Sunday, April 8, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৫১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়
আইন এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র
ধর্মতাত্ত্বিক(আইনের আরেক নাম ধর্ম - অনুবাদক) শাসনে ভারতঃ ভারত রাষ্ট্রের ধ্রুপদী মডেল
১৭৮৮এর মার্চে জোনস স্থিরসিদ্ধান্ত নিয়ে তার প্রস্তাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষণা চেয়ে, চিঠিতে পুরোনো যুক্তি জুড়ে কর্নওয়ালিসকে লিখলেন, এই সংহিতাটির কাজ শেষ এবং তারপরে ইংরেজিতে অনুদিত হলে ভারতীয় বিচার পদ্ধতির একটি মাপদণ্ড তৈরি হবে এবং ব্রিটিশ বিচারকেরা নিজেরাই বিচারের রায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারবেন। এই কাজ সম্পন্ন হলে কর্নওয়ালিস ভারতের জাস্টিনিয়ান রূপে পরিগণিত হবেন এবং ইঙ্গিতে বললেন তাকে(জোনসকে) লোকে ট্রিবোনিয়ানও বলবে। এই কাজ হলে ব্রিটিশ সরকার বাংলার দেশিয়দের বিচারের নিরাপত্তা দেবেন যা জাস্টিনিয়ান গ্রিক আর রোমিয় প্রজাদের দিতে পেরেছিলেন। কর্নওয়ালিস, জোন্সের উচ্চাকাঙ্খী প্রস্তাবটি পেয়েই পণ্ডিত, মৌলভি আর মুন্সিদের নিয়োগ বিষয়ে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯৪ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু পর্যন্ত তার বিচার বিভাগের দৈনন্দিনের কাজ পালন করেও সংহিতা প্রকল্পের রোজকার কাজ দেখাশোনা করতেন। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সংস্কৃত আর আরবি সঙ্কলনটি শেষ হয়েছিল; তিনি সেগুলি ইংরেজি অনুবাদের হাত দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর এইচ টি কোলব্রুক গোটা প্রকল্পের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং ১৭৮৭ সালে অনুবাদ শেষ হয়ে ১৭৮৮ সালে দ্য ডাইজেস্ট অব হিন্দু ল অন কন্ট্রান্টস এন্ড সাক্সেসনস কলকাতায় প্রকাশিত হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বোচ্চ কর্তারা জোনসের এই কাজের সম্মানে ভাষ্কর জন বেকন(যুবা)কে দিয়ে একটি মূর্তি গড়ানোর বেরাত দেন যেটি এখন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চে রাখা আছে। এই মূর্তিতে জোনসকে পরানো হয়েছে একটি টোগা, এক হাতে দেওয়া হয়েছে কলম এবং অন্য হাতে যতদূর সম্ভব মনুসংহিতার দুটি খণ্ড।
জোনস, বিশেষ করে তার কাজের উত্তরাধিকারী কোলব্রুক হিন্দু আইনে ইওরোপিয় জোব্বা চাপিয়ে দিলেন যা গোটা ব্রিটিশ এবং ইন্দো-ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার সংগঠন গড়া বিষয়ের ভাবনাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজ পর্যন্ত করে চলেছে। জোনস যাকে হিন্দু আইন বলে জানতেন, সেটি অনুবাদে পরস্পর বিরোধিতা আর উতক্রমণ আছে। জোনস ব্রিটিশ চিরাচরিত আইনে(কমন ল) প্রশিক্ষিত ছিলেন, যাতে প্রাকৃতিক আইন(ন্যাচারাল ল)এর নীতি, আইন এবং ভাবনা জড়িয়ে আছে; এর সঙ্গে আরও জুড়ে আছে সাম্য আর ন্যায়বিচারের ধারণ যা আদতে পূর্বের নানান মামলার নজির থেকে তৈরি আইন(কেস ল)। কেস ল তৈরি হয়েছে পূর্বের নজির থেকে। এটি নমনীয় এবং বিচারক বা উকিলদের নিজেদের ব্যখ্যা নির্ভর আইন। জোনস এবং তার সময়ের আইনতাত্ত্বিকেরা মনে করতেন ব্রিটিশ কমন ল ঐতিহাসিক পরিবর্তনে সাথে পরিবর্তিত হয়। কারণ দেশের মানুষদের চরিত্র, যা আজকের ধারনায় বলতে পারি তাদের কৃষ্টি, আচার, ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনে আইনেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু আশ্চর্যের জোনস বিশ্বাস করতেন হিন্দুদের কোন রকম পরিবর্তন হয় না, তাদের আইন সেই আদ্যি কাল থেকে এক এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে আছে, ব্রিটিশ কেস ল’এর মত মামলার নিদর্শনের ইতিহাসেও তার কোন পরিবর্তন ঘটে নি। ব্রিটেনে কেস ল ইত্যাদির ব্যখ্যায় উকিলে উকিলে বিচারপতি বিচারপতিতে মত এবং টিকাকরণের পার্থক্য ঘটে, কিন্তু ভারতের আইনে এই ধরণের কোন বৈচিত্র থাকতে পারে না – হিন্দুরা যেন সময়হীন একটা বৃত্তে বন্দী – যদি আইনে কোন পরিবর্তন ঘটে থাকে সেটা বিচারক আর আইন ব্যবসায়ীদের হয় অজ্ঞতা, নয় দুর্নীতি না হয় চতুরতা।
জোনস এবং ব্রিটিশেরা বিশ্বাস করতেন কোন অতীতের আইনের কোন একতা টেক্সট হল আইনের মূল ব্যাখ্যা দেয় এবং সঠিক আইন নির্দেশক। হিন্দু আইন বিষয়ে জোনসের ধারনা ছিল, হিন্দুরা এর কর্তৃত্বকে দেখে পবিত্র এবং প্রাচীনতম হিসেবে। এই হিন্দু আইন সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছে, যেটি পবিত্র, অপরিবর্তনশীল, এবং এর উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীন কালে, তারপরে আর তার কোন পরিবর্তন ঘটে নি। ডাইজেস্টের অনুবাদক কোলব্রুক বিশ্বাস করতেন, দ্য বডি অব ইন্ডিয়ান ল কম্পারজেস আ সিস্টেম অব ডিউটিজ রেলিজিয়াস এন্ড সিভিল। এটাই গোটা প্রকল্পের বীজ বাক্য। ব্রিটিশেরা বিশ্বাস করত এই আইনের একাংশ নৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয় যেখানে আচার, মন্ত্রোচ্চারণ, দুরকল্পী দর্শন এবং এমন কি প্রমানে নিয়ম একসঙ্গে করে চুক্তি আর উত্তরাধিকার আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। জোনস নিজে রাজনৈতিক বিশ্বাসে হুইগ মতাদর্শী ছিলেন, তিনি যে আইন তৈরি করছেন সেখানে অধিকার, জনপরিসর ব্যক্তিগত পরিসর, সম্পত্তি মালিকানা আর হাতবদলের নীতিতে প্রভাব পড়বেই।

হেস্টিংসের মতই জোনস বিশ্বাস করতেন না ভারতের পৌর সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক। তিনি বিশ্বাস করতেন অতীত ভারতে আইন প্রণেতারাই(লেজিসলেটরস) আইন প্রদায়ক(ল গিভার্স) ছিলেন যাদের মধ্যে মনু শুধু প্রাচীনতমই ছিলেন না পবিত্রতমও ছিলেন। মনু এবং তার পরবর্তী টিকাকারেরা তাদের সামগ্রিক কাজে মহিমান্বিত ভক্তির মর্ম ধরে বিকাশ ঘটালেন মানবসমাজের প্রতি দয়াশীলতা, সব চেতনপূর্ণ প্রাণীর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগপ্রবণতার... দ্য স্টাইল অব ইট হ্যাজ আ সার্টেন এসচুওর ম্যাজেস্টি দ্যাট সাউন্ডস লাইক দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব লেজিসলেশন এন্ড এক্সটর্টস আ রেস্পেক্টফুল অ। জোনস ভারতকে তার প্রাচীন আইন ফেরত দিতে চাইলেন, যা তৈরি হয়েছিল মুসলিমদের ভারত আগমনের আগে। তিনি মনে করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে ৩ কোটি কালো প্রজা সন্তুষ্ট হোক এবং উন্নতিশীলভাবে বিকশিত হোক, যাদের উদ্দিষ্ট উদ্যম ব্রিটেনের সম্পদ তৈরিতে কাজে লাগবে, যারা নিডেড নো মোর প্রোটেকশন ফর দেয়ার পার্সনস, এন্ড প্লেসেস অব এবোড, জাস্টিস ইন দেয়ার টেম্পোরাল কন্সার্নস, ইন্ডালজেন্স অব দেয়ার প্রেজুডিসেস অব দেয়ার ঔন রেলিজিয়ান, এন্ড দ্য বেনিফিট অব দোজ ল’জ, হুইচ দে হ্যাভ বিন টট টু বিলিভ সেক্রেড।  

No comments: