Friday, March 30, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩১ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা

গিলক্রিস্টের ভাষার ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া থেকে সাম্রাজ্যের পক্ষে ভারতীয়দের চরিত্র বিশ্লেষণ ঘটে গেল এবং তাদের কিভাবে দাবিয়ে রাখতে হবে সেটাও স্থির হয়ে গেল। এই মনোভাবের চমৎকার বিশ্লেষণ পাই লেফটান্যান্ট কর্নেল জন ব্রিগসএর লেটার্স এড্রেসড টু আ ইয়ং পার্সনস ইন ইন্ডিয়ায়। এই বইটিতে যেন তার দুই পুত্রকে – বড়টি সেনাবাহিনীতে আর ছোটটি প্রশাসনিক সেবায় থাকা – চিঠি লিখছেন ভারতে কোম্পানির চাকরি করা এক প্রবীন পিতা। প্রশাসনিক সেবায় কি ধরণের ব্যবহার করতে হয় তার বিশদ বিবরণ বইতে তুলে ধরেছেন ব্রিগস। বেশ কিছু বছর ভারতে থাকা বড় ছেলেটি বহু ভুল করেছে। ছোটটি কে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন সেই ভুলগুলি সঠিকভাবে এড়িয়ে যেতে। বড়টি দেশিয় ভাষা শেখে নি, ধারে গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে, ভুল রকমের চাকর নির্বাচন করেছে, চাকরকে নিয়মিত মারে এবং গালি দেয় ইত্যাদি - সাধারণভাবে যা ঠিক করার ছিল সে সব কিছু না করে সব ওলটপালট করে ফেলে। ছোট্টটির কাছে চিঠি লিখে বাবা জানান যে বড়টির ব্যর্থতা থেকে নিরন্তর শিখতে হবে কিভাবে নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানো যায়, সব থেকে বড় কথা যেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত না নড়ে সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। ব্রিগস তার যুবা পাঠককে যা বলছেন, ঠিক সেই কথাই মেজর জেনারেল স্যর জন ম্যালকম বলছেন ব্রিগসের ভাষায় – অলমোস্ট অল হু ফ্রম নলেজ এন্ড এক্সপিরিয়েন্স, হ্যাভ বিন ক্যাপেবল অব ফরমিং এনি জাজমেন্ট আপন কোশ্চান, আর আগ্রিড দ্যাট আওয়ার পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া রেস্টস অন দ্য জেনারেল ওপিনিয়ান অব দ্য নেটিভস অব আওয়ার কম্পারেটিভ সুপিরিওরিটি ইন গুড ফেইথ, উইসডম, এন্ড স্ট্রেংন্থ, টু দেয়ার ওউন রুলারস। দি ইম্পরট্যান্ট ইম্প্রেশন উইল বি ইম্প্রুভ বাই দ্য কন্সিডারেশন উই শো টু দেয়ার হ্যাবিটস, ইন্সটিটিউসন্স এন্ড রেলিজিয়ন – বাই দ্য মডারেশন, টেম্পার এন্ড কাইন্ডনেস, উইথ হুইচ উই কন্ডাক্ট আওয়ারসেলভস টুওয়ার্ডস দেম; এন্ড ইনজিওর্ড বাই এভ্রি এক্ট দ্যাট অফেন্ডস দেয়ার বিলিফ অর সুপারস্টিসন, দ্যাট শোজ ডিসরিগার্ড অব নেগলেক্ট অব ইন্ডিভিজুয়ালস অর কমিউনিটিজ, অর দ্যাট এভিনসেস আওয়ার হ্যাভিং, উইথ দ্য এরোগ্যান্স অব কনকারারস, ফরগটন, দোজ ম্যাক্সিমস বাই হুইচ দিস গ্রেট এম্পায়ার হ্যাজ বিন এস্টাব্লিশড, এন্ড বাই হুইচ আলোন ইট ক্যান বি প্রিজার্ভড।
ম্যালকমের নির্দেশ অনুযায়ী জ্ঞান আর সহানুভূতি অর্জিত হবে জনগণের বোলি শেখার মাধ্যমে – দ্য ভেইল হুইচ এক্সিস্টস বিটুইন আস এন্ড দ্য নেটিভস ক্যান অনলি বি রিমুভড বাই মিউচুয়াল এন্ড কাইন্ড ইন্টারকোর্স, লিখলেন ম্যালকম। অবশ্যই সহানুভূতিপূর্ণ আদানপ্রদান প্রয়োজন ছিল নেটিভদের সঙ্গে আলোচনায়, কিন্তু ব্রিগদের নিদানে, বোলি শেখার প্রয়োজন ছিল কেননা ভাষা না জানলে তথ্য জোগাড় করা যায় না। কারণ ভারতীয় ভাষাগুলির শেখার দক্ষতায় শাসিত দেশের যে ভারতীয় অনুগত(ডোসাইল), সহযোগী (কোয়াপারেটিভ), এবং সাহেবদের নির্দেশ মান্য করতে সদা তৎপর তাদের সমাজের আজব আজব প্রথা, আইন, এবং ভারতীয়দের আচার আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা জরুরি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে; ব্যতিক্রম যখন সাহেবের অজ্ঞতায় ভৃত্যের সংস্কারে আঘাত লাগায়। ভারতে যারা নতুন আসছে, তাদের হিন্দু আর মুসলমান – এই দুই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয় করয়ে দেওয়া হচ্ছে বইতেই। গিলক্রিস্ট তার পাঠকদের জানাচ্ছেন, মুসলমানেরা বড় চেহারার, দাড়িওয়ালা, আর হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী আর অকুতোভয়। কিভাবে চেহারা আর কাপড়চোপড়, পাগড়ি, কাপড় বাঁধা, চুল বাঁধার আঙ্গিক এবং সর্বোপরি তাদের নাম আর খাদ্যাভ্যাস থেকে তাদের আলাদা করা যাবে তাও বিশদে বলেছেন।

ব্রিগস আর ম্যালকমের চাকরি ছিল মধ্য আর পশ্চিম ভারত জুড়ে, তাই তাঁরা চাকরবাকরদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই উপদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে জ্ঞানী, রাজা, ধনী ব্যাঙ্কার, সওদাগর, এবং চাষীদের সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে তাও বলছেন – কিন্তু উলটো দিকে গিলক্রিস্টের ভারতীয় সমাজ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী বদ্ধ হয়েছিল নিচুশ্রেণীর চাকর আর গৃহভৃত্যদের মধ্যেই। বাংলাতে এসেই সব থেকে জ্ঞানী, সব থেকে উদারচিত্ত ইওরোপিয়ই বাঙ্গালি চাকরদের নির্বুদ্ধিতা, বিকৃতমনস্কতা এবং ক্ষুদ্রতা নিয়ে লিখে তাদের মারধোর করার নিদান দিয়েছেন। কিন্তু গিলক্রিস্ট বলছেন কি ভাবে এই সব অবস্থায় ইওরোপিয়দের চরিত্র বিচার হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন উচ্চবিত্তর বাড়িতে আমোদের নেমন্তন্নে গিয়ে গান-বাজানা, নাচা-গানা, এবং যদি নাটকের কোন অংশ ইওরোপিয় সূক্ষ্মতায় আঘাত লাগে, তাহলে ইওরোপিয়দের গলা তুলে ‘পশুসুলভ’ এই বিনোদন বিষয়ে প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকা উচিত। গিলক্রিস্ট বলছেন চুপ করে সেই সময় নিজেকে অকুস্থল থেকে সরিয়ে নিও যা তোমার বংশমর্যাদা আর উচ্চাভিমানের সঙ্গে মানানসই। 

No comments: