Saturday, November 18, 2017

বেরা ভাসান উৎসব৮ - সমুদ্র যাত্রার পাঁচালি - রীলা মুখার্জী

মাছ বাহনে সবুজ জোব্বা পরা অল খিজর

জল, বর্ষা এবং সমুদ্রগমণ আর বাণিজ্যr নানান বর্ণনা আগে উল্লিখিত আখ্যানগুলিতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু আমাদের সামনে দুটি পরস্পরবিরোধী সংস্করণ উপস্থপিত হচ্ছে – প্রথম আর শেষ দুটিতে বলা হচ্ছে এই প্রথাটি শুরু হয়েছিল ভাগীরথীতে অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদে বাংলার নবাবদের হাতে। কিন্তু্ তৃতীয় আখ্যানে বলা হচ্ছে, এটির উদ্ভব কিন্তু ঢাকায়, পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে, ১৬২৬-২৭ সালে সুবাদার মুকরম খাঁএর আমলে। তবে এটা পরিষ্কার প্রত্যেকটি বয়ানে আমরা পাচ্ছি যে এটি শুরু হয়েছিল সামাজিক উৎসব হিসেবে, দীর্ঘ এলাকা জুড়ে, খিজিরের স্মরণে, এবং এটা পরের দিকে শাসক শ্রেণী আত্তীকরণ করে নেয়।

কার হাতে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী মন্তব্য আছে। ব্লকম্যান(Blochmann, Notes on Sirajuddaulah and the Town of Murshidabad, taken from a Persian manuscript of the Tarikh-i-Mancuri) আর আশুবাবুর বয়ানে সিরাজের হাতে ১৭৫৬-৫৭ সালে, কিন্তু সালিম আল্লার তারিখিবাংলার তথ্য বলছে, বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর জানামায়(১৭০৪-১৭২৭)।

আমরা এর আগে দেখেছি বাংলার মূর্তিবিদ্যায় মাছের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। মনে রাখা দরকার পবিত্র কোরাণে খিজরের সঙ্গে মাছের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে – বলা হয়েছে দুটি সমুদ্রের মিলনস্থলে তিনি মাছের পিঠে চড়ে আবির্ভূত হলেন। প্রশ্ন হল স্থানটি কোথায়? এটা কি বাস্তব আর পরাবস্তবের মাঝামাঝি যায়গা, যেখানে দুটি সমুদ্র মিশেছে? ফলে খিজরের সঙ্গে জুড়ে থাকা সবুজ রং শুধু যে শক্তি বা নবজীবনের সঙ্গে সশ্লিষ্ট তাই নয়, পরলৌকিকতার ধারণাও যুক্ত। এটাও মনে রাখা দরকার প্রাচীন ইসলামি ধর্মতত্ত্বে খিজর হলেন এমন এক প্রতিনিধি/ব্যক্তিত্ব, যিনি আত্মসত্ত্ব এবং রক্ষাকারী দেবতার সত্তাতত্ত্বীয় (ontological) পৌরাণিকতা, যেখানে দুটি সাগর মিশেছে(আধ্যাত্মিক হৃদয়), সেটির মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করেন। সত্তাতত্ত্বীয় বিস্তারে পরাবুদ্ধিগত(nondiscursive), পরাবাস্তব(upra-rational) বুদ্ধিসূত্র অনুযায়ী অনুব্রহ্মাণ্ডসূত্রে(macrocosmically), প্রকৃতি এবং ব্রহ্মাণ্ডের(theophany= মানুষের মধ্যে দেবতার প্রকাশ) ধ্যানে খিজিরের পথ নির্দেশ। খিজিরের ধ্যান হল আদতে জীবনের মানে খোঁজার পথের আধ্যাত্মিক যাত্রা।

কিছু জাতিতাত্ত্বিক আবার খিজিরের সঙ্গে দরিয়া পীরের যোগসূত্র নির্মান করেন, কিন্তু আমাদের মনে হয় এটা প্রমাদপূর্ণ তত্ত্ব। এর আগে আমরা বরদারাজন বা আশুবাবু সূত্র উল্লেখ করে দেখিয়েছি পশ্চিম উপকূল আর বাংলায় দরিয়াপীর পুজিত হন কিন্তু তার সঙ্গে খোজা খিজিরের কোন সম্পর্ক নেই। পারসি শব্দভাণ্ডারে সমুদ্রের সমার্থক শব্দ হল দারা বা দরিয়া, ফলে দরিয়া(সমুদ্র) পীর হলেন সমুদ্র যাত্রায় রক্ষাকারী যে কোন পীর, এবং এই সাধারণিতে দরিয়া পীরের ধারণাও আছে। মনে রাখতে হবে দরিয়া পীর কোনভাবেই খোজা পীরের সমার্থক নয়।



কেউ কেউ বলছেন খিজর ইসলাম পূর্ব(পাগান = লৌকিক) দেবতা, এবং এই তত্ত্ব আমার মন টানে, কারণ আমরা দেখেছি, খিজর কাস্পিয়ান সমুদ্রের আশেপাশের পারস্যের তাজিকদের অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে সক্ষিণ সমুদ্র অঞ্চলে এসেছে। শুরুতেই আমি বলেছি, হয়ত তাজিকরা এই প্রথাটি দক্ষিণপূর্ব বাংলায় শুরু করে। ইসলামপূর্ব পারসিক নিগূঢ ইসলামি শিয়াবাদের পরম্পরায় খিজর, Hidden Imam বা mahdiর আগেই আবির্ভূত হয়েছেন। নবী আসার আগে তিনিই ছিলেন একমাত্র নবী। পরের অংশে আমরা বিশেষ জলাশয়ের সঙ্গে খিজরের সম্পর্ক আলোচনা করব।

No comments: