Wednesday, November 22, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই৬ - যোগেশ রাম মিশ্র

বহু কাল ধরে স্থানীয়ভাবে লোহা তৈরির কাজে লিপ্ত থাকায় এই জ্ঞানচর্চায় তাঁরা প্রযুক্তি আর ভূগোলকে হাতের তালুর মত চিনতেন। তারা নতুন খনি খোঁজা, লোহাচুর(বেল)এর উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে সেটির চরিত্র নির্ধারণ করা, কত চুরের সঙ্গে কত কাঠকয়লার গুঁড়ো মেশাতে হবে সেটা নির্ধারণ করা, চুল্লি, জ্বালানি তৈরি করে চুল্লিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় আগুণ জ্বালানো যাতে লোহা তাদের চাহিদা মত চরিত্রে গলে, পুড়ে না যায়, এবং সেই লোহা ব্যবহার করে চাষের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কাজ করতে এই জ্ঞানচর্চার ভিত্তিতে। উনবিংশ শতকের প্রথমপাদে ভেরিয়ার এলুয়িনের নৃতাত্ত্বিক কাজে আজ আমরা জেনেছি আগারিয়াদের লোহা তৈরির কাজে আচার একটা বড় ভূমিকা পালন করে যার মাধ্যমে এই জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। তিনি হাপর তৈরির গান আমাদের জানিয়েছেন। একটি গানে কোন কোন উপাদান ব্যবহার হবে তার উল্লেখ রয়েছে - The bellows are made of khamar wood/The skin of cow hide/The feed-poles of bamboo/ The Agaria girl blows the bellows। আরেকটিতে হাপর তৈরির পদ্ধতি বলেছে, ‘There is the Bamboo Maiden where the string is tied/There is Dhikan Mata where the two poles are fixed/I go to see/O Wind Maiden this is for you’।
কোম্পানি উনবিংশ শতের শুরু আর মধ্যভাগে ভূতত্ত্ববিদ পাঠিয়ে এই অঞ্চলটা কতটা লোহাচুরে ভর্তি তার অনুসন্ধান করেছে। তারা সমীক্ষা করে দেখেছে যে গোটা দামোদর নদ অঞ্চলের পাহাড় এবং সমতলভূমি হেমাটট ঋদ্ধ লোহায় ভরপুর। তারা খনিগুলির বিশাল এলাকায় ব্যপ্তি খুঁজে পেয়েছেন, এবং কিভাবে স্থানীয় সমাজ গভীরভাবেই এই কাজে যুক্ত ছিল তারও বর্ণনা পেয়েছি(D. H. Williams, A Geological Report on the Kymore Mountains, The Ramghur Coal Fields and the Manufacture of Iron এছড়াও ওল্ডহ্যাম Examination of the Districts বলছেন ১৮৫১ সালে এই অঞ্চলজুড়ে লোহা গলানোর পর লোহার বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন, the extent to which these operations had been formerly carried on, and of the long time during which they had been continued)। খনির তলা ভূমিতল থেকে মাত্র ১৫-২০ ফুট নীচে। এখানে (আধুনিক অর্থে) খনি শব্দটা ব্যবহার বিভ্রান্তিকর, সাধারণ খোঁড়ার খন্তা দিয়ে যতটুকু খোঁড়া যায় সেইটুকুই তারা খুঁড়তেন। এই বর্ণনাগুলো থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি, এই সমাজ যেখান থেকে লোহাচুর তুলত সেখানেই গলিয়ে নিত কাঠকয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যহার করে। এই কাজে কিছুটা দক্ষতা তৈরি হয়েছিল – কেউ হয়ত অশোধিত লোহা তৈরি করতেন, কেউবা তৈজস আর হাতিয়ার(Martin, Histories, Antiquities and Topographies)।

কিছু কিছু সমাজ খনির লোহাচুর, ব্যাপারীদের বেচতেন, ব্যাপারীরা সেগুলো নিয়ে যেতেন আড়ঙে। এইগুলি তুলনায় বড়, স্থায়ী চুল্লিওয়ালা শাল(কারখানা, workshop) ছিল। প্রতেক বারে লোহাচুর গলিয়ে ২৫ মন লোহা তৈরি হত। লোহা বিভিন্ন চরিত্রে বিক্রি হত, লোহাচুর, smelted sponge-like mass, অপরিশোধিত লোহা, পেটাই লোহা, বা চাষের হাতিয়ার বা বাড়িতে ব্যবহারের জন্য আংটা, খন্তা, ছুরি, বা চিমটা ইত্যাদি। এই এলাকায় কোন গঞ্জ(Hobson-Jobson Dictionary গঞ্জ সম্বন্ধে বলছে: ‘The Gunje signifies a range of buildings at a place of traffic, for the accommodation of merchants and all persons engaged in the purchase and sale of goods, and for that of their goods, and of the shopkeepers who supply them) ছিল না, ব্যাপারী আর তাদের দালালেরা ভাগলপুর, পাটনা, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ বা কলকাতায় গিয়ে কড়ি বা ফসলের বিনিময়ে লোহাপণ্য বিক্রি করত। উৎপাদনের এলাকায় রাজার প্রতিনিধিরা বিক্রির ওপর নজর রাখত। শুল্ক বসাত। W. Jackson, ‘Memorandum on the Iron Works of Beerbhoom’, Journal of the Asiatic Society of Bengal ১৮৪৫এর প্রকাশিত প্রবন্ধে লিখছেন, ২৫ মন বিক্রি হত ১টাকায়, প্রত্যেক বারের জন্য ১টাকা অর্থাৎ মোট বিক্রির ওপর ৪ শতাংশ শুল্ক ছিল।

No comments: