Sunday, October 1, 2017

জমির বিলিবন্টন ও রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৯

খাড়ি
আজকে যেটি শিয়ালদা জয়নগর লক্ষ্মীকান্তপুর ট্রেনরাস্তা, সেটি একদা ছিল বাংলার অন্যতম সেরা অতল নদী, বাংলার বাণিজ্য প্রাণ। ভগীরথের কাটা আদিগঙ্গা একসময় চিৎপুর, সালকিয়া, বেতাই, বেলেঘাটা, কালিঘাট, রসা, নাচন(ঘাটা)গাছা, বৈষ্ণবঘাটা, কল্যাণপুর, বারুইপুর, সাধুঘাট, সূর্যপুর, মুলুটি, দক্ষিণ বারাসাত, বহড়ু, জনগর, বিষ্ণুপুর, চত্রভোগ, খাড়ি, কাশীনগর, ধামাই, বেতাই, বগরা হয়ে কাকদ্বীপের পথে সাগরে পড়ত। জয়নগর মথুরাপুরের কাছেই খাড়ি। এক সময় এই রাস্তায় বিশাল বিশাল বাণিজ্যপোত পাল তুলে সুন্দরবনের পথে দূর সমুদ্র পথে বিদেশের পানে অদৃশ্য হত।
খাড়ির নাম প্রথম পাচ্ছি দশম শতের ডাকার্ণব বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ থেকে, এটি তান্ত্রিকদের চৌষট্টি পীঠের একটি বলা হয়। তাম্রলিপ্তের পতনের পর খাড়ির গৌরব শুরু। লক্ষ্মণসেনের সময় গৌড়বাংলার স্বর্ণ যুগ। মোগল আমলে যেটি সুবা, সেন আমলে সেটি ছিল ভুক্তি, আর সরকার হল মণ্ডল। খাড়ি ছিল তেমনি মণ্ডল এবং মণ্ডলেশ্বর এই খাড়িতেই বাস করতেন।
২২ নম্বর লাট বকুলতলায় দিঘি খননের সময় উঠে এল লক্ষ্মণসেনের আমলের একটি তাম্রশাসন – মহারাজ লক্ষ্মণসেনের। তিনি পৌণ্ড্রভূক্তির মধ্যে খাড়িমন্ডলের অধীনে জনৈক ব্রাহ্মণ, ব্যবসদেব শর্মাকে ভূমি দান করলেন। মণ্ডলগ্রাম আজও আছে। পুরাণ মতে মণ্ডলের আয়তন বত্রিশশত বর্গমাইল। মণ্ডলে থাকেন মণ্ডলেশ্বর, অমাত্য এবং এটি একটি দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত ছিল।
যেহেতু সুন্দরবন ছিল সীমান্ত এলাকা, সেহেতু প্রতিরক্ষার দিক থেকে খাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। সুন্দরবন ছিল বন্দরও। হুগলি, কলকাতা, সপ্তগ্রাম যখন হয় নি, তখন বহু বিদেশি জাহাজ এখানে ভিড় জমাত। একটি তাম্রশাসনে দেখা যাচ্ছে, মহাসামন্তাধিপতি ডোম্মনপাল রজত্ব করেছেন ১১১৮শকে(১১৯৬খ্রি)। প্রথমে লক্ষ্ণসামন্তের রাজা, পরে স্বাধীন হন। সেই তাম্রশাসনে দেখা যাচ্ছে ডোম্মন পাল, সুহৃদ বার্ধীনস গোত্রীয় যজুর্বেদিয় ব্রাহ্মণ, রাণ উপাধিধারী বাসুদেবকে বামহিতা গ্রাম দান করেছেন।
চৈতন্য ভাগবতে গৌড়পাণ্ডুয়ার পাঠান শাসনে খাড়ির বর্ণনা পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য আদিগঙ্গা দিয়ে চলেছেন বারুইপুর, সাধুঘাট, সূর্যপুর, মুলুটি, দক্ষিণবারাসাত, বহড়ু, জয়নগর, বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ, খাড়ি, কাশীনগর ইত্যাদি হয়ে নীলাচলের পথে। ছত্রভোগে নিমাই একরাত্রি অতিবাহিত করেন। তারপরে খাড়িতে অবতরণ।
দায়ুদ খাঁর কাটামুণ্ডুর ওপর দিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করল আকবর। আকবর সুহৃদ আবুলফজলের আইনি আকবরিতে বিশদে খাড়ির বর্ণনা পাচ্ছি – চট্টগ্রাম থেকে খাড়ির দূরত্ব চারশ ক্রোশ, উত্তরের পর্বত থেকে দক্ষিণের মাদারণ সরকারে দূরত্ব চারশ ক্রোশ। ওডিসা যোগ হওয়ায় দৈর্ঘে আরও তেত্রাল্লিশ ক্রোশ এবং প্রস্থে আরও তেইশ ক্রোশ যোগ হল। বাংলার সীমানার শেষ বন্দর খাড়ি এবং সুন্দরবন আর বাংলার দরজা। এখান থেকে সমুদ্র যাত্রার শুরু।
এর পরে ক্লাইভ। তিনি লিখছেন কারিজুড়ি পরগনার আয়তন কত জানি না, তবে খাড়ি পরগণা দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে। খাড়ির রাজস্ব চল্লিশ লক্ষ টাকা। কিন্তু অধিকাংশ জন শূন্য, জঙ্গলে ভর্তি ও চাষের অযোগ্য। তবে নবাবকে এই খাড়ি থেকে খাজনা দিয়ে থাকি পাঁচশ বাষট্টি টাকা মাত্র।

No comments: