Monday, November 20, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩ - বাংলার দাদনি বণিক - ইওরোপিয় কোম্পানির উদ্ধারকর্তা - বাংলার কার্যকর, বিস্তৃত, উন্নত ঋণ ব্যবস্থা - সুশীল চৌধুরী

(State and Finance in the Eurasian Continuum in the Early Modern Times: INDIAN MERCHANT/BANKERS TO THE RESCUE OF THE EUROPEAN COMPANIES, EASTERN INDIA, C. 1650 – 1757: SUSHIL CHAUDHURY)

৩) ইওরোপের সোনা/রূপো আর মশলা
পূর্বের দেশে যে সব জাহাজ আসত তারা নিয়ে আসত রূপো/সোনা আর মশলা, এটা তাদের জাহাজের মোট বহনের ৮০-৯০ শতাংশ ছিল। এই পণ্যগুলি মরশুমি ছিল এবং বহুবার সঠিক সময়ে এসে পৌঁছত না। আর যে সোনা/রূপা ইওরোপ থেকে আনা হত, দেশের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তার পরিমান ছিল অতি অল্প। কিন্তু আরও সমস্যা ছিল, তারা যে পরিমান এই পণ্যগুলো নিয়ে আসত সেগুলিকে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে সেই অর্থ দাদনি বণিকদের তুলে দেওয়া, যাতে তারা পণ্য আগ্রিম করতে পারে। খোলা বাজারে এই দামি ধাতু বিক্রি করে সেই অর্থ দাদনের জন্য ব্যবহার করতে পারাটা তাদের পক্ষে সুবিধেজনক ছিল। কিন্তু সে সময়, ভারতের সব থেকে বড় ব্যাঙ্কার, জগতশেঠের পরিবার একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রের মদতে টাঁকশাল নিয়ন্ত্রণ করত(দেখুন J. H. Little, The House of Jagat Seth, Calcutta, 1956; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline – Bengal in the Eighteenth Century; S. Chaudhury, The Prelude to Empire – Plassey Revolution of 1757)।

বাস্তবিকই বাংলার নবাব মুর্শিদকুলিখাঁর অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে, জগত শেঠের পরিবার বাংলার টাঁকশালের ওপর একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছিল। ১৭২১এ ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল লিখছে, ‘… Futtichund [Jagat Seth] having the entire use of the mint, no other shroff [money changer/banker] dare buy an ounce of silver’। কোম্পানি বহুকাল ধরে বাংলার টাকা ছাপাবার ব্যবস্থা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, এবং তারা কাশিমবাজার কাউন্সিলকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল, যাতে নবাবি দরবার থেকে এই ফরমানটা সংগ্রহ করে। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানি দরবারের কিছু উচ্চপদস্থ আমলার সঙ্গে সাঁট করতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারা কোম্পানি আমলাদের জানাল যে ফতেচাঁদের কড়া মুঠো থেকে বেরিয়ে একটাকাও ছাপাবার ব্যবস্থা করা যাবে না, while Futtichund was so great with the Nabob, they can have no hopes of that grant, ha alone having the sole use of the mint nor any other shroff dare buy or coin a rupee’s worth of silver।

টাঁকশালের ব্যবসা সোনার ডিম পাড়া হাঁস পোষার মত রোজগেরে অবস্থা, ফলে জগতশেঠ যে কোন মূল্যে টাঁকশালের নিয়ন্ত্রণ নিজের পরিবারের কব্জায় রাখতে আগ্রহী ছিল। ১৭৪৩ সালে কাশিমবাজারের কুঠিয়াল (ফ্যাক্টর) লিখছেন, … but this [minting] privilege they [the English] can never hope while Futtichund subsists and has that weight with the government which his usefulness to them and great influence at Court naturally gives him। ফলে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি বাধ্য হয়ে তাদের রূপো আর মশলা জগতশেঠদের কুঠিতে, জগতশেঠেদের দেয় দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হত(এখানে সুশীলবাবু বলছেন যে, বাংলার টাঁকশালে জগতশেঠেদের একাধিপত্য ছিল, এই তত্ত্ব ওম প্রকাশ খণ্ডন করলেও তাঁর From Prosperity to Decline, বইএর চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি প্রয়োজনীয় প্রমান দিয়ে এই তত্বটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ওম প্রকাশের সমালোচনাটি দেখতে বলছেন Indiasn Economic and Social History Review, পত্রিকায় প্রকাশিত ‘On Coinage in Mughal India’ প্রবন্ধে)।

ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া দাদনি বণিকেরা যেহেতু সোনা/রূপো আগ্রিম হিসেবে নিত না। ফলে কোম্পানিগুলোর সমস্যা বাড়ত বই কমত না। ১৭৪৬ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি, ‘due to them on account of the investment’ হিসেবে দাদনি বণিকদের সোনা/রূপা নগদে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দাদনি বণিকেরা এই শর্তে রাজি হয় নি কেননা, আড়ঙে নগদ অর্থ দিতে হয়, আর জগতশেঠের গদিতে রূপো বিক্রি করার তাদের কোন সুযোগই নেই, তারা তাদের থেকে রূপো কিনবেই না, ‘Rupees would pass at the aurungs [and] that they could no ways turn the Bullion into Rupees but by selling it to Juggutseat’s house who they were well assured would not buy it of them’। ফলে কোম্পানিকে এদেশে আনা আমদানি শেষ পর্যন্ত জগতশেঠের গদিতে শেঠেদের তৈরি করা দামে সঁপতে হত, সে দাম খোলা বাজারের তুলনায় যতই কম হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৭১৮ সালে ২৪০ সিক্কা ওজনের ব্রিটিশ স্টান্ডার্ড রূপোর দাম পাওয়া গিয়েছে ২১৮.৭৫ সিক্কা টাকা স্রফ ব্যবসায়ীর কাছে ৫ শতাংশ চুঙ্গী কর দিয়ে ২৪০এর বিনিময়ে পাওয়া যেত ২১০.৭.৯ সিক্কা ওজনের টাকা। তবে সাধারণত ২৪০এর বিনিময়ে জগতশেঠেরা দিত মোটামুটি ২০৩ সিক্কা টাকা।
ডাচেদেরও অবস্থা খুব একটা আলাদাও ছিল না, ভালও ছিল না। তাত্ত্বিকভাবে বাংলা সুবার মুঘল টাঁকশালগুলি খোলা বাজারের জন্য উন্মুক্ত ছিল, যে কেউ সেখানে ধাতু নিয়ে গেলে টাঁকশালের দায়িত্ব থাকত নির্দিষ্ট বাটার বিনিময়ে টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাস্তবে মুর্শিদাবাদের দরবারের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে জগত শেঠেরা টাঁকশালে একচেটিয়া কারবার চালাত। ডাচেরা টাঁক্সাল থেকে টাকা ছাপাত ঠিকই কিন্তু তার জন্য মাঝে মধ্যে বেশ কিছু অলঙ্ঘ্য বাধার মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। তারা তাদের আনা রূপো শেঠেদের কুঠিতে বিক্রি করতে বাধ্য হত। বাধার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক, তাদের দেওয়া রূপো টাকায় পরিণত করতে শেঠেরা ইচ্ছে করেই কিছুটা বেশি সময় নিয়ে নিত, ঠিক সময়ে সেই অর্থ তাদের দিত না। কিন্তু যেহেতু দাদনি বণিকদের সঙ্গে পণ্য চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে দাদন দেওয়া জরুরি ছিল, পুরোনো বকেয়া মেটানোরও দায় ছিল, তাই তাদের পক্ষে টাকা শেঠেদের টাঁকশাল থেকে কখন বেরোবে তার জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকা চলত না। বাংলার ডাচ ডিরেক্টর Sichtermann স্মৃতিকথায় লিখছেন, ১৭৪৪ সালে টাঁক্সাল থেকে তাদের দেয় রূপোর বিনিময়ে টাকা পেতে এত দেরি হচ্ছে যে তারা ভাবছে যে শেঠেদের টাঁকশাল থেকে টাকা না বানিয়ে, যদি ঠিকঠাক দাম পাওয়া যেত তাহলে সেই রূপো নগদে শেঠেদের কুঠিতে বেচে দেওয়াটা ভাল রণনীতি ছিল। ১৭৫৫ সালে বাংলার ডাচ ডিরেক্টর লিখছেন, শেঠেরা ইচ্ছে করেই অস্বাভাবিক দেরি করছে ‘unheard of delays in the mint which he suspected was partly because of the intrigues of the house of Jagat Seth’। ফলে ডাচেরাও বাধ্য হত শেঠেদের কুঠিতে তাদের দেওয়া দামে রূপো বেচে দিতে। এবং আমরা ১৭৫৫ সালে দেখব, ডাচেরা হুগলি বন্দরে(S. Chaudhury, ‘The Rise and Decline of Hughli – A Port in Medieval Bengal’, Bengal Past and Present,) শেঠেদের গোমস্তাকে তাদের নিয়ে আসা সমস্ত রূপো বিক্রি করে দিচ্ছে।
(চলবে)

No comments: