Friday, March 2, 2018

পুরুষের বুকে স্তনবৃন্তের ব্যাখ্যা একমাত্র গৌণধর্মই করেছে - গৌরপূর্ণিমা এবং পুরুষের শরীরে নারী ভাবের প্রকাশ - আজকের ব্যতিক্রমী কথাকার সোমব্রতর সামাজ দর্পণ

আমাদের কথা...
মাঝে মাঝে ভদ্রবিত্ত সমাজে দাঁড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়। Somabrata নিজের মত করে ব্যতিক্রমী বাংলার সমাজের হাজারো না জানা, কম জানা, হারিয়ে যেতে বসা(এই লব্জটা লিখতেই ভয় লাগে, ভদ্রবিত্তের এত্ত প্রিয় শব্দবন্ধ এটি;- সমাজ না জেনে খুব সহজেই দাগিয়ে দেওয়া যায়), নানান বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের পরম ব্যতিক্রমী কথাকার রূপে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। পরমের বাংলার সা্স্বরত অবদান সংখ্যায় সোমব্রত অসাধারণ একটা সাক্ষাতকারে বলেছেন পুরুষের বুকে স্তনবৃন্তের ব্যাখ্যা একমাত্র গৌণধর্মই করেছে।
এই লেখাটিতে তিনি পুরুষের শরীরে নারী ভাবের প্রকাশ নিয়ে অসাধারণ কলমপাত করেছেন। আমরা আমাদের সমাজ চিনি না, জানি না, জানতেও চাই না - তথাপি এই সমাজ আর তার সঙ্গঠনগুলিকে আমরা পশ্চিমের কাছে শেখা নানান অপভাষায় ভরিয়ে দিতে কসুর করি না।একটা বড় উদাহরণ বাংলার প্রগতিশীল লিখিয়েরাও। পুরুষের মধ্যে স্ত্রীভাবের প্রবেশকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারেনি ঔপনিবেশিক মাণীষা। কণ্ঠতুলে গালাগালি করেছেন এই সেদিনও। বিনয় ঘোষ বা সুনীতিবাবুর নবদ্বীপ সংক্রান্ত লেখা পড়লেই এই মনোভাব খোলসা হবে।
 সোমব্রত অসাধারণ লেখক, অনন্য সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী। বেশ বড় লেখা। আমি অন্তত আমাদের বন্ধুদের পড়তে অনুরোধ করব, কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা আচার পুরুষ নারীর নানান ধরণের আচারকে কোন রকম ভনিতা না করেই সযত্নে ধারণ করত। কিভাবে হিজড়ে ধর্ম সাধনায় অঙ্গীভূত হলেন।
অসাধারণ।
সোমব্রতর লেখা...
দোলের দিন নবদ্বীপে মহাপ্রভুর মন্দিরে আরতি হয় বসন্ত রাগে। কস্তুরী, চন্দন, অগুরু মাখিয়ে নিবেদন করা হয় মস্ত গলার মালা। এদিন তাঁর জন্মানোর দিন। তাই নবদ্বীপে আজ আর তিনি দেবতা কিংবা কৃষ্ণের অবতার নন। আজ তিনি শচী মাতার কোল আলো করা সেই ছোট্ট নিমাই। সবে জন্মেছেন তো। তাই মহাপ্রভু নন, শিশু নিমাইয়ের হাতে আজ চুষিকাঠি ধরিয়ে দেন গোবিন্দ বাবাজি। এ মন্দিরে তিনি অনেকদিন আছেন। আগে থাকতেন সমাজবাড়ি। সমাজবাড়ির সাথে বরাহনগর পাটবাড়ির মধুর যোগাযোগ। নবদ্বীপে সমাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন রাধারমণ দাস বাবাজি। রাধারমণ বাবাজির শিষ্য বৈষ্ণব পণ্ডিত রামদাস বাবাজি। তিনিই একসময় বরাহনগর পাটবাড়ির সংস্কার করিয়ে শ্রী ফিরিয়ে দেন। সমাজবাড়িতে আগে থেকেই মঞ্জরী ভাবের সাধনার চল ছিল। রামদাস বাবাজির সমসাময়িক ছিলেন সখী মা। তিনিই মঞ্জরী ভাবের সাধনা করতেন। এই সাধনা হত নবদ্বীপের সমাজবাড়িতে। এর মূল বিষয় যেটি, শ্রীকৃষ্ণের ভজন সাধনে শরীরের মধ্যে নারীর গুণাবলী এনে তোলা। সখী মা আদতে ছিলেন পুরুষ। রাধারমণ বাবাজি তাঁকে এই নারীবেশের সাধন দেন। মহাপ্রভু মন্দিরের প্রবৃদ্ধ গোঁসাই হরিধন বাবাজি দেখেছিলেন সখী মাকে। রামদাস বাবাজি দেহ রাখেন পাটবাড়িতে। তার পর পরই সখী মাও চলে যান। হরিধন বাবাজির কাছেই শোনা, সমাজবাড়িতে তখন মঞ্জরী ভাবের সাধনা যোগ হয়েছে পুরোদমে। শুধু সখী মা তো নন। আছেন আরও দুজন পুরুষ। ওঁরা ললিতা দাসী ও কিশোরী দাসী নামে পরিচিতা। নবদ্বীপে সমাজবাড়িতে ললিতা দাসীকে দেখেছিলেন অধ্যাপক ও অনুসন্ধানকারী বিশিষ্ট লেখক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। তিনি তখন কৃষ্ণনগর কলেজে পড়ান। সেখান থেকেই পুরুষ শরীরে নারীবেশের সাধনধারা নিয়ে থাকা ললিতা দাসীর নাম শুনে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। ললিতা ও কিশোরী দাসী দুজনে খুব শিক্ষিত মানুষ ছিলেন।