Thursday, November 23, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই১৪ - যোগেশ রাম মিশ্র

এক সময়ের পরে হ্যাঙ্গামগুলি বাড়তে থাকে। এই অভিযানগুলি সরাসরি কোম্পানি সরকার এবং তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হত। হামলাকারী দলে থাকত কখোনো ৪০০ থেকে ১০০০ চুয়াড়। চুয়াড়দের এই হ্যাঙ্গামে কোম্পানির সেটমেন্টের কাজ এক জায়গায় দাঁড় করয়ে দিল। ১৭৮৫ সালে পরণনা জুড়ে ১০০০ জনের একটি দল পশ্চিমের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি দপ্তর আর বাজার ধ্বংস করতে থাকে। ১৭৮৮ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানির বীরভূমের সদর সিউড়ির কাছের একটি গঞ্জ একদল লুঠেরা লুঠ করে। ১৭৮৯ সালের জুন মাসে দিনের বেলায় ইলমবাজারে একটি লোহা কারখানা ধ্বংস করে দেয় চুয়াড়েরা।

ঐতিহাসিকেরা বলছেন বীরভূমের আশেপাশের অঞ্চলগুলোয় দীর্ঘকাল ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলতে থাকে, এবং এই হামলার চরিত্রগুলো আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার। প্রথমত অধিকাংশ বিদ্রোহী উত্তর-পশ্চিম হাটগাছির পাশের রাদশি(Radshy) এবং অন্যান্য এলাকা থেকে আসা, বাংলার পশ্চিম সীমান্তের চুয়াড়দের গতিবিধি অনিয়ন্ত্রিত ছিল। বীরভূমের রাজার আমলারা তাদের এই চরিত্র জানতেন। কোম্পানি কর্মচারীরা চুয়াড়দের লুঠেরা এবং আক্রমণকারী দাগিয়ে দিলেও, সেনারা যে সব এলাকা ‘মুক্ত’ করেছে, সেই সব এলাকায় বাইরের উৎসাহী মানুষেরা বসতি তৈরি করে ফেলেছে, চুয়াড়েরা সেই সব এলাকা আক্রমণ করত। এই মানুষগুলি কাঠকয়লা, কাঠ, কয়লা, রেশম, লোহা ইত্যাদি – জঙ্গল যা তৈরি করে সেগুলি তৈরি বা জোগাড় করত। বিদ্রোহীরা বাজারে বিক্রি হয় এমন জিনিস এবং বিপুল সংখ্যায় চুল্লি ধ্বংস করেছে। মন্বন্তরের সময় ছাড়া তারা কোনদিনই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবারদাবারে হাত দিত না, কোনদিন তাদের স্বজাতি আর চাষীদের ওপর অত্যাচার করত না। তাদের লক্ষ্য ছিল কোমপানি আর জমিদারদের আমলা, মহাজন এবং ব্যবসায়ীদের আক্রমণ। অন্যভাবে বললে তাদের ধ্বংসকর্মের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তির(জমি আর জঙ্গল) আর কাজকর্মের(কৃষি আর কারিগরি) ওপরে তাদের যে অধিকার ছিল তা ফিরে পাওয়া।

কোম্পানির আমলারা সম্পত্তি বিষয়ে যে সব পুঁজিবাদী ধারণা, তাই নিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছে। তারা ভারতীয় সাধারণ আইন এবং ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী সম্পত্তির বিষটি দেখার চেষ্টা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্পদের সঙ্গে মানুষের দুটি সম্পর্ক তারা স্বীকার করে, একটি দখলি অন্যটি ভাড়াটিয়া। এই ধারনায় জঙ্গল এবং খাস জমির অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার শাসকের অধিকার অবিতর্কিত। যৌথ অংশিদারি বা সমূহের অধিকার(holding in common) এই ধারনাগুলি তারা জানেই না। কোম্পানি আমলারা স্থানীয় সম্পত্তির জটিল সম্পর্কগুলোকে বুঝতেই পারে নি।

চুয়াড়দের সঙ্গে জঙ্গলের সম্পর্ক কোম্পানির বোঝে নি। ফলে তাদের কাজকর্ম আমলাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে, ফলে তাদেরকে হুঁশিয়ারি হিসেবে দেখে আমলারা শান্তি আনতে সেই মত পদক্ষেপ করেছেন। উদ্বিগ্ন আমলাদের ধারনা ছিল কিছু জমিচ্যুত জমিদার এই সব হ্যাঙ্গাম ঘটাচ্ছে। আমলারা দেখল দিনের পর দিন চুয়াড়দের আক্রমণ বাড়ছে এবং তার ফলে সেটলমেন্টের কাজ কর্ম বন্ধই হয়ে গিয়েছে। তাই তাদের সিদ্ধান্ত হল যে স্থানীয় সামন্তেরা এই কান্ডগুলো ঘটাচ্ছে, তাই তাদের বিরুদ্ধে অন্য সামন্তকে লড়িয়ে দিতে হবে – তাতে ব্যর্থ হলে সেনা অভিযান – তাতেই চুয়াড় লড়াই শান্ত হবে। চুয়াড়দের লড়াইয়ের চরিত্র দেখলে, এ ধরণের সিদ্ধান্ত করা ছেলেমানুষির লক্ষ্মণ।

কোম্পানি আমলাদের বিশ্লেষনের ওপর নির্ভর করে ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকেরা বীরভূমের উপনিবেশ শুরুর সময়ের লোহা শিল্পের সে ব্যাঘাত ঘটে তার জন্য দায়ি করেছেন রাজার দরবার এবং ফাটকাবাজ বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের আর্থ-সামাজিক টানাপড়েনকে। হেটলি এই সম্পর্ককে দেখেছেন জমির মালিকানা নিয়ে কোম্পানির পরস্পরবিরোধী অবস্থানের জন্যই ফারকুহর আর রাজার দপ্তরের মধ্যে বাড়তে থাকিয়া বিবাদ হিসেবে। এবং যেহেতু কোম্পানি সরকার এই দুটি শিল্পস্থাপন করতে চাওয়া ব্যক্তিকে জমির অধিকার দিয়েছে, রাজাকে সেটলমেন্ট অনুযায়ী আর ফারকুহরকে তার ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখে – তাই দুপক্ষের গোলোযোগে এই উদ্যম দুটি অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে। সাম্প্রতিক উপনিবেশ-কেন্দ্রিক মতবাদ অনুসারে উপনিবেশ শিল্প স্থাপন করতে বাধা দেয় নি ঠিকই, কিন্তু তাদের সক্রিয় ভূমিকাও পালন করতে দ্যাখা যায় নি। হেটলির যুক্তি হল খণিজ সম্পদ সদর্থক ব্যবহারে দেরি হল তার কারণ ঔপনিবেশিক আমলাদের অব্যবস্থা এবং অযোগ্যতা।



ফারকুহর আর জমিদারদের মধ্যে অনুভবযোগ্য টানাপোড়েন তো ছিলই। ফারকুহরকে জমি ব্যবহার এবং লোহা উৎপাদনের একচেটিয়া অধিকার দেওয়ার প্রকাশ্য বিরোধ করেছিল ইন্দ্রনারায়ণ। তিনি ফারকুহরের লোহা কারখানাকে বাধা দেওয়ারো চেষ্টা করেন। হেটলি বলছেন, ‘‘[Farquhar’s] people were molested, fuel obstructed, miners bribed away, and perwannas for private furnaces issued’। ১৭৮৪সালে রাজা এই গোটা লোহা মহলকে নিজের দখলে নিয়ে এসে কারখানাড় ওপর পরোক্ষে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার কমিটি অব রেভিনিউ তার আবেদন বাতিল করে বলে, ‘must remain in [Farquhar’s] possession according to the terms of the grant, as he has hitherto held it’। ১৭৮৬ সালে ফারকুহরকে তার রাজস্ব জমা খরচের অধমর্ণ হিসেবে দেখান – কিন্তু তাতেও কাজ হয় নি, কোম্পানি সেনা আর আর্থিক সমর্থন নিয়ে ফারকুহরের পাশে দাঁড়ানোয়। কোম্পানির নিঃশর্ত সমর্থনের বলে স্বাভাবিকভাবে ফারকুহর ইন্দ্রনারায়ণের সব রকম আক্রমণ প্রতিরোধ করার সুযোগ পান। যদিও ফারকুহর প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন ১৭৮৯ সালে। কিন্তু চুয়াড়েরা ঔপনিবেশিক ইতিহাসে তারপরেও বিরাজ করে চলেছে বহুকাল।

No comments: