিয়ে বাক্যব্যয় করছি না(ডারমিগনি বলছেন তাভার্নিয়ে বাংলায় এসে দেখেন কাশিমবাজার ২২ হাজার বেল রেশম বস্ত্র উতপাদন করছে। প্রত্যেক বেলের ওজন ১০০ পাউন্ডের কাছাকাছি। মোট উতপাদন হয়ত ৩১ লক্ষ পাউণ্ড যার মধ্যে ৩ থেকে চার লক্ষ পাউণ্ড ক্রয় করে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি। ইওরোপিয় ইন্সট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলির মধ্যে ডাচেরাই সব থেকে বেশি রেশম ক্রয় করত এবং মোট উতপাদনের একতৃতীয়াংশ ৬০০০ থেকে ৭০০০ বেল কিনে নিত ভিওসি। তাদের ইচ্ছে থাকত আরও আরও বেশি কেনার কিন্তু ভারতীয় এবং অন্যান্য এশিয় ব্যাপারীদের সঙ্গে তারা খুব বেশি পেরে উঠত না। মনে রাখতে হবে ব্রিটিশেরা কোরা রেশমকে ওজন করেছে ১৬ আওন্সের বদলে ২৪ আউন্সে)। কোরা রেশমকে কয়েকটি মরশুমি উতপাদনে ভাগ করা যেত নভেম্বরের উতপাদন(সবথেকে ভাল), মার্চেরটি, তার পর জুন জুলাইএর(সব থেকে খারাপ)। এছাড়াও গুজরাট নামে এক প্রকার বস্ত্র উতপাদন করত, ব্যবসায়িকভাবে গুজরাটে যেত, আর ছিল কুমারকুলি রেশম, তৈরি হত কুমারখালিতে আর সব থেকে দামিটির নাম ছিল পাঞ্জিপুর রেশম, এই শেষতম উতপাদনটি মাঝেমধ্যেই ইওরোপিয়রা কিনত(কেউ কেউ একে গুজরাটও বলেছেন, কিন্তু এই দুটি বৈচিত্রকে কোম্পানিগুলির বার্ষিক ইনভেস্টমেন্ট তালিকায় আলাদা শীর্ষক করে দেখানো হয়েছে)। এছাড়াও ছিল রেশমসুতি মিলেমিশে কটন সিল্ক গুডস, এবং বেশ মোটা কোরা আর দোসুতি। বিনিয়োগ হত কোরা রেশম শীর্ষকে, সিল্ক পিস গুডস, কোরা আর দোসুতি, শেষ দুটিকে একসঙ্গেই ধরা হত। এই সবগুলিই চাহিদাবন্ত রেশম পণ্য ছিল, বিশেষ করে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির কাছে। এতা পরিষ্কার কাশিমবাজারের যে সব থেকে দামি রেশমটি ব্রিটিশ কোম্পানির বিক্রিতে দাম পেত না, বরং সেটি যে শেষ দুটি বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করা গিয়েছে একটু আগে তার ৩০% থেকেও কম দামে বিক্রি হয়েছে লন্ডনের বাজারে। ব্রিটিশদের চাহিদা অনুযায়ী যে ধরণের প্রক্রিয়া করা হত সব থেকে ভাল রেশম বস্ত্রটি, তার জটিলতা আর দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই পণ্যটি অন্যান্য পণ্য বৈচিত্র্যে দামের প্রতিযোগিতার সঙ্গে পেরে উঠত না। ফলে বাজারে খুব সহজে বিক্রি হত মাঝারি ধরণের দামের কোরা রেশম। এই তথ্যটা আমরা হয়ত সবাই জানি যে পূর্ব-দেশিয় বাজারে চিনের পরে যে ভৌগোলিক অঞ্চলটি সব থেকে বেশি বৈচিত্রের এবং দামের রেশম উতপাদন করত তার নাম কাশিমবাজার। 
(চলবে)

Sunday, July 24, 2016

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

দ্বিতীয় খণ্ড

ইওরোপিয়দের কাছে রেশম ছিল নতুনতর পণ্য। এই নতুন পণ্যের ব্যবসার প্রথম দিকে ডাচেরা ছিল একমাত্র বিদেশি। এবং রেশম ব্যবসাই ডাচ কোম্পানির লাভের ভাগ্য ফেরানোর অন্যতম কারিগর। ১৬২০ সালে তারা বাংলার উপকূলে একটি বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে একটি বাণিজ্য কুঠি তৈরি করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করল। বাংলায় তার রেশমের ব্যবসাই শুরু হল বছরে ১৫০০০-২০০০০ পাউণ্ডের রেশম বস্ত্র দিয়ে। ১৬৩৫-৪০ সালে দাঁড়াল বছরে ৫০০০০ পাউন্ড, ১৬৫০ সালে ২ লক্ষ পাউণ্ড। ১৬৫৪ সালের পর কেনার গড় থিতু হল বছরে ১ লক্ষ পাউন্ডে। সেই শতের সাতের এবং আটের দশকে কিছুটা কমতে শুরু করল ডাচেদের রেশম কেনার ধুম। যখন তারা নতুন করে ফিরে এল, তখন কিন্তু তারা এই পণ্যটি ব্রিটিশদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে কিনেছে। এই সময়ে ডাচেরা বাংলার রেশম জাপান থেকে হলন্ডে রপ্তানি করেছে। ১৬৯৩-৯৪ সালে ডাচেদের ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যগুলির মধ্যে বাংলা থেকে কেনা পণ্যই সব থেকে বেশি ছিল ৫৭.৮শতাংশ(যার মধ্যে বাংলা সুবার পাটনার সরকার সারণের সোরাও একটা বড় পণ্য ছিল - অনুবাদক) এবং জাপানে পাঠানো পণ্যের মধ্যে বাংলার পণ্যের অংশিদারি ছিল ৩৭.৩ শতাংশ।

ব্রিটিশ কোম্পানিও ডাচেদের খুব বেশি পিছনে ছিল না। ১৬২০ সাল নাগাদ সুরাট পণ্যের ওপরে নিজেদের নির্ভরতা কমাতে হুঘি আর পার্কারের নেতৃত্বে বাংলায় একটা বাণিজ্য মিশন পাঠায় তারা। তাদের কাজ ছিল বাংলা-বিহারের পণ্যগুলির মূল্যমান নির্ধারণ করা।

এই মিশনটি খুব সফল হয় নি, কেন না তাদের অধিকাংশ সুপারিশই সুরাটের উচ্চ আধিকারিকেরা বাতিল করে দিয়েছিলেন। অথচ ব্যবসায়িকভাবে কিন্তু হুঘি আর পার্কার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্য আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন – সেগুলির মধ্যে অবশ্যই রেশম ছিল। তাদের সুপারিশ ছিল বাংলার মুর্শিদাবাদের পরিবেশে খুব ভাল রেশম তৈরি হয় এবং সর্বভারতীয় দামের তুলনায় এখানে কম করে ২০% কম দামে রেশম বস্ত্র কেনা যায়। তাদের এই সুপারিশে পরের ৩০ বছর ধরে ধুলো জমবে, যতক্ষণনা ১৬৫৮ সালে ডাচেদের পিছন পিছন ব্রিটিশেরা কাশিমবাজারে তাদের গুদাম খুলছে।(১৬৬৪-১৬৮৫ পর্যন্ত এই নব্য পণ্যে ব্রিটিশ বিনিয়োগের নানান ওঠানামা হয়েছে। ১৬৮০তে কোর্ট অব দ্য কমিটি তাদের কর্মচারীদের নির্দেশ দেয় বাংলায় রেশম ব্যবসায় বিনিয়গের পরিমান বাড়াতে। তারা জানায় কোম্পানির সবথেকে বড় দুটি-তিনিটি রপ্তানি জাহাজ ভর্তি করে যদি রেশম ইওরোপে পাঠানো যায় তাহলে কোম্পানির লাভের ওপর কোন চাপ পড়বে না)।

১৬৮১ সালে বাংলায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার স্টার্লিং বাংলায় বিনিয়োগ(পণ্য কেনার পরিমানটাকে ইওরোপিয়রা বিনিয়োগ বলতেন) করে ব্রিটিশরা, যার মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার পাউণ্ড বিনিয়োগ ছিল শুধু কাশিমবাজারের ব্যবসায়। ১৬৯৮তে ইতালি এবং ফ্রান্সের রেশম উতপাদন ব্যহত হওয়ায় লন্ডনে বাংলার রেশম সর্বোচ্চ দামে বিকোল। ১৭০০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত মোটামুটি বার্ষিক একই গড় হারে বাংলার রেশমই ইওরোপে আমদানি করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেশমের উতপাদন সত্ত্বেও ১৭৩০ সাল নাগাদ কাশিমবাজার থেকে সব থেকে বেশি পরিমান রেশম বস্ত্র কিনতে শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের০ দাদনি বণিকদের মোট অগ্রিম দেওয়ার পরিমান ছিল ১৯১৭৫০ পাউণ্ড, অন্যদিকে ঢাকার ব্যবসায়ীদেরকে অগ্রিম দেয় ১২২৫২৬ পাউন্ড। একশ বছর আগে লিযঁ ইওরোপের সব থেকে বড় রেশমের বাজার ছিল, ডাচেদের বাংলা রেশম ক্রয়ের বিপুল উদ্যমে সেই ব্যবসার কেন্দ্রস্থল লিয়ঁ থেকে সরে গিয়েছিল আমস্টার্ডামে; কিন্তু বাংলায় আস্তে আস্তে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাচে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি সাফল্য পেতে শুরু করায় ক্রমশ ডাচেদের রেশম ব্যবসায় ইওরোপিয় আধিপত্য মার খেতে শুরু করে, শেষমেশ ১৭৩০-৪০এর দশকে আমস্টার্ডাম থেকে ইওরোপের রেশম ব্যবসার কেন্দ্রস্থল সরে এল লন্ডনে।

ফরাসি কোম্পানিও বাংলার রেশম ব্যবসায় পিছনে পড়ে থাকল না। ১৬৬০ সালে বার্নিয়ে ফরাসি কোম্পানিকে বাংলার রেশম ব্যবসায় আর বেশি মন দিতে বলছেন, তার মতে বাংলার রেশম লন্ডনে বিক্রি হওয়া ইওরোপিয় রেশমের তুলনায় বেশ উত্তম, কিন্তু সিরিয়ার রেশম থেকে একটু কমা। ১৬৮০ সাল নাগাদ সব কটি কোম্পানিই কাশিমবাজারের তাদের ব্যবসায়িক দপ্তর খোলে – খোদ কাশিমবাজারে যায়গা নেয় ব্রিটিশেরা, কালকাপুরে ঘাঁটি স্থাপন করে ডাচেরা আর আর্মেনিয়দের দেখাদেখি ফরাসিরা সৈদাবাদে বিশাল একটা বাগান সহ ভিলা স্থাপন করে।
{দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত}
(চলবে)

Saturday, July 23, 2016

কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা - রীলা মুখার্জী

দ্বিতীয় খণ্ড

বাংলার মূল বৈদেশিক বাণিজ্যিক পণ্য ছিল রেশম আর সুতি বস্ত্র এবং ইতিহাস প্রমান দাদনি বণিকেরা এই সব পণ্য নিজেরা সংগ্রহ করতেন। যদিও সুতি বস্ত্র এই উপমহাদেশের বহু স্থানে তৈরি হত, কিন্তু সেগুলির মধ্যে বাংলার তুলনায় করমণ্ডলের বস্ত্রের চাহিদা বেশি ছিল, কেননা সেগুলির দাম কম ছিল এবং সেগুলি ইন্দোনেশিয়া এবং মালয় দেশগুলিতে এবং আফ্রিকার উপকূলের দেশ সমূহে রপ্তানি করা হত। বাংলার সুতি বস্ত্রের মধ্যে মসলিন ছিল বিশ্ববিখ্যাত এবং সোনারগাঁও জেলার ঢাকায় এটি খুব গুণমানে ভাল তৈরি হত। এগুলি বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে উচ্চদামে বিক্রি হত। সপ্তদশ, অষ্টদশ শতে ইওরোপিয় কোম্পানিদের পক্ষে এই বিস্তৃত ব্যবসায় বিনিয়োগ করে সেই দ্রব্য এই উপমহাদেশের ধনীদের মধ্যে বিক্রি করা খুব একটা সহজসাধ্য কাজ ছিল না।

কিন্তু সারা বিশ্বে রেশম পণ্য হিসেবে উচ্চদামে বিক্রি হয়, দূরব্যবসার ক্ষেত্রে এটি খুব উপযোগী পণ্য। এশিয় স্থলপথ ব্যবসায় বহুকাল ধরে রেশম ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, যেহেতু হাল্কা ফলে বয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী এবং দামি – প্রায় বিশ্বের সব এলাকায় দামও ব্যবসায়ীর চাহিদামত পাওয়া যায়। ১৬৫০ পর্যন্ত বাংলার রেশম একমাত্র ভারতের বাজারেই বিক্রি হত, একাংশ গুজরাটে রপ্তানি হয়ে সেখানে সূচী কর্ম করে সেগুলি দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিক্রি হত – এবং তার কিছু নমুনা আজও ইওরোপের নানান জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে।

সপ্তদশ এবং অষ্টদশ শতে বাংলা থেকে ইওরোপে যাওয়া পণ্যগুলির মধ্যে রেশম মধ্যমণি ছিল। হয়ত কোন বিশেষ প্রয়োজনে কোম্পানিগুলি বাংলার রেশম বস্ত্র ইওরোপ এবং মধ্য এশিয়ার বাজারে পাঠিয়েছে।

সপ্তদশ শতের প্রথম দুই শতে ইওরোপের রেশম বস্ত্রর বড় বাজার ছিল ইতালি, ফ্রান্স এবং লিয়ঁ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ১৬১৯-২২এর সঙ্কট এবং ইতালিতে মন্বন্তর ঘটায় ১৬২০ থেকে ইতালিয় রেশম বস্ত্রের দাম বাড়তে থাকে এবং ১৬৬৪ সালে দেখা যায় এটি আর ব্যবসার কাজে লাভ জনক হচ্ছে না। ফলে রেশমের বাজার দেখার চেষ্টা চলল, সেই স্থান নিল পারস্য। এবং পারস্যের রেশম ১৬৫০ পর্যন্ত ইওরোপে ভাল ব্যবসা করেছে। কিন্তু তার পরের সময়ে পারস্যে রাজনৈতিক ডামাডোলে রেশমের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তা চলে অষ্টাদশ শত পর্যন্ত। পূর্ব সমুদ্রে রাজ করা ডাচ ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা করল পারস্যের রেশমকে চৈনিক রেশম দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার, কিন্তু হঠাতই বাংলার পশ্চিমপ্রান্তে চিনের তুলনায় অনেক শস্তার রেশম বস্ত্রের খোঁজ পাওয়া গেল, যার কেন্দ্র হল সে সময়ের বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার।
(চলবে)