নীলাচলের ঝাঁজপিঠা মঠে সমাজবাড়ির রাধারমণ বাবাজি এই তিন পুরুষকে নারীবেশী মঞ্জরী ভাবের সাধনা দেন। বরাহনগর পাটবাড়িতে একসময় রাধারমণ বাবাজির এই তিন শিষ্যরই যাতায়াত ছিল। কেননা ওখানকার তৎকালীন মহান্ত রামদাস বাবাজির এঁরাও তো গুরুভাই। এই তিন পুরুষবেশী নারীই বিশুদ্ধ তসরের শাড়ি পরতেন সকাল সকাল স্নান সেরে। তিন জনেরই ছিল বিন্যস্ত লম্বা চুল। কপালে আঁকতেন এঁরা চন্দনের টিপ। পায়ে দিতেন আলতা। ললিতা দাসী নূপুর পরতেন। হরিধন বাবাজি বলেছেন আমায়, ললিতা দাসী মহাপ্রভুর জন্মতিথিতে ভোর ভোর এসে শিশু নিমাইকে কোলে করে মাতৃবেশে হাতে চুষিকাঠি গুঁজে চুম্বন করতেন। শিশুর জামা বদলে নিতেন। দুধ খাওয়াতেন ঝিনুক বাটিতে করে। এই ছিল ওঁর সাধনা। সন্ধেবেলা যখন আরতি হত ললিতা দাসী বসন্ত রাগে গাইতেন, ভালি গোরাচাঁদের আরতি বাণী। তিনি যখন নেচে নেচে গাইতেন, জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী তখন তাঁর নূপুর বোল তুলত ভীষণ। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী দেখেছেন, ললিতা দাসী যখন মাথায় কাপড় টেনে নারীর ভূষণজনিত লজ্জায় ম্লান তখন তাঁর গালজোড়া পরিপাটি কামানো। পুরুষ থেকে নারী হতে লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজবাড়ির সখী মা, কিশোরী দাসী, ললিতা দাসীরা দাড়ি গোঁফ কামিয়ে প্রস্তুতি নিতেন। তারপর সারাদিন ভগবানের সেবা। চললে বলনে পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা এই সাধিকারা যে এখন আর নেই তাও তো নন। সমাজবাড়ির সেই সাধনা ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা বাংলায়। আজও নিতাইরানি দরবেশ শাড়ি পরে গোবিন্দের ভজনা করেন। মুর্শিদাবাদের বাউলানি রাই খেপী নপুংসক অভিধা মুছে বাউল সাধনাতে রত। বীরনগর থেকে চূর্ণী পেরিয়ে সাধন আশ্রমে আছেন হিজড়া নারী পাপিলেশ্বরী। তিনি এলাকার মায়ের সম্মান পান এখন। যখন গবেষণার কাজে নবদ্বীপ যেতাম, পুরাণ পরিষদ ছেড়ে বেরিয়ে মহাপ্রভুর মন্দিরে আসতাম বাবাজির কাছে এই নারীবেশী পুরুষদের সাধনকথা শুনব বলে। ললিতা দাসী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মিলনগড়ে আজও আছেন মহিয়সী মা। তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম এ। পিএইচডি করেছেন সহজিয়া সাধন নিয়ে। করতে করতে সমাজবাড়িতে যাতায়াত। ললিতা দাসী দিয়েছেন তাঁকে মঞ্জরী ভাবের এই সাধনা। জানি না সমাজবাড়ির ধারায় মঞ্জরী ভাবের শেষ সাধিকা তিনি কিনা। পাটবাড়িতে এই সাধনধারা আর নেই। নবদ্বীপে সখী ভাবের সাধনা নেই। তবু আছেন মা মহিয়সী । আশি পেরোনো অশক্ত শরীরে তিনি দোলের দিন আসেন মহাপ্রভুর মন্দিরে। গলা সুরে খেলে না। তথাপি পায়ে নূপুর পরে তিনি বসন্ত রাগে শিশু নিমাইয়ের জয়গান করেন । দোলের পরদিন মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন। মন্দিরে সকালবেলা বেজে উঠবে বৃন্দাবনী সারাং। এমনই তিথিদিনে আমি সেবার গবেষণার কাজে নবদ্বীপে। মহাপ্রভু মন্দির থেকে বেরিয়ে যাব সমাজবাড়ি। সঙ্গে আমার পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা রাধারমণ বাবাজির সাধনধারার সাধিকা মা মহিয়সী । বললাম যেতে যেতে, এই সাধনার মানেটা কী মা? বললেন, মঞ্জরী ভাব প্রচ্ছন্ন ভাব। গোপন ভাব। বিদ্যার অহং খসিয়ে পুরুষের পৌরুষ সরিয়ে নারী হয়ে আত্মবৎ সেবা। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। নিজের স্বরূপ। অহংকার যেন না বেরোয় । জীবনেও এই সাধনা বড়। যেটুকু তুমি, যা তুমি, তোমার বিদ্যা শিক্ষা সব, গোপন করো। রংদোলের আবির গোটা নবদ্বীপে। তারই ভেতরে আমি কেবল দেখছি গোপনীয়তার রং। বিদ্যা শিক্ষার অহং সরিয়ে এক পুরুষ তাঁর শরীরে নারীর প্লাবন ধরে রেখেছেন এই একুশ শতকের চূড়ান্ত ভোগবাদের ভেতরে। আমরা তখন হাঁটছি সমাজবাড়ির পথে। হাওয়া দিচ্ছে বসন্তের। তারই ভেতর দূরে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বসন্ত রাগের কীর্তন। দোলের নবদ্বীপের এটাও এক বৈশিষ্ট্য।

No comments: