আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান
তৃতীয় খণ্ড
৩১। দক্ষিণী আধিকারিকদের বিশ্বাসহীনতা
নুসরত জঙ্গএর খবর লেখক সম্রাটকে লিখলেন যে, দাক্ষিণাত্যের হাজিরা বইএর তালিকায় চার হাজারি মনসবদার, জিন্দা খাঁ ডেকানি, সম্রাটের সেবায় তার জীবন বহুবার উতসর্গ করে দিয়েছেন, ফলে তাকে আরও বেশি পদাধিকার দেওয়া হোক। নুসরত জং খাঁও সম্রাটকে একই আবেদন করলেন। তার নির্দেশে সম্রাট লিখলেন, ‘তার জীবন উতসর্গ করে দিয়েছে, এই শব্দগুচ্ছের অর্থ খুব ফুলেল এবং বাক্যের অলঙ্কার মাত্র। সে বহুবার তার জীবন যদি আমার সেবায় উতসর্গ করে দিয়ে থাকে, তাহলে কি করে সে এতদিন ধরে বেঁচে রয়েছে? এদের (দক্ষিণীদের) দয়া দেখানোর একটাই তরিকা আছে, এদের মাথায় বিছে আর হাতে গোখরো ছেড়ে দিতে হয়। কুফার জনগন অবিশ্বাসী।
মন্তব্য - দক্ষিণী আধিকারিকদের সম্বন্ধে এ ধরণের মনোভাব ঠিক ছিল না। দক্ষিণী আধিকারিকেরাই তাদের সাহস, কর্মদক্ষতা আর উদ্যমে শম্ভুজীকে গ্রেপ্তার করেছিল। ইউফ্রেটিসের পশ্চিমে আর মসদের পূর্বের শহরের নাম কুফা, এর অধিবাসীরা হুসেনকে ভুল বুঝিয়ে কারবালায় নিয়ে এসে মেরেছিল।
৩২। বারহার সৈয়দদের থেকে সাবধান
নান্দেরের সংবাদ প্রেরকের থেকে সম্রাট জানতে পারলেন, সৈয়দ হাসান আলি খাঁ বাহাদুর, পাঠান সর্দার হনুমন্তএর বিরুদ্ধে লড়ে তার মূল শিবির(বুঙ্গা) ধ্বংস করে দিয়েছে, জানাজির ভাইএর ছেলেকে ধরেছে, এবং তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিয়েছে। জুলফিকার খাঁ বাহাদুর নুসরত জং, মারাঠা সর্দার ধনা জাধভকে ধরতে যাচ্ছিলেন, তিনিও এই সংবাদে ডাক মার্ফত সম্রাটকে প্রস্তাব দিয়ে পাঠান যে দুই সৈয়দ ভাইয়ের পদোন্নতি করা হোক, এবং বড় ভাইয়ের যে ৮০০ মনসবদারি রয়েছে, সেটাকে হাজার করা হোক, এবং ছোট ভাইয়ের মনসবদারি ৭০০ থেকে ৯০০ করা হোক।
আবেদনপত্র জুড়ে সম্রাট লিখলেন, ‘সাবাস! ঠিক, এগুলি কেন করা হবে না? সৈয়দেরা নবিদের সঙ্গে থাকার কারণে তাদের পূন্য পারিবারিক পূর্বসূরীদের তৈরি করে যাওয়া বিশ্বাসের মর্যাদা আরো বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন। দণ্ডধারীদের মাধ্যমে দুই ভাইকে রাজপোষাকাগার থেকে দুটি ঢোলা জামা(পুণ্যাহের দিন বা সম্মান জানাতে অভিজাতদের দেওয়া হয় নাম খেলাত), দুটি জ্যাসপারের(দামী পাথর) কাজ করা আর দুপাশে মুক্তো বসানী খাপে ছোরাও দেবে। (সম্রাটের) ‘নির্দেশক্রমে’ প্রধানমন্ত্রী, তাঁদের স্তুতি করে চিঠি লিখবে।
নুসরজ জঙ্গের চিঠিতে মহামহিম লিখলেন, ‘বংশপরম্পরায় যে পরিবার আমাদের সেবা করে আসছে, তাঁদের পাদোন্নতির সুপারিশ করার মনোভাব আমি সম্মান করি, এবং সেটাই হওয়া উচিত। সেনাপতি যদি তার সেনার বীরত্ব সম্মান না জানায়, তা খুব আফসোসের ব্যাপার। কিন্তু একই ধাক্কায় তাঁদের পদোন্নতি করানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চপদের সৈয়দিদের প্রতি জনগনের বিশ্বাস আছে, এবং জনগণের ধর্মীয় ভাবনা/জ্ঞানে এই বিশ্বাসটা ঢুকেই থাকে। এই গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা মানে নরকে যাওয়া এবং সর্বশক্তিমানের রোষের শিকার হওয়া। কিন্তু আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা আমাদের মন দুঃখে ভরিয়ে দেয়। বারহার সৈয়দদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো হলে কিন্তু ধ্বংস ডেকে আনবে, মানে শেষটা খুব খারাপ হবে, কেননা, ‘বিশ্বে আমাদের মত আর কেউ নেই’ বলে তারা সাম্রাজ্যের যত সুযোগ, সুবিধে বাগিয়ে নিয়েছে, তারা সঠিক পথে থাকে না। তারা খুব উচ্চ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে, কিন্তু কাজ অল্প করে। তবুও তারা যদি উপেক্ষিত হয়, কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যায়। আর তাঁদের (ভুল কাজ) যদি ঠিক করা হয়, তাহলে তোমায় কাদায় পড়তে হবে’।
মন্তব্য – বারহার সৈয়দ হাসান আলি খাঁ, কুতুবউলমুলক আবদুল্লা খাঁ উপাধি পান এবং ফারুকশিয়রের উজির হন। তিনি ভারতে রাজক্ষমতার চত্তরে ‘সৈয়দভায়েরা’ রূপে কিংমেকার হিসেবে নামে পরিচিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের রাজত্বে সুলতানপুর আর নানন্দুরবারের ফৌজদার ছিলেন। মারাঠা নিমা সিন্ধিয়ার বিরুদ্ধে হাসান আলির বীরিত্বপূর্ণ কিন্তু সর্বনাশা লড়াই কাফি খাঁ বর্ণনা করেছেন। তার ভাই হুসেইন আলি খাঁ, পরে আমীরউলউমরাও হন, আওরঙ্গজেবের আমলে হিন্দুম-বিয়ানার ফৌজদার হন। তাঁদের বাবা, সৈয়দ আবদুল্লা নানন্দেরের ফৌজদার হন ১৬৯০ সালে, এই পদে থাকেন ১৬৯৫ পর্যন্ত। নুসরত জং রাজসভায় জাধভকে শাস্তিদিয়ে ফিরে আসেন জানুয়ারি ১৭০০ সালে। তিনি মারাঠা সৈন্যদের দেখা মাত্রই তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ পেয়ে ১৭০১ থেকে ১৭০৫ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যজুরে অভিযান চালান।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment