Sunday, March 18, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮ - ঔপনিবেশিকতাবাদের জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

নজরদারি(সার্ভিল্যান্স) পদ্ধতি
গোটা উনবিংশ শতক জুড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা দূর থেকে – ঘোড়ায়, হাতি, নৌকোয় বা রেলে বা অন্যান্য বাহনে চেপে সমীক্ষা করাতে স্বস্তি বোধ করেছে। বাজারে, সরু গলিতে, হাটে বা মেলায় – যেখানে ভারতীয় প্রজাদের সঙ্গে গা ঘেঁসতে হয়, সেখানে গিয়ে সমীক্ষায় খুব একটা উৎসাহী হয় নি।
ভারতে ভ্রমণ বা জীবন কাটানোর তাদের যে অভিজ্ঞতা আমরা পড়ি, সেখানে অভিজাত পরিবারের কিছু মানুষ বা তাদের ব্যক্তিগত সহকারী বা চাকর ছাড়া খুব কম ভারতীয়র নামোল্লেখ পাই। যে সব ভারতীয় সাম্রাজ্যিক দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়েছে, তাদের যোগ্যতাই ছিল ব্রিটিশ নির্দেশিত নাটুকে পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দ আলো করে দাঁড়ানো এবং সেই ক্ষমতাকে আরও সংহত করার কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। তারা সেই সব লেখায় উল্লিখিত হয়েছে সাম্রাজ্য নির্দিষ্ট পরিধেয় পরিধান করে, উপনিবেশের তৈরি করে দেওয়া প্রথা অবলম্বন করে যে সাম্রাজ্যিক জ্ঞাননির্ভর প্রথা তৈরি হল, সেই ঘেরাটোপের মধ্যে ঘোরাফেরা করে রাজকীয়রা কিভাবে প্রতিভাত হবে সেই আলেখ্য বর্ণনে। শাসক এবং শাসিত, প্রত্যেকেই ঔপনিবেশিক সামাজিক নাট্যমঞ্চে নির্দিষ্ট কতগুলি প্রথা মেনে অভিনয় করে গিয়েছে।
তবে সে সময় এই অভিজাত আর ভদ্র সমাজের বাইরে অবশ্যই কিছু গোষ্ঠী বা সমাজ ছিল যাদের কাজকর্ম বা প্রথা সাম্রাজ্যের কাছে হুমকি স্বরূপ ছিল এবং হয়ত অস্বিত্বের সঙ্কট ডেকে আনতে পারত। সেই সব লেখায় উল্লিখিত সমাজ ব্যবস্থার বাইরে থাকা চরিত্রগুলি চিহ্নিত হল সন্ন্যাসী, সাধু, ফকির, ডাকাত, গুণ্ডা, ঠগ, পশুপালক, মেষপালক, পরিযায়ী গোষ্ঠী এবং বিনোদনকারীরা। সাম্রাজ্যের যত্নে তৈরি করা আভিজাতিক এবং ভদ্রবিত্ত সমাজের বাইরে থাকা মানুষ, গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ব্রিটিশেরা কিছু বিশেষ পদ্ধতি তৈরি করে গবেষণার কাজ করে। তারা ভাবনাচিন্তা করতে থাকে কিভাবে তাদের দাগি সহ বিভিন্ন ছাপে ছুপিয়ে দেওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদ থেকে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, জাতি এবং গ্রামকে চিহ্নিত করা হল যে তারা শিশুভ্রুণ হত্যাকারী। যে দুষ্কর্ম যদি কিছু হয়ে থাকে তা ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগত নয়; এবং ব্রিটিশ আদালতে প্রমান করা কঠিন ছিল যে এই কাজে গোটা সমাজ জড়িত। পরের দিকে নারীভ্রুণ হত্যা হয়ে উঠল সাম্রাজ্যের হাতে তৈরি করা সংখ্যাতাত্ত্বিক দুষ্কর্ম, যেখানে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা হাতে তুলে নিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।
১৮৩৫ সালে ঠগি আর ডাকাতি দপ্তর তৈরি হল, যাদের কাজ হল গোষ্ঠীগত খুন আর ডাকাতি তদন্ত করে শাস্তি দেওয়া। সাম্রাজ্যের প্রথম কাজ হল সরকার যাদের অভিযুক্ত করছে, যেমন বিভিন্ন ধার্মিকদের হত্যা এবং পথচারীদের হত্যার পদ্ধতির তথ্য সংগ্রহ করা। এই শাস্তি সম্পাদন করতে রাষ্ট্রের সামনে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষকে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রীয় সাক্ষ্য দান করানো হল এবং পরে তাদের রাজ সাক্ষী এবং এদের থেকে ঠগীদের কৃষ্টি সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য সংগৃহীত হল। ঠগী এবং ডাকাতি দপ্তরের উদ্যোগে তৈরি হল অপরাধ এবং অপরাধী সংক্রান্ত জনতত্ত্ব মহাফেজখানা। এই উদ্যোগের ফল হল বিপুল সংখ্যক জনসমষ্টিকে অপরাধী আদিবাসী এবং জাতি দাগিয়ে দেওয়া।
ভারতে ব্রিটিশ(পশ্চিম শহুরে ইওরোপের পুলিশদের মত) প্রশাসন যে সব জাতি, গোষ্ঠী এবং সমাজ অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে আছে বলে সন্দেহ করছিল, তাদের সহজে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করার কাজ করে উঠতে পারছিল না। ফলে তাকে পদ্ধতিগতভাবে সেই সব গোষ্ঠী সমাজকে দাগিয়ে দেওয়ার জন্যে এমন কিছু স্থায়ী চরিত্র নির্ধারণ করার কাজে গবেষণা করতে হল, সেই সব চরিত্র দিয়ে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা যাবে। যদিও আলোকচিত্র দিয়ে ব্যক্তির বাহ্যিক গঠন নথিভূক্ত করা যেত, কিন্তু বিপুলাকায় ভারতের জন্যে প্রয়োজন হল কয়েক হাজারের নমুনা নিয়ে সেটাকে সার্বজনীন বলে চালিয়ে দেওয়ার তত্ত্ব নির্ধারণ করা।
গোটা গোষ্ঠীকে না হয় অপরাধী চিহ্নিত করা গেল। ব্যক্তিকে কিভাবে সহজে চিহ্নিত করা যায়? এই ভাবনা বিভিন্ন ঔপনিবেশিক কর্তাদের ভাবাচ্ছিল। এই লক্ষ্যে উনবিংশ শতকের শেষে, পুলিশ নির্দেশক আলফোনস বার্টিলঁ একটি এন্থ্রোপোমেট্রিক ব্যবস্থা তৈরি করলেন, মনেকরা গেল, এই প্রযুক্তি আর জ্ঞান দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত এবং চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে।


আলফোনস বার্টিলঁর প্রায় একই সময়ে উইলিয়াম হার্শেল, জঙ্গিপুরে কর্মরত এক ভারতীয় আমলা দুর্নীতি আর জালিয়াতির বিরুদ্ধে আঙুলের ছাপকে প্রমান হিসেবে গণ্য করার গবেষণা করছিলেন। বাংলা ছাড়ার পরও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান এবং সেই গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যান ফ্রান্সিস গ্যালটন। তিনি, হার্শেল এবং আরও কিছু পুলিশ আধিকারিক এমন একটি আঙুল ছাপ নির্ণয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা দিয়ে ব্যক্তি মানুষকে চিহ্নিত করা যায়।

No comments: