Wednesday, April 18, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৫৮ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে রূপান্তর

রাষ্ট্র এবং অতীত ভারত সমীক্ষা 
ম্যাকেঞ্জির উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস লেখার জন্যে সূত্র সংগ্রহ। মহীশূরে সমীক্ষা চলে দশ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে। তার কাজের সংক্ষিপ্তসার ছিল নিম্নরূপ-
১। জৈনধর্ম ও দর্শন আবিষ্কার এবং এটা কেন বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আলাদা
২। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী আর তার বিভাগগুলি – লিঙ্গভন্ত, শৈবম, পণ্ডারম মঠ ইত্যাদি
৩। শাসন(লেখ)গুলির চরিত্র আর এগুলির ব্যবহার করে হিন্দু রাজ পরিবারগুলির সময়কাল নির্ণয়, ১৮০০ সাল থেকে ৩০০০ বেশি লেখ অপঠিত অবস্থায় পড়েছিল। সেগুলির মমর্মবস্তু উদ্ধার।
৪। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তর কেপ ক্যামেরুন থেকে দিল্লি পর্যন্ত পাওয়া নানান ধরণের স্মারক আর স্মারক যাদের বলা হয় বীরাকল এবং মাস্তিকল নামক পাথরের আঙ্গিকগুলি থেকে প্রাচীন পশ্চিম দেশের সময়ের প্রথা ইত্যাদি নির্ণয়।
৫। এশিয়া ইওরোপের মত এশিয়ার নানান আদিবাসী সমাজের অতীতের অন্ত্যেষ্টি সংক্রান্ত নানান প্রথা, ঢিবি ইত্যাদির ছবি এঁকে প্রদর্শন।

সমীক্ষার সব থেকে কর্মক্ষম সময়টি ছিল ১৮০০ থেকে ১৮১০ সাল। এ সময় জাভায় পাঠানো দলের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মনোনীত হন ম্যাকেঞ্জি। সেখানে তিনি ১৮১৩ সাল পর্যন্ত থাকেন। সেখানে সামরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চলছিল দক্ষিণ ভারতে যেভাবে তিনি সমীক্ষা করছিলেন সেটিকে সেই দেশে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৮১৫য় মাদ্রাজের সার্ভেয়ার হিসেবে ফিরে আসেন। তাকে কলকাতায় বদলি করে পদোন্নয়ন করে সার্ভেয়ার জেনারেল অব ইন্ডিয়া পদ দেওয়া হয়। এর ফলে তিনি উত্তর ভারতের বহু এলাকা ঘুরতে পারেন। তাঁর সঙ্গে কুড়ি বছর ধরে সমীক্ষার কাজে অংশ নিয়ে বিপুল সংখ্যক উপাত্ত জোগাড় করে সেগুলি বিশ্লেষণ করতে পারা অভিজ্ঞ কর্মীদের তিনি কলকাতায় নিয়ে আসেন। এইচ এইচ উইলসন কোম্পানিকে দিয়ে প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর খোলালে ১৮২১এ ম্যাকেঞ্জির মৃত্যুর পরে এই অভিজ্ঞ কর্মীরা সেই দপ্তরে কাজ পায়। তার দপ্তরে চারজন অনুবাদক, চারজন পণ্ডিত, একজন মৌলভি এবং বহু করণিক আর পিয়ন ছিল। উইলসনের প্রাথমিক উৎসাহ ছিল সংস্কৃত আর ফারসি ভাষার প্রতি, ‘যা ব্যবহার করে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনা হবে’। দক্ষিণ ভারতের ভাষা বা কৃষ্টি বা ইতিহাস নিয়ে তার উৎসাহ ছিল না। সংস্কৃত আর ফারসি জানা কয়েকজন ছাড়া ম্যাকেঞ্জির কর্মীকে তার উদ্বৃত্ত মনে হল। কিন্তু কর্তারা ম্যাকেঞ্জির দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে ইতিহাস লেখার কাজে উৎসাহিত ছিলেন। ‘যে পদ্ধতিতে, যে উৎসাহে ম্যাকেঞ্জি দক্ষিণ ভারতের নানান উপাত্ত সংগ্রহ করে তার সংখ্যাতাত্ত্বিক কাজে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব এবং ধর্মের নানান তথ্য’ জড়ো করছিলেন তাকে তারা পিঠ চাপড়ানি দেন। ‘যেহেতু হিন্দুরা প্রামাণিক উপাত্ত’ রাখে না, তাই দক্ষিণ ভারতের ক্রমিক ইতিহাস রচনার কাজে ম্যাকেঞ্জি যে ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়ে যান, তাকে তারা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তারা তাকে তথ্যগুলি ‘বুঝতে এবং উন্নত’ করতে উৎসাহ দেন, এবং এই উপাত্তগুলি কোম্পানির জাদুঘরে দেওয়ারও আর্জি জানান। এই কাজ চালিয়ে যেতে যে পরিমান অর্থ ভর্তুকিকে খরচ হয়েছে, সেগুলো তাকে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেন কর্তারা। সেই জন্যে তার কাজের খরচের হিসেব চান তাঁরা। মনে হয় ম্যাকেঞ্জি কোনদিন কোম্পানিকে তার খরচের হিসেব দেন নি।  

১৮২৩ সালে ম্যাকেঞ্জির প্রাসাদ ব্যবস্থাপনা করা পামার এন্ড কোম্পানি তার সংগৃহীত নানান উপাদানের সমীক্ষা প্রকাশ করে, যা তাদের মতে বাজার মূল্য সেযুগে ৬১৪৫২টাকা ছিল। তারা জানায় ছড়ানো ছিটোনো নানান তথ্যের সমন্বয় করে এই অঙ্কে পৌঁছেছে। এটা স্বাভাবিকভাবেই বেশ কম অঙ্কের, মূল অঙ্ক অনেক বেশি হওয়ার কথা। এই এস্টেটটির জন্যে ১ লক্ষ টাকা দাম ধার্য করলে গভর্নর জেনারেল সেটিকে সমর্থন করেন কিন্তু কর্তারা বাতিল করে দেন। তবে ম্যাকেঞ্জির বিধবার থেকে কর্তারা তার সংগ্রহ ১০ হাজার পাউণ্ডের বিনিময়ে অধিগ্রহণ করেন। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞ উইলসন ম্যাকেঞ্জির অধিকাংশ কর্মীকে বরখাস্ত করে, তার সমীক্ষা, উপাত্তগুলির একটা তালিকা এবং সংক্ষিপ্তসার তৈরি করে দুখণ্ডে ১৮২৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। 

No comments: