Wednesday, March 28, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৬ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

১৭৭০ থেকে ১৭৮৫ এই ১৫ বছর সময়কে আমরা দেখতে পারি যখন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারত শাসনের অঙ্গ হিসেবে ভারতীয় ভাষাগুলিকে নিজেদের স্বার্থে বিকাশ ঘটানোর প্রকল্প নিল। একের পর এক ব্রিটিশ আধিকারিক ভারতের সংস্কৃত, ফারসি আর আরবির মত ‘ধ্রুপদী’ ভাষাসহ অন্যান্য অসংস্কৃত ভাষাগুলিও শিখতে শুরু করে। এই সময় ব্রিটিশেরা ভাষার জন্য এবং অন্যান্য ভাষা থেকে নানান হাতিয়ার যেমন ব্যকরণ, শব্দকোষ, ভাষা বিষক প্রবন্ধ, পাঠ্যপুস্তক এবং অনুবাদ প্রকাশ করার উদ্যম নেয়। আমার এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হল, এই সময় বা আগামী সময়ের প্রকাশনাগুলির মাধ্যমে তারা ভাষার গড়ন নির্দেশ করা, জ্ঞানচর্চার ভূমিকা ঠিক করে দেওয়া, আলোচনার ভিত্তি(প্রাচ্যবাদ) নির্নয় করে ভারতীয় জ্ঞানচর্চাকে ইওরোপিয় ঢঙ্গে পরিবর্তিত করার উদ্যম নেবে। ভারতে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের প্রথম এবং একমাত্র উদ্যম হল ভারতীয় ভাষাগুলিকে ইওরোপিয় লব্জে ব্যকরণিক, শব্দকোষিয়, এবং শিখন প্রণালীর জামা পরানো।
এই ধরণের কিছু প্রকাশনা হল ফ্রান্সিস বেলফোরের ‘হরকরণ’ বা গ্ল্যাডউইনের ‘আইন’। এই দুটি প্রকাশনা এই পথে যাওয়ার দিক নির্দেশিকা হয়ে উঠল। প্রথমটি একজন কায়স্থর চিঠি লেখা সংক্রান্ত মুঘল সময়ের নির্দেশাবলী অন্যটি সেই সময়েরই প্রশাসনিক কাজকর্মের নির্দেশনামা। ডাও আর ডেভির ফারসি আখ্যানগুলির অনুবাদের অন্যতম লক্ষ্য হল পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যের কাজকর্ম বোঝা এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা কেন তারা শাসন করতে বিফল হল। হ্যালহেদের জেন্টু ল আর উইলকিনসের গীতা অনুবাদের সূত্রধরে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রিত হিন্দু আইন এবং ধর্মর নিগড়ে ধাক্কা মারা হল।
এই পুস্তকগুলি প্রকাশ করে, শাস্ত্র হিসেবে কয়েক হাজার বছরের বিভিন্ন মতবাদের ভারতীয় জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, পুজারী, আইনজ্ঞ, আধিকারিক, ব্যবসায়ী এবং ব্যাঙ্কারদের জ্ঞানচর্চার বিচরণ ক্ষেত্রে ব্রিটিশেরা অনুপ্রবেশ করল, এবং এই বিপুল মানুষজনকেও ভারত সাম্রাজ্য শাসনের অংশীদার করে নিল। এরা এবারে সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখা সাদা সাহেবদের কড়া নজরদারির অধীনে বাবু, করণিক, অনুবাদক, নজরদার, তহশিলদার, দেশমুখ, দারোগা এবং মামলতদারে পরিণত হল।
হাতে গোণা ব্রিটিশ আধিকারিকের এই বিপুল জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার উদ্দেশ্যই ছিল সাম্রাজ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করা এবং বিপুল পরিমানে বাড়তে থাকা তথ্যভাণ্ডারের তথ্য সংগ্রহ আর নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নির্নয় করা। এই তথ্যগুলি তাদের অতীব প্রয়োজন ছিল যাতে তারা যতটা পারা যায় শস্তায় এবং কার্যকরভাবে রাজস্ব আদায় এবং শাসন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে; এবং এই তথ্যগুলি ভারতের সমাজের চরিত্র বিশ্লেষণ আর সমাজকে বিভক্ত করার কাজে আসে। ভারতীয় সমাজে সহায়ক অভিজাত খুঁজে পাওয়া জরুরি হয়ে গেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে। দেশজুড়ে রাজনৈতিক কৌশল ও কার্যপদ্ধতি নির্ণয় করে সংকলিত এবং সুগ্রন্থিত করে সফল দৌত্যে পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়ল, যাতে ক্ষমতাসীনদের অধীন করে ফেলা যায়। বিপুল বিশাল ভারতীয় সামাজিক বিশ্বকে ভেঙ্গেচুরে ইওরোপিয় শাসন সুবিধার্থে চরিত্রায়িত, শ্রেণীভুক্ত, এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হল। যে ভাষায় ভারতীয়রা কথা বলত এবং লেখাপড়া করত তাকে বদলে ফেলা হল। সাম্রাজ্যের শাসনের আওতার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সামাজিক স্বার্থগোষ্ঠীর বিপুল বৈচিত্র স্বার্থের দিকে নজর রেখে তাদের নিজস্ব আলোচনার আজেন্ডা তৈরি করে দেওয়া হল। উনবিংশ শতকের ভারতের সামাজিক এবং রাজনৈতিক মানচিত্রে জ্ঞাননর্ভর আলোচনার বৈচিত্রকে প্রতিষ্ঠিত এবং বিধিসম্মত করে তোলা গেল।
আমি যে ভাবনাটা ভাবতে চাইছি, সেটা স্বাভাবিভাবে মাইকেল ফুকো প্রভাবিত। আমার কাজ হল তিনি ইতিহাস দেখার অঙ্গ হিসেবে যেভাবে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন সেটিকে ধরে অগ্রসর হওয়া, যার অধিকাংশই ভারতের অতীত আলোচনার ছাত্রদের ভাবনায় খাপ খেয়ে যায়। ভারতীয় ইতিহাসের ছাত্রদের নিশ্চই মনে পড়বে, কিভাবে ১৭৭০ থেকে ১৮২০র সময়টিতে ভারতীয় ভাষাগুলি শিখন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এর জন্যে তাত্ত্বিক এবং জ্ঞানচার্চিক হাতিয়ারগুলি বিকশিত হয়। আমরা আলোচনা করব এই সময়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়াম এবং ফোর্ট সেন্ট জর্জের কলেজটি।

No comments: