Saturday, March 17, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২ - ঔপনিবেশিকতাবাদের জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

আমরা দেখব মেট্রোপলিটনের বহু নথি ভারত উপনিবেশেই বিকশিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস, মেট্রোপলিটনের রাষ্ট্রের চাকরির নীতি তৈরি করে দিয়েছিল। উল্টো দিকে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক বিদ্যালয়রূপী কারখানায় পড়া জমিদারদের সন্তান যারা ভবিষ্যতে ভদ্রবিত্ত(উনি মিডলক্লাস বলেছেন) আধুনিকতার ধ্বজাধারী হবে, তৈরি হচ্ছে। এই নকসাটি ভারতের মত অন্যান্য উপনিবেশেও প্রতিস্থাপিত হবে যাতে সাম্রাজ্য চালানোয় অনুগত শাসক ভৃত্য উতপাদন করা যায়।ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় প্রতিমা এবং জাতীয় আনুগত্য, রাজা/রানী। তাকে উনবিংশ শতকের মাঝপথে ভারতীয়দের সাম্রাজ্য আনুগত্যের সঙ্গেআলাদা করে জুড়ে দেওয়া হবে।
ভারতে ব্রিটিশ বিজয় বিষয়ে আমার গবেষণার একটা মৌল নীতি হল উপনিবেশ এবং মেট্রোপলকে একই জ্ঞানচর্চার দেহাঙ্গে দেখার চেষ্টা। মোটামুটি মেনে নেওয়া গেছে, অন্যান্য সমাজের মত এই দুটি সমাজও ধারাবাহিক কিছু তথ্যের আধারে বিশ্লেষণ করা যায়। এই তথ্যের আঙ্গিকটি স্বউদ্ভাসিত। এই স্বউদ্ভাসনাটি এই বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা যায় – দ্য এডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার স্টিমড ফ্রম দ্য এফিসিয়েন্ট ইউজ অব দিজ ফ্যাক্টস।
এই তথ্য(ফ্যাক্ট)গুলো আদতে কি, যেগুলি সংগ্রহ করে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়? অষ্টাদশ শতকের শেষের আর উনবিংশ শতকের শুরুর শিক্ষিত ইংলিশম্যানেরা বিশ্বাস করত বিশ্বকে অনুভূতি(সেন্সেস) দ্বারা জানা দরকার, তারা বিশ্বের নানান প্রাকৃতিক বিষয় নথিভূক্ত করেন। এই বিশ্বটি ঈশ্বরের হস্তাবলেপনে উদ্ভুত, পরীক্ষামূলকভাবে এই বিশ্বকে জানা দরকার এবং গঠনশীল বিজ্ঞানের(কন্সটিটিউটিভ অব সায়েন্সেস) মাধ্যমে প্রকৃতির আইনগুলি বিচার করে বিশ্ব এবং অন্যান্য বিষয়ও শাসন করার মন্ত্র বার করা দরকার। ভারতে এসে তারা জেনে না জেনে বা মতলবকরেও শুধু যে এলাকা দখল করল তাই নয়, জ্ঞানচর্চাতেও তারা প্রবেশ করল। এই পরিসরের বাস্তবতা(ফ্যাক্টস)র লাগাম শুধুই আর আক্রমনকারীদের হাতে রইল না। ব্রিটিশেরা মনে করল অনুবাদের মাধ্যমে, যোগাযোগের মাধ্যমে তারা এই পরিসরটা দখল করতে পারে, অজানাকে জানতে পারে।
প্রথম পদক্ষেপ হল স্থানীয় ভাষা জ্ঞান আহরণ করা। ধ্রুপদী পার্সি, আরবি এবং সংস্কৃতর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বলা দেশিয় ভাষাকেও জ্ঞান আহরণের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে ঠিক করা হল। ব্রিটিশেরা উপনিবেশে শিক্ষার প্রথম সংগঠন তৈরি করল দেশিয় সরকারি ভাষা শিক্ষার মধ্যে দিয়েই। দেশিয় ভাষা জ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নির্দেশ দেওন, রাজস্ব আদায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা – এবং যে মানুষকে তারা শাসন করছে, তাদের বিষয়ে আরও নানান আঙ্গিকের জ্ঞান সঞ্চয় করা। ব্রিটিশ শাসককে এই নবলব্ধ জ্ঞান অধিকার দিল, ভারত নামক বিপুল সামাজিক বিশ্বকে শ্রেণীবিভক্ত ও চরিত্র বিশ্লেষণ করে শাসন করার। বৃহত্তর ঔপনিবেশিক প্রকল্পে এই অনুজ্ঞা আর বিষয়গুলি বিচারের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকেরা গবেষণাধর্মী পদ্ধতি(ইনভেস্টিগেটিভ মোডালিটিজ)সমূহ ব্যবস্থাপনা করে তথ্য সংগ্রহে অবতীর্ণ হয়।
গবেষণাধর্মী পদ্ধতিতে অঙ্গীভূত রয়েছে, চাহিদার একদলাতথ্য, নির্দিষ্ট জ্ঞানটি কিভাবে সংগৃহীত হবে সেই পদ্ধতি নির্ধারণ, এর ক্রমীকরণ এবং বিচারবিশ্লেষণ, এবং তারপরে কিভাবে একে ছাপা সমীক্ষা, সংখ্যাতাত্ত্বিক উপস্থাপন, আইনি ভাষা, এবং বিশ্বজ্ঞান(এন্সাইক্লোপিডিয়া)রূপে ছেঁচে নিয়ে বাস্তবে ব্যবহারযোগ্য করা যাবে তার উপস্থাপনা। উপনিবেশের বেশ কিছু গবেষণাধর্মী পদ্ধতি বেশ সার্বজনীন যেমন ইতিহাস-রচনা এবং জাদুঘরবিদ্যা, যদিও সেগুলি ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের স্থান এবং বিশ্লেষণমাত্র। অন্যান্য পদ্ধতি যেমন সমীক্ষা বা জনগণনা অনেক বেশি সংজ্ঞায়িত এবং প্রশাসনিকতার সঙ্গে যুক্ত। অধিকাংশ গবেষণাধর্মী পদ্ধতি বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্রিয়াকলাপ দ্বারা নিবদ্ধ এবং তাদের স্বার্থেই তৈরি করা। এর মধ্যে কিছু যেমন আর্থশাস্ত্র, নৃবিদ্যা, ক্রান্তীয়অঞ্চলের ওষুধ ইত্যাদি, তুলনামূলক আইন অথবা মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানে রূপান্তরিত হল, এবং সেগুলি চর্চাকারীদের পেশাদার বলে দেওয়া হল।



এবারে আমরা এই পদ্ধতিগুলির কিছু কিছু সংক্ষেপে আলোচনা করব।

No comments: