Sunday, March 18, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৫ - ঔপনিবেশিকতাবাদের জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

সমীক্ষা(সার্ভে) পদ্ধতি
ব্রিটিশদের ব্যবহার করা সার্ভে বা সমীক্ষা শব্দটি বেশ কিছু নির্দিষ্ট ধরণের কাজের ইঙ্গিত দেয় – কোন কিছু দেখে বিচার করা, পাঁচিল দিয়ে ঘেরার জন্যে কোন জমি চিহ্নিত করা, পরিদর্শন করা, কোন কিছু তত্ত্বাবধান করে কোন ব্যক্তি বা এলাকার ওপরে নজরদারি করা। অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতেও বলা যায়, কোন বস্তু বা বিষয়ের ওপর আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা বোঝায়। অষ্টাদশ শতকে ভারতে শাসনের কাজে থাকা ব্রিটিশদের কাছে সমীক্ষা হল সামাজিক এবং প্রাকৃতিক ভূমিভাগ(ল্যান্ডস্কেপ) বিষয়ে অন্বেষণ/গবেষণা(এক্সপ্লোরেশন)। সমীক্ষা হল এমন একটা তদন্তমূলক পদ্ধতি, যার সঙ্গে বিপুল বিষয় যুক্ত – ভারতের মানচিত্র তৈরি করা থেকে শুরু করে গাছগাছড়ার নমুনা সংগ্রহ করা, ঐতিহাসিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যিক এবং প্রত্নতত্ত্বিক এলাকাগুলি নথিকরণ করা অথবা নিদেনপক্ষে চাষীর মাঠকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মাপন করা।
যদিও মানচিত্র তৈরি করা এবং রাস্তার অনস্থান ও দিক নির্নয় করা ভারতের সওদাগরি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বহুকাল ধরে, কিন্তু সেই কাজটা ১৭৬৫ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন রবার্ট ক্লাইভ বাংলা সুবার প্রধান হয়ে। তাঁর নির্দেশে নবতমভাবে ব্রিটিশ অধিকারে আসা বাংলা ভূখণ্ড সমীক্ষা করা শুরু করেন নৌসেনা আধিকারিক জেমস রেনেল। ঔপনিবেশিক ভারতে সমীক্ষার ধারণাটি হল ভারত সাম্রাজ্যের সরকারি নির্দেশে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক চরিত্র বিশ্লেষণ।
এর ফলে বিপুল ধরণের সরকারি নথিকরণের কাজ শুরু হল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার জর্জ ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায়, ভারতের ওপর কয়েকটি কল্পিত গারদ/ঝাঁঝারি টেনে দিয়ে যার মাধ্যমে সরকার যে কোন সময়ে যে কোন রাজ্যকে চিহ্নিত করতে পারত। নতুন নতুন এলাকা দখল করার পর নতুনভাবে সেই অঞ্চলের সমীক্ষা শুরু হত, যা কিন্তু মানচিত্র তৈরির থেকে বেশি গভীরে চলে গিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রানীকূল, উদ্ভিদকূল, ভূতত্ত্ব, জনবিন্যাস, অর্থনৈতিক পণ্য, ইতিহাস এবং সমাজবিদ্যা নথিকরণ বর্ণনা ও চরিত্র নির্ধারণ করত।


এই সমীক্ষার ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিখে গিয়েছেন কিছু ‘সহজাত প্রতিভা’ধর মানুষ যারা সমীক্ষা নিয়ে যেন ঘোরের মধ্যে থাকতেন – জেমস রেনেল, উইলিটাম ল্যাম্বটন, কলিন ম্যাকেঞ্জি, আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম এবং ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন। ‘মহান মানুষ’দের করা সমীক্ষা তত্ত্বের পিছনে আছে কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যিক জ্ঞানচর্চাগত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে সাম্রাজ্য তার প্রয়োজনীয় এবং নির্দিষ্ট ধরণের জ্ঞান পঞ্জীকৃত করে, যে জ্ঞান দিয়ে সে ভারতকে বিচার, চরিত্রায়ন এবং শাসন করার নীতি প্রণয়ন করবে। ভারতকে ফিক্সিং, বাউন্ডিং এবং সেটলিং করার জন্যে সে এই বিপুল আর বিশাল জ্ঞান লিখিত আকারে যেমন এনসাক্লোপিডিয়া এবং মহাফেজিকরণে রূপান্তরিত করে।

No comments: